মুজতাবা তামীম আল মাহদী
সেন্টমার্টিন যাওয়ার আগে সবাই আবহাওয়ার চিন্তা করে। সাগর শান্ত থাকবে কি না
খবর নেয়। জাহাজের টিকেট করার জন্য খোঁজ খবর নেয়। রিসোর্টে আগে থেকে রুম বুক করে
রাখে। আমি এগুলার কিছুই করিনি। জীবনের প্রথম সলো ট্যুর। কোনো প্ল্যানিং ছাড়াই বেরিয়ে
পড়েছিলাম।
সলো ট্যুর শব্দটি অনেকের কাছেই অপরিচিত। তাই একটু বলে নেওয়া ভালো। সলো ট্রাভেল
হচ্ছে সম্পূর্ণ একাই প্ল্যান করে অথবা প্ল্যান ছাড়া ঘুরে বেড়ানো। কিন্তু পুরো সময়
যে আপনি একাই থাকবেন ব্যাপারটা এমন না। আপনি পরিচিত হতে পারেন আশেপাশের মানুষের
সাথে। পেতে পারেন নতুন বন্ধু। যদি এটাও না চান,
তাহলে একাই ঘুরতে পারেন।
আমার সেন্টমার্টিন যাওয়ার কারণ ছিলো দুইটা।
প্রথমত, কিছু কারণে
বেশ স্ট্রেসড ছিলাম। মন ছিলো বিষণ্ণ। ২ মার্চ-2020 দুপুরে হুট করে মাথায় আসলো
ব্যাপারটা। কোথাও থেকে ঘুরে আসলে হয়তো কিছুটা ভালো লাগবে। সাথে সাথে সিদ্ধান্ত
নিলাম সেন্ট মার্টিন যাবো।
দ্বিতীয়ত, এর দুইদিন
আগে থেকে আমি একটা বই পড়ছিলাম। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শামীর মোন্তাজিদ ভাইয়ার
লেখা "উড়ছে হাইজেনবার্গ" । বইটি একটি ভ্রমণ কাহিনী, যেখানে ভাইয়া তার বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ানোর
অভিজ্ঞতার মজার বর্ণনা দিয়েছেন। বইটি আমাকে একা সেন্ট মার্টিন চলে যেতে সিংহভাগ
উদ্বুদ্ধ করেছিলো।
দুপুরে নেওয়া সিদ্ধান্তের সম্মানে সন্ধ্যা ৭ টার বাসে চড়ে বসলাম টেকনাফের
উদ্দেশ্যে। পরদিন অর্থাৎ ৩ মার্চ 2020 সকাল ৭ টায় টেকনাফ পৌঁছালাম। নেমেই প্রথমে
জাহাজের টিকেট করলাম। কেয়ারি সিন্দাবাদের ওপেন ডেকের টিকেট পেয়ে গেলাম। উপস্থিত
হয়ে টিকেট পাওয়া যাবে বলে আগেই ধারণা পেয়েছিলাম। কারণ আমি গিয়েছিলাম ওয়ার্কিং ডে
তে। তখন ভীড় অনেক কম থাকে। সকালের নাস্তা সেরে নিয়ে জাহাজে উঠে বসলাম। ৯.৩০ এ
জাহাজ ছাড়লো। নাফ নদীর বুক চিড়ে বঙ্গোপসাগরের পানে।
সেন্ট মার্টিন আমি এর আগেও দুইবার গিয়েছিলাম। একবার স্কাউট দলের সাথে, আরেকবার ফ্যামিলির সাথে। কিন্তু প্রত্যেকবার আমার
কাছে নতুন করে ভালো লাগে। মনে হয় এবারই প্রথম যাচ্ছি। জাহাজে কতো ধরনের মানুষ।
ওপেন ডেকের প্রথম সারিতে সীট আমার। তবে সেটা অন্য মানুষের দখলেই থাকলো বেশির ভাগ
সময়। কারণ আমি বসে না থেকে হেঁটে হেঁটে মানুষের কর্মকান্ড উপভোগ করছিলাম।
