।। আবদুল্লাহ আল মনসুর।।
প্রাণবন্ত
ক্লাস পরিচালনা পদ্ধতি
একটি স্বচ্ছ গ্লাসে যদি পানি রাখা হয়, তাহলে পিপাসা না থাকলেও পান করতে মন চায়।
কিন্ত ওয়াশরুমের বদনায় যদি দুধও পরিবেশন করা হয়, তাহলে সেটা
কেউ নেয়না। ঠিক তদ্রুপ একজন শিক্ষকের উপস্থাপন শৈলী যদি চমৎকার হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা সহজে তা গ্রহণ করতে পারে। এজন্য শিক্ষকতাকে বলা হয়
একটি শিল্প। একটি বিজ্ঞান। একটি কৌশল।
পৃথিবীর যত সম্মানজনক পেশা আছে তার অন্যতম হলো শিক্ষকতা। অনেক ভাল ছাত্র, ভাল শিক্ষক হতে পারেনা।
আবার অনেক কম মেধার ছাত্রও ভাল শিক্ষক হতে পারে। একজন শিক্ষকের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান
ও দক্ষতা যেমন দরকার। ঠিক তেমনি কোনো ক্ষেত্রে তার চাইতেও বেশী দরকার হলো উন্নত
দৃষ্টিভঙ্গি ও ইতিবাচক আচরণ। এজন্য মেনে চলতে হয় কিছু নিয়ম নির্দেশনা। অর্জন করতে
হয় কিছু গুণাবলী। তাহলেই সম্ভব একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়া।
কেন আপনি
একজন আদর্শ শিক্ষক হবেন?
আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য?
পার্থিব যশ, খ্যাতি,
মোহের জন্য?
নিশ্চয় না। আমরা জানি কেউই পৃথিবীতে স্থায়ী না। কারো জন্য কখন ‘ইন্না লিল্লাহ’ পড়া হয়ে যাবে কেউই জানিনা। সুতরাং দুনিয়াতে থাকাকালীন এমন কিছু করে যেতে
হবে যেটার সওয়াব মউতের পরও বহাল থাকে। আর এটি অর্জনের সর্বোত্তম পন্থা হলো
শিক্ষকতা। শিক্ষকতা পেশায় আছে একটি আত্মতৃপ্তি যা একজন আদর্শ শিক্ষকই কেবল অনুধাবন
করেন ও উপভোগ করেন।
আলোচ্য নিবন্ধে কয়েক পর্বে একজন আদর্শ শিক্ষকের নৈতিক গুণাবলী নিয়ে আলোচনা
করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। আজকের বিষয়: প্রাণবন্ত
ক্লাস পরিচালনা পদ্ধতি, ওয়াবিল্লাহিত তাওফিক।
শিক্ষকতা শুধু একটি
পেশা নয়, বরং ইবাদাতও। তাই শিক্ষকতায় আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত পৃথিবীর সর্বকালের
সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহ ওয়াসাল্লাম। তিনি যে পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করেছেন, বর্তমান
আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞান রিসার্চ করলে তারই প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায়।
পূর্ব প্রকাশিত হওয়ার পর------
প্রাণবন্ত
ক্লাস পরিচালনা পদ্ধতি
সিনেমার যে নায়ক দর্শকদের মাঝে জনপ্রিয়, সে কি তার সিনেমা দেখার জন্য লোকজনকে ডাকতে
হয়? অবশ্যই না। তাহলে আপনি একজন শিক্ষক। এর মানে আপনি একজন
অভিনেতা। আপনার ক্লাসে ‘হাজিরা’ নিতে
হবে কেন? কেন স্বতঃস্ফুর্ত হয়ে শিক্ষার্থীরা আসেনা? এর কারণ আপনাকে খোঁজে বের করতে হবে। ক্লাস পরিচালনায় যে শিক্ষক যতবেশী
ততপর, তিনি তত বেশী ভালো শিক্ষক। একজন শিক্ষক যতই জ্ঞানী হোন
না কেন, তিনি যদি ক্লাস রুমে সহজ ও আকর্ষণীয় পন্থায় সেটি
প্রয়োগ করতে না পারেন অর্থাৎ, নিজেকে ও নিজের ক্লাসকে সেরকম উপস্থাপন করতে না
পারেন, তাহলে তিনি একজন সফল শিক্ষক নয়। এজন্য একজন শিক্ষককে ক্লাসে ঢুকার আগে,
ক্লাস চলাকালীন সময়ে ও ক্লাসের বাহিরে কিছু বিষয় মেনে চলতে হয়।
আমি সে বিষয়ে কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করছি।
মনে করুন, আপনি নামাজ পড়ার ইচ্ছা করেছেন। তখন আপনি কী করবেন? অবশ্যই এর জন্য
প্রস্তুতি নিবেন। ওয়াশরুমের দরকার হলে আগে সেটা সম্পন্ন করবেন। ওযু করবেন। পোশাক
পরবেন। জায়নামাযে দাঁড়াবেন। মোটকথা এর জন্য একটা প্রস্তুতি আপনাকে নিতে হবে। ঠিক
তেমনি আপনি যদি ইফেক্টিভ একটি ক্লাস পরিচালনা করতে চান, তাহলে
