।। ইমদাদুল
হক যুবায়ের।।
মানুষ যখন সুখে থাকে অর্থাৎ বিপদ মুসিবত
বা রোগমুক্ত থাকে তখন স্বীয় জীবনকে নিয়ে রঙিন স্বপ্ন দেখে। পক্ষান্তরে, সে যখন
বিপদ মুসিবত এর সম্মুখিন হয়; বিশেষ করে রোগাক্রান্ত হয় তখন আল্লাহ ও পরকাল; বিশেষ
করে মৃত্যুর চিন্তাটা প্রবল হয়। আর কোনো মহামারি দেখা দিলে মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত
হয় আর আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
করোনা ভাইরাস; এটা একটা যুনোটিক ভাইরাস। মানে এটা প্রাণীদের
থেকে সংক্রমিত হয়ে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। বলা হয়ে থাকে বাদুড় থেকেই এর আগমনটা
বেশি হয়ে থাকে। শুকর থেকে যেমন সোয়াইন ফ্ললু হয়ে থাকে বেশি।
জ্বর, কাশি, শ্বাস কষ্ট,
শ্বাসে ঘাটতি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইনফেকশান হয়ে নিউমোনিয়া দেখা দিতে
পারে, কিডনি ফেইল করতে পারে এমনকি মৃত্যুও ঘটাতে পারে। এই রোগের প্রাদূর্ভাদ চায়না থেকে শুরু হয়েছে। এখন সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে
পড়েছে। এই
রোগ কি আমাদের গুণাহের কারণে হতে পারে? এ বিষয়ে কুরআন কী বলছে? আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ
﴿ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ﴾
অর্থাৎ
“স্থলে বা সাগরে যে সব ফাসাদ বা অনিয়ম ও বিশৃংখলা প্রকাশ পায় তা মানুষের হাতের
কামাই।” (আল-কুরআন, সূরা রুম, আয়াত:৩০)
কিন্তু
তাই বলে কারো এই রোগ দেখা দিলে আমরা বলতে পারবো না ঐ লোকের পাপের কারণে এই রোগ
হয়েছে। আমাদের পাপের কারণে রোগের প্রাদূর্ভাব হতে পারে, কারো হলে সেটা তার পাপের ফসল নয়। অনেক ছোট
বাচ্চার এইডস হয়েছে যারা কখনো সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড হবার সুযোগ পায়নি, তবে অন্য কোনোভাবে ভাইরাস তার দেহে ঢুকে
গেছে। কাজেই দুনিয়ায় কোনো মহামারি ছড়িয়ে পড়লে তাকে আল্লাহর তাক্বদীর মনে করে নিতে
হয়। এটা সায়্যিদুনা উমার (রাঃ) এর ভাষায়ঃ
﴿نَفِرُّ مِنْ قَدَرِ اللَّهِ إِلَى قَدَرِ اللَّهِ﴾
অর্থাৎ, “আমরা
এক তাক্বদীর থেকে অন্য তাক্বদীরে প্রবেশ করি।” (মুয়াত্ত্বা ইমাম মালেক, হাদীস নং১৩৯১)
একঃ মুসলমানদের কে বিশ্বাস রাখতে হবে যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা। এই পরীক্ষার মাধ্যমে আল্লাহ কিছু ভুল প্রাক্টিসের শাস্তি দিয়ে
আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছেন। ঐগুলো যেন আমরা আর না করি।
দুইঃ
এই ধরণের বিপদ থেকে আমরা মানবতাকে যেন রক্ষায় এগিয়ে আসি। যেমনভাবে আমওয়াস নামক
স্থানে মহামারি দেখা দিলে আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ, মাআয
ইবন জাবাল, ইয়াযিদ
ইবন আবু সুফইয়ান, সুহায়ল
ইবন আমর, দিরার
ইবন আল আযওয়ার অথবা আবু জানদাল ইবন সুহায়ল (রিদওয়ানুল্লাহি আলাইহিম আজমাঈন) এটাকে আল্লাহর
অমোঘ তাক্বদীর হিসেবে মেনে নিয়ে এক স্থানেই থেকে শেষ পরিণতি ও মৃত্যু উভয়কে মেনে
নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা তখন এই মৃত্যুকে শহীদী মরণ হিসেবে আখ্যা দেন।
আয়শা
(রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি
বলেন, আমি
মহানবী (সাঃ) এর কাছে মহামারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেন, এটা এক ধরণের আযাব, যে জনগোষ্ঠির উপর আল্লাহ চান, তাদের উপর তিনি তা পাঠিয়ে থাকেন। তবে এটা মুমিনদের জন্য রহমত বানিয়ে
দেন। যদি কোনো বান্দাহের এই মহামারী ধরে ফেলে, এর