বেশিরভাগই ফ্যামিলি। কয়েকজন নবদম্পতিও চোখে পড়লো। একটা স্কুলের শিক্ষকরা আনন্দ
ভ্রমণে যাচ্ছেন। উনারা সাউন্ডবক্স বের করে হেড়ে গলায় গান গাওয়া শুরু করলেন।
বামদিকে তখন মায়ানমার দেখা যাচ্ছে। সবাই মায়ানমার দেখতে বামদিকে চলে গেলো। ভেসে
আসলো নাবিকের উদ্ধত কন্ঠ। "আপনারা কি জাহাজ ডুবিয়ে ফেলবেন? বামদিক থেকে সরে আসুন"। তাতে লাভ কী হলো? এবার সবাই ডানদিকে কাত করে ফেললো।
সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় সব থেকে উপভোগ্য বিষয় হচ্ছে সীগাল। জাহাজের চারপাশে উড়ে
উড়ে খাবারের সন্ধানে থাকে এরা। দুধের মতো সাদা গায়ের রঙ্গ, পালকে কালো নকশা আঁকা,
আকারে কবুতরের মতো অনেকটা। পাখিগুলো জাহাজের সাথে তাল মিলিয়ে উড়তে থাকে।
মানুষের ছুড়ে দেওয়া চিপস কিংবা অন্য কোনো খাবার লুফে নেয় মুহুর্তেই। আমি প্রথমে
খুব ভালো করে খেয়াল করিনি। দেখছি মানুষ ছুড়ে দিচ্ছে। পানিতে পড়ছে। একটা পাখি
খাবারটা তুলে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করার পর কিছুটা ধাক্কা
খেলাম। সামনের দিকের পাখিগুলো চিপসের টুকরোটা পানিতে পড়ার আগে বাতাসের মধ্যে মুখে
নিয়ে নিচ্ছে। এটা আমাকে বেশ অবাক করলো। এতো তীক্ষ্ম এদের দৃষ্টি আর ক্ষীপ চলাচল।
সীগালের খাওয়া দেখতে দেখতে আরেকটা বিষয় আমার নজরে আসলো। প্রথম সারির পাখিরা যে
খাবারটা মিস করছে অর্থাৎ পানিতে পরে যাচ্ছে সেটার জন্য সময় নষ্ট করছেনা। সে ঘুরে
ওই খাবারটা তুলে আনতে যাচ্ছেনা। বরং তার দৃষ্টি সামনের দিকে। পরবর্তী খাবারটা সে
কোনোভাবেই মিস করতে চায়না। এখান থেকে একটা শিক্ষা আসলো আমার মাথায়। জীবনে সুযোগ
আসবে অনেক। যেটা মিস করবো সেটার জন্য পড়ে থাকলে চলবেনা। সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
কারণ পরের সুযোগটা নিশ্চয়ই আমি মিস করতে চাইবোনা।
সেন্ট মার্টিন যেতে যেতে জাহাজে বসে কয়েকটা রিসোর্ট দেখে নিয়েছিলাম অনলাইনে।
আমি খুঁজছিলাম নিরিবিলি নির্জন একটা জায়গা। একটা হ্যামক থাকবে। পাশেই থাকবে সাগরের
নীল জল। আমি সাগরের পাড়ে ক্লান্ত বিকেলে শুয়ে শুয়ে বই পড়বো আর ডাব খাবো। আমার
চাহিদা অনুযায়ী রিসোর্টের একটা লিস্ট করলাম। ভেবে রাখলাম যেটাতে ভালো লাগবে সেটায়
উঠবো। দুপুর ১২.৩০ এ জেটিতে নেমে আমার লিস্টের প্রথম রিসোর্টে রওয়ানা দিলাম।
