Saturday, April 4, 2020

গল্পঃ চেষ্টার ফল


।। আনিছ আহমদ ।। 

মানুষ হলো পৃথিবীর সুন্দরতম ও শ্রেষ্ঠতম এক জাতি। যারা অসাধ্যকে সাধন করতে জানে। মানুষের ইচ্ছা আকাঙ্খা হলো তার মুলমন্ত্র। মানুষ তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চায়। প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার জীবনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হয়। অন্য দশ জনের মত জাহিদও জীবনের স্বীয় লক্ষ্য-উদ্দেশ্যেকে বাস্তবায়ন করতে চায়। মনের ভিতরে লুকানো স্বপ্নকে জাগিয়ে তুলতে চায়। মনের ভিতর লুকায়িত সেই আগুনকে প্রজ্জলিত করতে চায়। 

একটু ইচ্ছাতেই আমরা মানুষের মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলতে পারি। আজ গ্রাম থেকে পাড়া মহল্লা, নগর-বন্দর প্রতিটি স্থানে মানুষ উপেক্ষিত। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এ শ্রেষ্ঠ জীবদের প্রতিভাকে জাগাতে হবে। প্রত্যেক মানুষ জন্মগতভাবে প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। প্রতিভাকে বিকশিত করতে হয় কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এ প্রতিভা থেমে যায় সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে। 

কথায় আছে পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি”। এই প্রতিপ্রাদ্য আমাদের জানান দিচ্ছে যে, বসে থাকা চলবে না, শ্রম, মেধা দিয়ে জয় করতে হবে দেশ-জাতি, ও বিশ্বকে। বিশ্বের বিশিষ্টজনরা যদি অঝো পাড়া গায়ে জন্ম নিয়ে হতে পারেন বিশ্বসেরা, সর্বজন স্বীকৃত ও সম্মানিত তাহলে অন্যজন পারবে না কেন? মনে রাখতে হবে পিছনে বাধা আসবে শত শত। কতজন কত কিছু বলবে! সামনে যারা আগাতে চায় পিছনে তাকানোর সময় তাদের নেই। লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে সামন পানে চলতে থাকলে এক সময় জয় ও সফলতা আসবেই আসবে।
জাহিদ এও বিশ্বাস করে মানুষ জ্ঞানী হয়ে জন্ম গ্রহণ করে না তাকে জ্ঞানী হতে হয়। জীবনের লক্ষ্য নিয়ে চলতে হবে। আর লক্ষ্য হলো- চূড়ান্ত গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর সংক্ষিপ্ত পদক্ষেপ স্তর। যেমন সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদে ওঠার ক্ষেত্রে লক্ষ্য হলো ছাঁদ, ওপরের দিকে সিঁড়ি এক একটি ধাপ হলো উদ্দেশ্যে। উদ্দেশ্যেহীন জীবন খাচায় বন্দি পাখির মতো।

বাস্তবিক ক্ষেত্রে বলতে গেলে শ্রম, মেধা প্রতিভা বিকশিত করতে হলে তাকে সুযোগ করে দিতে হয়। আর সেই সুযোগ পারে একজন সুনাগরিক তৈরী করতে, আর কতে পারে একজন আদর্শ ও নৈতিকতা সম্পন্ন ভবিষ্যৎ কান্ডারী।
প্রত্যেক মানুষ জন্মগ্রহণ করেই সে সবজান্তা হয় না, তাকে আস্তে আস্তে সব জেনে নিতে হয়। তেমনি জাহিদ তাদের মধ্যে একজন। জাহিদের জন্মের পরপরই নেমে আসে এক ক্রান্তিকাল। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে জাহিদের অনেক দায়িত্ব। কারণ জাহিদের পরিবারটি ছিল হত দারিদ্র। একটি দূর্ঘটনাতেই জাহিদ ও তাঁর পরিবারে নেমে আসে এক ভয়াবহ অন্ধকার।

তখন গায়ে তেমন শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়েনি। জাহিদ তখন স্থানীয় স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। স্কুলের মেধাবী ছাত্র হিসেবে ছিল তার বেশ ডাক-নাম। কিন্তু বিভিন্ন সমস্যার কারণে পড়ালেখা সেখানেই স্তব্ধ। পারিবারিক অসচ্ছলতার আর পেটের টানে এক সময় বাধ্য হয়ে জাহিদ সিলেট শহরে পাড়ি জমায়। যেহেতু সে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাতে চায়। সে লক্ষ্যেই গ্রামের এক আত্মীয়া তাঁর পরিচিত সিলেট শহরের নামকরা মোবাইল মার্কেটে জাহিদের চাকুরীর ব্যবস্থা করে দেন।

