Thursday, March 26, 2020

করোনা ভাইরাস: আল্লাহ প্রদত্ত কঠিন পরীক্ষা


।। মাজহারুল ইসলাম জয়নাল।। 

শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ববাসী রয়েছেন চরম  আতঙ্কে। আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিসহ সকল নাগরিক, এক কথায়, আজ আমি-আপনি কেউ শান্তিতে নেই এবং নেই স্বস্থিতেও। পরিবার, গ্রাম,  শহর,  রাষ্ট্রের সকল নাগরিকই আজ যেনো গৃহবন্দী।

নেই কোনো যান চলাচল, রাস্তা-ঘাট সবই আজ ফাঁকাযে শহর-বাজারে সব সময় যানজট লেগেই থাকত সেই শহর-বাজার, শপিংমল  আজ ফাঁকা, মানুষের কোনো আনাগোনা নেই, এ যেনো ভূতুড়ে নগরী। করোনা ভাইরাস আজ  পৃথিবীবাসীকে গৃহবন্দী করে ফেলেছে। আতঙ্কের সবচেয়ে বড় কারণ হলো- এ ভাইরাসটি প্রতিরোধে কোনো প্রতিষেধক নেই।

জাগতিক দৃষ্টিতে বিভিন্ন দিক বিবেচনায় করোনা ভাইরাস ছড়ানোর অনেকগুলো কারণ রয়েছে যা আজ অনলাইনসহ সব মিডিয়ায় ভাইরাল। আলহামদুলিল্লাহ এ থেকে আমরা যতেষ্ট সচেতনতাও অবলম্বন করছি। 
আল-হাদিসে অপরিচিত মহামারি ছড়িয়ে পড়ারও কিছু কারণ রয়েছে। মহামারি ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে অশ্লীল কাজে লিপ্ত হওয়াকে উল্লেখ করা হয়েছে।
হাদিসে এসেছে- রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা-বেহায়াপনা ছড়িয়ে পড়বে তখন তাদের মধ্যে এমন এমন রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়বে যা ইতঃপূর্বে কখনো দেখা যায়নি।’ 
(ইবনে মাজাহ)

একটি হাদিসে রাসুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক বিষয় থেকে দূরে থাকবে। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন- ইয়া রাসুলুল্লাহ! বিষয়গুলো কী কী? রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জবাবে  বললেন-
১. আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা।
২. জাদুটোনা করা।
৩. যথাযথ কারণ ছাড়া  কাউকে হত্যা করাযা আল্লাহ হারাম করে দিয়েছেন।
৪. সুদ খাওয়া।
৫. এতিমের সম্পদ গ্রাস করা।
৬. রণক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা ।
৭. মুসলিম সরলা নির্দোষ মহিলাদের নামে ব্যভিচারের দুর্নাম রটনা করা। 
(সহীহ বুখারী, হাদিস নম্বর: ২৭৬৬)

এবার আপনি নিজের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের দিকে একটু লক্ষ্য করুন আর মিলিয়ে দেখুন! হাদিসে উল্লেখিত আজাব নাজিল হওয়ার কারণগুলো বর্তমান সমাজে বিরাজমান আছে কি না? যদি একটু বিশ্লেষণ করি তথা মিলিয়ে নেই তাহলে আজ আমাদের সমাজে যা দেখতে পাই তা হচ্ছে-
১. সুদ কে মানুষ লভ্যাংশ বা প্রফিট হিসেবে গ্রহণ করেছে।
২. গান-বাজনা, অশ্লীলতাকে বিনোদন হিসেবে গ্রহণ করেছে।
৩. মদ পানকে ড্রিংক হিসেবে গ্রহণ করেছে।
৪. বিচারের নামে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে।
৫. বদমাশ তথা চরিত্রহীন লোককে জাতীর নেতা বানানো হচ্ছে।
৬.  শিরক করাকে মানুষ ইবাদত মনে করছে। 
৭. নেককার পুরুষ ও মহিলাদের নামে মিথ্যা মামলা আর তথ্য সন্ত্রাস চালিয়ে বিপদের সম্মুখীন করা হচ্ছে তথা তাদেরকে হয়রানি করা হচ্ছে।
৮. শরীয়তের ফরজ বিধান পর্দাকে এ যুগে কার্যকর নয় বলে মনে করা হচ্ছে। তাই স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালতে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশাকে গুণাহের কাজ মনে করা হচ্ছে না।

