Saturday, April 25, 2020

রমজান মাসের আগমন উপলক্ষে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর প্রদত্ত ভাষণের বাংলা রূপ


।। প্রফেসর ড. মোস্তাক আলী।।

হে মানুষগণ!
নিশ্চয় তোমরা অবগত আছ যে, বরকত, রহমত আর ক্ষমার বার্তা নিয়ে আল্লাহর এই (রমজান) মাস সমাগত। এ মাসটি আল্লাহর কাছে অন্য সকল মাসের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর। এ মাসের দিবসসমূহও সর্বাপেক্ষা উত্তম। এ মাসের রজনীগুলোও তাবৎ রজনীর চেয়ে মহত্তর। এ মাসের প্রতিটি ক্ষণ-ঘন্টা অন্য ক্ষণ-ঘন্টার চেয়ে উৎকর্ষবাহী। এ মাসে তোমাদেরকে আল্লাহর মেহমাদারিত্ব গ্রহণের দাওয়াত করা হয়েছে। এ মাসে তোমাদেরকে আল্লাহর একান্ত অনুগ্রহ ও বদান্যতা প্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।

তাই এ মাসে তোমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসে তাছবিহ করার ফজিলত দেয়া হবে, তোমাদের ঘুমকেও এবাদাতের অন্তর্গত করা হবে, তোমাদের সকল প্রকার আমল কবুল করা হবে এবং তোমাদের সকল দুআ-প্রার্থনা পূর্ণ করা হবে। সুতরাং তোমরা বিশুদ্ধ নিয়্যাত ও নিষ্কলুষ অন্তরযোগে আল্লাহর কাছে এ আর্জি পেশ কর যেন তিনি তোমাদেরকে যথাযথভাবে এ মাসের রোজা আদায় ও তার কিতাব তেলাওয়াতের তাওফিক্ব দেন।

তোমরা জেনে রাখ, যে মানুষ এ মহান মাসে আল্লাহর ক্ষমাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হলো সে-ই প্রকৃত অসুখী। তোমরা এ মাসে যে ক্ষুধা ও তৃঞ্চা অনুভব করবে তার মধ্য দিয়ে ক্বিয়ামত দিবসের (অন্তহীন) ক্ষুধা ও (অসহনীয়) তৃঞ্চার কথা স্মরন করবে।
হে মানুষগণ!
তোমরা তোমাদের ফকীর ও মিসকীনদের তরে সাদাকা কর, তোমাদের বয়োজেষ্ঠ্যদের সম্মান কর, ছোটদের করুনা কর, আত্মীয়তার সম্পর্ক জোড়া লাগাও, জিহবার হেফাজাত কর, হারাম-দৃষ্টি দেয়া থেকে নিজেদের চোখ সংবরণ কর এবং শুনতে মানা-এমন কিছু শ্রবণ করা থেকে বিরত থাক।

(বর্তমান) এতিমদের প্রতি মমত্ব প্রদর্শন কর, বিনিময়ে (ভবিষ্যতে) তোমাদের এতিমরাও মমতা-প্রাপ্ত হবে। তোমরা স্বীয় গোনাহের জন্য তাওবা কর এবং প্রত্যেক নামাজান্তে উপরের পানে হাত উত্তোলন কর। কেননা নামাজান্তের সময়গুলো এর জন্য শ্রেষ্ঠতম সময়। এসময়গুলোতে আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি করুনার দৃষ্টি প্রসারিত করেন। আল্লাহ তার বান্দাদের কথার উত্তর দেন, তাদের চাওয়া-চাহিদা পূরণ করেন এবং ডাকলে সাড়া দেন।

হে মানুষগণ!
জেনে রাখ তোমাদের আমলের উপর তোমাদের নফসের (শুভ-অশুভ) পরিণতি নির্ভরশীল। এ জন্য ইসতেগফারের মাধ্যমে স্বীয় নফসের মুক্তি সাধন কর। জেনে রাখ দুষ্কর্মের ভারে তোমাদের পৃষ্ঠদেশ যখন ভারাক্রান্ত, তখন তা প্রলম্বিত সেজদাহর মাধ্যমে হালকা করে নেবে।
তোমরা জেনে রাখ যে আল্লাহ তাঁর ইজ্জতের কসম করে নামাজী ও সেজদাকারীদের শাস্তি দেবেন না মর্মে অঙ্গীকার করেছেন। এ-ও অঙ্গীকার করেছেন যে ক্বিয়ামতের ময়দানে বিশ্ব-প্রতিপালক স্বীয় প্রভুর সামনে যখন সকল মানুষ দাড়াবে, তখন তিনি নামাজী ও সেজদাকারীদেরকে আগুনের স্পর্শ-ভয়ও দেখাবেন না।

