।। মাওলানা সৈয়দ ফয়জুল্লাহ
বাহার।।
------------- ১৯৯৬ সালের জুন মাসে আব্বার অসুস্থতার খবর
পেয়ে আমি সিলেট আসি। আসার দিন রাত হয়ে যাওয়ায় বন্ধু ও সহপাঠী মাওলানা মুজিবুর
রহমানের শহরস্থ লালাদিঘীরপার মসজিদ কোয়ার্টারের কক্ষে থেকে যাই। তিনি অবহিত করেন
যে, আমাদের উস্তায শায়েখ ইসহাক আল-মাদানী ও
মাওলানা আ ফ ম আব্দুর রহমান আমাকে খুঁজছেন। কারণ জানতে চাইলে বললেন যে, শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া পাঠানটুলায় আরবী প্রভাষক পদ শূন্য হয়েছে এবং
তারা চান যে, আমি যেন তাতে দরখাস্ত করি।
আমার শুভাকাংখীগণও এই মত পোষণ করেন। বন্ধু-বান্ধবরা ও জোর
দেন। ফলে আমি দরখাস্ত করি। এ সময় ১০-১৫ দিন
আমাকে আব্বার চিকিৎসার প্রয়োজনে শহরে থাকতে হয়। যথারীতি লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা
অনুষ্ঠিত হয় এবং গভর্ণিং বডি আমাকে সিলেক্ট করে। জামেয়ার তখনকার প্রিন্সিপাল হাফিজ
মাওলানা আব্দুল হালিম আমাকে তা অবহিত করেন। আমার আসলে আগ্রহ ছিলোনা। আমি চেয়েছিলাম
আরো লেখাপড়া করে জনপ্রশাসন বা আইন অঙ্গনে কাজ করতে। কিন্তু জামেয়ার গভর্ণিংবডি ও
দি সিলেট ইসলামিক সোসাইটির দায়িত্বশীলবৃন্দ ও আমার শুভাকাংখীদের পরামর্শে আমি
জামেয়ায় যোগ দেয়ার পক্ষে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেই।
সোসাইটির দায়িত্বশীলবৃন্দ মত দেন যে, আপাতত যোগ দাও, পরে দেখা যাবে। সোসাইটির সদস্য
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী ও অধ্যাপক মাওলানা সৈয়দ
ইকরামুল হক এ সময়ে আমাকে অভিভাবক সুলভ দিক নির্দেশনা দেন। আব্বার শরীরের অবস্থা
আরো নাজুক হয়ে পড়ে এবং জুলাইয়ের ৪ তারিখ তিনি ইন্তেকাল
করেন। ইন্তেকালের আগে জামেয়ায় আমার নিয়োগ হচ্ছে জেনে
আল-হামদুলিল্লাহ উচ্চারণ করেছিলেন। দাফনের কয়েকদিন পর আমি নরসিংদী ফিরে যাই।
পরবর্তীতে জামেয়ার অধ্যক্ষ যোগাযোগ করেন এবং নিয়োগপত্র
পাঠিয়ে দেন। সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ আমি সিলেট চলে আসি; যদিও আমার নরসিংদীর শুভাকাংখী বৃন্দ ও বন্ধু-বান্ধবরা চেয়েছিলেন আমাকে
সেখানে সেটেল্ড করতে। সেই জামেয়া কাসেমিয়া, অপরূপ জামেয়া
ক্যাম্পাস, ক্যাম্পাসের শতবর্ষী গাব গাছ, সেখানকার সুধী-শুভাকাংখী ও বন্ধু-বান্ধব আজো আমাকে টানে। এখনো আমি যোগাযোগ
রাখি, বছরে একবার হলেও সেখানে ছুটে যাই।
শতবর্ষী গাব গাছটাকে ভুলতে পারিনা। ভুলবোই বা কেমন করে? এ গাছের সাথে রয়েছে অনেক স্মৃতি, রয়েছে
গাব গাছের নীচে বসে বৈকালিক আসরের অনেক মনোমুগ্ধকর অতীত। এ গাছকে
নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন আমাদের বড় হুজুর, প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ ও
প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন হযরত মাওলানা হাফিজ ফয়জুল্লাহ' একটি
গাব গাছের আত্নকাহিনী' নামে। কবিতাটি আজ মনে করতে পারছিনা।
আজো ট্রেন বা সড়ক পথে ঢাকা গেলে নরসিংদীতে প্রবেশ করতেই এ গাছের কথা মনে পড়ে যায়।
যাক সে কথা, সেপ্টেম্বরের
১৬ তারিখ আমি শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া পাঠানটুলায় আরবী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেই।
সেই যে, শুরু হয়েছিল শিক্ষাসেবায় দায়িত্ব পালন,
এ বৃত্ত থেকে পরবর্তীতে আর বের হতে পারিনি। ৯৮ সালের সম্ভবতঃ মার্চ মাসে আগের আবেদনকৃত আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক থেকে
প্রবেশনারী অফিসার পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রবেশপত্র আসে। ব্যাংক এ পদে সারা দেশে ১০০
