।। অবদুল্লাহ আল মনসুর।।
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য। দান সাদকা একটি
গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। এতে রয়েছে ইহ-পরকালীন অসংখ্য উপকারিতা। মানুষ কিয়ামতের বিভীষিকাময়
পরিস্থিতি দেখে আফসোস করে বলবে হে আল্লাহ! আমাকে আরো একটা বার দুনিয়াতে পাঠান। আমি
সেখানে গিয়ে ‘সাদাকা করবো, আর ভালো
মানুষদের সঙ্গী হয়ে যাবে।
কারণ, মানুষ
তখন দান যে কত বড় উপকারী বস্তু তা স্বচক্ষে দেখবে। দান করলে নিজেরই লাভ। আর না করলে
নিজেরই ক্ষতি। প্রকৃতপক্ষে মানুষ যা দান করে, তাই বহাল
তাকে। মানুষের প্রতিটি দান জমা হয় আখেরাতের জন্য। মানুষের মনের চতুর্দিকে একটা
বাঁধন থাকে। দান করতে করতে সে স্বাধীন হয়। কিয়ামতের দিন মানুষ তার দানের ছায়ার নীচে
থাকবে।
অতএব দান
করুন মন খুলে। প্রতিদিন দান করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। সামান্য হলেও দান করুন। আল্লাহ
তায়াালা মানুষের অন্তর দেখেন। বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকেই দান করার অভ্যাস করে তুলুন।
মহাগ্রন্থ আল কোরআন ও হাদিসে দানের উপকারিতা সম্পর্কে অসংখ্য আয়াত ও হাদিস পাওয়া
যায়। নিম্নে দান সাদাকার ফযিলত সম্পর্কে
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কয়েকটি হাদিস দেয়া হলো।
দান
জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন, “একটুকরো খেজুর
দান করে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষা করো।” (সহিহুল
বুখারী, হাদিস নং ১৩২৮)
দানকারী নগদ
প্রতিদান পায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “প্রতিদিন
আকাশ থেকে দুইজন ফেরেশতা নেমে আসেন। একজন বলেন, হে আল্লাহ ,(আজকের
দিনের) দানকারীকে তার প্রতিদান দাও। আর অপরজন বলে হে আল্লাহ, কৃপণ লোককে
শীঘ্রই ধংস করো।” (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ১৩৫১)
দান করলে, আল্লাহও দান
করবেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “মহান আল্লাহ
বলেছেন, হে আদম সন্তান! তুমি খরচ করো, তাহলে তোমার
প্রতিও খরচ করা হবে।” (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ৪৯৩৩)
দান
সর্বোত্তম আমল। “কোনো এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে
বললো, ইসলামের কোন আমলটি সর্বেত্তম? তিনি
(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, কাউকে খাবার
খাওয়ানো ও পরিচিত অপরিচিত সবাইকে সালাম দেয়া। ” (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ১১)
দানকারীর
হাত উত্তম হাত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “হে আদম
সন্তান! তুমি যদি তোমার প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ খরচ করো তাহলে সেটা তোমার জন্য
কল্যাণকর। আর যদি তা ধরে রাখো, তাহলে সেটা তোমার জন্য
অনিষ্টকর। তোমার জন্য যে পরিমাণ সম্পদ যথেষ্ট তা ধরে রাখাতে তোমার জন্য কোনো
তিরষ্কার নেই। আর দান শুরু করবে তোমার নিকটাত্মীয়দের থেকে। উপরের হাত নীচের হাতের
চেয়ে উত্তম।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৪৩৫)
দানে সম্পদ
বাড়বেই বাড়বে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “সাদাকাহ
করলে সম্পদ কমেনা।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৬৭৫৭)
হালাল রুজির
সামান্য দানও বিরাট হয়ে যায়। যে ব্যক্তি তার হালার উপর্যন থেকে একটি খেজুরের মূল্য
পরিমাণ দান করে- বলা বাহুল্য মহান আল্লাহ হালাল বস্তু ছাড়া কিছুই গ্রহণ করেননা। আল্লাহ
তার সেই দান ডান হাতে গ্রহণ করেন। অতঃপর সেই দানকে তার দানকারীর জন্য বৃদ্ধি করতে
থাকেন। যেরুপ তোমাদের কেউ তার ঘোড়াকে লালন পালন করতে থাকে। অবশেষে তা একদিন পহাড়
সমতূল্য হয়ে যায়।” (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ১৩২১)
সময় থাকতেই
দান করতে হয়। “একজন লোক এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললো, ইয়া
রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন দান সওয়াবের দিক থেকে বড়? রাসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যখন তুমি
সুস্থ থাকো, সম্পদের প্রতি লোভ থাকে, তুমি
দারিদ্রের ভয় করো এবং ধনী হওয়ার আশা রাখো, সেই সময়ের
দান। সুতরাং তুমি দান করার জন্য মৃত্যু আসার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করবেনা। তখন তো
তুমি বলবে এই সম্পদ অমুকের জন্য, এই সম্পদ অমুকের জন্য, অথচ তখন তো
সম্পদ অমুকের হয়েই গেছে।” (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ১৩৩০)
যেসব ধনীরা
দান করেন না তাদের জন্য ধংস। “বিখ্যাত সাহাবি হযরত আবুযর গিফারি রাদিয়াল্লাহু আনহু
