।। আবদুল্লাহ আল মনসুর।।
পর্ব-২
আদর্শ শিক্ষকের নৈতিক গুণাবলী, পর্ব-২
একটি স্বচ্ছ গ্লাসে
যদি পানি রাখা হয়, তাহলে পিপাসা না থাকলেও পান করতে মন চায়। কিন্ত ওয়াশরুমের বদনায় যদি দুধও
পরিবেশন করা হয়, তাহলে সেটা কেউ নেয়না। ঠিক তদ্রুপ একজন
শিক্ষকের উপস্থাপন শৈলী যদি চমৎকার হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা
সহজে তা গ্রহণ করতে পারে। এজন্য শিক্ষকতাকে বলা হয় একটি শিল্প। একটি বিজ্ঞান। একটি
কৌশল।
পৃথিবীর যত সম্মানজনক পেশা আছে তার অন্যতম হলো শিক্ষকতা। অনেক ভাল ছাত্র, ভাল শিক্ষক হতে পারেনা।
আবার অনেক কম মেধার ছাত্রও ভাল শিক্ষক হতে পারে। একজন শিক্ষকের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান
ও দক্ষতা যেমন দরকার। ঠিক তেমনি কোনো ক্ষেত্রে তার চাইতেও বেশী দরকার হলো উন্নত
দৃষ্টিভঙ্গি ও ইতিবাচক আচরণ। এজন্য মেনে চলতে হয় কিছু নিয়ম নির্দেশনা। অর্জন করতে
হয় কিছু গুণাবলী। তাহলেই সম্ভব একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়া।
কেন আপনি
একজন আদর্শ শিক্ষক হবেন?
আর্থিকভাবে
লাভবান হওয়ার জন্য?
পার্থিব যশ, খ্যাতি,
মোহের জন্য?
নিশ্চয় না। আমরা জানি কেউই পৃথিবীতে স্থায়ী না। কারো জন্য কখন ‘ইন্না লিল্লাহ’ পড়া হয়ে যাবে কেউই জানিনা। সুতরাং দুনিয়াতে থাকাকালীন এমন কিছু করে যেতে
হবে যেটার সওয়াব মউতের পরও বহাল থাকে। আর এটি অর্জনের সর্বোত্তম পন্থা হলো
শিক্ষকতা। শিক্ষকতা পেশায় আছে একটি আত্মতৃপ্তি যা একজন আদর্শ শিক্ষকই কেবল অনুধাবন
করেন ও উপভোগ করেন।
আলোচ্য নিবন্ধে কয়েক পর্বে একজন আদর্শ শিক্ষকের নৈতিক গুণাবলী নিয়ে আলোচনা
করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। ওয়াবিল্লাহিত তাওফিক।
শিক্ষকতা শুধু একটি
পেশা নয়, বরং ইবাদাতও। তাই শিক্ষকতায় আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত পৃথিবীর সর্বকালের
সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহ ওয়াসাল্লাম। তিনি যে পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করেছেন, বর্তমান
আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞান রিসার্চ করলে তারই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায়।
একজন
আদর্শ শিক্ষকের মৌলিক গুণাবলী:
পূর্ব প্রকাশিত হওয়ার পর------
নয়- বিনয়ঃ
সকল ক্ষেত্রে বিনয়ী হওয়া। ক্লাসরুমে যেমন আপনি শিক্ষক, ক্লাসের বাহিরেও আপনি
শিক্ষক। বাজারে গেলেও শিক্ষক। সহকর্মী, প্রতিষ্ঠান প্রধান,
অভিভাবকসহ সবার সাথে সুন্দর আচরণ করা শিক্ষকের শুধু অপরিহার্য গুণ নয়,
বরং দ্বায়িত্বও বটে। বিশেষ করে ঝগড়ার কোনো উপলক্ষ তৈরী হলে শিক্ষক
নিজ দ্বায়িত্বে কেটে পড়বেন সেখান থেকে।
কখনও কারো সাথে তর্ক কিংবা ঝগড়ায় লিপ্ত হওয়া যাবেনা। সেটা প্রতিষ্ঠানে হোক
কিংবা বাহিরে কোথাও হোক। অভিভাবকদের সাথে কথা বলার দরকার হলে এটা বিশেষভাবে
লক্ষণীয়। প্রয়োজনে প্রথমে সংশ্লিষ্ট বা অভিভাবকের যে কিছু গুণ আছে এর প্রশংসা
করুন। তারপর অভিযোগ, পরামর্শ ইত্যাদি প্রদান অথবা গ্রহণ
করুন।
দশ-কটু বাক্য, প্রহার ও রাগ, 'তুই' বলে সম্বোধন বা ধমক ইত্যাদি পরিহার করাঃ
যে বাসনে আপনি খাবেন, তা যদি আগেই ফুটো করে দেন তাহলে সে বাসন দিয়ে তো আর খাবার খাওয়া যাবেনা! এটি হবে চরম বোকামি। শিক্ষক ভয়, কঠোরতা, প্রহার দিয়ে যদি আগেই শিক্ষার্থীর মনকে ঝাঝরা করে দেন, তাহলে কীভাবে শিক্ষার্থী এই উস্তাদের কাছ থেকে ইলম বা জ্ঞান নেবে?
