Friday, April 17, 2020

করোনা ভাইরাস : আমাদেরই কর্মফল


 
।। যুবাইর আহমদ মাবরুর।।

করোনা ভাইরাস : আমাদেরই কর্মফল

সমস্ত নবী রাসুলদের মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ট রাসুল হলেন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। রাসুল পাকের সম্মান ও মর্যাদা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বিভিন্নভাবে অন্যান্য রাসুলের তুলনায় বাড়িয়ে দিয়েছেন। এমন অনেক বৈশিষ্ট্য মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দান করা হয়েছে যেগুলো কোন নবীকেই দেয়া হয় নি। কারণ যার জন্য তামাম আলম সৃষ্টি তাঁর মর্যাদা, তাঁর সম্মান অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক।

এত সম্মানিত যে নবী তাঁর উম্মতদেরও কিছু স্বতন্ত্র সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। অনেক ছাড় এদের জন্য আল্লাহ পাকের কাছে। এদের এমন সম্মানিত করা হয়েছে যে, অনেক নবী আলাইহিমুস সালামও এদের অন্তর্গত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন। যুগে যুগে বিভিন্ন জাতিকে যে-সকল পাপের কারণে আল্লাহ তাআলা সীমাহীন আজাব আর গজবে সমুলে উৎপাটিত করেছিলেন এ উম্মত অনেক দিক দিয়ে সেগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে। তবুও নবীর স্পেশাল পাওয়ারে আল্লাহ পাক আ'ম গজব দিয়ে এ উম্মতকে এখনো ধ্বংস করেন নি, আর কেয়ামতের আগ পর্যন্ত করবেনও না। কারণ রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের চিন্থায় এতটা নিমগ্ন ছিলেন যে, আমাদের উপর যাতে আ'ম গজব না আসে সেটারও বন্দোবস্ত করে গেছেন।


সাদ রাদিআল্লাহু আনহু তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা আলিয়াহহতে এসে বানু মুআবিয়ায়অবস্থিত মসজিদের সন্নিকটে গেলেন। অতঃপর তিনি উক্ত মসজিদে প্রবেশ করে দুরাকাআত সলাত আদায় করলেন। আমরাও তাঁর সাথে সলাত আদায় করলাম। এ সময় তিনি তাঁর প্রতিপালকের নিকট দীর্ঘ সময় দুআ করলেন এবং দুআ শেষে আমাদের দিকে মুখ ফিরালেন। অতঃপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘’আমি আমার প্রতিপালকের কাছে তিনটি বিষয় প্রার্থনা করেছি। তন্মধ্যে তিনি আমাকে দুটি প্রদান করেছেন এবং একটি প্রদান করেননি। আমি আমার প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা করেছিলাম যে, তিনি যেন আমার উম্মতকে দুর্ভিক্ষের দ্বারা ধ্বংস না করেন। তিনি আমার এ দুআ কবুল করেছেন। তাঁর নিকট এও প্রার্থনা করেছিলাম যে, তিনি যেন আমার উম্মতকে পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস না করেন। তিনি আমার এ দুআও কবুল করেছেন। আমি তাঁর নিকট এ মর্মেও দুআ করেছি যে, যে মুসলিমেরা পরস্পর একে অপরের বিপক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে না পরে। তিনি আমার এ দুআ কবুল করেননি’’ (মুসলিম)

যে দু'আটি কবুল হয় নি সেটা বাস্তবে রূপ নিতে বেশি দিন লাগেনি, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের কিছুদিন পরেই তা শুরু হয়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে আমরা একে একে আমাদের আবাদকৃত ভূমিসমূহ হারিয়েছি। আমরা এমনভাবে আমাদের ভূমিগুলো হারিয়েছি যে, সেগুলো আদৌ আমাদের ছিল কী না সেটাই সন্দেহ। যার প্রকৃষ্ট উদাহরন স্পেন।

স্পেনে মুসলমানরা শাসন করেছেন সুদীর্ঘ আটশ বছর। স্পেন কে আধুনিক স্পেন মুসলমানরাই বানিয়েছেন কিন্তু আজ সেখানে এমন অবস্থা তৈরী হয়েছে যে
মুফতি তাকী উসমানি হাফিজাহুল্লাহ তাঁর 'দুনিয়া জুড়া বিস্ময়কর সফর' নামক গ্রন্থে আক্ষেপ করে বলেছেন, "স্পেনে আজ ক্বিবলা কোনদিকে তা দেখানোর মানুষও নেই"। সবই হয়েছে আমাদের কারনে, আমাদের উদাসীনতায়। আমরা স্বার্থপরও হতে পারলাম না, নিজেদের স্বার্থ নিজেরা রক্ষা করতে পারি না। উম্মতে মুহাম্মদির পরস্পর বিরোধীতা এখন চরম রূপ ধারণ করেছে। উম্মতে মুহাম্মদি এখন শতধাবিভক্ত। এ উম্মত এখন কোন একটা সাধারণ বিষয়েও ঐক্যমতে পৌছাতে পারে না। পূর্বেকার উলামায়ে কেরামের মতানৈক্য উম্মতের জন্য নিয়ামত ছিল যেগুলোর ফলে আমরা শরীয়তের অনেক সূক্ষ্ম বিষয়াদি সহজেই পেয়ে যাচ্ছি। তবে বর্তমানে সময়ের মতানৈক্যগুলো এ উম্মতের জন্য নিয়ামত না বরং তা অনেকাংশে গজবে পরিণত। এর থেকে উত্তরনের পথ খুঁজা সবচেয়ে জরুরি বিষয়।