কিন্তু বিধির বিধান সেখানে বেশি দিন থাকতে পারেনি জাহিদ। তারপর গ্রামের এক শ্রদ্ধেয়া চেষ্টা করে তাকে আবারো আরেকটি চাকুরীর ব্যবস্থা করে দেন। যেহেতু গ্রামের স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সে পড়ালেখা করেছে তাই মোটামুটি বাংলা, ইংরেজি পড়তে পারে। 
পরিশ্রম প্রিয় জাহিদের চাকুরী হয়ে গেল বৃহত্তর সিলেটের প্রাণকেন্দ্র অভিজাত একটি শপিংমলে। শুরু হলো নতুন করে নিজেকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা। এভাবে চলছে জাহিদের সিলেট তথা শহুরে জীবন। প্রতিভাকে চাইলেও লুকিয়ে রাখা যায় না। জাহিদের পড়ুয়া মন চায় শিক্ষার আলো। তাই জাহিদ মনের টানেই অবসরে বই, ম্যাগাজিন, গল্প-কবিতা ইত্যাদি পড়ে।

এক সময় জাহিদ জানতে পারে যে, সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্রে শ্রমজীবি শিশুদের জন্য একটি অবৈতনিক নৈশ বিদ্যালয় রয়েছে। সে চেষ্টা করে সেখানে ভর্তি হবার, কিন্তু প্রথমধাপে বাধা আসে, ভর্তি না হওয়ার জন্য। এভাবে চলে যায় দুই বছর। 

পরবর্তী বছর অনেক কষ্ট করে ভর্তি হয় সরাসরি পঞ্চম শ্রেণিতে। পড়ালেখা চলছেসেই সাথে চাকুরী, রাতে পড়া আর দিনে চাকুরী এভাবে চলছে স্বপ্ন বিভোর জাহিদের শ্রমে ভরা কষ্টের দিনগুলো। বছর শেষে সমাপনি পরীক্ষা। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করল। আলহামদুল্লিাহ বেশ ভালো ফলাফল অর্জন করেছে সে। তাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। 

এভাবেই ৬ষ্ঠ, ৭ম ও অষ্টম শ্রেণির জেএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উক্তির্ণ হয়। আরও উদ্যোগী হওয়ার পিছনে মূল চালিকা হিসেবে কাজ করেছে সরকার কর্তৃক সাধারণ বৃত্তি। কারণ প্রত্যেক শ্রেণিতেই সে ছিল মেধা তালিকায় শীর্ষে । শিক্ষক ও সহপাঠীদের মধ্যমণি। 
পড়ালেখার পাশাপাশি চাকুরী চলছে, যেহেতু পড়ালেখায় উন্নতি, তাই পেশাগত কাজেও উন্নতি হওয়া চাই, তাই এদিকে মনোযোগ দেয় সে। বেশ ভালোই কাটছে তার দিনগুলো। যে জাহিদ কখনো কম্পিউটার কি জিনিস তা জানত না। আজ সে কম্পিউটার চালায়, সে এক আলাদা অনুভুতি। ভাবতেই যেন অবাক লাগে। এভাবেই, পেশাগতভাবে কম্পিউটারের উপর দক্ষতা দিন দিন বাড়তেই থাকে। 

জাহিদ চাকুরী নিয়েছে একটি প্রিন্টিং প্রেস, তথা একটি প্রিন্টিং ফার্ম এ। তাই সে অনুপাতে কাজ করতে হয় অনেক, পরিশ্রম করতে হয় বেশি। জাহিদের নম্র-ভদ্র , অমায়ীক ব্যবহার অভিজ্ঞজনদের মুগ্ধ করে। তাই সবাই তাকে স্নেহ করে, ভালোবাসে, কম্পিউটার কাজ শিখায় উৎসাহী করে তোলে।

কম্পিউটারের উপর যখন জাহিদ কিছুটা দক্ষতা অর্জন করে তখন তার কদর বেড়ে যায়। যেখানে জাহিদের বেতন ছিল তিনশত টাকা সেখানে সামান্য কিছু কাজ শিখার বদৌলতে বেতন হয়ে যায় তিন হাজার টাকা। জাহিদের আর আনন্দের শেষ নাই।

দেখতে দেখতে জেএসসি পরীক্ষায়ও আল্লাহর রহমতে জাহেদ উত্তীর্ণ হয়। বেশ ভালোই চলছে, এসএসসি পরীক্ষা সামনে তাই পড়াশোনায় মনোযোগ বেড়ে গেল বেশি জাহিদের।

