মো. লুৎফুর রহমান হুমায়দী।।
করোনা
ভাইরাসের মাধ্যমে এক ভয়াবহ গযব এবং বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে সারা বিশ্ব। আল্লাহ
না করুক, আল্লাহ না করুক, আল্লাহ
না করুক আমাদের
প্রিয় জন্মভূমিও আজ এক মহা পরীক্ষা ও দুর্যোগের মুখোমুখি। অধিকাংশ অসচেতন এবং
দরিদ্র জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত, অধিক ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশে করোনা
ভাইরাসের সংক্রমন বিস্তৃতি লাভ করলে কীযে ভয়াবহ দশা হবে তা কল্পনা করলেও গা শিউরে
উঠে। এ
ভয়াবহ রোগের সংক্রমণ এবং হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথে অর্থনৈতিক বিপর্যয়, বেকারত্ব, দুর্ভিক্ষ
বা অনাহারে মৃত্যুও সমানতালে ধেয়ে আসবে এ পৃথিবীবাসীর প্রতি।
মানব সমাজের সীমাহীন পাপাচার, অশ্লীলতা এবং জুলুম অত্যাচারের
কারণে মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ পাক
আযাব
আর গযব দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা করেন। সেই
কঠিন সময়ে ঈমানদারকে বহুমুখী পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। ঈমানের পরীক্ষা, তকদীরের
উপর বিশ্বাস, সকল অপকর্ম থেকে আল্লাহর প্রতি
পরিপূর্ণ রুজু হয়ে তাওবা ইস্তেগফার করা এসব ব্যাপারে মুমীন কতটুকু ইসতেক্বামতের
উপর থাকতে পারে সেটাতো আল্লাহ পাক
অবশ্যই দেখবেন। সাথে সাথে যে বিষয়টা আমি আজ
বলতে চাচ্ছি, সেটা হলো এই যে দেশ লকড ডাউন
হয়ে যাচ্ছে, দোকান পাঠ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, গণ
পরিবহন সীমিত হয়ে যাচ্ছে, এই সময়ে সাধারণ দিন মজুর, দোকান
কর্মচারী, পরিবহন শ্রমিকসহ হাজার হাজার
গরীব মানুষ গৃহবন্দী হয়ে যাবে, তাদের পরিবার চলবে কিভাবে ? আমি মনে করি, এ
ব্যাপারে সরকারের সাথে সাথে দেশের শিল্পপতি, ব্যবসায়ী
এবং বিত্তশালী সম্প্রদায়কে এগিয়ে
আসতে হবে।
ইতপূর্বে আমরা দেখেছি, দেশ
বন্যা, ঘুর্ণিঝড় ইত্যাদিতে আক্রান্ত
হলে প্রবাসী ভাইয়েরা উদার হস্তে দেশের মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। এবার কিন্তু
সমস্যাটা বিশ্বব্যাপী। আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরাও গৃহবন্দী। কাজ-কর্ম নেই। বহুমুখী
পেরেশানী ও দুশ্চিন্তায় তারা সময় পার করছেন। তবুও আমি আশা করবো আপাতত কাজ নেই
এটাকে অজুহাত হিসেবে না নিয়ে যাদেরকে আল্লাহ পাক সম্পদ দান করেছেন, বা
যাদের টাকা পয়সা বিভিন্নভাবে গচ্চিত আছে, তারা এই কঠিন সময়ে এগুলোর
সদব্যবহার করবেন। আত্মীয় পরিজনদের সেবায়, দিশেহারা অসহায় মানুষের
বাঁচাতে, মানবতার কল্যাণে এগিয়ে আসবেন। আমরা বিশ্বাস করি পৃথিবী থেকে
মানবতা নিঃশেষ হয়ে যায়নি। পত্র পত্রিকা এবং অন লাইনে দেখলাম কিছু ভাইয়েরা এ দুর্যোগে
তাদের ভবনের বাসা ভাড়া মওকুফ করে দিয়েছেন। পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক
আফ্রিদি তার ‘আফ্রিদি ফাউন্ডেশনের’ মাধ্যমে করোনা মোকাবেলায় বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ
করেছেন। আমাদের দেশেও তো এরকম অনেক বিত্তশালী ব্যক্তি রয়েছেন। অনেক লিমিটেড কোম্পানীসমূহ রয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন রাজনৈতিক,
সামাজিক
সংস্থা, সংগঠন এবং দানশীল, সচেতন
ব্যক্তিবর্গ এগিয়ে আসছেন। মানবতার জন্য কিছু করার তো এখনই উপযুক্ত সময়।
সম্মানিত
ভাইয়েরা!
এই সংকটকালে আমরা প্রত্যকেই
আমাদের সামর্থ্য অনুসারে মানবিক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসি কি না, সেটাও
হয়ে যাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা পরীক্ষা। সুতরাং এই পরীক্ষায়ও আমাদেরকে উত্তীর্ণ
হতে হবে। আমাদের
চোখের সামনে লাশের মিছিল। আমরা অনুভব করতে পারছি,
কিসের
এ দুনিয়া, কিসের এ সম্পদ, সবই মরুভূমির মরিচীকা মাত্র। তাই এ সম্পদকে কাজে লাগানোর, পরকালে
এ সম্পদ থেকে লাভমান হওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।
প্রিয়
ভাই বন্ধুগণ!
