।। সাঈদ চৌধুরী।।
বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কবি অধ্যক্ষ আফজাল চৌধুরী
তাওহীদবাদী নান্দনিক সাহিত্য রচনা করে এক নবতর ধারার সৃষ্টি করেছেন। বিদ্রোহী কবি
কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী কিছু কবিতা ও ফররুখ আহমদের ইসলামী সাহিত্য সম্ভার এই
ধারায় ছিল প্রাণপ্রবাহ।
ষাটের দশকে অনিকেত গোষ্ঠির বিপরীতে সুনিকেত বৃত্তির
এই নতুন মাত্রা বেগবান হয়। তখন বিশ্বব্যাপী কমিউনিজমের ধ্বজাধারী কায়েমি
স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক-লেখক ও পৌত্তলিকতার দ্বারা প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত
লেখকগোষ্ঠী অবিভক্ত বাংলার সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
এসময় রাশিয়ান বলয়ে এবং কলকাতাকে কেন্দ্র করে যারা
লেখেন তাদের বিপরীতে ঢাকা কেন্দ্রিক বিশ্বাসী কবিদের চেতনাগত সংঘাত চলছিল। দুটি
শক্তির মোকাবেলায় দাঁড়ানো শুধু সাহসের ব্যাপার ছিল না, সাহিত্যে অভাবনীয় দক্ষতা ও পারদর্শিতার পরিচয়ও দিতে
হয়েছে। কবি আল মাহমুদ, কবি আফজাল
চৌধুরী প্রমুখ এই ধারায় নেতৃত্ব দেন।
কবি আফজাল চৌধুরী শুধু চেতনাগত পার্থক্য নয়, শব্দ প্রয়োগেও ভিন্নতার সৃষ্টি করেন। তিনি আমাদের
সাহিত্যে মূর্তিপূজা বা প্রতিমাপূজার আচার ও বিশ্বাস থেকে ফিরিয়ে বাঙালি মুসলিম
মধ্যবিত্তের স্বকীয় ভাবনা প্রকাশে সচেষ্ট হন। এটা এতোটাই কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল, তার প্রেরণায় উজ্জীবিত হলেও সাহিত্য চর্চার উপাত্ত
সংগ্রহের জন্য নতুন লেখিয়েরা বিশ্বাসের বিপরীত ধারায় বসবাস করতে হত।
তখনকার কবিদের লেখায় গ্রেকো রোমান বহুদেববাদ
রুপকভাবে ব্যবহৃত হত। ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকায় খ্রিস্টান ধর্মের প্রসারের আগে বহু
ঈশ্বরবাদী সংস্কৃতির ব্যবহার ছিল। এটি ব্যাপক অর্থে প্রসারিত সমকালীন ধর্মগুলোতে
বিশেষত অধিকাংশ পূর্বাঞ্চলীয় ধর্ম এবং আমেরিকা,
মধ্য এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া
ও আফ্রিকার আদিবাসী সমাজেও বিদ্যমান ছিল।
কবি আফজাল চৌধুরী প্রচলিত পৌত্তলিকতা ও
নাস্তিক্যবাদের বিপরীতে সংলাপ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফ্রন্ট নামে একটি সাহিত্য
আন্দোলনের যাত্রা করেন। অল্পদিনের মধ্যে নিজস্ব বিশ্বাসের আলোকে নতুন কমিটমেন্ট
নিয়ে একঝাক তরুণকে স্বকীয় ভাবনা প্রকাশে উজ্জীবিত করতে সক্ষম হন। আমি নিজেও
সংলাপের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। আফজাল চৌধুরী চেয়ারম্যান এবং আমি সেক্রেটারি জেনারেল
হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। সংলাপের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই এখন জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত।
কল্যাণব্রতের কবি খ্যাত শিক্ষাবিদ আফজাল চৌধুরী
বিচিত্র রচনায় সমৃদ্ধ করে গেছেন বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার। শিল্প-সাহিত্যের নানা
অঙ্গনে তিনি অসংখ্য কালজয়ী রচনা সৃষ্টি করেছেন। তিনি একজন বিশ্বাসী কবি কন্ঠ।
আধুনিক মুসলিম সাহিত্যের এক মহারাজ। বীরদর্পে বাংলা সাহিত্যের সব শাখায় সফল বিচরণ
করে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
