মাজহারুল ইসলাম জয়নাল
মহান আল্লাহ পাক অপূর্ব সুন্দর করে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তার চেয়েও সুন্দর
করে সৃষ্টি করেছেন আশরাফুল মাখলুকাত মানবজাতিকে। সুন্দর পৃথিবীর সব কিছুই সৃষ্টি
করেছেন মানুষের জন্য। সকল মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। সেজন্য আল্লাহর সৃষ্টি
চন্দ্র-সূর্য-তারকা সকল মানুষকে সমান আলো বাতাস প্রদান করে থাকে। মহান আল্লাহ তাঁর
সৃষ্টির প্রতি কোনো বৈষম্য প্রদর্শন করেন না। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- ‘যদি তোমরা আমার রহমত কামনা কর তবে আমার সৃষ্টির
প্রতি রহম কর’। (আল কুরআন)
মুসলমান হলো ঐ ব্যক্তি যার হাত ও যবান হতে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকবে। ঐ ব্যক্তি মুসলমান নয় যার হাত, যবান দ্বারা অন্য মানুষ জুলুম নির্যাতনের
স্বীকার হয়। যবান দিয়ে কাউকে গালি দেয়া, মিথ্যা কথা বলা, গীবত করা, অন্যায় ব্যবহার করা, কারো মনে কষ্ট দেওয়াকে ইসলাম হারাম ঘোষণা
করেছে। কেননা, এগুলো হচ্ছে মানুষকে ভালোবাসার বিপরীত। আমাদের প্রিয় নবী সা. তার
শত্রুকে ভালোবাসতেন, যার ফলে শত্রুরা
রাসুল সা. এর ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে দলে দলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা লাভ করে।
যেমন এক
বুড়ি মহিলা রাসুল সা. এর পথে প্রতিদিন কাঁটা পুঁতে রাখতো। যাতে রাসুল সা. কষ্ট পান, কিন্তু একদিন রাসুল সা. দেখলেন পথে কোনো কাঁটা
নেই, তাই রাসুল ভাবলেন
হয়ত বুড়িটি অসুস্থ তাই তিনি তাকে দেখতে গেলেন, এতে বুড়ি মা খুশি হয়ে মুসলমান হয়ে গেল। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা রাসুল সা., সাহাবায়ে কেরাম এবং ওলী আউলিয়াদের জীবনীর মধ্যে
পাওয়া যায়।
যুগে যুগে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা মানুষকে ভালোবাসার শিক্ষা দিয়েছেন। সুতরাং
মানুষের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ভালোবাসা হয় না। মানব
প্রেমই হচ্ছে আল্লাহপ্রেম ও রাসুলপ্রেম। আমাদের প্রিয় নবী সা. ইরশাদ করেছেন ‘আল্লাহর উপর ইমান আনার পর সর্বশ্রেষ্ট ইবাদত মানুষকে ভালোবাসা’। (আল-হাদীস)
এ প্রসঙ্গে আল কুরআনের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে যে- মহান আল্লাহ যখন
মানব জাতিকে সৃষ্টির জন্য ফেরেশতাদের নিকট অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন, তখন ফেরেশতারা বলেছিল, হে আল্লাহ আমরাইতো তোমার প্রশংসা এবং এবাদত
করতেছি সুতরাং আপনি মানব সৃষ্টি করার কী প্রয়োজন আছে? এরাতো দুনিয়াতে রক্তপাত ঘটাবে। তখন আল্লাহ
বলেছিলেন, ‘আমি যা জানি তোমরা
তা জান না।’
তাই মানুষ যখন পরস্পরকে ভালোবাসে তখন আল্লাহ ফেরেশতাদের নিকট অহংকার
প্রকাশ করেন। সেজন্য বলা হয়েছে মানুষকে ভালোবাসা সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ইবাদত। মানব
সভ্যতার ইতিহাসে অবিনশ্বর মহা মানবেরা যুগে-যুগে মানুষকে ভালোবাসার শিক্ষা দিয়ে
গেছেন। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার মাধ্যমেই পৃথিবীকে জয় করেছেন। সমাজে শান্তি আর
সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছেন।
কিন্তু আজকের সমাজে মানুষ ভালোবাসার বদলে পরস্পরের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ আর
অন্যায় অবিচারের মাধ্যমে পৃথিবীকে অশান্ত করে তুলেছে। মানুষের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হল
সবল মানুষ দুর্বল মানুষকে সহযোগিতা প্রদান করবে। আর পশুর বৈশিষ্ট হল সবল পশু
দুর্বল পশুকে আক্রমণ করবে। তাই মানুষ যখন তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছেড়ে পশুর বৈশিষ্টে চলে যায়, তখন সে দুর্বল
মানুষের প্রতি আক্রমণ করে থাকে। মানুষের মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন না থাকায় পরস্পরের
ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসা, প্রতিহিংসা, আর আধিপত্য
প্রতিষ্ঠার বাসনায় পৃথিবীতে আজ সর্বত্র অশান্তি আর অরাজকতা বিরাজ করছে।
ইতিহাস
সাক্ষী পৃথিবীতে মানবতার যত ধ্বংস সাধিত হয়েছে, তার সবই প্রতিহিংসা আর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মানসে হয়েছে। প্রতিহিংসার অনলে
প্রজ্জ্বলিত হয়ে ইয়াজিদ এর বাহিনী ইমাম হোসাইন (রা:) কে স্বপরিবারে হত্যা করেছিল।
হালাকু খান বাগদাদ নগরী ধ্বংস করে ইতিহাসে বিশ্বের ত্রাস সৃষ্টিকারী হিসেবে
পরিচিতি লাভ করেছিলেন। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ সকল যুদ্ধই আধিপত্য