পর ঐ শহরে ধৈর্য ধরে অবস্থান করতে থাকে যে, আল্লাহ, তার
ব্যাপারে যা-ই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন,
তা-ই
হবে। এরপরে ব্যক্তিটির মৃত্যু হলে শহীদের মৃত্যুর সাওয়াব পাবে। (বুখারি)।
এই
সিদ্ধান্তে অটল থেকে ঐ স্থানেই প্রায় পঁচিশ থেকে ত্রিশ হাজার সাহাবা ও তাবেয়ী (রাঃ)
ইন্তেকাল করেন।
তিন: আরেক
ধরণের রক্ষা হলো আমর ইবনুল আস এর কর্মপন্থা। আমওয়াসে নেতৃস্থানীয় সাহাবিগণের ইন্তেকালের পর আমর ইবনুল আস
(রাঃ) দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। তিনি বাকি সাহাবি ও তাবিঈগণকে নিয়ে নিকটস্ত এক
পাহাড়ে চলে যান।
তার
এই তড়িৎ সিদ্ধান্তে অনেকের জীবন রক্ষা পায়।
সাহাবীগণের
এই কর্মপন্থা আমাদের সুন্দর পথ দেখায়। তা হলো রোগ হয়ে গেলে যেমন কোয়ারেন্টাইনের
ব্যবস্থা করা উচিৎ। যা আব্দুর রহমান ইবন আউফের হাদীসে পাই। যদি আমরা কোনো
ভূখন্ডে থাকি যেখানে মহামারী বিস্তার লাভ করেছে, সেখান
থেকে যেন বের না হই। আবার সেখানেও আমরা যেন না যাই। দ্বিতীয় কর্মপন্থা হলো, পাশের সুরক্ষিত এমন স্থানে যাওয়ার সুযোগ
থাকলে যাওয়া, যেখানে
অন্য কেউ এর শিকার হবার সম্ভাবনা না থাকে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এই
সব মহামারী সম্পর্কে আমাদের একটা সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তিনি
বলেছেনঃ
﴿عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ قَالَ أَقْبَلَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ يَا مَعْشَرَ الْمُهَاجِرِينَ خَمْسٌ إِذَا ابْتُلِيتُمْ بِهِنَّ وَأَعُوذُ بِاللَّهِ أَنْ تُدْرِكُوهُنَّ لَمْ تَظْهَرْ الْفَاحِشَةُ فِي قَوْمٍ قَطُّ حَتَّى يُعْلِنُوا بِهَا إِلَّا فَشَا فِيهِمْ الطَّاعُونُ وَالْأَوْجَاعُ الَّتِي لَمْ تَكُنْ مَضَتْ فِي أَسْلَافِهِمْ الَّذِينَ مَضَوْا﴾
অর্থাৎ “কোনো জাতির মাঝে যদি অশ্লীল কার্যকলাপ
বৃদ্ধি পায়, এবং
তারা তা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে করে, তাহলে
আল্লাহ তাদের মাঝে মহামারী ছড়িয়ে দেন। এবং এমন সব রোগ দেন যা ইতিপূর্বের কোনো জাতির
মাঝে তা দেখা যায়নি।” (ইবন
মাজাহ, হাদীস নং ৪০০৯)
চার: এই
হাদীস আজকের যুগের মুসলিমদের জন্য খুবই উপকারী হতে পারে। যেসব রোগ আমাদের কাছে
মহামারী হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে তা কোনো না কোনো অশ্লীলতা ব্যাপকতার ফল। যেহেতু
মুসলিম জাতি অনেকাংশে নিজদের গুটিয়ে রাখে তাই ঐ সব মারাত্মক রোগে তাদেরকে ধরে
ফেলার সূচকও অনেক কম।
এক: আল্লাহর
প্রতি আমাদের ঈমান ও বিশ্বাসকে অনেক তুঙ্গে উঠাতে হবে। তিনি আমাদের রব, তিনি-ই সব করতে পারেন। আমার জীবন ও মরণ তাঁরই
হাতে। তিনি আমার মরণ চাইলে পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাকে জীবিত রাখতে পারবে না। তিনি আমাকে জীবিত রাখতে চাইলে দুনিয়ার কোনো
শক্তিই আমাকে মারতে পারবেনা।
দুই: রাসূলুল্লাহ
(সাঃ) জীবন যাপনের অনেক পদ্ধতি ওহির উপর ভিত্তি করে আমাদের শিখিয়ে গেছেন। যেমন
গোসল করা। পেশাব পায়খানার পর পানি দিয়ে ধোয়া। সুন্দর করে অযু করা। খাওয়ার আগে পরে
হাত মুখ ধোয়া। অযু অবস্থায় থাকা। ঘুমের সময়টাকে সুন্দরভাবে মানা। অপরের সাথে দেখা
হলে স্বাস্থ্য হাইজিন বজায় রাখা। খাওয়ার জিনিস হালাল ও পবিত্র হওয়া। ভালো, নির্মল ও তাজা জিনিসপত্র খাওয়া। পানের
ক্ষেত্রেও সুন্নাহ মেনে চলা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় সর্বোচ্চ সাবধান হওয়া।
তিন: স্বাভাবিক