রিসোর্টটি সম্পর্কে ভালো রিভিউ পেয়েছিলাম অনলাইনে। আর নামটাও আমার পছন্দ
হয়েছিলো। রিসোর্টের মালিক সোহেল ভাইয়া। চমৎকার মানুষ। উনার কথাও পড়েছিলাম আমি
রিভিউতে। পশ্চিম বীচে এর অবস্থান। আমি জেটি ঘাট থেকে ঘন্টা হিসেবে সাইকেল নিলাম।
তারপর গুগল ম্যাপ দেখে দেখে রিসোর্টের দিকে সাইক্লিং শুরু করলাম। সেন্ট মার্টিনের
সাইকেল গুলোর এতো বেহাল দশা। বেশিরভাগেরই ব্রেক নাই। ভাগ্য ভালো থাকলে বেল পেতে
পারেন, অনেকগুলাতেই
থাকেনা। প্রায় ১০ মিনিট সাইকেল চালিয়ে আমি উপস্থিত হলাম রিসোর্টে। প্রথম দেখাতেই
বেশ ভালো লাগলো। সোহেল ভাইয়ার সাথে কথা বলেও বেশ কমফোর্টেবল লাগলো। তাই এখানেই
থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। পুরো রিসোর্টে আমি একাই বোর্ডার ছিলাম। উনাদের সবথেকে ভালো
দিক ছিলো ২৪ ঘন্টা বিদ্যুত ও পানির ব্যবস্থা,
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আর ভাইয়ার অমায়িক ব্যবহার। সামনে বিশাল খালি জায়গা তাতে
সবুজ ঘাসের কার্পেট বিছানো। তারপরেই বীচ
এবং সাগরের নীল জল। বীচ যেখানে শুরু সেখানে কয়েকটা নারকেল গাছ। তার সাথে ঝুলানো
হ্যামক। প্রথমবার দাড়াতেই গায়ে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা লেগে কেঁপে উঠলাম। সবকিছু
স্বপ্নের মতো লাগছিলো।
দুপুরের খাবার সেরে নিতে সাইকেল নিয়ে বের হলাম। তখন ঘড়িতে ২ টা ছুই ছুই।
সাইকেল নিয়েছিলাম ঘন্টা প্রতি ৪০/- টাকা দরে। এক ঘন্টার বিল চুকিয়ে হাটতে লাগলাম
খাবারের খুঁজে। অনেকগুলা রেস্টুরেন্ট দেখে একটাতে দরদাম মনোপুত হলো। সামুদ্রিক মাছ, ভাত,
ডাল, সবজি দিয়ে
পেট পুরে খেয়ে নিলাম। সোহেল ভাইয়া শিখিয়ে দিয়েছিলেন যে, কয়েক ঘন্টার কথা বলে সাইকেল ভাড়া করলে ৩০ টাকায়
দিবে। সেই অনুযায়ী আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত একটা সাইকেল নিয়ে নিলাম ঘন্টা প্রতি ৩০
টাকায়।
সাইকেল নিয়ে আমি আবার রিসোর্টে ফিরলাম। দেখি যে সোহেল ভাইয়া ওখানকার লোকাল
কিছু কামরাঙ্গা কিনে এনেছেন। বসে বসে সেগুলা কেটে মরিচ আর লবণ মাখাচ্ছেন। আমি
আসতেই আমাকেও জয়েন করতে বললেন। আমি যদিও কামরাঙ্গার ভালো ফ্যান না, তাও স্থানীয় স্বাদ চেখে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম
না। কামরাঙ্গা টক হিসেবেই আমার কাছে বেশি পরিচিত ছিলো। কিন্তু এগুলো অনেকটাই মিষ্টি
ছিলো এবং খুব ভালো লাগছিলো খেতে।
