Saturday, March 28, 2020

গল্প- অতঃপর আমরা স্বাধীন হলাম


।। মিদহাদ আহমদ।।


এই আলী হোসেনের বাপ, মুখ সামলাইয়া কথা কইবা। গেরামে হিন্দু আছে তো কী হইছে? তাগোর লাইজ্ঞা আলাদা মন্দিরের ব্যবস্থা করোন লাগবো ক্যান? মাস্টার মাস্টারের মতো থাকবা। গ্রাম নিয়া মাতব্বরি করতে আইবা না।
মোবারক মিয়া আলীর বাবাকে এক নাগাড়ে বলেন কথাগুলো। মোবারক মিয়া গ্রামের মাতব্বর। স্কুল লাগোয়া বাড়িটি তার। সেই সাথে সাথে সে মসজিদ কমিটির সভাপতি। সভাপতি হওয়াটাও এক প্রকার জোর করে হওয়া। তাদের পূর্বপুরুষ মসজিদের সভাপতি ছিলেন; বংশানুক্রমে এখন সেও মসজিদের সভাপতি হবে। এই বিরোধ বেশ কয়েক বছর আগের। আলী হোসেনের বাবা, আলতাফ মাস্টার গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের ধর্ম শিক্ষার টিচার। গ্রামের শেষের দিকে এগারো ঘর হিন্দু আছে। তাদের অনেক দিনের দাবি, তাদের বাড়ির জায়গায় একটা শিবমন্দির হোক। 
সেই আবদারটা আলতাফ মাস্টারের কাছে এসে জানায় তারা। আলতাফ মাস্টার স্কুলের মিটিংয়ে মাতব্বর মোবারক মিয়াকে এই বিষয়টা জানান। আলতাফ মাস্টার মোবারক মিয়াকে বলেন,  মোবারক মিয়া, বুঝোনা ক্যান তুমি? দক্ষিণের গাঙ্গের লাগোয়া এগারো ঘর হিন্দু। তাছাড়া তাগোর মন্দির একটা হইলে সমস্যা কী? তারা তাগো ধর্ম চর্চা করুক।  এবার হুংকারের সুরে মোবারক মিয়া আলতাফ মাস্টারকে বললেন, তোমারে মিয়া কথা কইতে কইছি? মাতব্বরি এতো করো ক্যান? গেরামে মন্দির হইবো?  নাউজুবিল্লা। মন্দির হইলে আমগো মান ইজ্জত থাকবো? মোবারক মিয়ার কথার সাথে সম্মতি দিলেন খলকু,  স্কুলের সমাজের শিক্ষক রিপন মাস্টার আর দপ্তরি এখলাসও। এখলাস সাথে যোগ করলো, হ মোবারক চাচা ঠিকই কইতাছেন। গেরামে মন্দির করণ যাইবো না।

আজকের মিটিং এহানেই শেষ। মন্দির হইবো না এই আমি বইলা দিলাম। এই কুদ্দুসকুদ্দুস...কুদ্দুস কই গেলি? এইতো চাচা। যে বলেন, ছাতা ধর। যাই বাজারে। গিয়া দেহি মাছ টাছ নিয়া আইতে পারি কি না। মোবারক মিয়া চলে গেলেন। একে একে মিটিংয়ে আসা সবাই চলে গেলেন। চেয়ারে বসে আছেন স্কুলের হেড টিচার আমির উদ্দিন মাস্টার। তিনি আলতাফ মাস্টারের কাধে হাত রাখলেন। বললেন, মন্দির হইবো। এই গেরামেই হইবো। সত্যি? সত্যি কইতাছেন স্যার? আমগো গ্রামে মন্দির হইবো?  হ!মন্দির হইবো। আমি ব্যবস্থা করুম। সরকার থাইকা আদেশ আনুম। তারপর দেখুম কে কী কয়। মোবারক মিয়ার মাতব্বরি কই যায় দেখুম। মাস একের ভেতরের গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা মন্দির উঠলো। সরকারি অনুদানে মন্দির হলো। মোবারক মিয়া অনেক বিরোধের চেষ্টা করেছিলো। শেষ পর্যন্ত আলতাফ মাস্টার সফল হলেন। পেছনে মূল শক্তি হিসেবে ছিলেন হেড টিচার আমির উদ্দিন। উচ্চ পদে উনার পরিচিত একজন আছেন। সেখান থেকে মন্দিরের অনুমোদন ও অর্থায়ন এনে এটি তৈরি করান।