যাক সে সব কথা, মূল বিষয়ে আসা যাক।  যদিও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দু'আ কবুল করেছেন যে, আমাদের আ'ম গজব দিয়ে ধ্বংস করবেন না কিন্তু এ মর্মে আরেকটা হাদিস পাওয়া যায় যে, কিছু কিছু কাজ এ উম্মতের মধ্যে প্রকাশ পেলে আল্লাহর গজব আমাদের উপর পতিত হবে। কোন কোন কাজের দ্বারা আমরা নিজেদের উপর গজব হালাল করেছি সেগুলো রাসুলে আরাবীর জবান মুবারক থেকে শুনি:

হজরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন সরকারি মালকে নিজের মাল মনে করা হয়, আমানতের মালকে নিজের মালের মতো ব্যবহার করা হয়, জাকাতকে জরিমানা মনে করা হয়, ইসলামী আকিদাবর্জিত বিদ্যা শিক্ষা করা হয়, পুরুষ স্ত্রীর অনুগত হয়ে মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, বন্ধুদের আপন মনে করে বাবাকে পর ভাবা হয়, মসজিদে শোরগোল করা হয়, পাপী লোক গোত্রের নেতা হয়, অসৎ ও নিকৃষ্ট লোক জাতির চালক হয়, ক্ষতির ভয়ে কোনো লোককে সম্মান করা হয়, গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন অধিক হয়, মদ্য পানের আধিক্য ঘটে, পরবর্তী সময়ের লোকেরা পূর্ববর্তী লোকদের বদনাম করেতখন যেন তারা অপেক্ষা করে লু হাওয়া (গরম বাতাস), ভূমিকম্প, ভূমিধস, মানব আকৃতি বিকৃতি, শিলাবৃষ্টি, রক্তবৃষ্টি ইত্যাদি কঠিন আজাবের, যা একটার পর আরেকটা আসতে থাকবে, যেমন হারের সুতা ছিঁড়ে গেলে মুক্তার দানাগুলো একটার পর একটা পড়তে থাকে। (তিরমিযী)।

উপরোক্ত হাদিসে যত কাজ কে গজব আসার  কারণ হিসেবে বলা হয়েছে তার সবকটি বর্তমানে আমাদের সমাজে বিদ্যমান। এমন একটা কাজ নেই যে কাজটা আমাদের দ্বারা সংগঠিত হচ্ছে না। তো আমরা নিজেরা গজবকে আমন্ত্রন জানাবো আর তা আসবে না এমন হয় নাকি? একের পর এক ধারাবাহিকভাবে আসতে থাকবে, শুধু অপেক্ষার পালা। আমাদের কৃতকর্মের দরুন জমিনে গজব আসে তা কুরআনে কারীমে আল্লাহ পাক ঘোষণা দিয়েই রেখেছেন। 
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা  বলেন,
﴿ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
অর্থাৎ, “স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুণ বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।” (সুরা রূম, আয়াত :৪১)

গজব যে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে তা নিশ্চিত। আমরা যদি আমাদের কৃতকর্মের ক্ষমা আল্লাহর দরবারে চেয়ে তা মঞ্জুর করাতে পারি তবেই এর থেকে মিলবে মুক্তি। আল্লাহ পাকের রাগ থেকে বেঁচে থাকার পদ্ধতি তিনিই আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন,
﴿وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللَّهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللَّهَ تَوَّابًا رَحِيمًا

অর্থাৎ, (আল্লাহর রাসুল!) যদি তারা নিজেদের উপর যুলুম করত আপনার কাছে আসে অত:পর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় আর রাসূল (আপনি) তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন তাহলে তারা আল্লাহকে তাওবা কবূলকারী ও দয়াময় হিসেবে পাবে।” (সুরা নিসা, আয়াত:৬৪)

অতএব আমাদের কুরআন নির্দেশিত পথে রাসুলে আরাবীর ওসিলা নিয়ে আল্লাহ পাকের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁর দয়া লাভ করতে হবে। আমাদের রব রহমান, সুতরাং আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস তিনি আমাদের জন্য তাঁর দয়ার অবারিত দ্বার উন্মুক্ত করবেন।


লেখক: শিক্ষার্থী,
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,
সিলেট।


শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here