।। ডা: মো:
আব্দুল হাফিজ শাফী।।
প্রতিবার
বছরের এই সময়ে আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে সাধারণ ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপে
জ্বর আর ঠান্ডার সংক্রমণ দেখা দেয় বেশী। কিন্তু এর সঙ্গে এ বছর মহামারী করোনা ভাইরাসের
সংক্রমণ দেখা দেয়াতে সাধারণ সর্দি-কাশি বা ফ্লুতেও উৎকণ্ঠা রয়েছে অনেকের, সেই সাথে এই
সাধারণ সমস্যাগুলোও হয়ে উঠেছে ভয়ের কারণ। সত্যি বলতে কি, করোনার
সংক্রমণের সঙ্গে সাধারণ ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জার যেমন মিল আছে তেমনি আবার সুস্পষ্ট
অমিলও আছে।
১. করোনা ও
সাধারণ ফ্লু—দুটোই শ্বাসতন্ত্রের রোগ। দুটোর সংক্রমণ ছড়ায়ও
একইভাবে—ড্রপলেট (মুখ বা নাকনিঃসৃত তরল কণা), বিভিন্ন
বস্তু আর সংস্পর্শের মাধ্যমে। তাই দুটোকেই প্রতিরোধ করার উপায়ও এক। হাঁচি-কাশির
শিষ্টাচার মেনে চলা, হাত দিয়ে নাক-মুখ-চোখ স্পর্শ
না করা; বারবার হাত ধোয়া এবং সংক্রমিত
ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলার মাধ্যমেই কেবল রোগ প্রতিরোধ সম্ভব।
২. দুটো
স্বাস্থ্য সমস্যাই ভাইরাস জনিত হলেও ভাইরাস দুটি সমগোত্রীয় বা একই শ্রেণির নয়।
সাধারণ ফ্লু হয়ে থাকে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের প্রকোপে। অন্য দিকে কোভিড-১৯ এর কারণ
করোনা গ্রুপের ভাইরাস, যা সার্স ভাইরাসের কাছাকাছি
গোত্রের।
৩. দুটো
সংক্রমণের উপসর্গেও মিল আছে—সাধারণ মৃদু সর্দি-কাশি-জ্বর
থেকে শুরু করে তীব্র সংক্রমণ, নিউমোনিয়া বা শ্বাসতন্ত্রের
প্রদাহ হয়ে থাকে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণগুলোর সঙ্গে মিল থাকায় সাধারণ
সর্দি-কাশি হলেও সবাই ভয়ে পাচ্ছেন, করোনা হলো
কি না।
৪. সাধারণ
ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস অনেক ধীর গতিতে ছড়ায়। সেই তুলনায় করোনার কারণে COVID-19 ছড়ায় অতি
দ্রুত এবং মারাত্মক ছোঁয়াচে । করোনা ভাইরাস অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি মানুষের মধ্যে
সংক্রমণ ঘটাতে পারে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন এই ভাইরাসে আক্রান্ত শত শত নতুন
রোগীর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
৫. সাধারণ
ফ্লুর ক্ষেত্রে ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে অসুখ দেখা দেয়।
করোনার বেলায় অসুখ দেখা দিতে সময় নেয় ৭ থেকে ১৪ দিন, অনেক সময় ২১
দিন পরেও লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে।
৬. করোনা ভাইরাসে
আক্রান্ত ব্যক্তি পরিপূর্ণভাবে সুস্থ হতে পারেন। কারণ, এই ভাইরাসে
আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকেই জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টের মতো সাধারণ
সমস্যা অনুভব করে থাকেন। ফলে আশা করা যাচ্ছে, এই ভাইরাসে
আক্রান্ত বেশির ভাগ ব্যক্তিই সুস্থ হয়ে যাবেন। চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের এক
বিশেষজ্ঞ বলেছেন, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত
ব্যক্তি, যাঁদের রোগের প্রকোপ কম, তাঁদের
সুস্থ হতে এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।
স্বস্তির
কথা হচ্ছে, কোভিড-১৯ সংক্রমণের ৮১ শতাংশ
ক্ষেত্রে মৃদু উপসর্গ দেখা দেয়, যা এমনিতেই সেরে যায়। ১৪ শতাংশ
ক্ষেত্রে উপসর্গ হয় তীব্র মাত্রার। এমন ক্ষেত্রে রোগীকে অক্সিজেন দেওয়া লাগে।
মাত্র ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে রোগীর ভেন্টিলেটর (ICU) দরকার হয়।
তবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের বৈশ্বিক মহামারি শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই হার নিশ্চিত
করে বলা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
৭.