কুদ্দুস, এই কুদ্দুস...
জ্বে বলেন।
রেডিওতে কি কইলো মুজিব?
কী কইলো?
ধুর! শুনিস নাই? হেইডা আবার যুদ্ধের ডাক দিয়া দিলো বলে মনে হইতাছে। ঢাকায় বুঝি কইছে, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
হ। এইটা তো আমিও শুনছি হুজুর।
মুখ থেকে পানের পিক ফেলে মোবারক মিয়া কুদ্দুসকে বলেনমূর্খ! তুই আস্ত একটা মূর্খ। স্বাধীনতার ডাক কি এমনে এমনে দিছে? হেইডাও চায়না পাকিস্তান থাকুক। গেরামে হিন্দুয়ানি শুরু করছে আলতাফ মাস্টার। তারে আমি দেইখা নিমু। আর এই মুজিব আরেক দোহাইয়ে যুদ্ধ লাগাইছে। দেশে আল্লাহ ফিরিশতা বইলা কিছু থাকবোনা। আল্লাহ বাঁচাও আমগো। পাকিস্তানরে ভাইঙ্গো না আল্লাহ। আমগো পাকিস্থান রক্ষা করো আল্লাহ। রক্ষা করো।

মার্চের দশ তারিখ নাগাদ আলী হোসেন গ্রামে এলো। আলতাফ মাস্টারের একমাত্র ছেলে আলী হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে সে। বাড়িতে এসে ঢাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে বললো। বাবাকে বলল, সে সাত ই মার্চের ভাষণে ছিলো। নিজের কানে ভাষণ শুনেছে সে। শেখ মুজিবুর রহমান একপ্রকার যুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রস্তুত থাকতে হবে সবাইকে।
পাশ থেকে আলী হোসেনের মা কুলসুমা বেগম নাকি সুরে বলেননা রে আব্বা। যুদ্ধে যাইবানা কইয়া দিলাম। না আম্মা। যাইমু। দেশের লাইজ্ঞা যুদ্ধ করুম। দেশ স্বাধীন করুম। তাইনা আব্বা? হ। আমার পোলা দেশের লাইজ্ঞা যুদ্ধ করবো। দেশ স্বাধীন করবো। ধর্মের দোহাইয়ে দেশ বিক্রি করবো না।
হইছে হইছে। পোলাডা গেরামে আইছে দুই দিনের লাইজ্ঞা, তার মাথা খাইও না।
আলী হোসেন বাবা মায়ের কথায় হাসে।

সেদিন এশার নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে বাড়িতে ফিরছিলো আলী হোসেন। পেছন থেকে কে যেনো ওর মাথায় আঘাত করে। আলী হোসেন সেখানেই জ্ঞান হারায়। স্কুলের হেড মাস্টার আমির উদ্দিন তাকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পেয়ে মানুষ জড়ো করে বাড়িতে নিয়ে যায়। মাথাতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই মসজিদের ইমাম, ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়েন।

আলী হোসেন মারা যায় মার্চের সতেরো তারিখ। মাঝখানে দেশে এক বিশাল যুদ্ধ হয়। নয় মাসের যুদ্ধে গ্রামটা লণ্ডভণ্ড। মানুষ নিশ্চিহ্ন। এই নয় মাসে অনেক কিছু ঘটেছে। আলতাফ মাস্টারের স্ত্রী, আলী হোসেনের মা ছেলে ছেলে প্রলাপ করে মারা যান। স্কুলের হেড মাস্টারকে পাক সেনারা ক্রসফায়ার করে হত্যা করে। মন্দির পুড়িয়ে ফেলা হয়। এগারো ঘর হিন্দুর সব যুবতী মেয়েদেরকে ক্যাম্পে তুলে আনা হয়। এই নয় মাস সুখে ছিলো মোবারক মাতব্বর। পাকদের মদদ দিতো সে। পাকদেরকে স্কুলে ঘাটি গড়তে মোবারক মিয়া সাহায্য করে। নয় মাসের যুদ্ধে দেশ স্বাধীন হয়। আলতাফ মাস্টারের দেশ স্বাধীন হয়। লুকিয়ে গ্রামের বয়স্কদের নিয়ে একটা দল তৈরি করেছিলেন আলতাফ মাস্টার। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন তথ্য দিতে তিনি সহযোগিতা করতেন। যুদ্ধ শেষে যখন মুক্তিযোদ্ধাদের লিস্ট তৈরি হলো, তখন সেই দলে নাম লেখালো মোবারক মিয়া। আলতাফ মাস্টারকে একদিন এসে বললো, মুখ খুললে পোলার মতো তোমারেও উপরে পাঠায়া দিমু। মুখ বন্ধ রাখবা। আলতাফ মাস্টারের ইচ্ছে হয়, আকাশ ফাটিয়ে এই স্বাধীন দেশে চিৎকার করে বলতে, এই দেশটা আমার। এই দেশটা আমার পোলার। আমার পোলা একজন রাজাকারের হাতে নিহত হইছে। যুদ্ধ না করলেও আমার পোলা মুক্তিযোদ্ধা। আর আমি স্বীকৃতি না পেলেও, একজন মুক্তিযোদ্ধার বাবা। আমার পোলা, রাজাকারের হাতে মরছে।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, জেসিপিএসসি, সিলেট।

ইমেইলঃ midhadkhan11@gmail.com 

মোবাইলঃ ০১৭৬২০৯৫৭২৯ 



শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here