।। মুফতি মুহাম্মাদ আকতার আল-হুসাইন।।
রাহমাত, বারাকাত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাহিনা পবিত্র মাহে রামাদ্বানের ফরয রোজা রাখার পাশাপাশি আমাদের আরো কিছু করণীয় রয়েছে যেগুলো কুরআন-সুন্নাহর আলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
রামাদ্বান মাসকে সম্মান করাঃ
আল্লাহ তায়ালার গণনায় বারটি মাসের মধ্যে অন্যতম সম্মানীত
মাস হচ্ছে পবিত্র রামাদ্বান। আর সম্মানী কোনো কিছুকে সম্মান করতেই হয়। এটা ইসলামী
শরীয়তের অন্যতম নীতি। এ বিষয়ে এরশাদে বারী তায়ালা-
﴿ذٰلِکَ - وَمَنۡ یُّعَظِّمۡ شَعَآئِرَ
اللّٰہِ فَاِنَّہَا مِنۡ تَقۡوَی الۡقُلُوۡبِ﴾
অর্থাৎ, "এটাই হল আল্লাহর বিধান, যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে
সম্মান করে, নিঃসন্দেহে তা অন্তরের তাকওয়া থেকেই"। (সূরা হজ্জ, আয়াত:৩২)
সুতরাং এই মাসে যদি কেউ কোনো কারণে রোজা নাও রাখতে পারেন তাহলে সম্মান প্রদর্শন করার জন্য রোজাদারের সামনে না খাওয়া উত্তম। আর বিশেষ করে এই মাসে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকাই হবে তাকওয়ার পরিচয়।
রোজা রাখাঃ
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে রামাদ্বান
মাসের রোজা রাখা। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরয করে দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে পবিত্র
কুরআনে বলা হয়েছে-
یٰۤاَیُّہَا
الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ
مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ﴾
অর্থাৎ, "হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে,
যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা
তাকওয়া অবলম্বন কর"। (সূরা
বাকারা, আয়াত:১৮৩)
রোজার অনেক ফজিলত রয়েছে। হাদিস শরীফের মধ্যে এসেছে রোজার বদলা
আল্লাহ নিজ হাতে দিবেন। এমনকি রোজাদারের জন্য জান্নাতে রাইয়্যান নামক একটি দরজা
আছে যেটা দিয়ে সে জানাতে প্রবেশ করবে। বুখারী শরীফের হাদিসে এসেছে-
﴿حَدَّثَنَا
خَالِدُ بْنُ مَخْلَدٍ حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ بِلَالٍ قَالَ حَدَّثَنِي
أَبُو حَازِمٍ عَنْ سَهْلٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ فِي الْجَنَّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرَّيَّانُ
يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لَا يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ
غَيْرُهُمْ يُقَالُ أَيْنَ الصَّائِمُونَ فَيَقُومُونَ لَا يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ
غَيْرُهُمْ فَإِذَا دَخَلُوا أُغْلِقَ فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ﴾
অর্থাৎ,
"হযরত সাহল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- জান্নাতের রাইয়্যান নামক
একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন রোজা পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তাদের
ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেয়া হবে, রোজা পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তারা
ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে
দেয়া হবে। যাতে করে এ দরজাটি দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে"। (বুখারী, আস সহীহ, খণ্ড-৬, পৃ. ৪৬১, হাদীস নং ১৭৬৩)
মাথা থেকে পা পর্যন্ত
রোজা থাকাঃ
আমরা অনেকেই মনে করি যে, দিনের
বেলায় উপোস করার নাম রোজা। আসলে প্রকৃত পক্ষে শুধু উপোস থাকার নাম রোজা নয়। বরং
উপোস থাকার পাশাপাশি আপনার সমস্ত অঙ্গ প্রতঙ্গের রোজা আছে। যেমন, হাত, চোখ, কান, জবান ও পায়ের রোজা ইত্যাদি। এই সবকিছুকে আপনি খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে
হবে। যেহেতু রোজার অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা। এমনকি রামাদ্বান মাসে দিনের বেলায় অনেক
হালাল কাজও হারাম হয়ে যায়। বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিসে এসেছে-
﴿عن ابى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قال - قال
رسول الله (ﷺ) - قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ
إِلاَّ الصِّيَامَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ
فَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ يَوْمَئِذٍ وَلاَ يَسْخَبْ
فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ﴾
অর্থাৎ, "আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন- মানব সন্তানের প্রতিটি নেক
কাজের সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়। মহান আল্লাহ বলেন, আদম সন্তানের যাবতীয় আমাল তার নিজের জন্য কিন্তু রোজা বিশেষ করে আমার জন্যই
রাখা হয়। আর আমি নিজেই এর প্রতিদান দিব। রোজা পালনকারীর জন্য তা ঢাল স্বরূপ।
সুতরাং যখন তোমাদের কারো রোজার দিন আসে সে যেন ঐ দিন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে এবং
অনর্থক শোরগোল না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে বিবাদ করতে চায়,
সে যেন বলে, আমি একজন রোজাদার"। (বুখারী, আস-সহীহ, খণ্ড-২, পৃ. ৬৭৮; মুসলিম,
আস-সহীহ, খণ্ড-২, পৃ. ৮০৭) বুখারী ও মুসলিম শরীফে আরো এসেছে-
﴿حَدَّثَنَا
آدَمُ بْنُ أَبِي إِيَاسٍ حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي ذِئْبٍ حَدَّثَنَا سَعِيدٌ
الْمَقْبُرِيُّ عَنْ أَبِيهِ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ
رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ
الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ
وَشَرَابَهُ﴾
অর্থাৎ,
"হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে
অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তাঁর এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই"। (বুখারী, আস-সহীহ, খণ্ড-৬, পৃ. ৪৭২,
হাদীস নং ১৭৭০)
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করাঃ
একজন মানুষ ঈমান আনার পর ইসলামী শরীয়তে যে কাজটি তাকে প্রথম
করার নির্দেশ দেয়, সেটা হচ্ছে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়
করা। এই বিষয়ে কুরআন শরীফে সবচেয়ে বেশি বলা হয়েছে। এবং হাদিসের কিতাবে অসংখ্য
হাদিস রয়েছে।
সুতরাং রামাদ্বান মাস যেহেতু একটা সম্মানিত মাস এবং এ মাসে
একটা সাওয়াবের বদলা অন্য মাসের চাইতে সত্তর গুণ বেশি তাই আমরা খুব গুরুত্ব দিয়ে দৈনিক
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার চেষ্টা করব।
সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াত দ্বারা রোজা ফরয করে আল্লাহ
আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন কেন এটা ফরয করেছেন? যেমন
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- (لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ) যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।
সুতরাং এই মাস হচ্ছে মুমিন মাসলমানের তাকওয়া অর্জন করার অন্যতম একটি সুযোগ।
অপচয় না করাঃ
অপচয় না করাঃ
অপচয় ও অপব্যয় একটি খারাপ অভ্যাস ও নিন্দনীয় কাজ। অপচয়ের
সঙ্গে রয়েছে অহংকারের সম্পর্ক। নিজের বাহাদুরি প্রকাশের মনোভাব। অন্যদিকে অপব্যয়ের
সঙ্গে রয়েছে শরিয়তের বিধান লঙ্ঘনের সম্পর্ক। অপচয় ও অপব্যয় মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অবক্ষয় ডেকে আনে। যে কারণে ইসলামে অপচয় ও
অপব্যয় দুটিই নিষিদ্ধ। ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী কোনো কাজ বৈধ হলেও সে ক্ষেত্রেও যদি
প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যয় করা হয় তবে তাকে ইসরাফ বা অপচয় হিসেবে দেখা হয়। ইসলাম বৈধ কাজেও
মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় সমর্থন করে না। অবৈধ কাজে ব্যয় করাকে অপব্যয় বলা হয়। অপচয় করা
শয়তানের কাজে। যেমন মহান আল্লাহ পবিত্র কালামে ইরশাদ করেছেন-
﴿وَءَاتِ ذَا الْقُرْبٰى حَقَّهُۥ
وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا - إِنَّ
الْمُبَذِّرِينَ كَانُوٓا إِخْوٰنَ الشَّيٰطِينِ ۖ وَكَانَ الشَّيْطٰنُ لِرَبِّهِۦ
كَفُورًا﴾
অর্থাৎ, "নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের প্রতি খুবই
অকৃতজ্ঞ। আর আত্মীয়কে তার হক দিয়ে দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরকেও। আর কোনভাবেই অপব্যয়
করো না"। (সূরা বনী
ইসরাঈলে, আয়াত: ২৬-২৭) মহান আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন-
يٰبَنِىٓ ءَادَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِندَ
كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوٓا ۚ إِنَّهُۥ لَا يُحِبُّ
الْمُسْرِفِينَ﴾
অর্থাৎ, "হে বনী আদম, তোমরা প্রতি সালাতে তোমাদের বেশ-ভূষা গ্রহণ কর এবং খাও, পান কর ও অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না"। (সূরা আরাফ, আয়াত: ৩১)
ইসলামে অপচয়-অপব্যয়ের পাশাপাশি কৃপণতারও বিরোধিতা করা হয়েছে। ব্যয়ের
ক্ষেত্রে ইসলামে মধ্যপন্থা অনুসরণকে উৎসাহিত করা হয়েছে। মধ্যবর্তী অবস্থানে থেকে সবগুলো কাজ করা মুমিনের অন্যতম একটি গুণ।
যেমন পবিত্র কালামে ইরশাদ হয়েছে-
﴿وَالَّذِينَ إِذَآ أَنفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا
وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذٰلِكَ قَوَامًا﴾
অর্থাৎ, "আর তারা যখন ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না। বরং
মাঝামাঝি অবস্থানে থাকে"। (সূরা ফুরকান, আয়াত: ৬৭)
সাহরী ও ইফতারঃ
রামাদ্বান মাসের রোজা রাখার নিয়তে সাহরী খাওয়া ও সময়মতো
ইফতার করা অন্যতম একটি সুন্নাত। হাদিসে এসেছে-
﴿حَدَّثَنَا
آدَمُ بْنُ أَبِي إِيَاسٍ حَدَّثَنَا شُعْبَةُ حَدَّثَنَا عَبْدُ الْعَزِيزِ بْنُ
صُهَيْبٍ قَالَ سَمِعْتُ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ
النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَسَحَّرُوا فَإِنَّ فِي السَّحُورِ
بَرَكَةً﴾
অর্থাৎ,
"হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- তোমরা সাহরী খাও, সাহরীতে বারাকাত রয়েছে"। (বুখারী, আস-সহীহ, খণ্ড-৭, পৃ. ৩,
হাদীস নং ১৭৮৯)
মুসলিম শরীফের আরেক হাদিসে এসেছে-
﴿حَدَّثَنَا
قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ حَدَّثَنَا لَيْثٌ عَنْ مُوسَى بْنِ عُلَيٍّ عَنْ أَبِيهِ
عَنْ أَبِي قَيْسٍ مَوْلَى عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ عَنْ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ أَنَّ
رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ فَصْلُ مَا بَيْنَ
صِيَامِنَا وَصِيَامِ أَهْلِ الْكِتَابِ أَكْلَةُ السَّحَرِ﴾
অর্থাৎ,
"হযরত আমর ইবনে আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- আমাদের ও কিতাবীদের রোজার
মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া"। (মুসলিম, আস-সহীহ, খণ্ড-৫, পৃ. ৩৮৮, হাদীস নং ১৮৩৬)
﴿حَدَّثَنَا
يَحْيَى بْنُ يَحْيَى أَخْبَرَنَا عَبْدُ الْعَزِيزِ بْنُ أَبِي حَازِمٍ عَنْ
أَبِيهِ عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ
أَنَّ
رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا يَزَالُ النَّاسُ
بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ﴾
অর্থাৎ,
"হযরত সাহল ইবনে সাদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- যতদিন মানুষ বিলম্ব না করে
ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের উপর থাকবে"। (মুসলিম, আস-সহীহ, খণ্ড-৫,
পৃ. ৩৯০ হাদীস নং ১৩৮৮)
তারাবীর নামাজ আদায় করাঃ
রামাদ্বান মাসে তারাবীর নামাজ হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ
ইবাদত। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে অনেক হাদিস পাওয়া যায়। তাই
যারা সুস্থ আছেন তারা সবাই প্রতিদিন বিশ রাকাত তারাবীহ আদায় করা উত্তম হবে। এর
ফজিলত সম্পর্কে বুখারী শরীফে এসেছে-
﴿حَدَّثَنَا
يَحْيَى بْنُ بُكَيْرٍ حَدَّثَنَا اللَّيْثُ عَنْ عُقَيْلٍ عَنْ ابْنِ شِهَابٍ
قَالَ أَخْبَرَنِي أَبُو سَلَمَةَ أَنَّ أَبَا هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ
قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ
لِرَمَضَانَ مَنْ قَامَهُ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ
ذَنْبِهِ﴾
অর্থাৎ,
"আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূলুল্লাহু (ﷺ) কে রামাদ্বান সম্পর্কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি রামাদ্বানে ঈমানের সাথে সওয়াব লাভের আশায় কিয়ামে রামাদ্বান
অর্থাৎ তারাবীর নামাজ আদায় করবে তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হবে"। (বুখারী, আস-সহীহ, খণ্ড-৭, পৃ. ১৩৩ হাদীস নং ১৮৬৯)
কুরআনুল কারীম তেলাওয়াত করাঃ
রামাদ্বান মাস হচ্ছে কুরআনুল কারীম অবতীর্ণের মাস। আর এই
মাসে রাসূল (ﷺ)
বেশি বেশি তা তেলাওয়াত করতেন। সুতরাং আমরাও যেন সেটাই করি। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
﴿شَہۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡہِ
الۡقُرۡاٰنُ ہُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡہُدٰی وَ الۡفُرۡقَانِ﴾
অর্থাৎ, "রামাদ্বান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের
জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার
পার্থক্যকারীরূপে"। (সূরা
বাকারা, আয়াত:১৮৫)
﴿حَدَّثَنِي
الْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ الْحُلْوَانِيُّ حَدَّثَنَا أَبُو تَوْبَةَ وَهُوَ
الرَّبِيعُ بْنُ نَافِعٍ حَدَّثَنَا مُعَاوِيَةُ يَعْنِي ابْنَ سَلَّامٍ عَنْ
زَيْدٍ أَنَّهُ سَمِعَ أَبَا سَلَّامٍ يَقُولُ حَدَّثَنِي أَبُو أُمَامَةَ
الْبَاهِلِيُّ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
يَقُولُ اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا
لِأَصْحَابِهِ﴾
অর্থাৎ, "হযরত আবূ উমামাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
রাসূলুল্লাহু (ﷺ) বলেছেন- তোমরা কুরআন মাজীদ পাঠ কর ।
কেননা, কিয়ামতের দিন কুরআন, তার
পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হিসাবে আগমন করবে"। (মুসলিম, আস-সহীহ, খণ্ড-৪, পৃ. ২৩১ হাদীস নং ১৩৩৭)
তাহাজ্জুদ নামাজ পড়াঃ
নফল নামাজ সমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে তাহাজ্জুদ নামাজ।
রাসূল (ﷺ) এ
নামাজ নিয়মিত আদায় করতেন। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
﴿وَ مِنَ الَّیۡلِ فَتَہَجَّدۡ بِہٖ نَافِلَۃً
لَّکَ ٭ۖ عَسٰۤی اَنۡ یَّبۡعَثَکَ رَبُّکَ مَقَامًا مَّحۡمُوۡدًا﴾
অর্থাৎ, "আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ আদায় কর তোমার অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে। আশা
করা যায়, তোমার রব তোমাকে প্রশংসিত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত
করবেন"। (সূরা বনী
ইসরাঈল, আয়াত: ৭৯)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন-
﴿قُمِ اللَّيْلَ إِلاَّ قَلِيلا - نِصْفَهُ
أَوِ انقُصْ مِنْهُ قَلِيلا﴾
অর্থাৎ, "রাতে নামাজে দাঁড়াও কিছু অংশ ছাড়া। রাতের অর্ধেক কিংবা তার চেয়ে কিছুটা
কম"। (সূরা
মুযাম্মিল, আয়াত: ২ ও ৩) মুসলিম শরীফের হাদিসে এসেছে-