সেদিন খুব রোদ ছিলো। তাই সাইকেল নিয়ে ঘুরতে বেড়ানোর ইচ্ছাটা রোদ না কমা
পর্যন্ত দমিয়ে রাখলাম। ততোক্ষণ নাহয় নারকেল গাছের ছায়ায় হ্যামকে শুয়ে সাগর দেখতে
দেখতে বই পড়া যাক।
বিকেল হতেই পড়ায় ক্ষান্ত দিলাম। বীচে তখন কতো মানুষের আনাগোনা। বেশিরভাগ মানুষ
ছবি তোলায় ব্যস্ত। সাগরের পানিতে পা ভিজিয়ে নানান ঢঙ্গের ছবি। একা ঘুরার একটা
অসুবিধা মাথায় আসলো। আমার তেমন ছবি তোলাই হয়নি। কারণ ছবি তুলে দেওয়ার কেউ নেই। আমি
সাগরের ঢেউ ঘেষে সাইকেল চালাচ্ছিলাম। তাতে মাঝে মাঝে থেমে যেতে হচ্ছিলো। কারণ ঢেউ
এসে বালুকে নরম করে দিচ্ছিলো। তাতে সাইকেলে চাকা আটকে যাচ্ছিলো। আমি ঘুরছি আর
দেখছি। কেউ ছাতার নিচে শুয়ে আরাম করছে। ডাব খাচ্ছে। অনেকেই আমার মতো সাইকেল
চালাচ্ছে। তার মধ্যে অনেক মেয়ে সাইক্লিষ্টও চোখে পড়লো।
আমি সাইকেল নিয়ে ধীরে ধীরে মানুষের কোলাহলের বাইরে চলে এলাম। পশ্চিম বীচ ধরে
আগাতে থাকলে মানুষের উপস্থিতি কমতে থাকে। সামনে উন্মুক্ত হয় প্রবাল পাথর আর
বালুকাময় বীচ। ডান পাশে থাকে সাগরের ঢেউ আর বামপাশে গাছের সারি। বুকভরে শ্বাস
নেওয়া যায় এখানে। নির্ভেজাল বাতাসের স্বাদে অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে যায় পুরো দেহটা।
একজন বিদেশী মহিলা চোখে পড়লো। একা একা ওদিক থেকে হেঁটে আসছেন। উনি ছাড়া দুইদিনে
আমার আর কোনো বিদেশী পর্যটক চোখে পড়েনি। উনাদের আসার বা থাকার মতো পরিবেশ হয়তো
আমরাই নষ্ট করে ফেলছি। কয়েকদিন আগে জাহাজে একজন বিদেশীর সাথে কয়েকজনের তামাশার
ভিডিও বেশ ভাইরাল হয়েছিলো। এই বিদেশিনীর সাথেও কয়েকটা ছেলেকে সেলফি তুলতে দেখলাম
আমি।
একটা সময় আমি আবিষ্কার করলাম সামনে আর চলার পথ নেই। পুরোটাই প্রবাল পাথর
ছড়ানো। ততোক্ষণে সূর্য ডুবার সময় হয়ে গেছে। আমি ব্যাক করলাম। বীচের এখানে ওখানে
ছোট ছোট নানা রঙ্গের, ডিজাইনের
শামুক পড়ে থাকে। সেখান থেকে দুইটা শামুক খুব পছন্দ হলো। পকেটে পুড়ে নিলাম।
সূর্যডুবি দেখতে একটা ছাতার পাশে সাইকেলটা রেখে গা এলিয়ে দিলাম।
শুয়ে শুয়ে দেখছিলাম ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সূর্য মামাও সারাদিনের ব্যস্ততা চুকিয়ে ডুব দিচ্ছেন সাগরের নোনা জলে।
ভাবছিলাম জীবনের সূর্যের কথা। কখন সন্ধ্যা নামবে কেউ জানিনা। ভাবনার জাল কেটে গেলো
একটা কন্ঠ শুনে।
"ভাইয়া একটা
মালা নিবেন?"