কুরআনে হাকীমের সূরা রুমের যে আয়াতটি আজ বেশী উচ্চারিত হচ্ছে -
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ
অর্থাৎ "মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সাগরে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে।" (আল-কুরআন, সূরা রুম, আয়াত: ৪১)
এই আয়াতের পূর্ববর্তি ৩৮ থেকে ৪০ নং আয়াতে আল্লাহ জাল্লা শানুহু যা বলেছেন তা অবশ্যই
আমাদের চিন্তাভাবনায় স্থান দিতে হবে
এবং তদনুযায়ী আমল করতে হবে। অন্যথায় আমাদেরকে আরো পরীক্ষা এবং বিপর্যয়ের সম্মুখীন
হওয়া লাগতে পারে।
আল্লাহ
সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন --
فَآَتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ ذَلِكَ خَيْرٌ لِلَّذِينَ يُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
-- "অতএব আত্নীয়-স্বজনকে তাদের
প্রাপ্য দিন এবং অভাবগ্রস্থ ও মুসাফিরদেরও। এটা তাদের জন্যে উত্তম যারা আল্লাহর
সন্তুষ্টি কামনা করে এবং তারাই সফলকাম।"
-- "আর মানুষের ধন-সম্পদে তোমাদের
ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পাবে এই আশায় তোমরা সুদে যা কিছু দাও, আল্লাহর
কাছে তা বৃদ্ধি পায় না। পক্ষান্তরে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পবিত্র অন্তরে
তোমরা যা দিয়ে থাক, (তাই
বৃদ্ধি পায়) অতএব, তারাই
দ্বিগুণ লাভ করে।"
اللَّهُ الَّذِي خَلَقَكُمْ ثُمَّ رَزَقَكُمْ ثُمَّ يُمِيتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيكُمْ هَلْ مِنْ شُرَكَائِكُمْ مَنْ يَفْعَلُ مِنْ ذَلِكُمْ مِنْ شَيْءٍ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ
-- "আল্লাহ, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর রিযিক দিয়েছেন, এরপর
তোমাদের মৃত্যু দেবেন, এরপর তোমাদের জীবিত করবেন।
তোমাদের শরীকদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে এসব কাজের মধ্যে কোন একটিও
করতে পারবে? তারা যাকে শরীক করে, আল্লাহ
তা থেকে পবিত্র ও মহান। " (আল-কুরআন, সূরা রুম, আয়াত: ৩৮ - ৪০)
প্রিয়
ভাইয়েরা!
এখন আমাদের উপর দিয়ে একটা গযব
অতিবাহিত হচ্ছে। একটা মহা পরীক্ষা চলছে। সুতরাং
এখন
একে অপরকে দোষারোপ বা ট্রল করার সময় নয়। এখন তাওবা ইসতেগফারের সময়। আল্লাহর পথে
এগিয়ে আসার সময়। মানবিক দুর্যোগে এগিয়ে আসার
সময়। এ সময়ে এটাই আল্লাহর পথ। অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফুটানো।
স্বাস্থ্য বিধি অনুসারে আমরা
সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবো। আল্লাহ পাক বলেছেন-
خُذُوا حِذْرَكُمْ
অর্থাৎ, "তোমরা
সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করো।" (আল-কুরআন, সূরা আন নিসা, আয়াত: ৭১, ১০২)
এ
কথাটি যুদ্ধ সংক্রান্ত হলেও আমরা জানি দুনিয়াবী সকল ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরই
আল্লাহর উপর ভরসা করতে হয়। সুতরাং এ মহামারী থেকে নিরাপদ থাকতে ও আমাদের সকল
সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আর সর্বোপরি রোগ ব্যাধি থেকে
এবং দুর্যোগ থেকে বেঁচে থাকার জন্য নবী করিম সাঃ এর শিখানো দোয়া, সকাল সন্ধ্যার দোয়া, জিকরসমূহের উপর অবশ্যই আমরা
আমল করে যাব। সার্বক্ষণিক মনে প্রাণে
জবানে ইস্তেগফার এবং আল্লাহর কাছে পানাহ চাইব। আল্লাহ পাক সূরা আনফালে বলেছেন -
وَمَا كَانَ اللَّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
অর্থাৎ, "আর তারা যতক্ষণ ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে আল্লাহ কখনও তাদের
উপর আযাব দেবেন না।" (আল-কুরআন, সূরা আনফাল, আয়াত: ৩৩)
তাই আসুন, এ মহা পরীক্ষার
মাধ্যমে এ পৃথিবীর নশ্বরতা এবং পরকালের অবিনশ্বরতাকে আমরা আবারও হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি
করি। ক্ষণিকের মায়াজালে ঘেরা নশ্বর এ পৃথিবীর সম্পদের মায়া ত্যাগ করি। ধন সম্পদ দিয়ে, যার কাছে যা আছে তা দিয়ে
মানবতার কল্যাণে এগিয়ে আসি। দুহাত বাড়িয়ে দেই গরীব দুঃখী অসহায় মানুষের দিকে। মুছে
দেই অসহায় নয়নের নোনা অশ্রুগুলো। আর এর মাধ্যমে আমরাও পেতে পারি
সকল বিপদ থেকে পরিত্রাণ। কারণ
রাসুলে কারীম সাঃ বলেছেন-
الصَّدَقَةُ تَرُدُّ الْبَلَاءُ
অর্থাৎ, "দান-সাদাক্বা
বিপদ মুসীবত দূরীভূত করে।"
আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।
লেখকঃ অধ্যক্ষ, শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা, পাঠানটুলা, সিলেট।
মোবাইল: 01558304305,
0 coment rios:
You can comment here