এক সময় শিক্ষা পদ্ধতির এক অনুসঙ্গ বিষয় ছিল প্রহার করে শিক্ষাদান। সময়ের গবেষণা
প্রমাণ করেছে সেটি ছিল ভুল একটি পদ্ধতি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতের ২৩ বছরের জিন্দেগী, সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর সময়কার একটি ঘটনাও পাওয়া যাবেনা যে,
তারা শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ‘বেত’ কে ব্যবহার করেছেন। এদেশে শিক্ষকের
হাতে মার খেয়ে কত শিক্ষার্থীর জীবন ধ্বংস হয়েছে, আল্লাহই
জানে। কে নেবে এর দায়ভার? মার দিয়েই যদি শিখাতে হয় তাহলে আমি
কোন ধরণের শিক্ষক। এ প্রশ্নটা এখানে থেকেই যায়।
অনেক উলামায়ে কেরাম 'বেত' ব্যবহারকে নাজায়েজ আখ্যা দিয়েছেন। আবার যারা জায়েজ
বলেছেন, তারাও বেশ কিছু শর্ত স্বাপেক্ষে জায়েজ বলেছেন। তার অন্যতম হলো রাগ অবস্থায়
মারা যাবেনা। মুখে মারা যাবেনা। কিন্তু যারা প্রহার করেন, তারা
ক’জন এসব বিষয় মেনে চলেন। আপনি কি জানেন, একজন শিক্ষার্থীর মুখে মারার কারণে তার কত হাজার জ্ঞানকোষ মাথা থেকে ঝরে
যায়? তাছাড়া অন্যায়ভাবে প্রহার করলে অবশ্যই কিয়ামতের ময়দানে
রাব্বুল আলামীনের কাছে জবাবদিহী করতে হবে। আর এটি বান্দার হকের অন্তর্ভূক্ত।
নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রন করতে হবে। কারণ রাগ ওঠায় শয়তান। শিক্ষার্থীদের প্রহার না করে ক্লাস নিয়ন্ত্রণ করার বিকল্প কৌশল বের করতে হবে। অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের গাধা, গরু, শয়তান ইত্যাদি
বলে গালি দেন। যা খুবই দুঃখজনক। এতে শিক্ষার্থীর শেখায় আগ্রহ কমে যায়। এটি সম্পূর্ণ
বর্জনীয়। হাকিমুল উম্মত হযরত শাহ আশরাফ আলী থানভী রাহিমাহুল্লাহ সবক ইয়াদ তথা
স্মরণ না করতে পারার কারণে ছাত্রদের মারতে নিষেধ করেছেন। এবং তার খানকায় এব্যাপারে
খুব তাকিদ দিতেন যেন শিক্ষকরা ছাত্রদের না মারেন। শিক্ষককে মনে রাখতে হবে ‘আমি এবং শিক্ষার্থী উভয়ই আল্লাহর সৃষ্টি এবং তাঁরই অধীন। আমি তার মালিক নই। সে
আমার সৃষ্টি ও নয়। আমরা উভয়ই আল্লাহ তাআলার হুকুমের অধীন’
শিক্ষকের মাথায় একথা স্থির করতে হবে যে
‘এ
শিশুকে শাস্তি দেয়ার যে ক্ষমতা আমার আছে, আমাকে শাস্তি দেয়ার
ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা এর চেয়ে বেশী ক্ষমতাবান’। অনেকেই বলেন, আমরা তো শিক্ষার্থীদের
ভুল ত্রুটির উপর ভিত্তি করে তাদেরকে শাস্তি দেই। এজন্য কোনো জবাবদিহী করতে হবেনা। আল্লাহ
তায়ালা কিয়ামতের দিন ইনসাফের পাল্লা কায়েম করবেন। শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে ইনসাফ
