।। সাঈদ
চৌধুরী।।
২০০০
সালের ২৬ জানুয়ারী লন্ডন এসে পৌছি। দিনটি ছিল বুধবার। আকাশ ছিল খুবই পরিচ্ছন্ন।
রোদেলা বিকেল। উপর থেকে মনে হল একটা বিশাল দ্বীপপুঞ্জ পাড়ি দিচ্ছি। বিমানবালাকে জিজ্ঞেস করলে একটা তাৎক্ষণিক বর্ণনা দিয়ে বললেন, যুক্তরাজ্যকে আটলান্টিক মহাসাগর, উত্তর সাগর, ইংলিশ চ্যানেল এবং আইরিশ সাগর ঘিরে রেখেছে। যত দূর পর্যন্ত আমার দৃষ্টিগোচর
হল, আসমান-জমিন, গ্রহ-নক্ষত্র, সূর্যতাপ ও মেঘমালার মহান স্রষ্টা আল্লাহ পাকের অসীম
সৃষ্টি রহস্যে আমি ডুবে গেলাম।
হিথ্রো
বিমান বন্দরে প্রিয়তমা স্ত্রী সহ শশুর বাড়ির লোকজন আমাকে স্বাগত জানালেন। আমি ঘুরে
বেড়ানো মানুষ। এর আগে এশিয়া ও মধ্যাপ্রাচ্যের অনেক দেশ দেখেছি। আমার হৃদয়ের
আরাদনার ক্ষেত্র পুণ্যভূমি সাউদী আরব নিয়ে ’ধূসর মরুর বুকে’ শীরোনামে ৪০ পর্বের স্মৃতি চারণও লিখেছি। ফলে বিলেতের চাকচিক্য কিংবা বিদেশ
আসার মত বিশেষ আকর্ষণ আমার মধ্যে তেমন রেখাপাত করেনি। তবে বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশন
সার্ভিস ও বাসার পথে যানবাহনের শৃংখলা প্রথমেই আমাকে মুগ্ধ করেছে।
ওয়েস্টমিন্সটার
এসে আমাদের গাড়ি থামল। আমাকে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভবনটি দূর থেকে দেখানো হলো। নতুন দিনের জন্য এনিয়ে একটা
ভালো প্রতিবেদন করতে ইচ্ছে হল। আমি খানিকটা কৌতুহলী হয়ে উঠলাম। বিলেত, যুক্তরাজ্য, ইউনাইটেড্ কিংডম্, গ্রেট বৃটেন? এর সহজ নাম কোনটি? আর এত নামই বা কেন? এ যেন ভারতের মত ছানাবড়া দশা!
ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান, ভারত, মহাভারত ও ভারতবর্ষ। কোনটা রাখে আর কোনটা ছাড়ে! অন্ধের হাতি দেখার মত দশা।
অঙ্গে বিহঙ্গে তার পরিচয়।
মূলত
The
United Kingdom of Great Britain and Northern Ireland সংক্ষেপে ইউনাইটেড্ কিংডম্ বা
গ্রেট বৃটেন বলা হয়। বাংলায় এটাকে যুক্তরাজ্য বা বিলেত বানিয়ে ফেলা হয়েছে। অবশ্য
বিলেত শব্দটা উচ্চারণ করতে ভাল লাগে। ইউরোপীয় মূল ভূখণ্ডের উত্তর-পশ্চিম উপকূলের
সন্নিকটে অবস্থিত একটি স্বাধীন দ্বীপরাষ্ট্র এই বিলেত। এটি ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েল্স্ এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড এর সমন্বয়ে গঠিত। অনেকগুলো
দ্বীপ রাষ্ট্র। দ্বীপগুলোকে একত্রে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ নামে অভিহিত করা হয়। এর
মধ্যে সর্ববৃহৎ দ্বীপটির নাম গ্রেট ব্রিটেন। সবচেয়ে বড় ও জনবহুল ভাগটির নাম
ইংল্যান্ড, যা দ্বীপের দক্ষিণ ও
পূর্ব অংশ। পশ্চিম অংশে আছে ওয়েলস এবং উত্তরে স্কটল্যান্ড। আর উত্তর-পূর্ব
প্রান্তে আয়ারল্যান্ড অবস্থিত ।
মজার
ব্যাপার হল, বাংলাদেশে আমরা বহু
সম্প্রদায়ের মানুষকে বাঙ্গালি না বাংলাদেশী বলব তা নিয়ে দ্বন্দ্ব করি। বিশ্বে
বিলেত একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারকারী দেশ। এখানে সবাই ব্রিটিশ হলেও
ইংল্যান্ডের অধিবাসী ইংলিশ, ওয়েলসের অধিবাসীর ওয়েলশ, আয়ারল্যান্ডের অধিবাসী আইরিশ এবং স্কটল্যান্ডের অধিবাসী স্কটিশ হিসেবে
পরিচিত। এবিষয় নিয়ে অন্য পর্বে ভাষা ভিত্তিক গবেষণায় আলোকপাত করা যাবে।
গোধুলী
বেলায় নদী তীর হয়ে আসার পথে হালকা ঠান্ডার আমেজ অনুভব করেছি। সূর্য তখন মালদহি
আমের রঙ ধরেছে। আগের দিন নাকি কনকনে ঠান্ডা ছিল। গন্তব্যে পৌছে মাগরিবের সালাত
আদায় করলাম। দেশ থেকে নিয়ে আসা হালকা উপহার সামগ্রী বের করতে গেলে উপস্থিত সকলে
তাআজ্জুব! তাদের চক্ষু যেন চড়ক গাছ! ব্যাগেজে সিলেট শহরের সাহিত্যিক-সাংবাদিক, রাজনীতিক ও সমাজসেবিদের শত শত
ছবি! উপস্থিত অনেকে রহস্য না বুঝলেও আমার শশুর বিষয়টি ঠিকই বুঝেছেন। তিনি আমাকে
ভাল সাংবাদিক যেনে প্রথম দেখাতেই জামাতা হিসেবে মনে মনে পছন্দ করেছিলেন। ছবিগুলো