অবশ্যই আপনাকে ক্লাসে ঢুকার আগে পর্যাপ্ত
প্রস্তুতি নিতে হবে। যেমন-
১. বিষয়ভিত্তিক
পর্যাপ্ত পড়াশোনা করে লেসন প্লান রেডি করা।
২. নিজের পোশাক, দাঁত, জুতা ইত্যাদি পরিষ্কার আছে কি না চেক করা।
৩. শিক্ষার্থীর
ধরণ, মন মেজায, পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা,
পরিস্থিতি ইত্যাদি আয়ত্ম করা। (সাধারণত একটি ক্লাসে ৮ ধরণের
শিক্ষার্থী থাকে।)
৪. ক্লাসে ঢুকেই
সবক শুরু না করে, আগে তাদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে স্বাভাবিক হওয়া। বসার পরিবেশ সুন্দর
করা। ক্লাসের গেটআপ, সেটআপ চেক করা। ছাত্রদেরকে পরিপাটি করে
বসিয়ে নেয়া।
৫. মনযোগ আকর্ষণ করে
পড়ানো। বারবার মনযোগ ধরে রাখার জন্য বুদ্ধিমত্তার সাথে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা।
৬. ধীরে ধীরে ও পর্যায়ক্রমে সবক শুরু, গ্রহণ ও শেষ করা।
৭. ‘জগ মগ থিউরি’ নয়, বরং অংশগ্রহণমূলক (পার্টিসিপেটরি) ক্লাস গ্রহণ
করা।
৮. দাঁড়িয়ে ক্লাস গ্রহণ করা।
৯. মাঝেমধ্যে ক্লাসের মধ্য ভাগে হাটা তথা মোভ করা।
শ্রেণি কক্ষের ফ্যান, লাইট, জানালা খোলা আছে কিনা নজর রাখা।
১০. পুনরাবৃত্তি করে
ক্লাস গ্রহণ। সুরে ছন্দে পড়ানো। (সবক্লাসে নয়)
১১. মাঝে মাঝে পরীক্ষা গ্রহণ।
১২. গঁতবাধা নয়, উপস্থাপনাকে বাস্তবমুখী করা।
১৩. একনাগাড়ে নয়, বিরতি সহকারে পাঠদান।
১৪. প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে পাঠদান।
১৫. ক্লাসে প্রয়োজনে নিয়মিত হোয়াইট বোর্ড ব্যবহার করা।
১৬. মাল্টিমিডিয়ার
ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
১৭. শিক্ষার্থীদের নাম আয়ত্ম করে তাদের নাম ধরে
ডাকার চেষ্টা করা।
১৮. ক্লাসের
শৃঙ্খলা বজায় রাখতে শিক্ষার্থীকে সবসময় ব্যস্ত রাখা। প্রয়োজনে দলগত কাজ দেয়া।
১৯. শিক্ষার্থীরা
যেন একথা মনে না করে যে, শিক্ষক আমার ভুল ধরার জন্য ক্লাসে এসেছেন। সে যাতে বুঝতে পারে যে, আপনি তার বন্ধু বা কল্যাণকামী।
২০. শিক্ষকের
চারপাশে অদৃশ্য একটি কাঁচের দেয়াল থাকবে। শিক্ষার্থীরা যেন এই দেয়াল অতিক্রম করতে
না পারে।
২১. আই কন্টাক্ট তথা
চোখের যোগাযোগ ঠিক রাখা।
২২. বছরের প্রথম
দিকে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই আইন করে নেবেন আমরা ক্লাসে কী কী করবো, কী কী করবো নো?
২৩. যতক্ষণ পর্যন্ত
শিক্ষার্থীরা পূর্ণ মনোযোগী না হবে ততক্ষণ
পর্যন্ত ক্লাস প্রাণবন্ত হবেনা। সবার সক্রীয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। শিক্ষার্থীর
যদি তার নিজ ঘরের কোনো পারিপাশ্বিক সমস্যার কারণে মন খারাপ থাকে, তাহলে তাকে আগে মন ভালো
করতে হবে। একে বলে বরফ ভাঙ্গা।
উপরোক্ত বিষয়গুলোসহ প্রয়োজনীয় কৌশল ও হেকমত অবলম্বন করে বুদ্ধিমত্তার সাথে সময়
ও পরিবেশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কৌশল অবলম্বন করে ক্লাস গ্রহণ করলে আশা করা যায় একটি
প্রাণবন্ত ক্লাস হবে। আল্লাহ আমাদেরকে প্রাণবন্ত ক্লাস নেয়ার তাওফীক দান করুন।
আমিন।।
চলবে --------------
লেখকঃ শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
তাকমিল ফিল হাদিস, (মাস্টার্স
সমমান)
জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজির বাজার, সিলেট।
অনার্স (হাদিস), সিলেট
সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা।
(ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।)
শিক্ষক, শাহজালাল জামেয়া
ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা পাঠানটুলা, সিলেট।
ইনচার্জ, কোরানিক
গার্ডেন, মিরবক্সটুলা, সিলেট।
মেবাইল : ০১৭৪১৫৮৫০৪০
ইমেইল: abmonsur111@gmail.com
0 coment rios:
You can comment here