Saturday, April 18, 2020

মহামারি করোনা: সাম্প্রতিক ভাবনা


।। মো. আবদুল আউয়াল হেলাল।।

 মহামারি করোনা: সাম্প্রতিক ভাবনা

বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্থে ছড়ানো মহামারির ইতিহাস এই কয়দিনে একটু ঘেটে দেখার চেষ্টা করেছি। এতে দুটি বিষয় আমার কাছে পরিস্ফুটিত হয়েছে।

প্রথমত: ইতোপূর্বে পৃথিবীতে যত মহামারি এসেছে তা একসাথে সারা দুনিয়ায় আক্রমণ করে নি। এদিক থেকে করোনা ভাইরাস বাহিত কোভিড ১৯ নামক মহামারি ব্যতিক্রম। সব মহাদেশেই তা কমবেশি একই সাথে হানা দিয়েছে।

দ্বিতীয়ত: যখনই কোন মহামারি কোন এলাকায় হানা দিয়েছে সে এলাকায় অনিবার্যভাবে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। আর মহামারি যত দীর্ঘায়িত হয়েছে দুর্ভিক্ষ তারচেয়ে বেশি সময় ধরে জনজীবন দুর্বিষহ করে রেখেছে।
 
ফলস্বরূপ দেখা গেছে যত মানুষ মহামারিতে প্রাণ হারিয়েছে দুর্ভিক্ষের প্রকোপে সমান সংখ্যক কিংবা তারচেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
সুতরাং বর্তমানে ছড়িয়ে পড়া মহামারিতে কতজন আক্রান্ত হলো, কতজন মারা গেলো সেই সংখ্যা নিয়ে আলোচনায় আটকে না থেকে এর প্রতিক্রিয়ায় নিকট ভবিষ্যতে যারা বেঁচে থাকবে তারা কি কি সমস্যার মুখোমুখি হবে তা নিয়ে ভাবা এবং করণীয় নির্ধারণ করা একান্ত জরুরী বলে মনে করি।

একটি বিষয় গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে হবে, নোভেল করোনা মহামারি কোন নির্দিষ্ট দেশ অথবা মহাদেশে সীমাবদ্ধ নয়। সুতরাং এর পেছনে যে দুর্ভিক্ষ আসছে তাও কোন দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন থিংকট্যাংক দুর্ভিক্ষ থেকে উত্তরণের উপায় উপকরণ নিয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। মনে রাখা দরকার, এই মহামারি পুরো বিশ্বের অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে । এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক যে মন্দা সৃষ্টি হবে তা কাটিয়ে উঠতে উন্নত দেশগুলোরও বিশ ত্রিশ বছর লেগে যেতে পারে।


এমতাবস্থায় আমাদের মত অনুন্নত কিংবা স্বল্প উন্নত দেশগুলোর জন্য তা মারাত্মক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে যাবে। সব রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আপাতত: আমাদের দেশে এমন কোন ডায়নামিক নেতৃত্ব দেখছি না যে এই মহা বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষার সহজ কোন উপায় খুঁজে বের করতে পারবেন। প্রধান মন্ত্রীর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা যেটুকু আছে তা তাঁর চারপাশের লুটেরা, স্বার্থপর, স্তাবক শ্রেণির রাজনীতিজীবিদের (রাজনীতি যাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন) লাগামহীন দুর্নিতীর তলায় চাপা পড়ে যাবে। গণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করাও তাঁর পক্ষে খুব একটা সহজ হবে না। কিছু দিন পরপর জিরো টলারেন্সর বয়ান শুনে শুনে জাতিকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
উন্নত দেশগুলোতে দুর্ভিক্ষ হানা দিতে কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু আমাদের দেশে দুর্ভিক্ষের প্রাথমিক স্ট্যাজ শুরু হয়ে গেছে। খুব সহসাই তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। ইতোমধ্যে দেশের শিল্প কারখানা সাময়িক বন্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থা কতদিন দীর্ঘায়িত হবে তা কেউ নিশ্চিত বলতে পারবে না। ফলে কয়েক লক্ষ শ্রমিক এখনই অর্থ কষ্টে নিপতিত, ক্রমান্বয়ে এর তীব্রতা কেবল বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এছাড়া যে বিশাল সংখ্যক মানুষ দিন আনে দিন খায় তাদের অনাহার অর্ধাহার এখনই দৃশ্যমান।

দুর্ভিক্ষ শব্দের আভিধানিক অর্থ ভিক্ষা পাওয়া যায় না এমন অবস্থা। এই সামগ্রিক বিপর্যয়ের সময় সরকারের সাফল্য ব্যর্থতার খতিয়ান পর্যালোচনা করা মুখ্য নয়। বরং নিজেদের স্বার্থে করণীয় ঠিক করে নেয়া একান্ত দরকার।


চলমান মহামারি এবং পরবর্তী দুর্ভিক্ষে করণীয় সম্পর্কে আমার নিজস্ব চিন্তা তুলে ধরছি।

