‘যেথা আছে ডোবা-নালা যেথা আছে কর্দম,/
মশাদের ছানাপোনা খেলে সেথা হরদম।’
মশা এক প্রকারের ছোট্ট মাছি প্রজাতির রক্তপায়ী পতঙ্গ। এটি চিকুনগুনিয়া
ম্যালেরিয়া, মস্তিষ্ক প্রদাহ, গোদ, পীত, ডেঙ্গু ও হলুদ জ¦র ভাইরাস ঘটিত এনসেফালিটিস ও
কতিপয় চর্মরোগসহ বহু রোগ জীবাণুর বাহক।
গঠনগত
দিক থেকে মশার সৃষ্টি অন্য যেকোনো প্রাণী থেকে অনন্য এমনকি অন্যান্য উড়ন্ত পতঙ্গ
থেকেও অনেকগুলো কারণে ভিন্ন। আমাদের ধারণা যে, মশা বেঁচে থাকার জন্য আমাদের রক্ত খায় আসলে রক্ত মশার খাবার নয়। তারা
বিভিন্ন ফল-মূল থেকে বেঁচে থাকার জন্যে রস খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। রক্ত শুধু
নারী মশাদের ডিম পাড়ার জন্য প্রয়োজন হয় এবং এটি তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচিয়ে
রাখার প্রয়াস মাত্র। কিন্তু এ রক্ত সংগ্রহ করার সময় তাদের দ্বারা বাহ্যিক বিভিন্ন
রকমের জীবাণু আমাদের শরীরে প্রবেশ করে ফলে আমাদের বিভিন্ন রকম অসুখ হয়।
মশা
নিয়ে রয়েছে গবেষকদের গবেষণা, কবিদের কবিতা, ছাড়াকারদের ছড়া। এছাড়া অগণিত নাট্যকারদের অসংখ্য নাটকে উচ্চারিত হয়েছে এ
শত্রুর কথা। এ মশা বর্তমান সময়ের একটি আলোচিত প্রসঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব কর্তাব্যক্তিদের
বক্তব্য-বিবৃতি থেকে বেরিয়ে আসছে মশার প্রাদুর্ভাব সংক্রান্ত বিষয়ে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার
কথা। আর নেয়া হচ্ছে মশা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উদ্যোগ।
খ্রিষ্টের
জন্মের ২৭০০ বছর আগে চাইনিজরা মশাকে চিনত। গ্রীক বীরেরা বারবার পরাজিত হয়েছে এ পতঙ্গের
কাছে। এমনকি রোমান সা¤্রাজ্যের পতনের ও নমরুদের ধ্বংশের কারণও ছিল এ অতি ক্ষুদ্রকায় পতঙ্গ।
মুসলিম
জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর সময়ের রাজা নমরুদ নিজেকে সৃষ্টিকর্তা, জন্ম-মৃত্যু, খাদ্যের জোগান দাতা এবং সকল
ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে দাবি করত। সেই নমরুদের সেনাবাহিনীকে শেষ করে দেয়া
হয়েছিল অসংখ্য মশা দ্বারা। আর ছোট্ট এই মশা প্রবেশ করেছিল নমরুদের নাকের মধ্যে।
শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছিল সৃষ্টিকর্তা দাবিদার এই পাপিষ্ঠের একটি মশার কারণে।
মানুষ
যখন আল্লাহর চরম অবাধ্য হয়ে যায় তখন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য
বিভিন্ন ধরণের শাস্তি দিয়ে থাকেন। মশার প্রাদুর্ভাবজনিত ব্যাপক রোগ ব্যাধি আল্লাহর
পক্ষ থেকে যেমন আমাদের পরীক্ষা করার নিমিত্তে হতে পারে, তেমনি আমাদের পাপের শাস্তিও হতে পারে। নমরুদের বেলয়াও তাই হয়েছিল।
মশা
সৃষ্টির মধ্যে মানুষের জন্য নিদর্শন রয়েছে। এ রকম নিদর্শন মানুষের জন্য যেমন সঠিক
পথের দিশা হতে পারে তেমনি অবিশ্বাসী ও অসৎ লোকদেরকে বিপথগামীও করতে পারে। কিন্তু
অসৎ বা অবিশ্বাসীরা বুঝতে পারেনা।
মশার
কথা আল্লাহ কেন কুরআনে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তার কিছু অন্তনির্হিত কারণ
বুঝতে আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের সহায়তা করছে। মশার আচরণ, প্রকৃতি ও গঠনগত দিক থেকে বেশ কিছু তথ্য তারা আবিষ্কার করেছে যা সত্যি সচেতন
যে কাউকে ভাবনায় ফেলে দেবে ।
গোটা
পৃথিবীতে বিদ্যমান তিন সহ¯্রাধিক মশা প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ১১৩ প্রজাতির মশা শনাক্ত হয়েছে।
একটি মশার ওজন হতে পারে ২.৫ মিলিগ্রাম। এটি উড়ার গতিবেগ হলো ঘন্টায় ১ থেকে ১.৫
মাইল। এটির ৪৭ খানা দাঁত ও এক শ’রও বেশি ডানা আছে। একটি মশার ৩টি হার্ট, নাকে ছয়টি পৃথক ছুরি ও তার শরীরে রয়েছে এক্সরে মেশিন, যা দ্বারা রাতের আঁধারে মানুষের
চামড়াকে শনাক্ত করে। এটি সেকেন্ডে ৩০০-৬০০ বার ডানা ঝাপটাতে পারে।
একটি
মশা ১০০-৩০০ ডিম পাড়ে। এটি মূলত বদ্ধ জলাশয়ে কিংবা স্যাঁতস্যাঁতে স্থানে ডিম পাড়ে।
বাড়িতে কোনো জায়গায় অল্প পরিমাণে পানি দীর্ঘদিন যাবত জমে থাকলে সেটা হয়ে উঠতে পারে