জীবন যাপন করা উচিৎ। টেনশান,
উদ্বিগ্নতা, অতিরিক্ত সাবধানতা দেখাতে গিয়ে বাজার সংকট
সৃষ্টি করা, ও
এমন হা হুতাশ করা যা একজন মুসলিমের জন্য শোভা পায়না, এসব গর্হিত কাজে অংশ না নেয়া উচিৎ। আল্লাহর কাছে বিভিন্ন ধরনের দোয়া করা মহানবীর (সাঃ) এর আদর্শ। করোনার জন্য আলাদা কোনো দোয়া নেই। তবে মহামারী ও অন্যান্য মারাত্মক রোগের জন্য যে সকল দোয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ) শিখিয়ে গেছেন তা বার বার পড়া। দান সাদাক্বা বাড়িয়ে দেয়া।
মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সেবা করার জন্য এগিয়ে আসা ইত্যাদি।
চার: মানুষের
মাঝে ভয় ছড়িয়ে দেয়া উচিৎ নয়। রোগ একবার হয়ে গেলে চিকিৎসা গ্রহণে কোনোরূপ দুর্বলতা
না দেখানো উচিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
﴿عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللَّهَ أَنْزَلَ الدَّاءَ وَالدَّوَاءَ وَجَعَلَ لِكُلِّ دَاءٍ دَوَاءً فَتَدَاوَوْا﴾
অর্থাৎ, “আল্লাহ
প্রতিটি রোগেরই ঔষুধ দিয়েছেন,
কাজেই
চিকিৎসা নেওয়া।” (আবু দাউদ,
হাদীস নং ৩৩৭৬)
পাঁচ: চিকিৎসা
হলো রোগ নিরাময়ের মাধ্যম। কাজেই আমাদের উচিৎ হলো এই মাধ্যমের যিনি সৃষ্টিকর্তা তার
কাছেই ধর্ণা দেওয়া। ক্বাদি ইয়াদ্ব (রাঃ) বলেনঃ “আমি যখন অসুস্থ হই, তখন তিন কারণে আমি আল্লাহর প্রশংসা করি।
প্রথমতঃ
তিনি চাইলে এর চেয়েও বড় রোগ আমাকে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি আমার উপর রহম করেছেন।
কাজেই তাঁর জন্য প্রশংসা করি।
দ্বিতীয়ত: তিনি
এই রোগ হওয়া সত্বেও আমাকে সবর করার তাওফীক্ব দিয়েছেন। কাজেই তাঁর-ই প্রশংসা করি।
তৃতীয়ত: তিনি
আমাকে ‘ইন্না লিল্লাহ’ পড়ার সুযোগ দিয়েছেন। যা বললে তিনি সালাওয়াত ও রাহমাহ দেবেন
বলে ওয়াদাহ করেছেন। তাই আবারো তাঁর
প্রশংসা করি।
আর
প্রশংসা এই জন্য করি যে, তিনি এই বিপদ আমার শরীরে দিয়েছেন। আমার দীনে কোনো বিপদ দেননি।
ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, সাহাবীদের সময়ে একবার মহামারী প্লেগের
প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শাহাদাতবরণ করেন অনেক সাহাবী। তার
মধ্যে একজন ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী।
৬৩৯ খ্রিস্টাব্দ। তখন খলিফা ছিলেন হযরত উমর ইবনুল
খাত্তাব (রাঃ)। প্লেগ দেখা
দিয়েছিলো সিরিয়ায়-প্যালেস্টাইনে। ইতিহাসে যা ‘আম্মাউস প্লেগ’ নামে পরিচিত। উমর (রাঃ) সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন। ‘সারগ’ নামক জায়গায় পৌঁছার পর সেনাপতি আবু
উবাইদাহ (রাঃ) খলিফাকে জানালেন, সিরিয়ায় তো
প্লেগ দেখা দিয়েছে।
উমর (রাঃ) প্রবীণ সাহাবীদেরকে পরামর্শের
জন্য ডাকলেন। এখন কী করবো? সিরিয়ায় যাবো নাকি যাবো না? সাহাবীদের মধ্য থেকে দুটো মত আসলো। একদল বললেন,
“আপনি যে
উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন, সে উদ্দেশ্যে যান”। আরেকদল বললেন, “আপনার না যাওয়া উচিত”।
তারপর আনসার এবং মুহাজিরদের ডাকলেন
পরামর্শ দেবার জন্য। তারাও মতপার্থক্য করলেন। সবশেষে বয়স্ক কুরাইশদের ডাকলেন। তারা
এবার মতানৈক্য করলেন না। সবাই মত দিলেন- “আপনার
প্রত্যাবর্তন করা উচিত। আপনার সঙ্গীদের প্লেগের দিকে ঠেলে দিবেন না।”
উমর (রাঃ) তাঁদের মত গ্রহণ করলেন। তিনি
সিদ্ধান্ত নিলেন, মদীনায় ফিরে যাবেন। খলিফাকে মদীনায় ফিরে
যেতে দেখে সেনাপতি আবু উবাইদাহ (রাঃ) বললেন,
“আপনি কি আল্লাহর
নির্ধারিত তাকদীর থেকে পালানোর জন্য ফিরে যাচ্ছেন?”
