Sunday, March 29, 2020

‘করোনা’ ভাইরাসের সংক্রমণ ঝুঁকি : প্রসঙ্গ হজ ও ওমরা


।। ড. মুহাম্মদ এনামুল হক চৌধুরী।।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঝুঁকি কমানোর জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় সাময়িকভাবে ওমরাহ ভিসা প্রদান বন্ধ করেছে। এছাড়া আগে যাদের ওমরাহ ভিসা দেওয়া হয়েছিল, তাদের সৌদি আরবে প্রবেশের অনুমতি স্থগিত করা হয়েছে। সৌদি সরকারের এই সিদ্ধান্তে বিভিন্ন দেশে প্রতিক্রিয়া হয়েছে।

হজ ও ওমরাহ মৌসুমে সৌদি আরবে মুসলিমদের বৃহত্তম জমায়েত হয়ে থাকে, যেখানে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ২৫ লাখ হজযাত্রী অবস্থান করেন। ২৭ রমজানের রাতে প্রায় ২০ লাখ মুসলিম মক্কায় উপস্থিত হন। 

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর দুনিয়া জুড়ে মুসলমানদের মনে দুটি প্রশ্ন জেগেছে। প্রথমত, ২০২০ সালের রমজানে ওমরাহ কার্যক্রম কি স্থগিত করা হবে? দ্বিতীয়ত, যেহেতু ভাইরাসটি এখনো নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, তাহলে কি এবারের হজ পালন স্থগিত করা হবে?
এরপরও ইতিহাসে হজ বন্ধ থাকার নজির আছে। হিজরতের নবম বছরে হজ পালন ফরজ ইবাদত হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর থেকে এ যাবৎ আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে মোট ৪০ বার হজ স্থগিত হয়েছিল। যার মধ্যে মোট ১২ বার স্থগিত করা হয়েছিল সম্পূর্ণরূপে। করোনা ভাইরাসের কারণে হজ ও ওমরাহ ২০২০ সালে স্থগিত হওয়া অসম্ভব নয়, কিন্তু তা নির্ভর করবে এই রোগের সংক্রমণ আন্তর্জাতিকভাবে নিয়ন্ত্রণে আনার ওপর। হজ ও ওমরাহ বন্ধ রাখার প্রসঙ্গ আলোচনার ক্ষেত্রে আমাদের হজের ইতিহাস ও গুরুত্বের দিকেও ফিরে তাকাতে হবে।

জুহায়মান আল-উতাইবি একজন সৌদি নাগরিক ছিলেন। তিনি আল-জামাআহ আল-সালাফিয়াহ আল-মুহতাসিবাহনামক সালাফি গ্রুপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি ও তার শত শত অনুসারী বাদশাহ খালিদ বিন আবদুল আজিজের রাজত্বকালে পবিত্র মসজিদুল হারামে হামলা করে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। জুহায়মান দলদাবি করেছিল যে জুহাইমানের ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আল-কাহতানি হলেন প্রত্যাশিত ইমাম মাহদি। তার প্রতি আনুগত্যের আহ্বান জানিয়েছিল। এদের দমনে সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলি হয়। এ সময় পবিত্র মসজিদের ভেতরে অনেকে মারা যায়, যার মধ্যে ছিল আটকে থাকা হাজি, জুহাইমানের অনুসারী বন্দুকধারী এবং সৌদি নিরপাত্তা বাহিনীর সদস্য। রক্তাক্ত এ ঘটনার অবসান ঘটে বিশেষ কমান্ডোবাহিনীর অভিযানের মধ্য দিয়ে। সৌদি কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, এ ঘটনায় ১১৭ জন জুহায়মানের সশস্ত্র সন্ত্রাসী এবং ২৬ জন হাজি নিহত হন।

১৯৮০ সালের ৯ জানুয়ারি এ ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিচারের রায় কার্যকর হয়। সৌদি শরিয়াহ বিচার বিভাগের বিধান অনুসারে জুহাইমান আল-ওতাইবিসহ ৬১ জনকে তরবারি দ্বারা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। এছাড়া তাদের সহযোগী আরো ১৯ জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। 

রোগ ও মহামারি ছড়িয়ে পড়ার কারণে হজ বিঘ্ন হওয়ার অনেক ঘটনা ইতিহাসে পাওয়া যায়।

ক. ১৮১৪ সালে বিলাদ আল-হিজাজে প্রায় ৮ হাজার মানুষ প্লেগ রোগে মারা গিয়েছিল, এ কারণে হজ বন্ধ ছিল।

খ. ১২৪৬ হিজরি, অর্থাৎ ১৮৩১ সালে একটি ভারতীয় মহামারির কারণে হজের মৌসুমে তিন-চতুর্থাংশ হজযাত্রী মারা যান।