মশার জন্য ডিম পাড়ার উত্তম স্থান। ডিম থেকে বের হওয়ার প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যেই
মশা পূর্ণ বয়স্ক মশার মত আচরণ করতে শুরু করে। মশার আয়ুকাল প্রজাতিভেদে ৫ থেকে ৬
মাস পর্যন্ত হয়ে থাকে। পুরুষের চেয়ে নারী মশারা বেশি দিন বাঁচে। পূর্ণিমার সময়ে
মশা প্রায় ৫০০ গুণ বেশি কামড়ায়। বিশ^ব্যাপী মানুষের মৃত্যুর জন্য সকল প্রাণীর মধ্যে মশাই বেশি দায়ী।
মশা
যে কামড়ায়, মশা যে শুধু দংশন করে এবং
বহু রোগ জীবাণুর বাহক হিসেবে কাজ করে তা নয়, বরং মশা অনেক ছোট ছোট মাছের খাদ্যও বটে! প্রকৃতিতে দেখা যায় যে, একটি ছোট্ট প্রাণীকে একটি বড়
প্রাণী খাচ্ছে, সেই প্রাণীকে তার চেয়ে বড় প্রাণী খাচ্ছে এবং আরও বেশি বড় প্রাণী এই বড় প্রাণীকে
খাচ্ছে। প্রকৃতিতে এই প্রক্রিয়া সর্বত্র বিরাজমান এবং এই প্রক্রিয়া প্রকৃতির
ভারসাম্য রক্ষায় একটি শক্তিশালী সূত্র।
প্রকৃতিতে
প্রায় তিন কোটি প্রাণীর মধ্যে যদি কোনো একটি প্রাণী মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীর
জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায় তাহলে আমরা তাকে সমূলে ধ্বংস করতে পারি না। কারণ, এই প্রাণী আল্লাহ বিনা কারণে
সৃষ্টি করেননি। এই প্রাণীর এমন কিছু কার্যক্রম আছে যা প্রকৃতির জন্য কল্যাণকর।
আমরা যা করতে পারি তা হলো বিশেষ পর্যায়ে এই প্রাণীর নিয়ন্ত্রনে বিজ্ঞান সম্মত
বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি।
প্রাণী
জগতে মানুষের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ট সম্পর্ক মশার। সে সম্পর্ক আর্থিক নয়, দৈহিক। মশার সঙ্গে মানুষের
সম্পর্ক রক্তের। মশা মানুষের রক্ত সম্পর্কের শত্রু। শত্রুকে ঘৃনা করা যায় কিন্তু
অবহেলা করা সম্ভব নয়। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে মশাই এখন আলোচনার বিষয় হয়ে
দাঁড়িয়েছে। তাই এ বিষয়ে করণীয় ও বর্জনীয় কী তা নিয়ে মানুষ ভাবতে শুরু করেছে।
মশার
প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি হয় মূলত অপরিচ্ছন্নতার কারণে। ইসলামে পরিচ্ছন্নতাকে ‘ঈমানের অঙ্গ’ করা হয়েছে। কাজেই মানুষ এবং
স্বীয় পরিবেশ যদি অপরিষ্কার ও অপরিচ্ছন্ন থাকে, তবে মশা-মাছির মতো আরো বহু দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বস্তুর উৎপাত তাদের জীবনকে
বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে।
মশার
প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে সকল ধরণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি মহান
আল্লাহর কাছে তাঁর রহমত ও করুণা চাইতে হবে। চিরক্ষমতাশালী আল্লাহর কাছেই স্বীয়
জীবনের সুস্থতা ও নিরাপত্তার জন্য বিশ^নবীর শেখানো ভাষায় দোয়া করতে হবে। তাঁর ভাষায়-
أعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ
অর্থ: আমি
আল্লাহ তাআলার পরিপূর্ণ বাক্যাবলীর মাধ্যমে তাঁর সৃষ্টির সকল অনিষ্টতা থেকে আশ্রয়
নিচ্ছি। (মুসলিম, তিরমিজী, আহমাদ)
অন্য
বর্ণনায় এসেছে, এক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এসে বলল, গত রাতে আমাকে একটি বিচ্ছুতে
দংশন করেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, আমি কি তোমাকে বলিনি যখন সন্ধ্যা
হবে তখন তুমি বলবে, আউজু বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি মিন শাররি মা খালাকা। তাহলে তোমাকে কোন
কিছু ক্ষতি করতে পারত না। (মুসলিম, হাদীস নং ২৭০৯)
আল্লাহ
আমাদেরকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখুন এবং এ দুনিয়ায় তাঁর দেখানো পথে চলার তাওফীক দান
করুন। আমিন।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক,
শিক্ষক, জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক
স্কুল এন্ড কলেজ,
জালালাবাদ
সেনানিসবাস, সিলেট।
মোবাইল:
01712374650
ইমেইল: zubairjcpsc@gmail.com
0 coment rios:
You can comment here