আবু উবাইদাহর (রাঃ) কথা শুনে উমর (রাঃ)
কষ্ট পেলেন। আবু উবাইদাহ (রাঃ) ছিলেন তাঁর এতো পছন্দের যে, আবু উবাইদাহ (রাঃ) এমন কথা বলতে পারেন উমর (রাঃ) সেটা ভাবেননি।
উমর (রাঃ) বললেন, “ও আবু উবাইদাহ! যদি তুমি ব্যতীত অন্য কেউ কথাটি বলতো! আর হ্যাঁ, আমরা আল্লাহর এক তাকদীর থেকে আরেক তাকদীরের দিকে ফিরে যাচ্ছি।”
আল্লাহর এক তাকদীর থেকে আরেক তাকদীরের
দিকে ফিরে যাওয়ার মানে কী? উমর (রাঃ) সেটা আবু উবাইদাহকে (রাঃ)
বুঝিয়ে বলেন, “তুমি বলতো,
তোমার কিছু উটকে
তুমি এমন কোনো উপত্যকায় নিয়ে গেলে যেখানে দুটো মাঠ আছে। মাঠ দুটোর মধ্যে একটি মাঠ
সবুজ শ্যামল, আরেক মাঠ শুষ্ক ও ধূসর। এবার বলো, ব্যাপারটি কি এমন নয় যে, তুমি সবুজ মাঠে
উট চরাও তাহলে তা আল্লাহর তাকদীর অনুযায়ী চরিয়েছো। আর যদি শুষ্ক মাঠে চরাও, তা-ও আল্লাহর তাকদীর অনুযায়ী চরিয়েছো।”
অর্থাৎ,
উমর (রাঃ) বলতে
চাচ্ছেন, হাতে সুযোগ থাকা সত্বেও ভালোটা গ্রহণ করা
মানে এই না যে আল্লাহর তাকদীর থেকে পালিয়ে যাওয়া।
কিছুক্ষণ পর আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ)
আসলেন। তিনি এতক্ষণ অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি এসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর একটি হাদীস
শুনালেন।
“তোমরা যখন কোনো এলাকায় প্লেগের বিস্তারের কথা শুনো, তখন সেখানে প্রবেশ করো না। আর যদি কোনো এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব নেমে আসে, আর তোমরা সেখানে থাকো, তাহলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেও না।” (সহীহ
বুখারী, হাদীস নং ৫৭২৯)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাদীসটি সমস্যার
সমাধান করে দিলো। উমর (রাঃ) হাদীসটি শুনে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।
মদীনায় ফিরে উমর (রাঃ) আবু উবাইদাহকে
(রাঃ) চিঠি লিখলেন। “আপনাকে আমার খুব প্রয়োজন। আমার এই চিঠিটি
যদি রাতের বেলা আপনার কাছে পৌঁছে, তাহলে সকাল হবার
পূর্বেই আপনি রওয়ানা দিবেন। আর চিঠিটি যদি সকাল বেলা পৌঁছে, তাহলে সন্ধ্যা হবার পূর্বেই আপনি রওয়ানা দিবেন।”
চিঠিটা পড়ে আবু উবাইদাহ (রাঃ) বুঝতে
পারলেন। খলিফা চাচ্ছেন তিনি যেন প্লেগে আক্রান্ত না হন। অথচ একই অভিযোগ তো তিনি
উমরকে (রাঃ) করেছিলেন।
প্রতি উত্তরে আবু উবাইদাহ (রাঃ) লিখেন- “আমিরুল মুমিনিন! আমি তো আপনার প্রয়োজনটা বুঝতে পেরেছি। আমি তো মুসলিম
মুজাহিদদের মধ্যে অবস্থান করছি। তাদের মধ্যে যে মুসিবত আপতিত হয়েছে, তা থেকে আমি নিজেকে বাঁচানোর প্রত্যাশী নই। আমি তাদেরকে ছেড়ে যেতে চাইনা, যতক্ষণ না আল্লাহ আমার ও তাঁদের মাঝে চূড়ান্ত ফয়সালা করে দেন। আমার চিঠিটি
পাওয়া মাত্র আপনার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করুন এবং আমাকে এখানে অবস্থানের অনুমতি
দিন।”
চিঠিটি পড়ে উমর (রাঃ) ব্যাকুলভাবে কান্না
করেন। তাঁর কান্না দেখে মুসলিমরা জিজ্ঞেস করলো,
“আমিরুল মুমিনিন!
