ইমদাদুল হক
যুবায়ের
গোয়ালে গরু
বাঁধা, খড় খাওয়ার মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি যখন শিল্পীর তুলিতে আঁকা হয়, তখন সেই দৃশ্য সত্যিই সবার
দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শিল্পীর সৃজনশীল অঙ্কিত এ সব ছবি সাধারণত যে কারো শৈশবের সব
স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। ভাবনা-কল্পনা নিজেকে শৈশবে ফিরে নিয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
শহুরে পরিবেশে যে যতই অনাড়ম্বর জীবন যাপন করুক না কেন শিকড়কে,
শৈশবে বেড়ে ওঠার স্মৃতিকে কেউই ভুলতে পারে না।
গ্রামীন পরিবেশে জমিতে সোনার সবুজ ধান,
গ্রামের থরে থরে প্রাকৃতিক সবুজের বিশাল সমারোহ সত্যিই মন কাড়ে। দলে দলে মাঠে গরুর ঘাস খাওয়ার দৃশ্য
নিজকে অতীতে ফিরে নিয়ে যায়।
ছোট্টকালে
মাঠে গরু চরাতাম, ফুটবল
খেলতাম, গরুবারীতে
যেতে হত, তাও আবার স্কুল কামাই দিয়ে। কারণ তখন তো অভিভাবকদের কাছে স্কুলের চেয়ে গরু বারীতে যাওয়াটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। প্রখর রোদে সারাটা দিন একসাথে ৩০০ থেকে ৪০০ গরু নিয়ে গ্রামের এ মাঠ থেকে ঐ মাঠে, হাওরের এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে ছুটে বেড়ানো,
দুপুরে নদীতে গরুকে গোসল করানো,
সূর্য মামা ডুবার সাথে সাথে মালিকের কাছে তা বুঝিয়ে দেয়া এসব এখন মোর শুধু শুধুই
স্মৃতি। গ্রামীণ পরিবেশে শীতকালীন পড়ন্ত বিকালের আমেজ,
বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ভিজে খেলা করা,
নিজ হাতে কলা গাছের ভেলা বানিয়ে বা নৌকা ভ্রমণ করার স্মৃতি রোমন্থন করতে
কার না ভালো লাগে।
ফজরের আজান
হলো। মসজিদের পুকুরে ওজু করলাম, নামাজ পড়লাম। পুকুর ঘাটের সিড়িতে পা ডুবিয়ে ওজু
করার তৃপ্তিটাই আলাদা। মনে পড়ে গেলো শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিপট। কারণ, জীবনের বিরাট একটা সময়
এখানেই যে আমার বেড়ে ওঠা। নামায শেষে মুরব্বি মুসল্লীদের সাথে নব নির্মিত মসজিদ নিয়ে অনেক
কথা অনেক গল্প। মসজিদের পাশেই বিশাল পঞ্চায়েতী গোরস্থান। যিয়ারত করলাম আর রাব্বে করীমের
নিকট মুরদেগানদের মাগফিরাত চেয়ে মিনতি করলাম; যারা ছিলেন এ গ্রামেরই মুরব্বি-মাতেব্বর। যাদের ইশারায় পরিচালিত হতো গ্রামের সামাজিক সব কাজ। যাঁদের চোখের সামনে আমি বড় হয়েছি। কবরের পাশে আসলে আসলে মৃত্যুর কথা স্মরণ হয় না
এমন কে আছে। কবরের পাশে
দাড়ালে কবরবাসীর চেহারা ভেসে ওঠে হৃদয়ের মনি কোটায়।
আমি এলাকার সন্তান হিসেবে চিনা
জানা অনেকেই। কবরের অধিবাসীর চেহারা মনে পড়ার সাথে সাথে মনে পড়ে যায় দুনিয়ায় তার জীবন চরিত্রেের কথা, মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন তিনি আর আল্লাহর গোলাম
হিসেবেও কেমন ছিল তার কর্ম তৎপরতা। ভাবনায় আমার গা শিহরিত হয় এটা চিন্তা করে যে, কখন জানি আমারও ডাক পড়ে যাবে কবরের অধিবাসী হওয়ার।
তখন হয়তো আমার কবরের পাশে এমন কেউ দাঁড়াবে যে আমাকে চিনে জানে। আমার চেহারা তার
চোখে ভেসে ওঠার সাথে সাথে আমার জীবন চরিত্রও তার চোখে ভেসে ওঠবে। কেমন ছিলাম মানুষ
হিসেবে আমি, আর আল্লাহর গোলাম হিসেবেও কেমন ছিল আমার কর্ম তৎপরতা।
বাল্যকালে
নিজেদের ক্ষীরা ক্ষেত রাত জেগে পাহারা দিতাম। মাঠে নিজ হাতে ক্ষীরা পেড়ে ক্ষীরা
খাওয়া আসলেই মজা লাগতো। বরই গাছে উঠে বরই খাওয়া,
জাম গাছে উঠে সব চেয়ে কালো জামটি মুখে দেওয়া,
আম গাছের মগডালে উঠে গাছপাকা আমটি গাছে বসে বসেই খাওয়া কি না স্বাদের ছিল!