﴿حَدَّثَنِي
قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ حَدَّثَنَا أَبُو عَوَانَةَ عَنْ أَبِي بِشْرٍ عَنْ
حُمَيْدِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ الْحِمْيَرِيِّ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ
اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَفْضَلُ
الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللَّهِ الْمُحَرَّمُ وَأَفْضَلُ الصَّلَاةِ
بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلَاةُ اللَّيْلِ ِ﴾
অর্থাৎ,
"হযরত আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- রামাদ্বানের রোজার পর
সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহাররমের রোজা এবং ফরয নামাজের পর সর্বোত্তম
নামাজ হচ্ছে রাতের নামাজ"। (মুসলিম, আস-সহীহ, খণ্ড-৬, পৃ. ৬৩, হাদীস নং ১৯৭২)
সাদাকাহ করাঃ
আল্লাহর রাস্তায় দান করার অনেক ফজিলত রয়েছে। আর সেটা যদি
রামাদ্বান মাসে করা যায় তাহলে তার সাওয়াব সত্তর গুণ বেশি পাওয়া যাবে ইনশা আল্লাহ।
দানকারীদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
﴿مَثَلُ الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ اَمۡوَالَہُمۡ
فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ کَمَثَلِ حَبَّۃٍ اَنۡۢبَتَتۡ سَبۡعَ سَنَابِلَ فِیۡ کُلِّ
سُنۡۢبُلَۃٍ مِّائَۃُ حَبَّۃٍ ؕ وَ اللّٰہُ یُضٰعِفُ لِمَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ
اللّٰہُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ﴾
অর্থাৎ, "যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা
একটি বীজের মত, যা উৎপন্ন করল সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে রয়েছে একশ দানা। আর আল্লাহ যাকে চান তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আর
আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ"। (সূরা বাকারা, আয়াত: ২৬১) আল্লাহর
রাস্তায় দান করলে পাহাড় পরিমান সাওয়াব পাওয়া যাবে।
যেমন বুখারী শরীফের হাদিসে এসেছে-
যেমন বুখারী শরীফের হাদিসে এসেছে-
﴿حَدَّثَنَا
عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مُنِيرٍ سَمِعَ أَبَا النَّضْرِ حَدَّثَنَا عَبْدُ
الرَّحْمَنِ هُوَ ابْنُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ دِينَارٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ أَبِي
صَالِحٍ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ
صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ تَصَدَّقَ بِعَدْلِ تَمْرَةٍ مِنْ كَسْبٍ
طَيِّبٍ وَلَا يَقْبَلُ اللَّهُ إِلَّا الطَّيِّبَ وَإِنَّ اللَّهَ يَتَقَبَّلُهَا
بِيَمِينِهِ ثُمَّ يُرَبِّيهَا لِصَاحِبِهِ كَمَا يُرَبِّي أَحَدُكُمْ فَلُوَّهُ
حَتَّى تَكُونَ مِثْلَ الْجَبَلِ﴾
অর্থাৎ, "হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- যে ব্যক্তি (তার) বৈধ উপায়ে
উপার্জিত অর্থ থেকে একটি খেজুর পরিমাণও কিছু দান করে, আর আল্লাহ তো বৈধ অর্থ ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণই করেন না, সে ব্যক্তির ঐ দানকে আল্লাহ ডান হাতে গ্রহণ করেন। অতঃপর তা ঐ ব্যক্তির
জন্য লালন-পালন করেন, যেমন তোমাদের কেউ তার অশ্ব-শাবককে
লালন-পালন করে থাকে। পরিশেষে তা পাহাড়ের মত হয়ে যায়"। (বুখারী, আস-সহীহ, খণ্ড-৫,
পৃ. ২২১, হাদীস নং ১৩২১)
ইতিকাফ করা
রামাদ্বান মাসে ইতিকাফ করা রাসূল (ﷺ) এর অন্যতম একটি আমল ছিল। আর এটা
আমাদের জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। তাই সময় সুযোগ থাকলে এটা করা অনেক
সাওয়াবের কাজ হবে। বুখারী শরীফের হাদিসে এসেছে-
﴿حَدَّثَنَا
إِسْمَاعِيلُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ حَدَّثَنِي ابْنُ وَهْبٍ عَنْ يُونُسَ