আবু উবাইদাহ কি ইন্তেকাল করেছেন?” উমর (রাঃ) বললেন, “না, তবে তিনি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।” (আসহাবে
রাসূলের জীবনকথা, আব্দুল
মা’বুদ, খণ্ড-১, পৃ. ৯৩-৯৪)
কিছুদিন পর আবু উবাইদাহ (রাঃ) প্লেগে আক্রান্ত হন। আক্রান্ত হবার অল্পদিনের মধ্যেই শাহাদাত বরণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “(প্লেগ) মহামারীতে মৃত্যু হওয়া প্রত্যেক মুসলিমের জন্য শাহাদাত।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৮৩০)
আবু উবাইদাহ (রাঃ) ছিলেন জান্নাতের
সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী। আশারায়ে মুবাশশারার একজন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর খলিফা নির্বাচনের প্রসঙ্গ উঠলে আবু বকর (রাঃ) আবু উবাইদাহকে (রাঃ) প্রস্তাব
করেন। উমর (রাঃ) ইন্তেকালের আগে কে পরবর্তী খলিফা হবেন এই প্রশ্ন উঠলে তিনি বলেন, “যদি আবু উবাইদাহ বেঁচে থাকতেন,
তাহলে কোনো কিছু
না ভেবে তাঁকেই খলিফা বানাতাম।”
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্লেগ সম্পর্কে বলেন, “এটা হচ্ছে একটা আজাব। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাদের উপর ইচ্ছা তাদের উপর
তা প্রেরণ করেন। তবে, আল্লাহ মুমিনদের জন্য তা রহমত স্বরূপ করে
দিয়েছেন। কোনো ব্যক্তি যদি প্লেগে আক্রান্ত জায়গায় সওয়াবের আশায় ধৈর্য ধরে অবস্থান
করে এবং তার অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে,
আল্লাহ তাকদীরে
যা লিখে রেখেছেন তাই হবে, তাহলে সে একজন শহীদের সওয়াব পাবে।” (সহীহ
বুখারী, হাদীস নং ৩৪৭৪)
আবু উবাইদাহর (রাঃ) ইন্তেকালের পর
সেনাপতি হন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর আরেক প্রিয় সাহাবী মু’আজ ইবনে জাবাল (রাঃ)। সবাই তখন
প্লেগের আতঙ্কে ভীত-সন্ত্রস্ত। নতুন সেনাপতি হবার পর মু’আজ (রাঃ) একটা ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেনঃ “এই প্লেগ
আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো মুসিবত নয় বরং তাঁর রহমত এবং নবীর দু’আ। হে আল্লাহ! এই রহমত আমার ঘরেও পাঠাও এবং আমাকেও এর যথেষ্ট অংশ দান করুন।” (হায়াতুস
সাহাবাঃ খণ্ড-২, পৃ.
৫৮২)
দু’আ শেষে এসে
দেখলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয়পুত্র আব্দুর রহমান প্লেগাক্রান্ত হয়ে গেছেন। ছেলে বাবাকে
সান্ত্বনা দিয়ে কুর’আনের ভাষায় বলেনঃ
﴿الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِينَ﴾
অর্থাৎ, “তুমি কখনো
সন্দেহ পোষণকারীর অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।”
(সূরা বাকারা, আয়াত:১৪৭) পুত্রের সান্ত্বনার জবাব পিতাও জবাব দেন কুর’আনের ভাষায়ঃ
﴿سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ﴾
অর্থাৎ, “ইনশাআল্লাহ তুমি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবে।” (সূরা আস-সাফফাত, আয়াত:১০২)
কিছু দিনের মধ্যে তাঁর প্রিয়পুত্র প্লেগে
আক্রান্ত হয়ে শহীদ হন, তাঁর দুই স্ত্রী শহীদ হন। অবশেষে তাঁর
হাতের একটা আঙ্গুলে ফোঁড়া বের হয়। এটা দেখে মু’আজ (রাঃ)
প্রচন্ড খুশি হন। আনন্দে বলেন, “দুনিয়ার সকল
সম্পদ এর তুলনায় মূল্যহীন।” অল্পদিনের মধ্যে তিনিও প্লেগে আক্রান্ত
হয়ে শহীদ হন।” (আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, খণ্ড-৩, পৃ. ১৫১-১৫২)
করোনা ভাইরাস আজ মহামারী আকার
ধারণ করেছে। সারাবিশ্বে এখন আলোচিত প্রসঙ্গ হলো এ ভাইরাস। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা
এর থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে ব্যস্ত। বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দর, স্টেশনগুলোতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সবমিলিয়ে পুরো
বিশ্ব একটা আতঙ্কের মধ্যে এখন বিরাজমান।
ঠিক এই মুহূর্তে প্রশ্ন উঠছে- করোনা
ভাইরাস কি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো আজাব?
