।। মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম।।
সারা পৃথিবী যখন অবরুদ্ধ তথা লকডাউনের কবলে পড়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা
স্থবির হয়ে আছে, কর্মজীবী মানুষগুলো কর্মহীন হয়ে পড়েছে, দিনমজুর তার
নিত্য দিনের আহার সংগ্রহ করতে না পেরে হা-ভাতে দিনাতিপাত করছে, ঠিক সেই কঠিন
মুহূর্তেও একদল দেশপ্রেমিক দূর দেশে বসে বারবার দেশের কথা ভাবছে, দেশের মানুষের
কথা ভেবে প্রতিক্ষণেই তাঁদের মন বেদনায় হু হু করে কাঁদছে।
বলছিলাম দেশান্তরী একদল অভাগার কথা। আমাদের সুখী রাখতে জীবন
বাজি রাখা একদল যোদ্ধার কথা। লাখো পরিবার বেঁচে থাকার মাধ্যম একদল প্রবাসীর কথা। যাঁদের
নিয়ে আমরা নানা কথা শুনি। কত ঘৃণা, কত কটূক্তি তাঁদের পিছনে লেগে
থাকে তা বলাই বাহুল্য। এমনও কিছু নাদান বান্দা আছে যারা প্রবাসীদের হেয় করে দু-চার
কথা বলতে পারলে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। এমনকী অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গও আছেন যাঁরা
প্রবাসীদের তুচ্ছজ্ঞান করে সম্বোধন করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। এমন মানসিকতা যাদের আছে
আমি তাদের সুস্থ সবল মানুষ বলতে নারাজ। হয় তারা মানসিক বিকারগ্রস্ত, আর না হয় হিংসায়
জ্বলেপুড়ে যাওয়া একদল নাদান।
প্রবাসীদের নিয়ে কেউ যখন নেতিবাচক কিছু লিখে বা কটূ কথা বলে
তখন প্রবাসীদের মতো আমারও কষ্ট হয়, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। বলবেন
ভাই আপনার এত লাগার কারণ কী? আমার লাগার যথেষ্ট কারণ আছে ভাই। আমি প্রবাসী নই; কিন্তু প্রবাসী
পরিবারের একজন সদস্য। কত সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার
সসমারোহে জীবনের শত যন্ত্রণার যাঁতাকলে পৃষ্ট হতে দেখেছি অনেক প্রবাসীর বুক ভরা স্বপ্ন।
সবকিছুর পরেও এই প্রবাসীরাই আমাদের দেশের সম্পদ, রেমিটেন্স যোদ্ধা, আমাদের অহঙ্কার
ও আমাদের গৌরবের প্রতীক।
যখন কেউ প্রবাসীদের নিয়ে তাচ্ছিল্যপূর্ণ
কথা বলেন তখন আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয় বিশ্বব্যাপী লকডাউনের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে কতজন
সরকারি চাকরিজীবী বা প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ নিজ দায়িত্বে অসহায়দের আর্তনাদের অংশীদার
হয়েছেন? কতজন তাদের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়েছেন? কতজন নিজের
এক মাসের বেতন অসহায়দের তরে বিসর্জন দিয়েছেন? সারা দেশ খুঁজলে এমন মহামানবের
সংখ্যা যে নিতান্তই নগণ্য হবে তা বলাই বাহুল্য।
সরকারি ত্রাণের চাউল, ডাল, তেল যখন আত্মসাৎকারীরা
ক্ষমতার দাপটে কিংবা পারিবারিক নৈতিকতার অভাবে আত্মসাত করছে। একটা গ্রাম কিংবা মহল্লায়
চার থেকে পাঁচজন সরকারি ত্রাণ পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করলেও অসংখ্য অসহায় এবং নিম্নবিত্ত
শ্রেণীর মানুষ যখন রুটি-রুজির তাড়নায় দিক্বিদিক ছুটছে, মধ্যবিত্তরা
যখন লোক লজ্জার ভয়ে একবেলা কম খেয়ে মুখ বুজে বসে আছে ঠিক তখনই লকডাউনের কঠিন মুহূর্তে