বজায় না রাখলে, অবশ্যই রবের কাছে জবাবদিহী করতে হবে। এজন্য
শাস্তির বিকল্প চিন্তা করতে হবে।
এগারো- দায়ী ইলাল্লাহর মেজাযঃ
প্রতিটি ক্লাস রুম দাওয়াতি কাজের এক উন্মুক্ত প্লাটফর্ম। একজন শিক্ষকের উচিত
তাকে কাজে লাগানো। দাওয়াতি কাজ করলে কী লাভ? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেন, 'যে ব্যক্তি ভালো
কাজের পথ দেখায়, সে আমলকারীর
ন্যায় সমান সওয়াব পাবে’ (সহিহ মুসলিম)।
ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন আমলের প্রতি উৎসাহ প্রদান, তাদেরকে নৈতিকতা শিক্ষাদান ইত্যাদির সর্বোত্তম জায়গা হলো ক্লাসরুম।
ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন আমলের প্রতি উৎসাহ প্রদান, তাদেরকে নৈতিকতা শিক্ষাদান ইত্যাদির সর্বোত্তম জায়গা হলো ক্লাসরুম।
বারো-সময়ানুবর্তিতাঃ
সময়ের পূর্বে আগমন ও সময় শেষে প্রস্থান শিক্ষকের অন্যতম দ্বায়িত্ব। নির্ধারিত
সময়ের পূর্বে ক্লাস সমাপ্তকরণ। এজন্য সময়কে ভাগ করে নেয়া যেতে পারে। অর্থাৎ একটি
ক্লাসে আপনি কতক্ষণ পড়াবেন, কতক্ষণ গল্প করবেন, কতক্ষণ লেখাবেন ইত্যাদি
সময়গুলোকে আগেই ভাগ করে নেওয়া একজন ভালো শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট।
অনেক দক্ষ শিক্ষক ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় ক্লাস শুরুর অনেক পরে ক্লাসে পৌঁছান, এতে শিক্ষার্থীরা দুষ্টুমির সুযোগ পায়। অনেক সময় এই সামান্য সময়ের ভেতরে দূর্ঘটনাও ঘটে যায়। তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে শিক্ষক আসার ফাঁকে কি শিক্ষার্থীরা একটু হলেও আনন্দ করবেনা? জ্বি, করবে অবশ্যই করবে আর তা শিক্ষক নিজেই শিক্ষার্থীদের নিয়ে আনন্দ করবেন। (ক্লাস মনমুগদ্ধকর করার কৌশল পর্বে এ ব্যাপারে আমি বিস্তারিত আলোচনা করবো, ইনশাআল্লাহ)
অনেক দক্ষ শিক্ষক ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় ক্লাস শুরুর অনেক পরে ক্লাসে পৌঁছান, এতে শিক্ষার্থীরা দুষ্টুমির সুযোগ পায়। অনেক সময় এই সামান্য সময়ের ভেতরে দূর্ঘটনাও ঘটে যায়। তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে শিক্ষক আসার ফাঁকে কি শিক্ষার্থীরা একটু হলেও আনন্দ করবেনা? জ্বি, করবে অবশ্যই করবে আর তা শিক্ষক নিজেই শিক্ষার্থীদের নিয়ে আনন্দ করবেন। (ক্লাস মনমুগদ্ধকর করার কৌশল পর্বে এ ব্যাপারে আমি বিস্তারিত আলোচনা করবো, ইনশাআল্লাহ)