أَنَّ نَافِعًا أَخْبَرَهُ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ
عَنْهُمَا قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعْتَكِفُ
الْعَشْرَ الْأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ﴾
অর্থাৎ,
"হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্নু উমর (রাঃ)
থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল
(ﷺ)
রামাদ্বানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন"। (বুখারী, আস-সহীহ, খণ্ড-৭, পৃ. ১৫৬, হাদীস নং ১৮৮৫)
লাইলাতুল কদর তালাশ করা
এই রাত সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে সূরা কদর নামে একটি সূরাই
আল্লাহ নাযিল করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
﴿لَیۡلَۃُ الۡقَدۡرِ ۙ خَیۡرٌ مِّنۡ اَلۡفِ
شَہۡرٍ﴾
অর্থাৎ, "লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম"। (সূরা ক্বদর, আয়াত:৩) হাদীসে এসেছে-
﴿حَدَّثَنَا مُسْلِمُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ
حَدَّثَنَا هِشَامٌ حَدَّثَنَا يَحْيَى عَنْ أَبِي سَلَمَةَ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ
رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ
عَنْ
النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ قَامَ لَيْلَةَ
الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ﴾
অর্থাৎ, "আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন- ঈমানের সাথে এবং সাওয়াবের
আশা যে লোক লাইলাতুল কাদরের (ইবাদাতের জন্য) রাতে জেগে থাকে, তার পূর্ববর্তী গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হয়"। (বুখারী, আস-সহীহ, খণ্ড-৬,
পৃ. ৪৬৮, হাদীস নং ১৭৬৮)
ঈদের নামাজের আগেই সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। বুখারী
শরীফের হাদিসে এসেছে-
﴿حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ
السَّكَنِ حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ جَهْضَمٍ حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ
جَعْفَرٍ عَنْ عُمَرَ بْنِ نَافِعٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ
عَنْهُمَا قَالَ فَرَضَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَكَاةَ
الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ عَلَى الْعَبْدِ وَالْحُرِّ
وَالذَّكَرِ وَالْأُنْثَى وَالصَّغِيرِ وَالْكَبِيرِ مِنْ الْمُسْلِمِينَ وَأَمَرَ
بِهَا أَنْ تُؤَدَّى قَبْلَ خُرُوجِ النَّاسِ إِلَى الصَّلَاةِ﴾
অর্থাৎ, "হযরত ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
প্রত্যক গোলাম, আযাদ, পুরুষ,
নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত
বয়স্ক মুসলিমের উপর আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সদকাতুল ফিতর
হিসেবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা’ পরিমাণ আদায় করা ফরয
করেছেন এবং লোকজনের ঈদের সালাতের বের হবার পূর্বেই তা আদায় করার নির্দেশ
দিয়েছেন"। (বুখারী, আস-সহীহ, খণ্ড-৫, পৃ. ৩৭০, হাদীস নং ১৪০৭)
সর্বোপরি-
এই মাস হচ্ছে দোয়া কবুলের মাস। তাই ফরয রোজা, ফরয নামাজ ও নফল ইবাদত করার পাশাপাশি আল্লাহর কাছে জীবনের সব গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি চেয়ে জান্নাত কামনা করতে হবে।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে রামাদ্বানের রোজাগুলো রাখার পাশাপাশি সকল নেক আমল করার তৌফিক দান করুন। (আমিন)
লেখক-
ইমাম ও খতিব
ওল্ডহাম জামে মসজিদ,
যুক্তরাজ্য
Admin-
Al-Hussain Media Facebook
page and
YouTube channel
Facebook id-
Muhammad Aktar Al-Hussain
Email: mahussain10@gmail.com
0 coment rios:
You can comment here