একটা ছোট্ট মেয়ে। হাতে একটা
মালা। আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম-
-"মালা দিয়ে
আমি কী করবো?"
- "ভাইয়া, তাইলে ১০ টাকা দেন,
ঝালমুড়ি খাবো।"
- "তুমি কি
পড়াশোনা করো?"
-"হ্যাঁ, ক্লাস টু তে পড়ি"
-"তুমি যদি A-Z পর্যন্ত বলতে পারো,
আমি তোমাকে ১০ টাকা দিবো।" আমি বললাম।
সে পারলোনা। আরেকটা সুযোগ দিলাম। বললাম তাহলে বাংলা স্বরবর্ণ বলো। অ, আ এগুলা। সে বেশ ভালোই পারলো। এমনিতেও পিচ্চিদের
সাথে কথা বলতে আমার বেশ ভালো লাগে। তাই জিজ্ঞেস করলাম ক, খ পারে কিনা। সে শুরু করলো। "ট" পর্যন্ত
এসে থেমে গেলো। কথায় কথায় ওর ফ্যামিলির কথা জানলাম। আনন্দের বিষয় হচ্ছে সে আমাকে
সূরা ফাতিহা, সূরা ইখলাস
তেলাওয়াত করেও শুনালো। এবং বললো সে নামাজও পড়ে নিয়মিত। ততোক্ষণে তার আরেকটা
বান্ধবী এসে হাজির। উনি নিয়ে এসেছে পিয়াজুর থালা। আমাকে একটা পিয়াজু নিতে
রিকুয়েস্ট করলো। দাম মাত্র ৫ টাকা। আমি ওর কাছ থেকে দুইটা পিয়াজু নিলাম। আর
দুইজনকে ১০ টাকা করে দিলাম। বেশ সখ্যতা হয়ে গেছে দুজনের সাথেই।
এবার ওরা বায়না ধরলো। ভাইয়া আপনার মোবাইলে গেইম আছে? লুডু আছে?
চলেন না লুডু খেলি। আমার মোবাইলে লুডু ছিলোনা। ডাউনলোড করলাম তখনই। তারপর ৩
জন মিলে লুডু খেলতে লাগলাম। হৈ হুল্লোড়ে মজা করতে করতে লুডু খেলা চলতে লাগলো।
আশেপাশে তখন ওদের আরো বন্ধু বান্ধবী চলে আসলো। ওরাও মালা আর পিয়াজু বেচা বাদ দিয়ে
আমার সাথে লুডু খেলায় মজে গেলো। সূর্য মামা কখন জানি টুপ করে ডুবে গেলেন। আমিও
লুডুর পাট চুকিয়ে উঠে পড়লাম।
সন্ধ্যা নামতেই সাইকেল ফেরত দিয়ে নিজের পায়ে চলা শুরু করলাম। সবাই তখন ব্যস্ত
বার বি কিউ আয়োজনে। কয়লার আগুণে উত্তপ্ত চারপাশ। সামনে নানার মাছের পসরা সাজানো।
আরো আছে কয়েক রকমের কাকড়া। মাছগুলো কিছু আগে থেকেই মশলা মাখিয়ে রাখা। সবার আগ্রহ
সেই হোটেলগুলোতে। আমার মতো কেউ কেউ ঘুরে দেখছে,
আর দাম জিজ্ঞেস করে আলতো করে সরে আসছে। হাটতে হাটতে চলে গেলাম জেটি ঘাটে।
অন্ধকারের চাদরে ঢেকে গেছে মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপটিও। আমার দুর্ভাগ্য
সেদিন পূর্ণিমা রাত ছিলোনা। তবুও আকাশের সৌন্দর্য্যে কমতি ছিলোনা। আমি তারার পরিচয়
জানিনা। কদাচিৎ দু’একটা তারার নাম জানি। কিন্তু কোথায় তাদের অবস্থান এসব সম্পর্কে
কোনো ধারণা নাই। তবুও আমার তারা দেখতে ভালো লাগে। কতো হাজার কোটি মাইল দূরের
নক্ষত্রগুলো জ্বলজ্বল করছে। আকারে নাকি এরা পৃথিবী থেকেও অনেক বিশাল। ভাবতেই কেমন