বলেন, একদা আমি রাসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে গেলাম। সে সময় তিনি কাবা ঘরের ছায়ায় বসা
ছিলেন। তিনি আমাকে দেখে বললেন, কাবার রবের কসম! ‘তারাই
ক্ষতিগ্রস্থ’। আমি বললাম তারা কারা? রাসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যাদের সম্পদ
বেশী তারা। তবে ঐ ব্যক্তির কথা ছাড়া। যে এরুপ করে, এরুপ করে।
(অর্থাৎ হাতের তালু ভর্তি করে দান করে ) নিজের সামনের দিক থেকে, বাম দিক
থেকে, ডান দিক থেকে। অবশ্য এমন লোকের
সংখ্যা খুবই কম।” (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ৬১৪৭)
সামান্য
হলেও দান করা। “হে মুসলিম নারীগণ! তোমাদের মধ্যে কোনো প্রতিবেশিনী যেন নিজ
প্রতিবেশীনিকে উট বা ছাগলের একটি খুর দান করাকেও তুচ্ছ মনে না করে। (অর্থাৎ
সামান্য হলেও দান করে।)” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৪৪১)
দানকরীকে
গায়েবী সাহায্য করেন আল্লাহ তায়ালা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন, “একদা এক লোক পানিহীন এক
প্রান্তর দিয়ে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে সে মেঘ থেকে একটি আওয়াজ শুনতে পেল। ‘অমুক
ব্যক্তির বাগানে পানি বর্ষণ করো’। এটা শুনে মেঘ খন্ডটি একদিকে
এগিয়েয়ে গেল। এবং পাথরময় ভুখন্ডে
পানি বর্ষণ করতে লাগলো। আর পানি ছোট ছোট নালাসমূহ থেকে বড় একটি নালার দিকে অগ্রসর
হলো। এমনকি পুরো বাগানকে বেষ্টন করে ফেললো। লোকটি সেই
পানির পিছনে পিছনে যেতে লাগলো। এমন সময় সে দেখতে পেল, এক ব্যক্তি
তার বাগানে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার বেলচা দিয়ে এদিক সেদিক পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। সে ঐ
ব্যক্তিকে বললো, হে আল্লাহর বান্দা আপনার নাম
কী? সে বললো, আমার নাম
অমুক। অর্থাৎ ঐ নামই বললো যা সে মেঘে থেকে শুনতে পেয়েছিল। বাগানের মালিক বললো, হে আল্লাহর
বান্দা আমার নাম তুমি কেন জানতে চাইছো? যে মেঘ থেকে
এ পানি বর্ষিত হয়েছে তা থেকে আমি তোমার নাম শুনতে পেয়েছিলাম। ঐ আওয়াজ ছিল এই যে ‘অমুকের
বাগানে গিয়ে পানি বর্ষণ করো’। আপনার নামই তাতে বলা হয়েছিল।
আচ্ছা আপনি এ বাগানে এমন কী আমল করেছেন? (যার কারণে
মেঘ থেকে আপনার বলা হলো) সে বললো, আপনি যেহেতু জানতে চাচ্ছেন, তাহলে
শুনুন। এ বাগান থেকে যা কিছু উৎপন্ন হয়, আমি তার
তত্ত্বাবধান করি। উৎপাদিত দ্রব্যের এক তৃতীয়াংশ দান করে দেই। আরেক তৃতীযাংশ আমি ও
আমার পরিবার খেয়ে থাকি। আর এক তৃতীয়াংশ পুণরায় এতে লাগিয়ে দেই “ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৭৬৬৪)
প্রকৃতপক্ষে
যা খরচ হয় তাই বাকি থাকে। একবার রাসুলুল্লাাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর
পরিবারে একটি বকরী জবাই করা হলো। (এবং তা থেকে মুসাফির মেহমানদের খাওয়ানো হলো)
অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রী আয়েশা রাদিয়াল্লাহ
আনহাকে বললেন: বকরীর কতটুকু অংশ বাকি আছে? তিনি জবাবে
বললেন, একটি বাহু ছাড়া আর কিছুই বাকি
নেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (প্রকৃতপক্ষে)
এর সবই অবশিষ্ট আছে শুধু এই বাহু ছাড়া। (তিরমিযি, হাদিস নং ২৪৭০ শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন হাদিসটি সহিহ)
মুমিনের
ছায়া হবে তার দান সাদাকাহ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “কিয়ামতের দিন মুমিনের ছায়া হবে
তার দান সাদাকাহ।” (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১৮০৪৩ শায়খ
আলবানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন হাদিসটি সহিহ)
পরিবারে খরচ
করাও এক প্রকারের সাদাকাহ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যখন কোনো
মুসলিম সওয়াবের আশায় তার পরিবারের প্রতি খরচ করে, তখন সেটাও
সাদাকাহ হিসেবে গণ্য হয়।” (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ৪৯৩২)
আল্লাহ আমাদেরকে দান সাদকা করে তার রেজামন্দি হাসিল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
লেখকঃ শিক্ষক
ও প্রাবন্ধিক
তাকমিল ফিল হাদিস, (মাস্টার্স
সমমান)
জামেয়া
মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজির বাজার, সিলেট।
অনার্স
(হাদিস), সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা।
(ইসলামী
বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।)
শিক্ষক, শাহজালাল
জামেয়া ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা পাঠানটুলা, সিলেট।
ইনচার্জ, কোরানিক
গার্ডেন, মিরবক্সটুলা, সিলেট।
মেবাইল : ০১৭৪১৫৮৫০৪০
ইমেইল: abmonsur111@gmail.com
0 coment rios:
You can comment here