অবরুদ্ধ থেকেও নিজেদের ভবিষ্যৎ না ভেবে তিল তিল করে জমানো অর্থ খরচ করে নির্জনে নির্বিঘ্নে
পাড়া-প্রতিবেশী এবং দেশের মানুষের পাশে কত প্রবাসীকে দাঁড়াতে দেখেছি।
করোনায় ইতালির অবস্থা নিশ্চয়ই জানেন, তাই না? এই তো ক'দিন আগের কথা।
ইতালিতে যখন করোনা তার ভয়ঙ্কর রুপ ধারণ করেছিল, সর্বক্ষণ প্রাণনাশের
ভয় নিয়ে ঘরবন্দি ছিল জনগণ। প্রতিদিন আট'শ-নয়'শ লোকের মৃত্যু
সংবাদ শুনতে হয়েছিল, ঠিক সেই সময়েও একজন ইতালি প্রবাসী নিজের কথা না ভেবে দেশের
প্রতিবেশীর জন্য চিন্তা করেছেন। ত্রাণের অর্থ পাঠিয়েছেন এবং একেবারে নির্জনে তাদের
হাতে তুলে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
সৌদি আরবের প্রবাসীরা তো এমনিতেই বিপদে ছিলেন। একে তো রুজি কম, তার উপর ঘুমিয়ে
খাওয়া। তাঁদের যে অঢেল অর্থ জমা ছিল তা কিন্তু না। তবুও দেশের প্রতিবেশী অনাহারে অর্ধাহারে
থাকবে তা-তো মেনে নেয়া যায় না। কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিজের কথা ভুলে গেলেন। পাঠিয়ে
দিলেন ত্রাণের অর্থ। বলে দিলেন রক্ষা করতে হবে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা।
ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা জানতে পারছি ও দেখতে পারছি যে, অসংখ্য প্রবাসী স্বদেশের প্রেমে নাড়ীর টানে দেশের এ কঠিন মুহূর্তে অসহায়দের সহায়তার জন্য আগ্রহ নিয়ে
এগিয়ে আসছেন। আমার আশা ও প্রাণের দাবী আমার দেশের প্রথম শ্রেণীর যে সকল সরকারি কর্মজীবী আছেন যারা
মাস শেষে চল্লিশ থেকে লক্ষ টাকা বেতন উঠাচ্ছেন তাঁরাও এগিয়ে আসবেন ও অসহায়দের পাশে দাঁড়াবেন। ফুটাবেন সহায় সম্বলহীন নিঃস্ব শ্রমজীবী মানুষের মুখে হাসি।
এত একাকীত্ব, এত ত্যাগ, এত দুঃখ, এত কষ্ট, এত যন্ত্রণা
সহ্য করার পরেও যাঁরা দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে তাঁদের তাচ্ছিল্য করার অধিকার কারো নেই, একটুও নেই।
প্রবাসীরা বিদেশের মাটিতে দিনরাত কষ্ট করে একটু সুখের আশায়, পরিবারকে সুখে
রাখার আশায়। এটা কি তাঁদের অপরাধ?
মানুষকে সুখে রাখা, দেশের জনগণকে কর্মসংস্থান তৈরি
করে দেয়া সে তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্রের পাশাপাশি আজ যখন জনগণকে সুখে রাখার জন্য প্রবাসীরাও বিভিন্নভাবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসছে। সেটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নাই। তাই নিজ দেশের কাছ থেকে তাঁরা
যেমন অভ্যর্থনা পাওয়ার দাবী রাখে সাথে দাবী রাখে দেশও তাদের জন্য ভাববে।তাদের মূল্যায়ন করবে। সবকিছুর পরও যখন প্রবাসীর সাথে ঘটে যায় অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটনা তখন আমি বলি দেশীয়
দেশপ্রেমিকের চেয়ে প্রবাসী দেশপ্রেমিকের মূল্য আমার কাছে অন্তত অনেক বেশি।
লেখকঃ
মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম,
অনার্স, মাস্টার্স
আল-হাদীস বিভাগ,
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
মোবাইল: 01712-353643
ইমেইল: shofiq.islam.99@gmail.com
0 coment rios:
You can comment here