তেরো-শিক্ষার্থীকে সবসময় উৎসাহ দেয়ার মন মানষিকতাঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা সু সংবাদ দাও, হেয় করনা। সহজ করো, কঠিন করোনা।’ (সহীহুল বুখারী)। আপনার একটু
অনুপ্রেরণাদায়ক কথাবার্তা একজন শিক্ষার্থীর জীবন পরিবর্তন করে দিতে পারে। আপনি
নিজে হয়ত তা জানতেই পারবেন না। শিক্ষার্থী হয়ত ভুল করবে, দুষ্টুমি করবে। আপনার মন
চাইবে তাকে একটু ভর্ৎসনা করতে। কিন্তু এর বদলে আপনি যদি তাকে একটু উৎসাহ দেন,
দেখবেন তার অবস্থা বদলে গেছে।
পাকিস্তানের জনপ্রিয় শিক্ষক
প্রশিক্ষক কাসিম আলী শাহ একটি ট্রেনিং সেশনে একটি ঘটনা বলেন।
"এক ছাত্র প্রতি বছর ক্লাসে ফেল করতো। বছর শেষে তাকে রিকুয়েস্ট করে ক্লাস
প্রমোশন দেয়া লাগতো। ক্লাস ওয়ান থেকে শুরু করে ক্লাস এইট পর্যন্ত কোনো ক্লাসেই তার কোনো পাশের
রেকর্ড নাই। ক্লাস নাইনে ওঠার সময় তাকে ক্লাস প্রমোশন না দেয়ার জন্য স্যাররা
বললেন। অবশেষে অনেক রিকুয়েস্টে এর পর তাকে বেশ কিছু শর্ত স্বাপেক্ষে ক্লাস প্রমোশন
দেয়া হলো। প্রথম সাময়িক পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। সেই আগের ফেল। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। এবার
তো পুরোটাই চমক। বিষ্ময়কর রেজাল্ট। প্রত্যেক সাবজেক্টে সর্বোচ্চ মার্কস। সবাই হতবাক।
সবার প্রশ্ন, এটা কীভাবে সম্ভব? পরীক্ষার খাতা চেক করার দাবি
ওঠলো। খাতাও পূণঃনীরিক্ষণ করা হলো। দেখা গেল সবই ঠিক আছে। এবার তাকে এর কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেসা করা হলো।
সে বললো, আমার জীবনে একজন শিক্ষক এসছিলেন কিছু দিনের জন্য। তাঁর বিশেষ কোনো
যোগ্যতাও ছিলনা যে আমাকে তিন মাসে মেধাবী বানিয়ে নিবেন। কিন্তু তিনি একটি কাজ
করতেন আর তা হলো, আমি যখনই কোনো কাজ করতাম তিনি সবসময় আমাকে বলতেন ‘সাবাশ,
বেটা, তুমি পারবে!’ তার
এই সাবাশ বলার কারণে আমি খুব অনুপ্রাণিত হতাম। আমার কাছে সবকিছু সহজ মনে হতো।
আস্তে আস্তে সত্যিই আমি মনেযোগি হয়ে ওঠলাম ক্লাসে। যার কারণে আজকের এই রেজাল্ট।
তার পর কাসিম আলী শাহ উপস্থিত সবাইকে সম্বোধন করে বললেন, আপনারা
কি চিনেন, কে ছিল সেই বালক? যে ক্লাস
এইট পর্যন্ত কোনো পরীক্ষায় পাশ না করে, কোনো এক পরীক্ষায় চমক
লাগিয়ে দিয়েছিল। সে আর কেউ নয়, এই কাসিম আলী শাহ। যে আজ
আপনাদেরকে ট্রেনিং করাচ্ছে।
চৌদ্দ-গুনাহ বর্জনঃ
বিশেষত, গীবত, কুদৃষ্টি ইত্যাদি বর্জন করা। শিক্ষক নিজেই যদি
গুনাহের কাজে জড়িত থাকেন, তাহলে কীভাবে শিক্ষার্থীদের
নৈতিকতা শেখাবেন। বিশেষত দুটি গুনাহ আজ ব্যাপক হারে বেড়ছে। তার একটি হলো চোখের
গুনাহ।
আরো একটি গুনাহ প্রকট আকার ধারণ করেছে সেটা হলো গীবত। এটি ভাইরাস আকার ধারণ