আফজাল চৌধুরী শুধু আদর্শবাদী শিল্পীই ছিলেন না, তিনি সমাজ সংস্কারকও ছিলেন। তিনি সংস্কার চেয়েছিলেন
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন অসীম প্রাণ স্ফূর্তির অধিকারী অদম্য
সাহসী মানুষ। পলায়নপরতা ও হতোদ্যম তার স্বভাবে ছিল না। তিনি ছিলেন একক এবং
সমষ্টিগতভাবে নিরন্তন গতিশীল।
‘কল্যাণব্রত’ আফজাল চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ‘বলিও আমার প্রেম ঈশ্বরের ভষ্ম নয় ভূমা/ আলোকিত
কোলাহলে সমতল আত্মার সঙ্গীত/ রাশি রাশি পুলকের বিন্দু বিন্দু বোধের অতীত/ অন্য এক
বোধ আর স্পন্দমান আলোর উপমা/ আলোক সে নির্ভুলের আন্তরিক বলীয়ান ক্ষমা/ বলিও আমার
প্রেম ঈশ্বরের ভষ্ম নয়-ভুমা।’
কবি আফজাল চৌধুরীর কবিতায় অবেগ-অনুভূতি সহজ কথা ও
ছন্দে পরিস্ফুটিত। এর উচ্চারণ বলিষ্ঠ এবং প্রত্যয়ী। জীবন-বিশ্বাসের গভীর থেকে
উত্থিত।
’মৃত্যুর
মোহন নৃত্য বার বার চোখ বুঁজে দেখি,/
পরলোকে ছায়া ফেলে এই কুঞ্জে দাঁড়াই যখনি/ খুলে দাও দাও খুলে রহস্যের নিখিল
দরোজা,/ তোমার
গৃহস্থ যারা তাদের স্বচ্ছন্দ বিচরণে/ নিভৃত এ কুঞ্জ হোক ওপারের বিমূর্ত আঙিনা/
শিরা উপশিরাগামী রক্তস্রোত নাশ করে স্নায়ু/ এবং গোগ্রাসে গিলে শতাব্দীর মস্ত অজগর’
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল্লাহ আবু
সায়ীদ ‘কল্যাণব্রত’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর ত্রৈমাসিক ‘কন্ঠস্বর’
(কবিতা সংখ্যা-১৯৭০)এ লিখেছেন “আমাদের
কাব্যক্ষেত্রে ষাটের অঙ্গন যেসব উদ্যোগী তরুণের আশান্বিত পদপাতে সরব হয়েছিল, আফজাল চৌধুরী তাদের অন্যতম। অন্য লোকের মত আমরাও
যারা সেই নতুন কবিতা-চেষ্টার প্রতিটি অনিবার্য ও সজীব প্রবণতাকে উদগ্রীব প্রত্যাশা
নিয়ে লক্ষ্য করে চলছিলাম সে সময়, নিশ্চিতভাবে
অনুভব করেছিলাম, আফজাল
চৌধুরীর অপরাগ হাত এমন কিছু উল্লেখযোগ্য উপহার দেবার প্রতিশ্রুতি দেখাচ্ছে যা সজীব
ও প্রাণবন্ত এবং যা আগামী সময়ের আকাঙ্খিত দিনগুলোয় কবিতার স্বচ্ছল প্রয়াসে আমাদের
কাব্য-ভাঁড়ারকে সমৃদ্ধ করবে।
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ আরো বলেন, ‘কল্যাণব্রত’ পাঠের সময় এই কাব্যের যে গুণটি বড় হয়ে পাঠকের চোখে
ভাসে তা হলঃ এর স্বকীয়তা। আফজাল চৌধুরীর কন্ঠস্বর আলাদা ও স্বকীয়, স্বাদে ও চরিত্রে গতানুগতিক কবিতা থেকে আলাদা। তার
কবিতার ডালে ডালে শব্দের যে অবাক বিস্ময় গুচ্ছ গুচ্ছ হয়ে ফুটে আছে, তা যে কোন পাঠককেই আকর্ষণ করবে।
আফজাল চৌধুরীর প্রাণস্পর্শী প্রজ্ঞাদীপ্ত
বক্তৃতা-ভাষণ ছিল সাহিত্য আসরে বিরল বিস্ময়। তার কন্ঠের যাদুকরী উচ্চারণে দর্শক
শ্রোতা সম্মোহিত ও আকৃষ্ট হতেন। কবিতার ধ্বনিসঙ্গীতে নিপিড়িত মানুষের কথা তিনি
বলতেন। তার বহুমাত্রিক সাহিত্য সম্ভার সমকালীন কবি সাহিত্যিকদের ভাবনায় ফেলে
দিয়েছিল। মোকাবেলায় কোন পথ না পেয়ে তাদের পছন্দের কাগজ সমূহে তাকে বর্জনের চেষ্টা
করা হয়েছে অত্যন্ত জঘন্যভাবে।
কবিতার পাশাপাশি কাব্যনাট্যেও শক্তিমান এক পুরুষ
হিসেবে আফজাল চৌধুরী নিজের লেখনীর প্রমান দিয়েছেন। ‘হে পৃথিবী
নিরাময় হও’ কাব্যনাটকে
বিষয় ও প্রকরণগত সৃজন শৈলীতে
বহু মাত্রিকতার সংযোজন
ঘটিয়েছেন তিনি।
বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ এ কাব্যনাট্য