লাগে। তখনো ব্যস্ত সেন্ট মার্টিনের জেটি ঘাট। একটা ট্রলার কোথা থেকে এসে যেনো ঘাটে
ভিড়লো। কিছু স্পীডবোট এখনো ছোটাছুটি করছে।
কিছুক্ষণ পরে চলে আসলাম বীচের দিকে। প্ল্যান হচ্ছে মাছ বার বি কিউ খাবো। দেখে
শুনে একটা কোরালের বার বি কিউ ওর্ডার করে ফেললাম। সাথে দুইটা রুটি নিয়ে শুরু করলাম
খাওয়া। সেই স্বাদ আসলে বলে বুঝানো যাবেনা। যারা খেয়েছেন তারা এতোক্ষণে নিশ্চয়ই
স্মৃতি রোমন্থন করছেন। আর যারা খাননি তারা আক্ষেপ করবেন না। ব্যস্ততার ফাঁকে একবার
ঘুরে আসুন না। জীবনের সেরা কিছু স্মৃতি তৈরি হবে কথা দিলাম।
খাওয়ার পর্ব শেষ করে কিছু সময় সাগরের পানিতে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সময়টা
একান্তই ছিলো নিজের জন্য। নিজেকে নিয়ে ভাবনাগুলো জাবর কাটার মতো মাথায় ঘুরতে
লাগলো। কিছু সমস্যা সমাধান খুঁজছে। কিছু প্রশ্ন উত্তর খুঁজছে। কিছু অস্থিরতা
তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সবাইকে একে একে সময় দিলাম। কথা বললাম নিজের সাথে। ঠান্ডা বাতাস
গায়ে লেগে হিম অনুভূতি শিরদাঁড়া বেয়ে শরীরজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
রাত নেমেছে সেন্টমার্টিনে। যেকোন নতুন জায়গায় গেলে আমার একটা ভাবনা সবসময়
মাথায় আসে। এখানেও তো রাত হয়। অন্ধকারে ঢেকে যায় চারদিক। তখন কেমন দেখায় সবকিছু? এই যে দিনের বেলা কতো মানুষের আনাগোনা, রাত গভীর হলে সবাই চলে যায়। তখন কি এই সাগর একাকীত্ব
অনুভব করে? মানুষের
কাছাকাছি থাকতেই কি জোয়ারের পানি তীর বেয়ে উপরে উঠে আসে?
হেটে হেটে রিসোর্টে ফিরছিলাম। জেটি ঘাট থেকে কিছুটা দূরে হওয়ায় মাঝখানের
কয়েকটা রাস্তা খুব অন্ধকার আর নির্জন ছিলো। মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম। রুমে ফিরে সোহেল
ভাইয়ের সাথে শেয়ার করলাম। উনার কথায় অবাক হলাম। সেন্টমার্টিনে নাকি ক্রাইম রেকর্ড
শুন্যের কোঠায়। যেকোনো সময়, যেকোনো
জায়গায় চলাচল করা যায়। এখানকার মানুষ ধর্মপরায়ণ হওয়ায় ছিনতাই-চুরি এগুলো নাকি
একদমই হয়না বললেই চলে। ব্যাপারটা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে।
রাতের কিছু অংশ হ্যামকে শুয়েই কাটিয়ে দিলাম। গরম কাপড় তেমন কিছুই আমি নিয়ে
যাইনি। রাত যতো বাড়ছিলো ঠান্ডা বাতাসে শরীর কেপে উঠছিলো। তাই একটা সময় রুমে ফিরে
যাওয়াই উত্তম মনে হলো।
এভাবেই কেটে গেলো সেন্টমার্টিনে আমার প্রথম দিন। সেন্টমার্টিন আমাকে দারুণভাবে
টানে সেই প্রথম থেকেই। এর আগে কখনো এখানে রাত কাটানো হয়নি। এতোদিন কী মিসটাই না
করেছি। ভাবতে ভাবতে
