মাস্টার জামিলুল হক স্যারের সাক্ষাৎকার।
মানুষ গড়ার কারিগর একজন আদর্শ শিক্ষক
মাস্টার জামিলুল হক। যিনি ১৯৫২ সালের ১২ জুলাই সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার
ডুংরিয়া গ্রামে বাবা মৌলভী আব্দুল খালিক ও মা মোছাঃ আয়েশা সিদ্দিকার ঘরে আলোকিত করে
এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষা জীবন দুর্গাপুর মাদরাসা
থেকে শুরু হয়ে প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শেষ করেন মুসলিম হাইস্কুল আন্দরকিল্লাহ চট্টগ্রামে।
এবং সেখান থেকেই ১৯৬৯ সালে মেট্টিক পাশ করেন। তিনি ৪ ছেলে এক মেয়ের গর্বিত পিতা। যিনি
দীর্ঘ দিন সফলতার সাথে ৪৬ নং শ্রীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে
সমাসীন ছিলেন। তাঁর অর্জিত অতীত অভিজ্ঞতা ও বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তিনি কথা
বলেন প্রান্তিক জনপদের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন প্রান্তিক জনপদের প্রতিনিধি
তাওহীদুল আলম শাহীন।
তাওহীদুল আলম শাহীন: স্যার, আপনি শিক্ষকতার মতো মহান
পেশায় সারা জীবন অতিবাহিত করেছেন। আপনার জীবনের বিরাট একটা সময় শ্রীপুর সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কমরত ছিলেন। আপনার কর্মজীবনে শ্রীপুর সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয়ে যোগদান সম্পর্কে যদি একটু বলেন।
মাস্টার জামিলুল হক: আমার শিক্ষকতা জীবন শুরু হয় ১৯৭০ সালে কপলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। এরপর
১ জুলাই ১৯৯৩ ঈসায়ী তারিখে ৪৬ নং শ্রীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক
হিসেবে যোগদান করি। চাকুরী হতে অবসর গ্রহণ করি ১ লা জুলাই ১৯৯৪ ঈসায়ী সালে। আমি যোগদানের
পর যাকে পাই তিনি হলেন বিশিষ্ট শিক্ষানুগারী মাস্টার আইয়ুবুর রহমান (আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী
করুন) আমরা দুইজন মিলেই সব ক্লাস নিতে হতো। এরপর তিন বছর পর সরকারি নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকগণ যোগদান করে। এভাবেই চলতে থাকে স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম।
তাওহীদুল আলম শাহীন: আপনি যখন এ বিদ্যানিকেতনের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তখন এলাকার শিক্ষা ব্যবস্থার হালচাল
কেমন ছিল?
মাস্টার জামিলুল হক: আমি যখন যোগদান করি তখন অত্র লেখার শিক্ষা দিক্ষার ক্ষেত্রে খুবই পিছিয়ে ছিল।
কৃষিপ্রধান এলাকা হিসেবে শ্রমজীবি মানুষেরা নিজেদের সন্তানদেরকে স্কুলে প্রেরণের ক্ষেত্রে
খুবই উদাসীন ছিলেন। অত্র এলাকার মানুষ কিন্তু খুবই ধর্ম প্রাণ। তাই সাধারণ মানুষকে স্কুলমুখি করার লক্ষ্যে মাঝে মাঝে স্কুলেই আমি খতমে
কুরআন ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করি। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে পরামর্শ নিয়ে স্কুলকে সামন পানে এগিয়ে
নিতে প্রানান্তকর চেষ্টা চালাই। তখন আমাকে সার্বিক সহযোগিতা করছেন মরহুম রাকিব উল্লাহ
মেম্বার, মরহুম ক্বারী আব্দুল
কাদির, মরহুম আখল আলী, মরহুম তৈমুছ আলী মেম্বার, মরহুম সোনাহর আলীসহ আরো অনেকে। আজ তারা পরপারে। আল্লাহ
তাদেরকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন। এছাড়া স্থানীয় স্কুলকে এগিয়ে নিতে অনেক যুবকরা আমাকে
বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন। সবার কাছে আমি চিরঋণি।
তাওহীদুল আলম শাহীন: আপনার দায়িত্বকালীন সময়ে কী কী সমস্যার সম্মুখিন হয়েছিলেন আর তা সমাধানের জন্য
কী ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন?