মনে হল তার পছন্দ হয়েছে। তিনি বললেন, আমি যেন আমার এই পেশায় সম্পৃক্ত থাকি।
পরের
দিন ২৭ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার। আমাকে দেখতে আসা আত্মীয় স্বজনকে কিছুটা সময় দিয়ে
আমি ছুটে গেলাম সাপ্তাহিক নতুন দিন অফিসে। আমার জন্য অপেক্ষা করছেন নতুন দিন
সম্পাদক ও লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মহিব উদ্দীন চৌধুরী। নতুন দিন তখন বেশ
আলোচিত সংবাদপত্র এবং মহিব চৌধুরী একজন সাহসী সম্পাদক। বিলেতের বিকাশমান কমিউনিটির
ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলায় সামনের কাতারের সৈনিক। একজন ভাল সংগঠক ও সফল ব্যবসায়ী
ব্যক্তিত্ব।
মহিব
চৌধুরী যখন আমাকে স্বাগত জানালেন, তখন সেখানে আরো উপস্থিত ছিলেন লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও
সাপ্তাহিক সুরমার সাবেক সম্পাদক, সৃজনশীল সাংবাদিক ও কলামিস্ট নজরুল ইসলাম বাসন, নতুন দিনের নির্বাহী সম্পাদক বর্তমানে জনমতের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ নাহাস
পাশা, সহকারী সম্পাদক ও বর্তমানে
যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফারুক, সহ সম্পাদক ও রেডিও প্রেজেন্টার মিসবাহ জামাল, বার্তা সম্পাদক আখলাকুল ইসলাম বাদল, সহ-বার্তা সম্পাদক সৈয়দ আব্দুল কাদির, হেড অব প্রডাকশন বর্তমান সুরমা সম্পাদক আহমদ ময়েজ প্রমুখ। এই দিনটি বিলেতের
জীবনে আমার কাছে বেশ স্মরণীয়। নতুন দিন পরিবারের সদস্য হিসেবে তারা আমাকে বরণ করে
নিলেন। একই সাথে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবেও আমাকে সংযুক্ত করে নেন।
অবশ্য
নতুন দিনে আমার অনেক লেখা আগেও প্রকাশিত হয়েছে। সিলেটের বরেণ্য সাহিত্যিক, সংলাপ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফ্রন্টের
অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডিয়াম মেম্বার কবি রাগিব হোসেন চৌধুরী পাঠাতেন। তিনি
নতুন দিন সম্পাদকের বড় ভাই এবং বালাদেশ প্রতিনিধি। আমি তখন সংলাপের সেক্রেটারি
জেনারেল এবং জাতীয় দৈনিকে কাজ করি।আমার লন্ডন আসার পূর্বেই কবি রাগিব হোসেন চৌধুরী
নতুন দিনে আমার নিয়োগ নিশ্চিত করেছেন।
সাপ্তাহিক
নতুন দিন বৃহস্পতিবার মার্কেটে আসে। মূল কাজ হয় মঙ্গল ও বুধবার। সৈয়দ ফারুক এই দু’দিন থাকেন। আমরা এক সাথে কাজ
করি। প্রথম পাতা সাজাতে গিয়ে লীড ও সেকেন্ড লীড নিয়ে মাঝে মাঝে আমাদের ভিন্ন মত
হয়। আমি রাজনীতির মানুষ নই। সৈয়দ ফারুক রাজনীতি করেন। সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তার
রাজনীতি প্রাধান্য পেতেই পারে। মহিব চৌধুরী উভয়কে খুশি রেখে চমৎকার সমাধান দিতেন।
আমরা সবাই মুগ্ধ হতাম। তবে একটি ব্যাপার খুবই লক্ষণীয় ছিল, সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশে
বিভিন্ন পেশার মানুষের রাজনীতি সম্পৃক্ততা দেখেছি। সৈয়দ ফারুকের মত দলের প্রতি
আনুগত্য, কমিউনিটির প্রতি দায়বদ্ধতা
এবং নির্লোভ রাজনীতিক কম দেখেছি।
বিবিসি
বাংলা বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সাংবাদিক ও নতুন দিনের প্রধান সম্পাদক গোলাম কাদের, সুলেখক খসরু নোমান, সাংবাদিক মাহবুব রহমান, আব্দুল করিম গনি, তানজিম ইসলাম সহ আরো অনেকে নতুন
দিনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। গভীর রাতে কাগজ প্রেসে দেয়ার পর আমাদের আপ্যায়ন
পর্ব ছিল এক ভিন্ন স্বাদের। মজার মজার কাহিনী ও ঘটনা প্রবাহ আড্ডার মধ্য দিয়ে আলোচিত
হত। যাপিত জীবনের নানা প্রসঙ্গে এসব হয়ত চলে আসবে। তখনকার আরো অনেকের কথাও মনে
পড়ে। সকলের স্মৃতি রোমন্থনের প্রত্যাশা করছি।
লেখকঃ লন্ডন প্রবাসী, বিশিষ্ট কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও
কলামিস্ট।
0 coment rios:
You can comment here