ক্লান্ত দেহে ঘুমের পরশ ছুয়ে গেলো।
৪ তারিখ। সকাল ৬ টায় ঘুম ভাঙলো। উঠে ফ্রেশ হয়ে সূর্যোদয় দেখতে বের হলাম।
নাস্তা সেরে কিছুক্ষণ হ্যামকে শুয়ে বই পড়লাম। সকাল ৮ টার দিকে ছেড়া দ্বীপের
উদ্দেশ্যে সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। কোনদিকে,
কিভাবে যেতে হবে কোনো ধারণা নেই। গুগল ম্যাপই আমার ভরসা। পশ্চিম বীচ ধরেই
আগাতে থাকলাম। সবজায়গায় সমান গতিতে সাইকেল চালানো যায়না। বালুর উপর দিয়ে সাইকেল
থেকে নেমে হাটতে হয়। মাথার উপরে সূর্য্য মামা তখন প্রচন্ড মেজাজে আছেন। আমি ঘামছি।
সাথে থাকা পানির বোতলে চুমুক দিচ্ছি মিনিট দশেক পরপর। আমার আশেপাশে কোনো মানুষ
নেই।
সাগরকে পাশে রেখে বীচ দিয়ে যতোটুকু সম্ভব সাইকেল চালিয়ে এগোলাম। একটা সময়
সামনে আসলো শুধুই প্রবাল পাথর। ম্যাপেও দেখলাম এদিকে আর সামনে আগানোর সুযোগ নেই।
এবার মেইন রাস্তায় উঠতে হবে। কিন্তু কোনদিক দিয়ে। উপরে তাকিয়ে দেখি সবদিকে বেড়া
দেওয়া। একদম শেষ মাথায় গিয়ে সাহস করে উপরে উঁকি দিলাম। দেখি একটু দূরে একটা ঘর।
সেখানে দুইজন বৃদ্ধ লোক বসে আছেন। উনাদের জিজ্ঞেস করলাম, রাস্তায় যাবো কিভাবে?
উনারা নিজেদের বাড়ির ভিতর দিয়ে গিয়ে আমাকে মেইন রোডে উঠার সুযোগ করে দিলেন।
এবার তো আমি আরো অবাক! এটাও কি সেন্টমার্টিন!! গ্রামের ভিতরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে
আমি চারপাশ দেখছিলাম। সেন্টমার্টিন বললেই আমাদের সামনে সাগরের নীল জল আর বীচের
সৌন্দর্য ভেসে উঠে। কিন্তু গ্রামের ভিতরের ভিন্ন এক সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্য এই
প্রথম আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। একপাশে গ্রামের বাড়ি ঘর। ঘরের সামনেই ক্ষেত।
সেখানে তরমুজ চাষ হচ্ছে। অনেকগুলো তরমুজ স্তুপাকারে সাজানো, যেগুলো মাত্রই তোলা হয়েছে। আরেকপাশে বিস্তীর্ণ জমি।
মাঝখানে দিয়ে ছোট্ট একটা রাস্তা। তাও কাচা রাস্তা। সেই পথ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে
সামনে আগাচ্ছিলাম। রোদের তীব্রতা আর বাতাসের ঝাপটায় মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিলো শরীরে।
কিছুক্ষণ গ্রামের মধ্যে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে আবারো বীচে নামতে হলো। যেখানে
সেন্টমার্টিন দ্বীপের শেষ। তারপর আছে আরো ৩ টি দ্বীপ। প্রত্যেকটাই ভাটার সময়
চলাচলের উপযুক্ত হয়। শেষ দ্বীপটাই আমার গন্তব্যস্থল ছোড়াদিয়া দ্বীপ বা ছেড়া দ্বীপ।
দীর্ঘ ১ ঘন্টা সাইক্লিং করার পর আমি ছেড়া দ্বীপে আসলাম। সাইকেল চালিয়ে বা হেটে