মহামারি এখন চলমান রয়েছে। কোভিড ১৯ এর কার্যকর কোন প্রতিশেধক এখনো আবিষ্কৃত হয় নি। বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা যদিও এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, কিন্তু  গ্রহণযোগ্য ফলাফল পেতে বারো থেকে আটারো মাস সময় লাগতে পারে বলে তারা জানাচ্ছেন। এমতাবস্থায় যারা এখনো সুস্থ আছি তারা জানিনা কে কখন কিভাবে আক্রান্ত হবো। আর আক্রান্ত হলে এই ঘাতক ব্যাধির সাথে লড়াই করে ঠিকে থাকতে পারবো এর কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই এই সময়ে বিশেষজ্ঞগণের পরামর্শ মতে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার সাথে সার্বক্ষণিক ঘরে অবস্থান করতে হবে। এরই মাঝে প্রত্যেকে মনের দিক থেকে নিজেকে সংশোধনের প্রতি মনযোগি হতে হবে।

একজন মুসলমান হিসেবে আমরা জানি, আমার উপর আল্লাহ ও রাসূলের কিছু হক রয়েছে। আর নিজের পরিবার পরিজন, পাড়া প্রতিবেশি তথা মানব জাতির কিছু হক রয়েছে। তাই এখনই আমাদের করণীয় হলো-

এক: এ পর্যন্ত জীবনের যে সময়টুকু পার করে এসেছি এর মধ্যে আল্লাহ ও রাসূলের হক আদায়ে যে গাফলতি করেছি এসম্পর্কে আন্তরিকভাবে অনুশোচনায় জর্জরিত হয়ে তাওবা করে নিতে হবে। তাওবা শুদ্ধ হওয়ার শর্ত পূরণের জন্য যে কয়দিন বেঁচে আছি অতীতের ভুল এবং গাফলতির পুনরাবৃত্তি না করে দৃঢ়তার সাথে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত, নফল ও মুসতাহাব সব আমল যত্নের সাথে প্রতিপালন করতে হবে।

দুই: মা বাবা, ভাই বোন, স্ত্রী/ স্বামী সন্তান, পাড়া প্রতিবেশী তথা গোটা মানব জাতির কোথায় কার হক কিভাবে নষ্ট করেছি তা খুঁজে বের করে তাদের হক আদায় করে নিতে হবে। অপারগতায় তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজেকে দায়মুক্ত করে নিতে হবে।

তিন: যে কয়দিন বেঁচে আছি লেনদেন, আচার ব্যবহার, কথাবার্তা দ্বারা আপন পর কোন মানুষের হক নষ্ট করবো না মর্মে দৃঢ প্রতিজ্ঞ হতে হবে।

চার: যে কয়দিন বাঁচি মানবজাতির কল্যাণে যথাসাধ্য নিজের মেধা ও শ্রম ব্যয় করতে মনস্থির করে নিতে হবে।

পাঁচ: পরিবারের সবাই বার বার একত্রে বসে সার্বিক অবস্থা নিয়ে মত বিনিময় করতে হবে। একেঅন্যে সাহস যোগাতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে কোন বিপর্যয়ে ঠিকে থাকার প্রধান অবলম্বন মানসিক শক্তি।

ছয়: আগতপ্রায় দুর্ভিক্ষ নিয়ে এখনই সাধ্যমত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

সাত: পরিবারের সবাই মিলে খাদ্য সাশ্রয়ে মনযোগি হতে হবে। চেষ্টা করতে হবে এক সপ্তাহের খাদ্য সামগ্রি দিয়ে কমপক্ষে তিন সপ্তাহ চালিয়ে নেয়া।

আট: অনাগত দিনের ভয়াবহ বিপর্যয় সম্পর্কে বাচ্চাদের সতর্ক করতে উপযুক্ত উপায় অবলম্বন করি।

নয়: বাচ্চাদের খাদ্যাভ্যাসে দ্রুত পরিবর্তন আনতে হবে। যাতে খাদ্য সংকটকালে তারা সহজে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে পারে।

দশ: পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন কেউ খাদ্য সংকটে পড়লে নিজের সাধ্যমত তাদের পাশে দাঁড়াতে মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।

সর্বাবস্থায় বিশ্বাস রাখতে হবে, মহামারি ও দুর্ভিক্ষ বা যেকোন ধরণের বিপর্যয় মুমিন মুসলমানের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন-

وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ * الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ
 অর্থাৎ আর অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো কিছুটা ভয় ভীতি, ক্ষুধা, সম্পদ ও প্রাণের ক্ষতি এবং ফল ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে।তবে সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলদের, যারা কোন বিপদে নিপতিত হলে বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য আর আমরা অবশ্যই তাঁর কাছেই ফিরে যাবো। (সুরা আল বাকারাহ, আয়াত ১৫৫-১৫৬)


সুতরাং একমাত্র আল্লাহর সাহায্য ব্যতিরেকে এসব থেকে উত্তরণের কোন উপায় নেই। তাই আমাদেরকে আল্লাহর পথে ফিরে আসতে হবে। কায়মনোবাক্যে তাঁর আশ্রয় ও সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে।

লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও গবেষক


শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here