সম্পর্কে বলেন, ‘হে পৃথিবী
নিরাময় হও’ কাব্যনাট্য
এক অসাধারণ নাট্যগুণ আর প্রতিবাদগুণ সম্পন্ন গ্রন্থ। প্রতিবাদ প্রচলিত সমাজের
রন্দ্রে রন্দ্রে কলুষ কালিমার বিরুদ্ধে। এই কাব্য নাট্যখানি আমাদের সাহিত্যে এক
নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী সফল কাব্যনাট্য।
বিশিষ্ট সাংবাদিক আখতারুল আলম ‘হে পৃথিবী নিরাময় হও’
কাব্যনাট্যকে স্বতন্ত্র এক ধারার সূচনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, আমাদের সাহিত্য ক্ষেত্রে নিদারুন হৈ চৈ আর গোলযোগের
মধ্যে এই গ্রন্থখানি এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম।
কবি আল মুজাহিদী আফজাল চৌধুরীর ‘হে পৃথিবী নিরাময় হও’
কাব্যনাট্য সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে কবিকে এ শতাব্দীর সবচে প্রতিবাদী
কবিকন্ঠ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
কবি আফজাল চৌধুরীর ২য় কাব্যগ্রন্থ ‘শ্বেতপত্র’
এবং তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সামগীত
দুঃসময়ের’ প্রতিটি
কবিতা পুষ্প সৌরভে পাঠককে মুহিত করে। তারপর ’শবমেহেরের ছুটি’, ’নয়া পৃথিবীর জন্য’,
’বিশ্বাসের দিওয়ান’, ’এই ঢাকা এই
জাহাঙ্গীরনগর’ প্রভৃতি
কাব্যগ্রন্থে নতুন রুপ ও গ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে। তার সনেট এবং আত্মজৈবনিক কবিতা আমাদের
সাহিত্যে এক ভিন্ন মাত্রার সংযোজন।
কবি আফজাল চৌধুরী কবিতা, কাব্যনাট্য
এবং প্রবন্ধের পাশাপাশি চমৎকার নাটকও লিখেছেন। হযরত শাহজালাল (র) এর সিলেট
আগমনের পটভূমিতে লেখা তার নাটক ‘সিলেট বিজয়’। একটি অত্যন্ত মঞ্চ সফল নাটক। তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি
করতে সক্ষম হয়েছিল ব্যতিক্রমী এই নাটক।
বার্নাবাসের বাইবেল অনুবাদ আফজাল চৌধুরীর এক অনবদ্য
সৃষ্টি। ব্যাপকভাবে পাঠক সমাদৃত এই গ্রন্থ বাংলা ভাষী প্রতিটি শিক্ষিত মানুষ
স্মরণে রাখতে বাধ্য। অনুবাদে তার বিশেষ দক্ষতা ও শক্তিমত্তার প্রামাণ্য দলিল এটি।
সম্পাদনার ক্ষেত্রেও উজ্জল স্বাক্ষর রেখেছেন কবি
আফজাল চৌধুরী। আফগানিস্তানের অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যতের আবর্তকে ধারণ করে সুবিশাল
গ্রন্থ ‘আফগানিস্তান
আমার ভালবাসা’ তিনি ও কবি আল মাহমুদ যৌথ সম্পাদনা
করেন। ‘ঐতিহ্য’ নামে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে একটি সাহিত্য ত্রৈমাসিক
সম্পাদনাও তার আরেক উজ্জ্বল সুকৃতি।
সত্য প্রকাশে,
অন্যায়ের প্রতিবাদে, জুলুমের
বিরুদ্ধে আফজাল চৌধুরী ছিলেন সোচ্চার ও বজ্রকন্ঠ। সমাজনীতি ও রাজনীতির কাব্য
মঞ্চেও ছিলেন বীরের ভূমিকায়। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মিছিলে তার কলম ছিলো ক্ষুরধার
ও তেজোদ্বীপ্ত।
’মানুষই
সম্পূর্ণ দ্বীপমাত্র নয়/ প্রতিটি মানুষের সম্পূর্ণের অংশ মাত্র।/ মৃত্যু আমাকে
খর্ব করে
কারণ আমি জড়িত মানবতার সঙ্গে,/ সুতরাং নিজেকে জিজ্ঞেস করোনা, কার জন্যে/ মৃত্যু ঘন্টা বাজে, জেনো,
সে তোমার জন্যে,/ সে তোমার
জন্যে।’
’কি-রূপ
নি:সঙ্গ আজ মনে হয় নিজেকে এ পার্থিব প্রবাসে/ চারপাশে এতো ভীড়, ক্রস্ত-চাপ,
বিরতিবিহীন কর্মযোগে/ কোথায় আমার নিজ স্থায়ী কক্ষ, কোথায় সে অন্তিম শয়ান?/
কি আমার পরিণতি, বিজয়ী না
শহীদের রক্তাপ্লুত লাশে/ যাত্রাশেষ?