এককথায়, পাপের এমন কোনো রাস্তা নেই যা বর্তমানে হচ্ছে না। দুংজনক হলেও সত্য যে, আজ অশ্লীলতাপূর্ণ বিভিন্ন কাজকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্টপোষকতাও করা হচ্ছে । আল্লাহ তায়ালার  আজাব তথা শাস্তি যখন আসে তখন ভালো লোক ও খারাপ লোক সমানভাবে সবাইকেই গ্রাস করে। আজ আমরা আমাদের পাপের ফল হিসেবেই মহামারির শিকার হচ্ছি। মানুষ যখন মহামারির সম্মুখিন হবে তখন সে কী করবে এ বিষয়ে ইসলামের রয়েছে কিছু দিক নির্দেশনা।

মহামারি দেখা দিলে  মানুষের জন্য ইসলামের দিক-নিদের্শনা হলো-
১. সর্ব প্রথম আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত তাকদীরের উপর খুশি থাকা।
২. ধৈর্য ধারণ করা।
৩. আল্লাহর কাছে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া থেকে বেঁচে থাকতে সাহায্য চাওয়া।
৪.  প্রয়োজনীয় সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা।

আল-হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মহামারি আল্লাহ তাআলার একটি শাস্তি। তবে তা মুসলমানদের জন্য আল্লাহর রহমত। (সহীহ বুখারি)

যারা আল্লাহ তায়ালার ওপর অগাধ আস্থা এবং বিশ্বাস রাখে, সেসব লোকের পায়ে যদি কোনো কাটাও ফুটে, তবে তারা আল্লাহর কাছে এর বিনিময় পাবে। সুতরাং যারা মাহামারির ভয়াবহ অবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করে ধৈর্য ধারণ করবে তাদের জন্য এটি মহামারি নয়। এদের জন্য এটি আল্লাহর রহমত। এর মাধ্যমে তাদের গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।

প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের মত কঠিন দুর্যোগে এ মহামারির হাত থেকে রক্ষা পেতে, প্রয়োজনীয় সতর্কতার পাশাপাশি নিচের দোয়াগুলো আমরা বেশি বেশি পাঠ করার চেষ্টা করবো
এক: আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. মহামারি থেকে বাঁচতে বেশি বেশি এই দোয়া পড়তে বলেছেন,
اللَّهمَّ إِنِّي أَعُوُذُ بِكَ مِنَ الْبرَصِ، وَالجُنُونِ، والجُذَامِ، وسّيءِ الأَسْقامِ.
বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আয়ুজুবিকা মিনাল বারাছ, ওয়াল জুনুন, ওয়াল জুযাম, ওয়া সায়্যিইল আসক্বাম।
 বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট ধবল, কুষ্ঠ এবং উন্মাদনাসহ সব ধরনের কঠিন দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে পানাহ চাই।
তথ্যসূত্র: আবু দাউদ: খণ্ড-২, পৃষ্ঠা - ৯৩; সহিহ তিরমিযী: খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা - ১৮৪; সহিহ নাসাঈ: খণ্ড- ৩, পৃষ্ঠা ১১১৬।

দুই: হাদীসে এসেছে- রাসূলুল্লাহ সা. বলেন- যে ব্যক্তি সকাল ও বিকালে সূরা ইখলাস ৩ বার,  সূরা ফালাক ৩ বার  সূরা নাস  ৩ বার  পড়বে এটা তার সবকিছুর জন্য যথেষ্ট হবে।
তথ্যসূত্র: আবূ দাউদ: খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা - ৩২২, হাদীস নং ৫০৮২; তিরমিযী: খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা - ৫৬৭, হাদীস নং ৩৫৭৫।