বিস্তারের মানসে হয়েছে। ভালোবাসাহীন মানব হৃদয়ের কারণে আজও দাউদাউ করে জ্বলছে
হিরোশিমা, নাগাশাকি, নমপেন, বৈরুত, বাগদাদ, প্যালেস্টাইন, আফগানিস্তান, চেচনিয়া, বসনিয়া, মায়ানমারসহ অনেক দেশ।
কবি তাঁর ভাষায় বলেছেন-
‘গাহি সাম্যের গান/
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান,/
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’
মানব সৃষ্টির উষা লগ্নে স্রষ্টার বলিষ্ট ঘোষণা ছিল তাঁর প্রতিনিধি হয়ে সৃষ্টি
জগতে তাঁরই মহিমা প্রকাশ করবে এবং তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে মানুষ স্বর্গীয়
সুখ লাভ করতে পারবে। তাই মানুষের উচিত প্রেম ও ভালোবাসার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে
মানুষের জাগ্রত সত্তাকে স্থান দেয়া। ইসলাম মানুষকে ভালোবাসার শিক্ষা দিয়েছে।
ভালোবাসার দ্বারাই পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইসলামের আদর্শ দেখে মানুষ দলে
দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে।
লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া-বিবাদ, দ্বন্দ-কলহ, মারামারি-হানাহানি বোমাবাজি, সন্ত্রাসী তথা
বিশ্ব মানবতার জন্য ক্ষতিকর বা অশান্তির কারণ এমন কোনো শিক্ষা ইসলাম ধর্মে স্বীকৃত
নয়। কারণ ইসলাম শব্দের অর্থই হল শান্তি বা আত্মসমর্পণ। মানুষহীন রাষ্ট্র যেমন
কল্পনা করা যায় না তেমনি ধর্মহীন মানুষও কল্পনা করা যায় না। মহান আল্লাহ পাক
মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে সৃষ্টি করে ইহকালিন
মানবপ্রেম ও সমৃদ্ধি অর্জন করার জন্য কতগুলো নিয়ম কানুন সম্বলিত ধর্ম বা জীবন
ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছেন: যেন, মানুষে মানুষে
পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, সহমর্মীতা, খোদাপ্রেম, স্নেহ-মমতা, শান্তি-সম্প্রীতি ও পবিত্র ভালোবাসার সম্পর্ক বিরাজ থাকে। ইসলামের আদর্শই হলো
ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, ক্ষমা ও উদারতা।
ইসলাম অন্যান্য ধর্মের লোকদের নিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে চায়। যার বাস্তব
প্রমাণ দেখি আমরা পৃথিবীর প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র মদীনা প্রজাতন্ত্রে। মহানবী (সা:)
মদীনা রাষ্ট্রের ইহুদী, খ্রিস্টান তথা সকল
নাগরিককে সমান সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছিলেন। আল্লাহর সৃষ্টি মানুষকে ভালোবাসলে
আল্লাহতায়ালাকে ভালোবাসা হয়। একের প্রতি অন্যের ভালোবাসা শুধু মানুষের উদ্দেশ্যে
মানুষকে ভালোবাসা নয়, বরং আল্লাহর জন্য
মানুষকে ভালোবাসা।
আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন বলবেন ঐ সকল লোক কোথায়? যারা দুনিয়াতে আমার মহত্তের দিকে লক্ষ্য
রাখিয়াই পরস্পরকে ভালোবাসিতো? আজ আমি তাদেরকে
আমার ছায়াতলে আশ্রয় প্রদান করব। আজ আমার ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়া নেই। মহানবী
(স:) ইরশাদ করেছেন একজন মুসলমান ব্যক্তিকে হত্যা করা আল্লাহর নিকট অধিকতর ভয়াবহ
সারা দুনিয়া ধ্বংশ হবার চেয়ে। মহানবী (স:) ইরশাদ করেছেন, “সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। সমগ্র সৃষ্টির
মধ্য আল্লাহর নিকট অধিকতর প্রিয় সেই ব্যক্তি যে তার (পরিবারের) সৃষ্টির প্রতি দয়ালু।” (আল-হাদীস)
মানুষ মানুষের জন্য। সুতরাং পৃথিবীতে মানুষে মানুষে যদি পবিত্র ভালোবাসার
বন্ধন দৃঢ় থাকে, তাহলে আমাদের সমাজ
শান্তিতে ভরপুর হয়ে যাবে। সমাজে কোন অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা বিদ্যমান থাকবে না। আমাদের সমাজে দেখা যায় এমনও অনেক লোক আছেন যারা
সম্পদশালী অথচ তারা তাদের দরিদ্র প্রতিবেশির প্রতি নজর রাখেন না। কিংবা অনেক
ধর্মপ্রাণ লোক আছেন যারা তাদের প্রতিবেশিকে সাহায্য সহযোগিতা করেন না। তারা যতই
ধর্মপ্রাণ আর পরহেজগার বলে লোকমুখে পরিচিত হউন না কেন, তাদের আমল কোন কাজে আসবে না।
পরিশেষে বলব, আসুন আমরা সামাজিক অশান্তি আর অরাজকতা দূর করতে পারস্পরিক ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হই। ভুলে যাই হিংসা বিদ্বেষ আর হানাহানি। তবেই সুন্দর হবে সমাজ। শান্তি পাব আমরা। খুশি হবেন আমাদের স্রষ্টা। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন। আমিন।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
মোবাইলঃ 01748-237131
0 coment rios:
You can comment here