বিগত কয়েক মাসের চীন সরকারের মুসলিম
বিদ্বেষী মনোভাব এবং মুসলিমদের উপর নির্যাতনের ফলে অনেকেই মনে করছেন, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আজাব। চীন সরকার উইঘুরের মুসলিমদের যেমনভাবে নির্যাতন
করেছে, মুসলিম আইডেন্টিটির জন্য তাদেরকে যেভাবে
হয়রানি করা হয়েছে, চীন সরকারের এই ‘অ্যাকশন’ এর জন্য একটা ‘রিঅ্যাকশনারি’ অবস্থান থেকে মুসলিমরা কেউ কেউ করোনা
ভাইরাসকে আল্লাহর পক্ষ থেকে আজাব বলে অভিহিত করছেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাদীস থেকে দেখতে
পাই, প্লেগকে তিনি বলেছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে
আজাব, আবার বলেছেন এটা মুমিনদের জন্য শর্ত
সাপেক্ষে রহমত। একই মহামারী ভাইরাস কারো জন্য হতে পারে আজাব, আবার কারো জন্য হতে পারে রহমত। তাই বলে,
একে ঢালাওভাবে
আল্লাহর পক্ষ থেকে আজাব কিংবা ঢালাওভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত বলার সুযোগ নেই।
মহামারী ভাইরাস যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে
আজাব হয়ে থাকে, তাহলে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী
আল্লাহর আজাবে ইন্তেকাল করেছেন? সাহাবীদের বেলায়
আল্লাহ সাধারণভাবে ঘোষণা করেছেন- আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর
প্রতি সন্তুষ্ট। তাহলে সুহাইল ইবনে আমর, মু’আজ ইবনে জাবাল, ফদল ইবনে আব্বাস, ইয়াজিদ ইবনে আবি সুফিয়ান, আবু মালিক আশ’আরী (রাঃ) সাহাবীগণ আল্লাহর আজাবে নিপতিত হয়েছেন?
উত্তর হচ্ছে- না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাদীস
অনুযায়ী ঐ মহামারীকে তারা রহমত হিসেবে নিয়েছিলেন। মহামারীতে মৃত্যুবরণ করাকে তারা
শাহাদাত হিসেবে দেখেছেন। যার ফলে মু’আজ ইবনে জাবাল
(রাঃ) সেই রহমত পাবার জন্য দোয়া পর্যন্ত করেন।
হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
যখন সরকারি
মালকে নিজের মাল মনে করা হয়, আমানতের মালকে
নিজের মালের মতো ব্যবহার করা হয়, জাকাতকে জরিমানা
মনে করা হয়, ইসলামী আকিদা বর্জিত বিদ্যা শিক্ষা করা
হয়, পুরুষ স্ত্রীর অনুগত হয়, মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়,
বন্ধুদের আপন
মনে করা হয়, বাবাকে পর ভাবা হয়, মসজিদে শোরগোল করা হয়, পাপী লোক গোত্রের নেতা হয়, অসৎ ও নিকৃষ্ট লোক জাতির চালক হয়,
ক্ষতির ভয়ে কোনো
লোককে সম্মান করা হয়, গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন অধিক হয়, মদ্য পানের আধিক্য ঘটে, পরবর্তী সময় লোকেরা পূর্ববর্তী লোকদের
বদনাম করে—তখন যেন তারা অপেক্ষা করে লু হাওয়া (গরম
বাতাস), ভূমিকম্প,
ভূমিধস, মানব আকৃতি-বিকৃতি, শিলাবৃষ্টি, রক্তবৃষ্টি ইত্যাদি কঠিন আজাবের,
যা একটার পর
আরেকটা আসতে থাকবে, যেমন হারের সুতা ছিঁড়ে গেলে মুক্তার
দানাগুলো একটার পর একটা পড়তে থাকে।” (তিরমিজি)
উপরের হাদীসটিতে উল্লেখিত সকল কাজই আজ
সমাজের সর্বত্র চলতেছে। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “যখন কোনো জাতি
বা সম্প্রদায় অশ্লীল ও ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হয় তখন তাদের মধ্যে এমন এক ভয়ঙ্কর মহামারী
দেখা দেয়, যা তারা অতীতে কখনো দেখেনি।” (ইবনে
মাজা)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ১৪০০ বছর আগের শাশ্বত
ভবিষ্যৎ বাণীসমূহ আজ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে। বর্তমানে পাপের এমন
কোনো রাস্তা নেই যা দুনিয়াতে চলতেছে না। গজব বা মহামারী
যখন আসে তখন এর থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিৎ।
সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা
রাখতে হবে। এর থেকে মুক্তির পথ একটাই ব্যক্তিগত,
পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পাপের পথসমূহ বন্ধ করে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পথে
নিজেদের জীবনকে পরিচালনা করতে হবে।