তিন: যে ব্যক্তি সকালে তিন বার এবং বিকালে তিন বার নিচের এই দোয়া পড়বেন, কোনো কিছুই তার ক্ষতি করতে পারবে না। দোয়াটি হলো-
بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَىْءٌ فِي الأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ 
বাংলা উচ্চারণ: বিস্‌মিল্লা-হিল্লাযী লা ইয়াদ্বুররু মাআ ইস্‌মিহী শাইউন ফিল্ আরদ্বি ওয়ালা ফিস্ সামা-ইওয়াহুয়াস্ সামীউল আলীম
বাংলা অর্থ: আল্লাহ্‌র নামে; যাঁর নামের সাথে আসমান ও যমীনে কোনো কিছুই ক্ষতি করতে পারে না। আর তিনি  সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী।
তথ্যসূত্র:  আবূ দাউদ: খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা - ৩২৩, হাদিস নং: ৫০৮৮; তিরমিযী: খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা - ৪৬৫, হাদিস নং: ৩৩৮৮; ইবন মাজাহ, হাদিস নং: ৩৮৬৯; আহমাদ, হাদিস নং:  ৪৪৬। আর আল্লামা ইবন বায রাহিমাহুল্লাহ তাঁর তুহফাতুল আখইয়ারগ্রন্থের ৩৯ পৃষ্ঠায় এটার সনদকে হাসান বলেছেন।

চার: আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যদি কেউ ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বলে,
بِسْمِ اللَّهِ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللَّهِ لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ
বাংলা উচ্চারণ: বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ, লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।
বাংলা অর্থ: আল্লাহর নামে, আল্লাহ তাআলার ওপরই নির্ভর করলাম, আল্লাহ তাআলার সাহায্য ছাড়া বিরত থাকা ও মঙ্গল লাভ করার শক্তি কারো নেই।  তবে তাকে বলা হয় (আল্লাহ তাআলাই) তোমার জন্য যথেষ্ট, তুমি হেফাজত অবলম্বন করেছ (অনিষ্ট থেকে)। তাতে শয়তান তার থেকে দূরে সরে যায়।

তথ্যসূত্র: তিরমিজি, হাদিস নং : ৩৪২৬

পাঁচ: তিরমিজি শরীফের বর্ণনায় এসেছে, নিচের দোয়াটি পড়তে বলেছেন বিশ্বনবি-
 اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ مُنْكَرَاتِ الأَخْلاَقِ وَالأَعْمَالِ وَالأَهْوَاءِ وَ الْاَدْوَاءِ
বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন মুনকারাতিল আখলাক্বি ওয়াল আমালি ওয়াল আহওয়ায়ি, ওয়াল আদওয়ায়ি।
বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার কাছে খারাপ (নষ্ট-বাজে) চরিত্র, অন্যায় কাজ ও কুপ্রবৃত্তির অনিষ্টতা এবং বাজে অসুস্থতা ও নতুন সৃষ্ট রোগ বালাই থেকে আশ্রয় চাই।(তিরমিজি)
সকল মুমিন মুসলমান ভাই-বোনদের প্রতি প্রাণের দাবী আসুন, করোনা ভাইরাসের মহামারি হতে বাঁচতে নিজেদের ঈমান ও আমলকে খাঁটি করার প্রানান্তকর চেষ্টা করি। প্রয়োজনীয় সতর্কতার পাশাপাশি বেশি বেশি নফল ইবাদত বন্দেগীসুন্নাহ সম্মত জিকির-আজকার,  কুরআন তেলাওয়াতে অবসর সময়টুকু কাটাতে সর্বাত্তক চেষ্টা করি।
আসুন, আমরা রাব্বে করীমের নিকট আকুতি জানাই এ বলে যে, ইয়া আল্লাহ! আপনার খাছ রহমত দিয়ে করোনা ভাইরাসের মহামারি হতে  আমাদেরকে রক্ষা করুন। আমরা আমাদের কৃত সকল গুণাহের উপর তাওবা করতেছি আপনি আমাদের মাফ করে দেন হে গাফুরুর রাহীম।

আল্লাহ আমাদেরকে সকল বিপদ মুসিবতের কঠিন পরীক্ষায় উক্তির্ণ হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমিন।

লেখক:
প্রাবন্ধিক ও গবেষক।
মোবাইল: 01748237331
ইমেইল:
majharul276@gmail.com


শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here