কোভিড-১৯-এ মৃত্যুহার এখন পর্যন্ত ৩-৪ শতাংশ। বিভিন্ন
তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যায় ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ১ শতাংশ (০.১%)।
৮. যদি এই
মুহূর্তে সর্দি-কাশি-জ্বর দেখা দেয়, আপনার
করোনা সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার কোনো ইতিহাস বা ঝুঁকি না থাকে এবং আপনি
যদি ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের তালিকায় না থাকেন, তাহলে
উদ্বিগ্ন হবেন না। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল, প্রচুর পানি
ও তরল পান করুন, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ আর
বিশ্রামই আপনার চিকিৎসা। মনে রাখবেন সাধারণ ফ্লু এর প্রধান চিকিৎসা হচ্ছে বিশ্রাম, বিশ্রাম, বিশ্রাম।
উপসর্গ
অনুযায়ী জ্বর হলে প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট (500mg) ১ টা করে ৪
বেলা খাবার পরে, কাশি হলে এন্টিহিস্টামিন
ট্যাবলেট ফেক্সোফেনাডিন 120mg রোজ রাতে একটা ১০ দিন; শুস্ক কাশি
বেশী হলে ট্যাবলেট মন্টেলুকাস্ট 10mg রোজ রাতে
একটা; গলা ব্যাথার জন্য কুসুম গরম
পানিতে লবণ মিশিয়ে গড়গড়া করবেন; এছাড়া ট্যাবলেট সিভিট 250mg(ভিটামিন সি)
রোজ ১ টা করে ২ বেলা চুষে খেতে পারেন, সর্দির জন্য
Antazol nasal drop (বয়সভেদে)
ব্যবহার করতে পারেন।
আবার
শিশুদের ক্ষেত্রে: প্যারাসিটামল সিরাপ, হিস্টাসিন
সিরাপ, মন্টেলুকাস্ট 4mg চুষে খাবার
ট্যাবলেট দিতে পারেন।
এই ঔষধগুলো ফার্মেসিতে ওটিসি
ড্রাগ (ব্যবস্থাপত্র ছাড়া বিক্রি করা যায়) হিসেবে পাওয়া যায়। দিনে নিয়ম করে
দুইবেলা জ্বর পরিমাপ করবেন। সাধারণ ফ্লুতে এই চিকিৎসা নিলে এবং বিশামে থাকলে দ্রুত
আরোগ্য লাভ করা যায় আল্লাহর রহমতে।
৯. উপসর্গ
দেখা দেয়ার পর ৭২ ঘণ্টা অপেক্ষা করা যেতে পারে। তারপরও যদি দেখা যায় উপসর্গ কমার
বদলে বাড়ছে, প্রবল জ্বর উঠছে বা শ্বাসকষ্ট
হচ্ছে তা কিন্তু বিপদের লক্ষণ। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির এই উপসর্গের সাথে
ডায়রিয়াও থাকতে পারে। প্রাথমিক চিকিৎসার পরেও রোগীর দ্রুত অবস্থার অবনতি ঘটলে
অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে হাসপাতালে দেখাতে হবে। আর যদি আপনি ঝুঁকিপূর্ণ
ব্যক্তি হন, সম্প্রতি বিদেশফেরত বা
আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে গিয়ে থাকেন, তবে উপসর্গ
দেখা দেওয়ামাত্র সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ
ও গবেষণা বিভাগ/ IEDCR এর হটলাইনে যোগাযোগ করুন।
১০. কোভিড-১৯-এ
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ঝুঁকিতে দেখা গেছে ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের (যদিও যেকোনো বয়সের
যে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন)।
এছাড়া
ডায়াবেটিস, হাপানি, ক্যান্সার, হৃদ্রোগ, কিডনি
জটিলতাসহ অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় আক্রান্ত এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তারাও
ঝুঁকিতে রয়েছে। আর ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে শিশুরা।
১১.
প্রাথমিক লক্ষণ দেখে আসলে সন্দেহ করা যেতে পারে। নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত কি না, তা লক্ষণ
দেখে জানা যাবে না। করোনা ভাইরাসের নির্দিষ্ট টেস্ট (পরীক্ষা) ছাড়া তা কোনোভাবেই
নিশ্চিত হওয়া যাবে না। কারও এই পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ এলেই নিশ্চিত হওয়া যায় যে
তিনি কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত।
১২. করোনার
কার্যকর ওষুধ বা প্রতিষেধক এখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত/আবিস্কৃত হয়নি। তবে ইনফ্লুয়েঞ্জার
কার্যকর টিকা আছে।
সবশেষে
সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হলে সারমর্ম হচ্ছে দুটি কথা-
এক:- আতংকিত না
হয়ে নিজ দায়িত্বে অবশ্যই বাসায় থেকে উপসর্গ অনুযায়ী প্রাথমিক
চিকিৎসা নিন। ভিটামিন সি জাতীয় খাবার বেশী খান। অবশ্যই পরিবারের সবার থেকে সামাজিক
দূরত্ব বজায় রাখুন। হাচি-কাশি শিষ্টাচার মেনে
চলুন।
দুই:- সেটা
আপনার-আমার হাতে নেই। সেটা হচ্ছে টেস্ট -টেস্ট এবং টেস্ট। এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত
পরিমাণ টেস্ট কিট (COVID-19) দরকার। দেশের গুরুত্বপূর্ণ
বিভিন্ন প্রান্তে করোনা ভাইরাস এর নির্দিষ্ট পরীক্ষার ব্যবস্থা করে প্রত্যেক সন্দেহভাজন
রোগীকে টেস্টের আওতায় আনা খুবই দরকার। আশাকরি খুব দ্রুত সরঞ্জাদিসহ ল্যাব এর সমাধান হবে।
নিজ নিজ
ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলি। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন।
লেখক:
ডা: মো:
আব্দুল হাফিজ শাফী,
এম.বি.বি.এস
(স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ),
বি.সি.এস
(স্বাস্থ্য)
0 coment rios:
You can comment here