করেছে আমাদের সমাজে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে উলামায়ে কেরাম পর্যন্ত কেউই বাদ পড়ছেন
না এই ভাইরাস থেকে। দু’জন
কোথাও বসলেই তৃতীয় আরেকজনের আলোচনা ওঠবেই। আর ক্রমেই সেটা রূপ নেবে গীবত কিংবা
তুহমতে। একটি কথা মনে রাখতে হবে, গীবত বান্দার হক সংশ্লিষ্ট
গুনাহের অন্তর্ভূক্ত। আর বান্দার হক বান্দা যদি মাফ না করে, তাহলে
আল্লাহও মাফ করবেন না। আমরা সকলেই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে কমবেশি অবগত। আল্লাহ আমাদের
হেফাযত করুন। আমিন।
পনেরো- আখলাকে হাসানাহঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেসা করা হয়েছিল, কোন জিনিষ অধিক হারে
মানুষকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছিলেন, ‘আল্লাহর ভয় ও
উত্তম চরিত্র’। তিনি আরো বলেন, ‘আমি জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে ঐ ব্যাক্তির
জন্য একটি ঘরের জিম্মাদার হবো, যে তার চরিত্রকে সুন্দর করে
নিলো।’ (সুনানু
আবূ দাউদ)
আজকাল দক্ষ ও
পরিশ্রমী অনেক শিক্ষক পাওয়া যায়। কিন্তু নববী আখলাক সম্পন্ন শিক্ষকের অভাব সব সময়, সবখানে। যার কারণে
শিক্ষাঙ্গনগুলোতেও আজ অনৈতিকতার ছড়াছড়ি। একজন শিক্ষকের কাছ থেকে যখন বদ আখলাকি
প্রকাশ পায় তখন একদিকে যেমন ঐ শিক্ষক ক্ষতিগ্রস্থ হন, পাশাপাশি
পুরা শিক্ষাঙ্গনটাও কলুষিত হয়ে যায়।
সাধারণ মানুষের মাঝে দ্বীনের প্রতি এক ধরণের অনাস্থা তৈরী হয়। আল ইয়াজু
বিল্লাহ। এজন্য নফসকে শয়তান ও কু-চিন্তা থেকে মুক্ত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে
হবে সবসময়। অনেক ভালো শিক্ষক যাদের শিক্ষকতায় রয়েছে দীর্ঘদিনের সুনাম। কিন্তু সেই
সুনাম নষ্ট হতে কতক্ষণ? নফস অথবা শয়তানের ওয়াসওয়াসায় পড়ে নিমিষেই তা তলিয়ে গেছে। শয়তান জান্নাত
থেকে বহিস্কৃত হবার যে বক্তব্য দিয়েছিল, আল্লাহ তাআলা হুবহু
তা কুরআনে উল্লেখ করেছেন। কালামে বারী তায়ালা হলো-
﴿قَالَ
فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ﴾
‘যেহেতু (এই আদম এর
কারণে) আমাকে তুমি বিভ্রান্ত করলে, তাহলে অবশ্যই আমি তাদের
জন্য আপনার সীরাতে মুস্তাকীমে ওঁৎ পেতে বসে থাকবো’। (সূরা আরাফ, আয়াত:১৬)
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয় শয়তান মানুষের রক্ত ক্ষণিকার সাথে
প্রবাহিত হয়’ (বুখারী,
মুসলিম)। চিন্তা করুন, শয়তান মানুষকে বিভ্রান্ত
করার জন্য সর্বস্ব নিয়ে প্রস্তুত। কিন্তু তার থেকে বাঁচার জন্য আমাদের কী প্রস্তুতি?