সময়ের প্রয়োজনে অনেক কিছু করতে হয়, জানতে হয়। এসএসসি পরীক্ষা চলে এলো, পরীক্ষা চলছে সাথে করে চাকুরীটাও। পরীক্ষা শেষ হলো। জাহিদ ভাবতেই পারছে না যেখানে যার পড়ালেখা স্তব্ধ হওয়ার কথা, আর সেই জাহিদ এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করছে। এ যেন অবাক করার এক বিষয়। এসএসসির ফলাফল বের হলো, আলহামদুল্লিাহ ভালোই হলো ফলাফল।
জাহিদের কাছে মনে হলো, যদি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে সৎ থাকে, তাহলে বিজয়ী হবে আসবে সফলতা। মনে মনে সে ভাবল আজ মহাকাশ জয় করেছে। আনন্দে আর শ্রদ্ধায় মস্তকাবনত শির তার রবের কাছে। 

অন্ধকার পৃথিবী থেকে এসেছে জাহিদ আলোর মশাল প্রজ্জলিত করতে, নিজেকেও আরও শক্ত করলো সে। উচ্চ মাধ্যমিক এ ভর্তি হলো সিলেট শহরের নামকরা কলেজে। ততদিনে  জাহিদের পরিচয় সে একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার। এ যেন তার স্বপ্ন ও চাহিদা পুরণ হওয়ার যুগান্তকারী এক পথ চলা।
কলেজ জীবন চলছে ভালোই, পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা, যা নিজের বাস্তব জীবনে মোকাবেলা করেছে। নিজের অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগিয়ে সমাজে বিদ্যমান সামাজিক সমস্যা নিরসনের জন্য কাজ শুরু করে দেয় জাহিদ। নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে সামাজিক বিভিন্ন সংস্থার সাথে জড়িয়ে পড়ে সে। 

একসময় কলেজ জীবন শেষ হলো। আর বেশ ভালো ফলাফল অর্জনও করলও সে। এখন চিন্তা কোথায় ভর্তি হবে। মনের ইচ্ছা ছিল নামকরা কোনো বিদ্যায়তনে ভালো কোনো বিষয় নিয়ে অনার্স পড়বে, কিন্তু বিধির বিধান সেখানে তা হয়ে ওঠেনি।

এমন এক সময় ঘনিয়ে এলো জাহিদের যেন আর  অর্নাস পড়া হচ্ছে না। নিজেকে নিয়ে হতাশা গ্রস্ত সে। আশার আলো নিয়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজে এ ভর্তি পরীক্ষা দেয়। পরীক্ষা ভালো হলো, ফলাফল আসলো, ভর্তি হওয়ার মত যোগ্যতা অর্জন করল কিন্তু বিধিবাম ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত বিষয়টা মন:পুত হলো না। তাই হতাশা আরও বেড়ে যায় তার। বিশিষ্টজনের পরামর্শে অবশেষে ভর্তি হয় সে।
কিন্তু পরক্ষণেই বাধা আসে সেই চাকুরীর তথা কম্পিউটার ফার্মের কর্তৃপক্ষের। এ পর্যন্ত আসার পিছনে যে চাকুরীটাই নাকি ছিল তার আসল সম্বল। তারা কোনোভাবেই জাহিদের মত একনিষ্ট, কর্তব্যপরয়ন ছেলেকে হাতছাড়া করতে চায় না। জাহিদ তাদের রাজি করাতে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে। 

এক সাথে এতদিন যেখানে হঠাৎ করে চলে যেতে চাইলে যেকেউ মেনে না নেওয়াটাইতো স্বাভাবিক। জাহিদ ভর্তি হওয়ার পরও  দুই মাস সময় কাটায় তাদের সাথে।

এক সময় তাদেরকে বুঝাতে সক্ষম হয় জাহিদ। চলে যায় ঢাকায়। শুরু হয় জাহিদের জীবন যুদ্ধের  আরেক পথ চলা। জাহিদ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। মানুষের মত মানুষ হতে চায়। কাজ করতে চায় দেশের জন্য, সমাজের জন্য, অবহেলিত সমাজের  পিছিয়ে থাকা সাধারণ মানুষের জন্য। জাহিদ এটা বুঝিয়ে দিতে চায় যে, মানুষের মন জয় করতে পারলে, শ্রষ্ঠার করুনা লাভ করতে পারলে আর পরিশ্রম ও স্বপ্ন দেখতে পারলে সেই স্বপ্নই একদিন স্বপ্ন দ্রষ্টাকে পৌঁছে দিবে তার মাকসুদ মানজিল পানে।

লেখকঃ শিক্ষার্থী।
সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা। 
(ঢাকা বিশ্ববিদ্যায় অধিভুক্ত)
ইমেইল: ahmad2013anis@gmail.com
https://www.facebook.com/anissyl173
মোবাইলঃ 01772594173



শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here