মহামারী থেকে বাঁচার জন্য আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করবো, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী চলবো। নিজে সচেতন থাকবো অন্যকে সচেতন করবো।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাদীসসমূহ এবং উমর (রাঃ) এর শাসনামল এর সময় কালের পর্যালোচনা থেকে আমাদের নিতে হবে- মহামারীর বেলায় প্রতিরক্ষার দিকে সতর্ক হবার শিক্ষা।
আবার, অন্যান্য সাহাবীরা যখন প্লেগে আক্রান্ত হয়েছেন, তখন ধৈর্যধারণ করে, রহমত মনে করে আল্লাহর ফয়সালাকে মেনে নিয়েছেন। যার প্রতিদান স্বরূপ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর হাদীস অনুযায়ী তাঁদের মৃত্যু হলো- শাহাদাত বরণ।
আসুন,
হতাশা নয়; আল্লাহর উপর ভরসা রাখি, তিনিই আমাদের একমাত্র অভিভাবক। আল্লাহ
তালার দিকে ধাবিত হই, তিনিই একমাত্র মুক্তি দাতা।
আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে অসংখ নবী-রাসুল
প্রেরণ করেছেন। আল কুরআনের অসংখ্য ঘটনাবলী থেকে জানা যায়- বিভিন্ন নবী
রাসুলদের উম্মতরা আল্লাহর দেওয়া বিধানের অবাধ্য হওয়ায় আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে
দেওয়া বিভিন্ন ধরেনের মহমারীতে ওই গোত্র ও জনপদ পুরোপুরি ধ্বংসে করে দিয়েছেন।
মানুষের কৃতকর্মের জন্য
জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে তাদেরকে কোনো কোনো
কর্মের শাস্তি আস্বাদন করানো হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর কাছে এই মর্মে দোয়া
করেছেন- আল্লাহ আপনি আমার উম্মতদেরকে এমন মহামারী দিয়েন না, যার ফলে তারা সমূলে ধ্বংস হয়ে
যাবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিভিন্ন সময় উম্মতদের বালা মুসিবত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য
আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন।
এ জগতে ব্যাপকহারে মানুষ আল্লাহ তাআলার
অবাধ্য হলে আল্লাহ পাক পৃথিবীতে গজব নাজিল করেন; যাতে মানুষ তাদের ভুল বুঝতে পেরে তাওবার
মাধ্যমে আবার ফিরে আসতে পারে। গজব বা মহামারী আসলে তখন করণীয় কী? ইসলামে এ সম্পর্কে
সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। যে কোনো মহামারী থেকে বাঁচতে প্রথম ও প্রধান করণীয়
হচ্ছে- নিজেদের কৃতকর্ম থেকে তাওবা করা এবং বেশি বেশি ইস্তেগফার করা।
এই মুহূর্তে আমাদের সবার উচিত, মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা
চাওয়া এবং অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকা। সর্বদা পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন থাকা। কারণ,
কিয়ামতের নিদর্শনগুলোর একটি হলো মহামারী।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন, “কিয়ামতের আগের ছয়টি
নিদর্শন গণনা করে রাখো। আমার মৃত্যু, অতঃপর বায়তুল মুকাদ্দাস
বিজয়, অতঃপর তোমাদের মধ্যে ঘটবে মহামারী, বকরির পালের মহামারীর মতো, সম্পদের প্রাচুর্য,
এমনকি এক ব্যক্তিকে একশ’ দিনার দেয়ার পরও সে
অসন্তুষ্ট থাকবে। অতঃপর এমন এক ফিতনা আসবে, যা আরবের প্রতিটি
ঘরে প্রবেশ করবে। অতঃপর যুদ্ধ বিরতির চুক্তি, যা তোমাদের ও
বনি আসফার বা রোমকদের মধ্যে সম্পাদিত হবে। অতঃপর তারা বিশ্বাসঘাতকতা করবে এবং ৮০টি
পতাকা উড়িয়ে তোমাদের বিপক্ষে আসবে; প্রতিটি পতাকার নিচে থাকবে
১২ হাজার সৈন্য।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নং: ৩১৭৬)
তাই আমাদের উচিত, যেখানে এ ধরনের রোগের
প্রকোপ দেখা দেবে, সেখানে যাতায়াত থেকে বিরত থাকা। এরই মধ্যে
বিভিন্ন দেশ সরকারিভাবে করোনা আক্রান্ত দেশগুলোতে যাতায়াতে সতর্কতা জারি করেছে। যেহেতু
চিকিৎসকদের মতে এ ভাইরাসটি একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়। সাধারণত ফ্লু বা
ঠান্ডা লাগার মতো তীব্র নিউমোনিয়া সিনড্রোমের মতো করেই এ ভাইরাস ছড়ায়।
মহামারি আল্লাহর গজব হলেও এতে আক্রান্ত
মৃত ব্যক্তিকে পাপী-জাহান্নামি মনে করা যাবে না। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)