গ. ১৮৩৭ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে হজ মৌসুমগুলোতে মহামারির প্রাদুর্ভাব হয়েছিল।

ঘ. ১৮৪৬ সাল থেকে কয়েক বছর যাবৎ কলেরার প্রকোপ ঘটে। কলেরা হজযাত্রীদের মধ্যে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৮৫০ সাল পর্যন্ত হজ মৌসুমে উপস্থিত ছিল। এরপর আবার ১৮৬৫ এবং ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ফিরে আসে।

ঙ. ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে টাইফয়েড মহামারি আকারে দেখা দেয়, যা মদিনা থেকে আসা একটি কাফেলা থেকে ছড়িয়ে পড়ে।

চ. ১৯৮৭ সালে মেনিনজাইটিসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। গুরুতর ও অত্যন্ত সংক্রামক মেনিনজাইটিসের কারণে কমপক্ষে ১০ হাজার জনের সংক্রমণ ঘটে।

মক্কার হারাম শরিফ ও মদিনার মসজিদে নববির ইতিহাসে মহামারির অনেক ঘটনা আছে। এই মৌসুমে সংক্রামক রোগ করোনা ভাইরাস দ্বারা হাজিরা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ এটি খুব সহজেই শ্বাসযন্ত্রের নিঃসরণের সঙ্গে অন্যদের সংক্রমিত করতে পারে।

সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, করোনা ভাইরাস বিশ্বব্যাপী ১ লাখেরও বেশি মানুষকে আক্রান্ত করেছে। এদের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ জন মারা গেছে, যাদের বেশির ভাগ চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান ও ইতালিতে। এ কারণে শুধু ওমরাহ স্থগিত করা হয়নি, বরং বিশ্ব জুড়ে অনেক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত বা বাতিল করা হচ্ছে। 

একই কারণে ৫ মার্চ থেকে সৌদি আরব সংক্রমণ রোধের সতর্কতামূলক ব্যবস্থাহিসেবে এশা ও ফজর নামাজের মধ্যকার সময়ে পবিত্র মসজিদ দুটি বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। সৌদি আরবে করোনা ভাইরাসে বেশ কিছু লোক আক্রান্ত হওয়ার পর এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে এক ব্যক্তি টুইট করেছেন :কাবার চারপাশে একটি আচ্ছাদন তৈরি করা এবং তাওয়াফ বন্ধ করা, যাতে কোনো আক্রান্ত ব্যক্তি কাবা স্পর্শ না করে এবং সংক্রমণ না ছড়াতে পারে। বিষয়টি স্বাভাবিক এবং সবার নিরাপত্তার খাতিরে এই আয়োজন করা হয়েছে।

এই আলোচনার পর আবারও যে প্রশ্নটি আসে, চলতি বছর বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাস যদি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসে, সে ক্ষেত্রে হজ থেকে হজযাত্রীদের নিষিদ্ধ করা এবং রমজান মাসে ওমরাহ পালনে ইচ্ছুকদের যেতে না দেওয়ার ব্যাপারে সৌদি সরকার কী করবে? এ কথায় যে কোনো বিবেকবান ব্যক্তি বলবেন, মহামারি ও সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার কারণে ওমরাহ ও হজ সাময়িকভাবে আংশিক বন্ধ অথবা স্থগিত করা বৈধ।

সৌদি আরবের গ্র্যান্ড ফাতওয়া বোর্ড, আল-আজহারের ফাতওয়া বোর্ড, পাশাপাশি কাতারে আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলারসের সেক্রেটারি জেনারেল আলি আল-ক্বারাহ দাগি ২০২০ সালের ১ মার্চ নতুন করোনার ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ও হজযাত্রীদের জীবনের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করার কারণে ওমরাহ ও হজের সাময়িক স্থগিতাদেশ জারির অনুমতি দিয়েছে।

আল্লাহর পবিত্র ঘরের প্রতি সব মুসলমানের অন্তরে টান ও ভালোবাসা রয়েছে। এটি মুসলিম অনুভূতি ও চেতনার প্রকাশ। মহান আল্লাহ তাআলা তার ঘরকে সুরক্ষিত রাখার অঙ্গীকার করেছেন। অবহেলা বা খারাপ উদ্দেশ্য কখনোই এই পবিত্র স্থানকে ইবাদতশূন্য হতে দিতে পারবে না। তবে জরুরি অবস্থায় সব জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হারাম শরিফ সাময়িকভাবে সম্পূর্ণ বা আংশিক বন্ধ রাখা যেতে পারে। আমরা বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি থেকে মুসলমান ও মানব সম্প্রদায়কে রক্ষা করার দোয়া করি। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন।
লেখক:মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, গবেষক


শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here