মাস্টার জামিলুল হক: নিয়মিত শিক্ষকের ঘাটতি ছিল। দুইজন শিক্ষক মিলেই সব ক্লাস নিতে হতো। অপর্যাপ্ত শ্রেণি কক্ষ
ও শিক্ষার্থীর তুলনায় অপ্রতুল চেয়ার বেঞ্চ ছিল। এলাকাবাসীর আর্থিক সহযোগিতায় বেসরকারি কিছু খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে ক্লাস কার্যক্রম চালিয়ে নিতে থাকি। যাতে কোমলমতি
শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার কোনো ক্ষতি না হয়। এছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় শিক্ষার
পরিবেশ রক্ষার চেষ্টা করি এবং স্কুল সামনে বৃক্ষ রোপন করি। যা আজো কালের স্বাক্ষি হিসেবে
আছে।
তাওহীদুল আলম শাহীন: একজন ভালো শিক্ষক হতে হলে কী করতে হবে বলে আপনি মনে করেন?
মাস্টার জামিলুল হক: এটা খুব সংক্ষেপে বলা যায় না। সবচেয়ে বড় হলো ছাত্রদের শিক্ষা দেয়া। ছাত্রদের সহকর্মীদের
সাথে সম্পর্ক। বর্তমান মাল্টিমিডিয়া সম্পর্কে জ্ঞান থাকা। লেখা-লেখি করা। বই পুস্তক
রচনা করা। প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বের বাইরে লেখালখি। পেপার পত্রিকায় লেখা-লেখি করা। এক কথায়, কেউ
যদি শিক্ষকতাকে জীবনে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন এং ভালো শিক্ষক হওয়ার গুণাবলী অর্জনের
চেষ্টা করেন তাহলে তিনিই ভালো শিক্ষক হতে পারবেন।
তাওহীদুল আলম শাহীন: আপনার কাছে পড়া লেখা করেছে এমন হাজারো ছাত্র আজ দেশে বিদেশে সামাজিক ও অথনৈতিকভাবে
প্রতিষ্ঠিত। এ বিষয়টি ভাবনায় আসলে আপনার কেমন লাগে?
মাস্টার জামিলুল হক: বিষয়টি ভাবনায় আসলে আমার মন আনন্দে আর গর্বে বুক ভরে যায়, আনন্দের অশ্রু বেয়ে পড়ে চোখ থেকে। যখন দেখি একজন ছাত্র সেও আজ পৌঢ় হয়েছে
অথচ ফোন দিয়ে বলছে স্যার, আমি আপনার সাবেক ছাত্র অমুক। তখন আসলে খুব ভালো লাগে যা ভাষায়
প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আসলে শিক্ষকতার অবসরে একজন শিক্ষকের এটাই পরম চাওয়া ও পাওয়ার
বিষয়।
তাওহীদুল আলম শাহীন: আপনার প্রিয় শিক্ষক কে? ও কেন?
মাস্টার জামিলুল হক: আমার প্রিয় শিক্ষক অনেকেই আছেন। তবে যাঁর কথা বলবো তিনি হলেন সর্বজনাব ফয়জুর রহমান স্যার । স্যার পড়ানোর
সময় বিষয়বস্তু খুব ভালোভাবে প্রাণবন্ত করে উপস্থাপন করতেন। তার ভাষা মার্জিত ছিলো।
এককথায় তিনি অনন্য একজন শিক্ষক!
তাওহীদুল আলম শাহীন: পাঠদানের সময় শিক্ষার পরিবেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
মাস্টার জামিলুল হক: পাঠদানের সাথে শিক্ষার পরিবেশ অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। ভালো পরিবেশ না থাকলে ভালোভাবে
পাঠদান করা যায় না। শিক্ষাকার্যক্রম ফলপ্রসূ করতে উপযুক্ত পরিবেশের কোনো বিকল্প নেই।
তাওহীদুল আলম শাহীন: ভালো ফলাফলের জন্য অভিভাবকের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত?