 হে মানুষগণ!
এ মাসে তোমাদের কেউ যদি একজন রোজাদারকে ইফতার করায়, তবে সে আল্লাহর কাছে একজন দাস মুক্ত করার সমপরিমান সওয়াব পাবে এবং তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ মাফ হয়ে যাবে। তখন সাহাবায়ে কেরাম রাসুল (সা.) কে জিজ্ঞাসা করে বলেন: হে আল্লাহর রাসুল আমাদের মধ্যে যাদের এরূপ সাদকা করার সক্ষমতা নেই তারা কি করবে? তখন উত্তরে রাসুল (সা.) বলেন: তোমরা খেজুরের কিয়দাংশ দান অথবা এক ঢোক পানি পান করিয়ে হলেও আগুন থেকে আত্মরক্ষা কর।

 হে মানুষগণ!
এ মাসে তোমাদের মধ্যে যে নিজ চরিত্র উন্নত করবে সে পুল-সিরাতে যখন মানুষের পা পিছলে পড়তে থাকবে, তখন নিজেকে ঐ চরিত্রের বদৌলতে পার করে নিতে পারবে।

এ মাসে যে ব্যক্তি তার অধীনস্থদের কর্মভার লগু করবে আল্লাহ তার আমলের হিসাব হালকা করে নিবেন। এ মাসে যে ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি বা অনিষ্ঠ করার মানুষিকতা অবধমিত করবে, বিনিময়ে ক্বিয়ামত দিবসে আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন না। এ মাসে যে ব্যক্তি কোনো এক অনাথের করুনা করবে, আল্লাহর সাক্ষাত দিবসে তার প্রতি করুনা প্রদর্শন করা হবে।

এ মাসে যে মানুষ তার আত্মীয়তার সম্পর্ক পূনঃস্থাপন করল, রোজ ক্বিয়ামতে আল্লাহ তাকে তার রহমতের দ্বারা সম্পৃক্ত করে নেবেন। আর যে ব্যক্তি তার আত্মীয়তা ছিন্ন করল, রোজ ক্বিয়ামতের সাক্ষাতে তাকে আল্লাহ তার রহমত থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন।

এ মাসে যে কেউ একটি নফল নামাজ পড়ে, তখন তার এ নামাজের বিনিময়ে আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম-মুক্তির ফায়সালা করবেন। এ (মহিমান্বিত) মাসে কেবলমাত্র একটি ফরজ আদায় করলে অনান্য মাসের তুলনায় সত্তরটি ফরজ আদায়ের সওয়াব পাওয়া যাবে। আর যে ব্যক্তি আমার উপর বেশী-বেশী দুরুদ পাঠ করবে, ‘আমলনামা হালকা হওয়া আশংকার দিনে' আল্লাহ তাআলা তার আমলনামা ভারী করে দেবেন। এ ছাড়াও এ মাসে কুরআনের একটি আয়াত পরিমান তেলাওয়াতের সওয়াব অন্যান্য মাসে কুরআনের পূর্ণ এক খতম সওয়াবের সমতুল্য।
 হে মানুষগণ!
জেনে রাখ এ মাসে বেহেশতের সকল দরজা খোলা থাকে। সুতরাং এ সব দরজা যেন তোমাদের জন্য রুদ্ধ না হয়ে যায়- এ প্রার্থনা তোমরা তোমাদের রবের কাছে করতে থাক। এ মাসে জাহান্নামের আগুনের দরজা বন্ধ করা হয়। সুতরাং এ সব দরজা যেন তোমাদের জন্য উন্মুক্ত না হয়ে যায়- এ ফরিয়াদ তোমরা তোমাদের রবের কাছে করতে থাক। এ মাসে শয়তানেরা শৃংখলাবদ্ধ থাকে, তাই এ সব শয়তানেরা যেন পূনরায় তোমাদের উপর কর্তৃত্ব করতে না দেয়া হয়- এ আবেদন তোমরা তোমাদের রবের কাছে করতে থাক।

রাসুল (সা.) এর এ ভাষণ শেষে হযরত আলী (রা.) উঠে দাঁড়ালেন এবং রাসুল (সা.) কে বললেন: হে আল্লাহর রাসুল এ মাসের শ্রেষ্ঠতম আমল কি তবে?
জবাবে রাসুল(সা.) বললেন: হে আবুল হাসান এ মাসের শ্রেষ্ঠতম আমল হচ্ছে মহান আল্লাহর তাআলার নিষেধসমূহ থেকে পরহেজ থাকা।

বি.দ্র. রাসুল (সা.) -এর এ ভাষণটির বহুল প্রচার প্রয়োজন। আমরা যদি আমাদের রোজা থেকে বহুকাংখিত আল্লাহর রেজামন্দি লাভ করতে চাই, তাহলে এ ভাষণটিকে রোজ একবার হলেও পড়ে নিয়ে তদুনাযায়ী আমল করতে হবে। প্রকৃত পক্ষে রাসুল (সা.) -এর এ খুতবাটির মধ্যে কেবল রমজানই নয় বরং আমাদের সারাজীবনের পথ-পাথেয় রয়েছে। তাই এটির বহুল প্রচার প্রয়োজন।


ড. মোস্তাক আলী
প্রফেসর
আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।


শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here