জানি না তা। বুঝি না এ ভঙ্গুর দেহটি চিররোগে/ ক্ষয়ে যাবে, নাকি হবে জনারণ্যে সমাদৃত নন্দিত প্রয়াণ?/ কি হবে,
কি হবে ওহে, বলে দাও কোন
যোগাযোগ/ আমার শুরু ও শেষ, কোথায় কোথায়
মুক্তি, কোন
বিনিয়োগে?/ হে সত্য, তোমার রূপ এখনও প্রচ্ছন্ন এই জীবন বিন্যাসে/ হে জীবন, পারিনি তো তোমার দারুণ ক্ষতে যথাযোগ্য ত্রাণ/ স্নেহে
বিছিয়ে দিতে। সূর্যোদয় লক্ষ্য বটে এই সন্ধ্যাকাশে।/ এখনও প্রান্তিক দূর্গে যুদ্ধ
চলছে; কুরবান
হয়েছে এই জান/ এইটুকু বলতে পানি-জীবন ব্যয়িত নয় কেবল সম্ভোগে/ কেবল কৈবল্য যপে
অঙ্ক কষাকষি নয় যোগে ও বিয়োগে।’
আফজাল চৌধুরী ১০ মার্চ ১৯৪২ সালে হবিগঞ্জের খাগাউড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০০৪ সালের
৯ জানুয়ারি ইন্তেকাল করেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। বড় ভাই প্রখ্যাত
রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধের
সংগঠক, প্রাক্তন
এমএনএ ও সংসদ সদস্য মরহুম এ কে লতিফুর
রহমান চৌধুরী (কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী) এবং মেঝো ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাষা
সৈনিক ও রাজনীতিবিদ মরহুম আলতাফুর রহমান চৌধুরী (ইয়াকুত চৌধুরী)।
কবি আফজাল চৌধুরী
হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন (১৯৫৯), হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক (১৯৬১), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বিএ (অনার্স) (১৯৬৪)
ও এমএ (১৯৬৫) সম্পন্ন করেন। ১৯৬৯ সালে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য হিসেবে তার
কর্ম জীবনের শুরু হয়। প্রথম কর্মস্থল ছিল রাজশাহী সরকারী ইন্টারমেডিয়েট কলেজ (১৯৬৯
-’৭০)।
পরবর্তীতে সিলেট সরকারী এমসি ইন্টারমেডিয়েট কলেজ (১৯৭০-’৭২),
চট্রগ্রাম সরকারী ইন্টারমেডিয়েট কলেজ (১৯৭২-৭৩),
সিলেট সরকারী কলেজ (বর্তমান সরকারী এমসি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ১৯৭৫ -৮০ ও ১৯৯০-৯৫) এবং সিলেট সরকারী মহিলা কলেজে
(১৯৮৯-৯০) অধ্যাপনা করেন। হবিগঞ্জ সরকারী বৃন্দাবন কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন
১৯৯৬-৯৯ পর্যন্ত। এ পদে কর্মরত থাকাবস্থায় ১৯৯৯ সালের ৯ মার্চ সরকারী চাকরি থেকে
অবসর গ্রহণ করেন। হবিগঞ্জ সরকারী বৃন্দাবন কলেজের প্রিন্সিপাল থাকাবস্থায় এ কলেজের
উন্নয়নে তিনি প্রভুত অবদান রাখেন এবং ৭টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করেন।
মাঝখানে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি প্রেষণে
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এর ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সিলেট ও ঢাকার যথাক্রমে ’উপ-পরিচালক’
(১৯৮০-৮১) ও ’পরিচালক’ (১৯৮২-৮৪) এবং ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত মাধ্যমিক ও
উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার ’স্কুলসমূহের পরিদর্শক’
ছিলেন। তিনি ছিলেন ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সিলেটের প্রতিষ্ঠাতা ’উপ-পরিচালক’
। ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ঢাকার ’পরিচালক’ থাকাকালে সাহিত্য পত্রিকা ’ঐতিহ্য’