আসা মানুষের সংখ্যা হাতে গোণা। সবাই ট্রলারে বা স্পীডবোটেই আসে। তাই কয়েকজন অবাক
হয়ে জিজ্ঞেস করছিলো সাইকেল দিয়ে সেন্টমার্টিন থেকেই আসছি কিনা। দেশের সর্বশেষ
ভূখন্ডে দাঁড়িয়ে মুক্ত বাতাসে নি:শ্বাস নিলাম।
ছেড়া দ্বীপে কোনো বসতি নেই। বালুকাময় সাগরতীর ধরে কিছু গাছ আর বাকি পুরোটাই
প্রবাল পাথর। সেন্টমার্টিনের সাথে খুব বেশি পার্থক্য নাই। বড় বড় প্রবাল মাড়িয়ে
একদম শেষ প্রান্তে চলে আসলাম। গুগল ম্যাপে নিজের অবস্থান দেখে গর্ব হচ্ছিলো। এখানে
ডাব খাওয়ার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু কয়েকজন বললো,
সেন্টমার্টিন থেকে এখানের ডাব নাকি ভালো না। তাই আর খাইনি। আধাঘন্টার মতো সময়
কাটিয়ে একই পথ ধরে ফিরে চললাম রিসোর্টের দিকে।
আজ আমার শেষ দিন সেন্টমার্টিনে। বিকেল ৩ টায় জাহাজ ধরতে হবে। রুমে ফিরতে ফিরতে
১১ টা বেজে গেলো। সেন্টিমার্টিনে এসে এখনো আমি সাগরের পানিতে শরীর ভিজাইনি। একবার
না ভিজলে আফসোস থেকে যাবে। তাই ভাবলাম কিছুক্ষণ সাগরের লোনা জলে দাপাদাপি করে আসি।
হেঁটে হেঁটে বীচে আসলাম। দীর্ঘক্ষণ সাইক্লিং এর ক্লান্তি দূর করতে দুইটা ডাব
খেলাম। তারপর নামলাম সাগরে। একটু একটু করে আগাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম যতো পাপ পঙ্কিলতা
সব যেনো সাগরের জল ধুয়ে মুছে নেয়।
সেন্টমার্টিনের পানিতে অনেক বেশি বেগুনি কালারের ছোট ছোট জেলি ফিশ। এগুলো গায়ে
লাগা মাত্রই লাল হয়ে ফুলে যাচ্ছিলো। আর চুলকাচ্ছিলো অনেক। তাই কিছুক্ষণ পরেই উঠে
আসলাম। রুমে ফিরে গোসল করে ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম।
দুপুর ১ টার
দিকে রুম থেকে চেক আউট করলাম। বীচ থেকে আসার সময় সাইকেল নিয়ে এসেছিলাম। সেই
সাইকেলে চড়েই আবারো রওয়ানা দিলাম জেটি ঘাটের দিকে। পিছনে পড়ে রইলো দুইদিন এক রাতের
অসাধারণ কিছু স্মৃতি।
ভ্রমণ জীবনকে উপভোগ্য করে। নতুন করে বাচার আশা জাগায়। সৃষ্টিকর্তার অপরুপ সব
সৃষ্টি দেখে তার কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসে। বিশাল ব্রহ্মান্ডের সিংহভাগই এক জীবনে
দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায়। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়,
"দেখা হয়নাই
চক্ষু মেলিয়া,
ঘর হইতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপর
একটি শিশিরবিন্দু"
লেখক: শিক্ষার্থী, এম বি বি এস (চতুর্থ বর্ষ),
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ।
0 coment rios:
You can comment here