বলেছেন, “পাঁচ প্রকার মৃত শহীদ—মহামারিতে
মৃত, পেটের পীড়ায় মৃত, পানিতে ডুবে মৃত,
ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে মৃত এবং যে আল্লাহর পথে শহীদ হলো।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নং: ২৮২৯)
প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে, প্রয়োজনীয় সতর্কতার পাশাপাশি নিচের দোয়াগুলো
আমরা বেশি বেশি পাঠ করার চেষ্টা করবো।
এক: আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মহামারি থেকে বাঁচতে বেশি বেশি এই দোয়া পড়তে
বলেছেন,
﴿اللَّهمَّ
إِنِّي أَعُوُذُ
بِكَ مِنَ الْبرَصِ،
وَالجُنُونِ، والجُذَامِ،
وسّيءِ الأَسْقامِ﴾
বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আ’য়ুজুবিকা মিনাল বারাছ,
ওয়াল জুনুন, ওয়াল জুযাম, ওয়া সায়্যিইল আসক্বাম।
অর্থাৎ, “হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট ধবল, কুষ্ঠ এবং উন্মাদনাসহ সব ধরনের
কঠিন দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে পানাহ চাই।”
তথ্যসূত্র: আবু দাউদ: খণ্ড-২, পৃষ্ঠা - ৯৩; সহিহ তিরমিযী: খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা - ১৮৪; সহিহ নাসাঈ: খণ্ড- ৩, পৃষ্ঠা
– ১১১৬।
দুই: হাদীসে এসেছে- “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন-
যে ব্যক্তি সকাল
ও বিকালে সূরা ইখলাস ৩ বার, সূরা ফালাক ৩ বার ও সূরা নাস ৩ বার
পড়বে এটা তার সবকিছুর জন্য যথেষ্ট
হবে।”
তথ্যসূত্র: আবূ দাউদ:
খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা - ৩২২,
হাদীস নং ৫০৮২; তিরমিযী: খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা - ৫৬৭, হাদীস নং ৩৫৭৫।
তিন: যে ব্যক্তি সকালে তিনবার এবং বিকালে তিনবার নিচের এই দোয়া
পড়বেন, কোনো কিছুই তার ক্ষতি করতে পারবে না। দোয়াটি হলো-
﴿بِسْمِ
اللَّهِ الَّذِي
لاَ يَضُرُّ مَعَ
اسْمِهِ شَىْءٌ
فِي الأَرْضِ وَلاَ
فِي السَّمَاءِ وَهُوَ
السَّمِيعُ الْعَلِيمُ﴾
বাংলা উচ্চারণ: বিস্মিল্লা-হিল্লাযী লা ইয়াদ্বুররু মা‘আ ইস্মিহী শাইউন ফিল্
আরদ্বি ওয়ালা ফিস্ সামা-ই, ওয়াহুয়াস্ সামী‘উল ‘আলীম।
অর্থাৎ, “আল্লাহ্র নামে; যাঁর নামের সাথে আসমান ও
যমীনে কোনো কিছুই ক্ষতি করতে পারে না। আর তিনি সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী।”
তথ্যসূত্র: আবূ
দাউদ: খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা - ৩২৩, হাদিস নং: ৫০৮৮; তিরমিযী:
খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা - ৪৬৫, হাদিস নং: ৩৩৮৮; ইবন মাজাহ, হাদিস
নং: ৩৮৬৯; আহমাদ, হাদিস নং: ৪৪৬। আর আল্লামা ইবন বায রাহিমাহুল্লাহ তাঁর ‘তুহফাতুল আখইয়ার’ গ্রন্থের
৩৯ পৃষ্ঠায় এটার সনদকে হাসান বলেছেন।
চার: আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যদি কেউ ঘর থেকে বের হওয়ার সময়
বলে,
﴿بِسْمِ
اللَّهِ تَوَكَّلْتُ
عَلَى اللَّهِ لاَ
حَوْلَ وَلاَ
قُوَّةَ إِلاَّ
بِاللَّهِ﴾
বাংলা উচ্চারণ: বিসমিল্লাহি
তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ, লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।
অর্থাৎ, “আল্লাহর নামে, আল্লাহ
তাআলার ওপরই নির্ভর করলাম, আল্লাহ তাআলার সাহায্য ছাড়া বিরত
থাকা ও মঙ্গল লাভ করার শক্তি কারো নেই।”
তবে তাকে বলা হয় (আল্লাহ তায়ালাই) তোমার জন্য যথেষ্ট, তুমি হেফাজত অবলম্বন করেছ (অনিষ্ট থেকে)। তাতে শয়তান তার থেকে
দূরে সরে যায়।
তথ্যসূত্র: তিরমিজি,
হাদিস নং: ৩৪২৬।
এছাড়া নিয়মিত তাওবা ইস্তেগফার করার অভ্যাস অব্যাহত রাখতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে এই ভয়াবহ এ করোনা ভাইরাস থেকে হেফাজত করুক। আমীন।
গবেষক, প্রাবন্ধিক,
কলামিস্ট।
শিক্ষক, জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ।
জালালাবাদ সেনানিবাস, সিলেট।
ইমেইল: zubairjcpsc@gmail.com
মোবাইল: 01712374650
0 coment rios:
You can comment here