এর প্রকাশ ও সম্পাদনা, সেমিনার, আলোচনা সভা প্রভৃতির মাধ্যমে দেশের বরেণ্য কবি , সাহিত্যিক,
সাংবাদিক সহ বুদ্ধিজীবিদের উপস্থিতিতে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নবজাগৃতির সৃষ্টি
করেন। ১৯৮৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওআইসি’র
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলন উপলক্ষে ’আফগানিস্তান
আমরা ভালবাসি’ সংকলন
গ্রন্থের প্রকাশ প্রভৃতি ছিল তার অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচায়ক।
গ্রন্থপঞ্জি : কবি আফজাল চৌধুরীর প্রকাশিত গ্রন্থের
সংখ্যা ১২টি। এরমধ্যে কাব্যগ্রন্থ ৭টি,
কাব্যনাটক ১টি, প্রবন্ধ
গ্রন্থ ২টি, নাটক ১টি ও
অনুবাদ গ্রন্থ ১টি। তার
অপ্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৬টির ও অধিক। রচনাসমগ্র প্রকাশিত হলে তা দেড় হাজার
পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে যাবে।
প্রকাশিত গ্রন্থ : কাব্যগ্রন্থ : কল্যাণ ব্রত (১৯৬৯, দ্বি. সং. ২০০৮),
শ্বেতপত্র (১৯৮৩), সামগীত
দু:সময়ের (১৯৯১), শবমেহেরের
ছুটি (২০০৫), নয়া পৃথিবীর
জন্য (২০০৬), বিশ্বাসের
দিওয়ান (২০০৭), এই ঢাকা এই
জাহাঙ্গীরনগর (২০১১)। কাব্যনাটক : হে পৃথিবী নিরাময় হও (১৯৭৯)। নাটক : সিলেট বিজয়
(২০০৫)। প্রবন্ধ গ্রন্থ : ঐতিহ্যচিন্তা ও রসুল প্রশস্তি (১৯৭৯, ৪র্থ সং. ২০০৪),
তাঁর কাব্যালোকে সৈয়দ আলী আহসান (২০১২)। অনুবাদ গ্রন্থ : বার্নাবাসের বাইবেল
(১৯৯৬, দ্বি. সং.
২০০৫)।
অপ্রকাশিত রচনা : কবিতা : বন্দী আরাকান ও অন্যান্য
কবিতা , খোশাহাল খান
খটকের জন্য পঙক্তিমালা , অন্য গোলার্ধে
হৃদয়, শাশ্বতের
পক্ষে কবিতা, ঐতিহাসিক
মর্সিয়া ও অন্যান্য কবিতা, অনুবাদ
কবিতা : জালালুদ্দীন রুমির কবিতা, আলী শরীয়তীর
কবিতা, কাব্যনাটক :
বাঁশী, গীতিনকশা :
সবুজ গম্বুজে ঢাকা ফুল, নাটক :
ক্ষুধিত ক্যাম্পাস, প্রবন্ধ
গ্রন্থ : কবিতার সংসারে জটিলতা, প্রতিশ্রুত
কথকতা, সমকালীন
সাহিত্যের ধারা, নান্দনিক
ভুবন, সিলেটে সূফী
সাধনা, মক্কার পথ :
মুহম্মদ আসাদের মহাজীবন প্রভৃতি।
কবি আফজাল চৌধুরী ২০০১ সালে সিলেট বিভাগের
মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ’রাগীব-রাবেয়া
সাহিত্য পুরস্কার’ এবং ২০০৪
সালে মরণোত্তর ’কিশোর কন্ঠ
সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন।
কবি আল মাহমুদের ভাষায় বলতে পারি, কবি আফজাল চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে এবং কাব্যলোকে
অনন্য নকীবের ভূমিকায় সরব ছিলেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন এক অসাধারণ মেধা, প্রজ্ঞা ও প্রতিভায় নিজেকে রেখেছেন বিপুল ভাবে
সক্রিয়। তার কবিতা বাংলা সাহিত্যে অমূল্য সম্পদ। কবির একান্ত সান্নিধ্যে থাকা কবি
ও সমালোচক মুকুল চৌধুরী তার জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা মূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন।
তিনি আফজাল চৌধুরীর অপ্রকাশিত মহামূল্যবান লেখাসমূহ প্রকাশের প্রয়াস অব্যাহত
রেখেছেন কবি আফজাল চৌধুরী ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে।
লেখকঃ লন্ডন প্রবাসী বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
0 coment rios:
You can comment here