জন কর্মকর্তা নেবে। আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ১৫০০ জন। লিখিত পরীক্ষার জন্য ঢাকা যাই
এবং তাতে আমি সপ্তম স্থান লাভ করি। ভাইভা পরীক্ষাও
যথারীতি অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে নিয়োগপত্র হাতে আসলে দি সিলেট ইসলামিক সোসাইটি,
জামেয়ার গভর্ণিং বডি ও আমার শুভাকাংখীদের পরামর্শে ব্যাংকে যোগ না
দিয়ে জামেয়ায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।
বড় ভাই, ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান
সিনিয়র এসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মাওলানা সৈয়দ জিল্লুর রহমান ব্যাংকিংয়ের
চেয়ে শিক্ষকতাকে প্রাধান্য দেয়ার পরামর্শ দেন। উল্লেখ্য, তিনিও
আগে শিক্ষকতা করতেন এবং আমার আব্বাও শিক্ষক ছিলেন। আমাদের পরিবারের সর্বজৈষ্ঠ ভাই
ও আমার ছোট এক বোনও এখনো শিক্ষকতায় আছেন।
জামেয়ায় যোগ দেয়ার পর সপ্তাহ খানেক আমি আমার সহপাঠী ও বন্ধু
মাওলানা আবু সালেহ নোমানের কক্ষে গেষ্ট হিসেবে থাকতাম। তিনি তখন সিলেট সরকারী
আলিয়া মাদ্রাসায় কামিলে লেখাপড়া করতেন। অসুস্থতার কারণে প্রথম বার পরীক্ষা দিতে না
পারায় তিনি আমাদের এক বছর পেছনে পড়ে গিয়েছিলেন। পরে আমি জামেয়া হোস্টেলে প্রথমে আবাসিক শিক্ষক ও পরবর্তীতে হোস্টেল সুপার হিসেবে যোগ দেই। এই
হোস্টেল নিয়েও অনেক চমৎকার স্মৃতি রয়েছে। হোস্টেলে কিছু ভালো ছাত্র ভর্তি হলেও
বেশীর ভাগ শিক্ষার্থী থাকতো লেখাপড়ায় অমনোযোগী ও দুষ্টু প্রকৃতির। আমরা অনেক সময়
বিরক্ত হয়ে বলতাম, মা-বাবা যাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে
পারেনা তাদেরকেই হোস্টেলে পাঠায়। হোস্টেল ছিল অনেকটা মায়ে খেদানো, বাপে তাড়ানো ও বড় লোকের সন্তানদের নিরাপদ আশ্রয়-অভয়ারণ্য।
ভালো ছাত্রদের কথা স্বতন্ত্র। তারা এখানে থেকে অনেকেই ভালো
লেখাপড়া ও উন্নত রেজাল্ট করে উন্নতির শিখরে আরোহন করেছে। এখানে থেকে লেখাপড়া করে
ডাক্তার, ইঞ্জিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষক, তাফসীর মাহফিলের বলিষ্ঠ
বক্তা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি, জাতিসংঘের ইমিগ্রেশন এডভাইজার হওয়ার নযীর ও
আছে। ফখরুল ইসলাম নামের তখনকার ষষ্ঠ শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর কথা এখনো প্রায়ই আমার
মনে পড়ে। হোস্টেলে শিক্ষার্থীদের জন্য সকালে ঘুমানো
নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তার অবস্থা ছিলো যে, সে ঘুমাবেই।
আমরা তত্ত্বাবধানের জন্য নিয়মিত টহল দিতাম। তার কক্ষে গেলেই
সে শোয়া অবস্থায়ই শাস্তির বেত খাওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিত। অবস্থা এ রকম ছিল যে, শাস্তি দেন অসুবিধা নেই, তাকে
ঘুমাতে হবেই। এই ফখরুল এখন সম্ভবতঃ বৃটেনে থাকে। আমি
তার কল্যাণ কামনা করি।
যাক, সেই যে, শিক্ষা
সেবায় নিয়োজিত হয়েছিলাম, আর তা থেকে বের হতে পারিনি। এটিই
আমার মিশন-ভিশন হয়ে যায়। এ ভিশনের অংশ হিসেবেই আমি সিলেটের সানিহিল স্কুল এন্ড
কলেজ ও সিলেট আইডিয়াল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন
এবং পলিসি মেকিং এ এখনো ভূমিকা রেখে চলেছি। শিক্ষাকে নিয়েছি আন্দোলন হিসেবে।
শিক্ষাসেবায় আমার আগ্রহের আরো কিছু ক্ষেত্র আছে। সময়মত তাও বাস্তবায়নে কাজ করব
ইনশাআল্লাহ।
( চলবে) ------------
লেখকঃ ভাইস প্রিন্সিপাল,
শাহজালাল জামেয়া
ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা,
পাঠানটুলা, সিলেট।
0 coment rios:
You can comment here