গাছ
গাছালিতে ভরপুর আমাদের পুরাতন সেই বাড়ীটি আজো আছে কিন্তু সেই রকম আম গাছ নেই আর
নেই স্বাদের সেই বরই গাছও। নিজেদের যে
পুকুরে সাঁতার কাটতাম, জাল ফেলে
মাছ ধরতাম সেই পুকুর আছে কিন্তু সেই রকম পানিও নেই আর নেই ধরার মতো মাছও।
গ্রামের
বাড়িতে আসলে আগে যে সকল মুরব্বিদের দেখতে পেতাম আজ তাদের বেশিরভাগই পরপারে। যখনই বাড়িতে আসতাম
দেখতে পেতাম পঞ্চায়েতী কবরে নতুন নতুন কবর। জিজ্ঞেসা করে জেনে নিতাম এটা কার কবর
ওটা কার কবর? এ সকল
মুরব্বিদের কবর পাশে দাঁড়িয়ো দোয়া করা ছাড়া আর তো কিছুই করার নেই যে এখন।
আজ আমাদের
গ্রামের তারাই মুরব্বি যারা আমার ছাত্র বা শৈশব জীবনে ছিলেন যুবক। যারা ছিলেন ধনি তারা আজ হয়েছে গরিব। আর যারা ছিল গরিব তারা হয়েছে আজ ধনি।
বৈচিত্র্যময় আমাদের ধরণীর ক্ষণস্থায়ী এ জীবনধারা। সময়ের বিবর্তনে এ সবকিছুর মধ্যেই আজ একটা পরিবর্তন আর পরিবর্তন।
একটা
প্রজন্মের পর আরেকটি প্রজন্মের উত্থান হয়। আমাকে তো একদিন সেই চলে যাওয়া মুরব্বিদের পথ
ধরতেই হবে। মিলিত হতেই হবে তাঁদের সাথে। আমার পরে আসবে আবার আরেকটি প্রজন্ম। আমার উত্তরসূরীরা। আজ আমার জীবনের কাছে আমার নিজের প্রশ্ন?
আমি কি আমার
চলে যাওয়া সেই মুরব্বিদের সাথে মিলিত হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পেরেছি??
আমি ধরা
থেকে চলে যাওয়ার পর আমি কি যোগ্য উত্তরসূরী রেখে যেতে পারবো???
লেখকঃ গবেষক, প্রাবন্ধি ও কলামিস্ট।
শিক্ষক, জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, সিলেট।
মোবাইল: ০১৭১২৩৭৪৬৫০
ইমেইল zubairjcpsc@gmail.com
লেখকঃ গবেষক, প্রাবন্ধি ও কলামিস্ট।
শিক্ষক, জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, সিলেট।
মোবাইল: ০১৭১২৩৭৪৬৫০
ইমেইল zubairjcpsc@gmail.com
না, স্যার। আমরা পারিনি। আমাদের ভবিষ্যৎ পজন্মের জন্য কাজ করা এখন সময়ের দাবী।
ReplyDelete