এজন্য নাফস পরিশুদ্ধির চেষ্টার পাশাপাশি বেশী বেশী আল্লাহর কাছে
দোয়া করা।
ষোলো-
সালাম প্রদানঃ
একজন শিক্ষক হিসেবে আমরা চাই শিক্ষার্থীরা আমাদের সালাম দিক। কিন্তু নিজেরা পরষ্পরে কিংবা
শিক্ষার্থীদেরকে কখনো সালাম দিতে চেষ্টা করিনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বাচ্চাদেরকে আগে সালাম দিতেন তাদেরকে শিক্ষা দেয়ার জন্য। কারণ আপনি
শিক্ষক হয়ে যখন শিক্ষার্থীদের আগে সালাম দিবেন, তখন দেখবেন শিক্ষার্থীরা এমনিতেই সালাম
প্রদানে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা পরষ্পরে সালাম দেয়ার অভ্যাস সৃষ্টির জন্য
তাদেরকে বারবার উৎসাহ দিতে হবে। মনে রাখবেন, শিক্ষকের মাঝে
যে বিষয়ের আমল নেই, তিনি যতই সে বিষয়ে শিক্ষার্থীদের নাসীহা
বা উপদেশ দেন তার প্রভাব না পড়ার সম্ভাবনাই বেশী।
একজন শিক্ষক হিসেবে শিশু মনোবিজ্ঞানের নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা থাকা দরকার।
শিশুদের সাধারণ
বৈশিষ্ট্য:
১. আত্মর্যাদাবোধ;
২. খেলাপ্রিয় ;
৩. চঞ্চল;
৪. কিছু করতে চায়;
৫. জানার আগ্রহ ও
৬. গল্প প্রিয়।
শিক্ষা তিন প্রকার।
১. অনানুষ্ঠানিক
শিক্ষা;
২. উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও
জন্ম থেকে ২ বছর শিশু শিক্ষা নেই। ৩ থেকে ৬ বছর অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা।
৭ থেকে ১০ অনানুষ্ঠানিক ও আনন্দদায়ক শিক্ষা।
১১ থেকে ১৪ বছর অনুষ্ঠানিক ও মৃদু শাসন।
১৩ থেকে ১৯ সতর্ক বন্ধু, সূলভ ব্যবহার।
৩ বছরের শিশু খেলতে শুরু করে, কোথাও স্থির থাকতে চায়না। কোনো কিছুতেই তার স্থিরতা/ দীর্ঘস্থায়ী আকর্ষণ নেই। এসময় ২০০ শব্দ, ২০/৩০ মিনিট মনে
থাকে। এরা নির্মাণকাজ, পুতুল খেলা/খেলনা দিয়ে খেলাধূলা
পছন্দ করে।
৪ বছরের শিশু নার্সারীতে যেতে শুরু করে, খুব চঞ্চল থাকে, নতুনকে
জানার আগ্রহ বেশী থাকে। কাজ ও কথায় সঙ্গতি রাখার চেষ্টা করে। নতুন কিছু করার বা বুঝার
জেদ ধরে। গল্পপ্রিয়, নতুন গল্প শুনার আগ্রহী, গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। দৌড়াদৌড়ি করতে পছন্দ করে। ছবি আঁকা ও কাগজ ভাঁজ
করতে ভালোবাসে। স্থিরতা বা দীর্ঘস্থায়ী আকর্ষণ নেই। এরা খেলাধূলা পছন্দ করে। তুচ্ছ
বিষয়ে হাসি কান্না করে যারা নির্দোষ মনের অধিকারী।
৫ বছরের অধিকতর শিশুদের কর্মতৎপরা অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি পায়। কোনো বিষয়ে জানার আগ্রহ বাড়েনা।
খেলাপ্রিয়, স্পর্শকাতর, মান অপমানবোধে
জাগে, আদর অনাদর বুঝতে শিখে। নতুন বিষয়ে চিন্তা করে, চিন্তার ধারাবাহিকতা থাকেনা। এসময়টি শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য খুবই
গুরুত্বপূর্ণ।
৬ বছর বয়সে শিশুর
শৈশবের সমাপ্তি ঘটে। আচরণে অসঙ্গতি আসে। শিষ্টাচার হৃাস পায়। পরষ্পর বিরোধী
মনোভাবের সৃষ্টি হয়। ঘৃণা ও ভালোবাসা প্রখর হয়। আত্মমর্যাদা বাড়ে। স্বার্থের জন্য
মিথ্যার আশ্রয় নেয়। খেলা প্রিয়, স্পর্শকাতর, সমবয়সীদের সাথে দলবেধে
খেলতে ভালোবাসে। সুস্বাদু খাবারের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে। এদের মানসিকতা গঠনে খাদ্য,
পুষ্টি ও পারিবারিক সুস্থ পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
চলবে --------------
লেখকঃ শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
তাকমিল ফিল হাদিস, (মাস্টার্স
সমমান)
জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজির বাজার, সিলেট।
অনার্স (হাদিস), সিলেট
সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা।
(ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।)
শিক্ষক,
শাহজালাল জামেয়া
ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা পাঠানটুলা, সিলেট।
ইনচার্জ, কোরানিক
গার্ডেন, মিরবক্সটুলা, সিলেট।
মেবাইল : ০১৭৪১৫৮৫০৪০
0 coment rios:
You can comment here