মাস্টার জামিলুল হক: অভিভাবক; ভালো ফলাফলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। অভিভাবক সচেতন হলেই শিক্ষার্থীরা
ভালো ফলাফলের পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে যায়। অভিভাবক শিক্ষার্থীকে শাসন করবেন, আবার আদরও করবেন। তারা শিক্ষকদের সাথে সার্বিক যোগাযোগ
রাখবেন।
তাওহীদুল আলম শাহীন: শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
মাস্টার জামিলুল হক: শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সন্তানতুল্য। শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের মধ্যেই সদ্ভাব ও
আন্তরিক সম্পর্ক বজায় থাকবে। শিক্ষার্থীরা তাদের সুবিধা-অসুবিধা জানাতে শিক্ষকের কাছে কুণ্ঠিত
হবে না। তবেই ভালো কিছু সম্ভব।
তাওহীদুল আলম শাহীন: পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনি মনে করেন?
মাস্টার জামিলুল হক: সুস্থ দেহ-সুস্থ মন, পড়া শুনায় সারাক্ষণ। শরীর-মন ভালো থাকলে পড়াশোনায় মন বসবে। তাই পড়াশোনার পূর্ব
শর্ত হলো শরীর-মন সুস্থ রাখা। এ জন্য প্রয়োজন নিয়মিত খেলাধুলা ও শরীর চর্চা । শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার
পাশাপাশি খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করবে, তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাবে।
তাওহীদুল আলম শাহীন: আপনার শিক্ষকতা জীবনের একটি সুখের স্মৃতি সম্পর্কে বলুন।
মাস্টার জামিলুল হক: আমি যোগদানের পর প্রতি বছরই বৃত্তি পরীক্ষায় ছাত্রদের অংশগ্রহণের জন্য যথাযথ উদ্যেগ
গ্রহণ করতাম। ১৯৯৫ সনে যখন প্রথম আমার প্রিয় ছাত্র লাল মিয়া
(যার বর্তমান নাম ইমদাদুল
হক যুবায়ের, যে নামটা আমিই পরিবর্তন
করে দিয়েছিলাম)
এবং মাস্টার আইয়ুবুর রহমান সাহেবের সন্তান আলমগীর হোসেন বৃত্তি পায়। সেটাই ছিল আমার খুবই আনন্দের স্মৃতি।
এবং মাস্টার আইয়ুবুর রহমান সাহেবের সন্তান আলমগীর হোসেন বৃত্তি পায়। সেটাই ছিল আমার খুবই আনন্দের স্মৃতি।
তাওহীদুল আলম শাহীন: আপনার অবসর সময় কীভাবে কাটে?
মাস্টার জামিলুল হক: খবর দেখি, পত্রিকা পড়ি। কখনো টিভিতে
খেলা দেখি। পরিবারকে সময়কে দেই। এভাবেই এগুচ্ছে আমার দিনগুলো----।
তাওহীদুল আলম শাহীন: আপনার সাবেক ছাত্র-ছাত্রী ও প্রান্তিক জনপদের পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার আছে
কি?
মাস্টার জামিলুল হক: আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রান্তিক জনপদ পরিবারের প্রতি যাঁরা সাক্ষাৎকার নিয়ে
আমাকে ধন্য করেছেন। পত্রিকাটির সার্বিক উন্নতি অগ্রগতি কামনা করি। সাবেক ছাত্র-ছাত্রীসহ
সবার প্রতি আমার একটাই দাবী সেটা হলো আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ
আছি। আল্লাহ যেন আমাকে সুস্থ করেন ও ইমানের সাথে খাতেমা বিল খায়ের নাসিব করেন।
তাওহীদুল আলম শাহীন: আপনার জীবন সুন্দর হোক, পূরণ হোক আপনার মনের ভিতর লুকায়িত সকল প্রত্যশা সেই দোয়া করছি রাব্বে কারীমের দরবারে।
স্যার, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
মাস্টার জামিলুল হক: আপনাকের ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন-
তাওহদীদুল আলম শাহীন
মোবাইল: 01726701076
0 coment rios:
You can comment here