Wednesday, April 22, 2020

মাহে রমযানে কুরআন খতম: শরয়ী দৃষ্টিকোণ



।। মুহাম্মদ জিয়াউর রহমান।।

ভূমিকা
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন লাওহে মাহফুযে সংরক্ষিত বিশ্বজাহানের একমাত্র প্রতিপালক মহান আল্লাহ তাআলার অবিনশ্বর কালাম। মানবজাতির হেদায়তের অভিনব ও অপূর্ব এ মহাগ্রন্থ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর অবতীর্ণ হয়, যা বিশ্বনবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সর্বশ্রেষ্ঠ মুজিযা। মানবজাতির সর্বময় কল্যাণের এ আলোকবর্তিকা ইসলামি শরিআতের প্রথম ও প্রধান উৎস। মহান রাব্বুল আলামিনের এ পবিত্র কালাম  তিলাওয়াতে যেমন রয়েছে অফুরন্ত কল্যাণ তেমনি এর বিধিবিধান অনুসরণেও মুসলমান মাত্রেরই বাধ্যবাধকতা রয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করেছেন ঠিক সেভাবেই সাহাবিদেরও তিলাওয়াতের নির্দেশ দিয়েছেন। তাই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবাদের নির্দেশিত পদ্ধতিতে কুরআন খতম করা প্রয়োজন।

মাহে রমযান
আরবি বার মাসের মধ্যে রমযান হলো নবম মাস। রমযান ‘ শব্দটি আরবি। এর আভিধানিক অর্থ- উত্তাপ, তাপাধিক্য, তাপের উচ্চমাত্রা, দগ্ধ করা, দগ্ধ করে পুরিয়ে দেয়া। এ মাসটির এ নামে নামকরণের কারণ হচ্ছে, সর্বপ্রথম সিয়ামের বিধান যে মাসে এসেছিল সেই মাসটি ছিল প্রচন্ড গরমের। ঝলসে দেয়ার মতো গরম, তাই এর নাম রাখা হয়েছে রমযান। যে সমস্ত বান্দা এ মাসের বিধানাবলি সুচারুরূপে পালন করেন, আল্লাহ তাআলা তাঁর সমস্ত পাপকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভষ্ম করে দেন। মহান রাব্বুল আলামিন এ মাসে সিয়াম ফরয করেছেন।

রমযান মাসের অন্যতম সুন্নাত কর্ম হলো, কুরআন নাযিলের এ মাসে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা। বিশেষ করে বর্তমান বৈশ্বিক মহামারীর এ পরিস্থিতিতে কুরআন খতম করে এ থেকে পরিত্রাণের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করা।
কুরআন খতমের পরিচয়
কুরআনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ধীরেস্থিরে তাজবিদের নিয়ম অনুসরণ করে তিলাওয়াত করাই কুরআন খতম। কুরআন সম্পূর্ণটা পড়ার ক্ষেত্রে খতম শব্দের প্রয়োগ সাহাবাদের মাঝে লক্ষ্য করা যায়।

ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুর রহমান দারিমি তাঁর সংকলিত গ্রন্থ আস-সুনানখাতমুল কুরআননামে একটি অনুচ্ছেদের নামকরণ করেন। উক্ত অনুচ্ছেদে বিবৃত হাদিসে খতম শব্দের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। যেমন:- সাবিত রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
﴿كَانَ أَنَسٌ إِذَا خَتَمَ الْقُرْآنَ جَمَعَ وَلَدَهُ وَأَهَلَ بَيْتِهِ فَدَعَا لَهُمْ
অর্থাৎ আনাস রা. যখন কুরআন খতম করতেন তাঁর সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের একত্রিত করতেন এবং তাঁদের জন্য দুআ করতেন। (আস-সুনান আদ-দারিমী, হাদীস নং-৩৪৭৪, খ. ২, পৃ. ৫৫৯)।

কুরআন খতমের গুরুত্ব
কুরআন খতমের গুরুত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিসে আলোকপাত করা হয়েছে। এসম্পর্কে আবদা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
﴿إِذَا خَتَمَ الرَّجُلُ الْقُرْآنَ بِنَهَارٍ صَلَّتْ عَلَيْهِ الْمَلاَئِكَةُ حَتَّى يُمْسِىَ ، وَإِنْ فَرَغَ مِنْهُ لَيْلاً صَلَّتْ عَلَيْهِ الْمَلاَئِكَةُ حَتَّى يُصْبِحَ﴾
অর্থাৎ যে ব্যক্তি দিনে কুরআন খতম করে ফেরেশতারা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য দুআ করতে থাকেন। আর যদি রাতে কুরআন খতম করে ফেরেশতারা সকাল পর্যন্ত তার জন্য দুআ করতে থাকেন।(আস-সুনান আদ-দারিমী, হাদীস নং-৩৪৭৫, খ. ২, পৃ. ৫৬০)। অপর এক হাদিসে যুরারা ইবনু আউফা রা. থেকে বর্ণিত যে,

﴿إِنَّ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- سُئِلَ : أَىُّ الْعَمَلِ أَفْضَلُ؟ قَالَ : الْحَالُّ الْمُرْتَحِلُ. قِيلَ : وَمَا الْحَالُّ الْمُرْتَحِلُ؟ قَالَ : صَاحِبُ الْقُرْآنِ يَضْرِبُ مِنْ أَوَّلِ الْقُرْآنِ إِلَى آخِرِهِ ، وَمِنْ آخِرِهِ إِلَى أَوَّلِهِ كُلَّمَا حَلَّ ارْتَحَلَ
অর্থাৎ নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন আমলটি আল্লাহর কাছে অধিকতর উত্তম? বললেন, যে ব্যক্তি গন্তব্যে পৌঁছে আবার রওয়ানা দেয় (অথবা সওয়ারী থেকে নেমেই আবার রওয়ানা দেয়)। তাঁকে (পুনরায়) জিজ্ঞেস করা হলো, গন্তব্যে পৌঁছে আবার রওয়ানা দেয় কে? তিনি বললেন, কুরআন পাঠকারী ব্যক্তি- যে কুরআন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এবং শেষ থেকে প্রথম পর্যন্ত পাঠ করে। যখনই কুরআন খতম হয় পুনরায় প্রথম থেকে পড়া শুরু করে দেয়। (আস-সুনান আদ-দারিমী, হাদীস নং-৩৪৭৬, খ. ২, পৃ. ৫৬০)।
সাবিত আল-বুনানী রহ. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
﴿كَانَ أَنَسُ بْنُ مَالِكٍ إِذَا أَشْفَى عَلَى خَتْمِ الْقُرْآنِ بِاللَّيْلِ بَقَّى مِنْهُ شَيْئاً حَتَّى يُصْبِحَ فَيَجْمَعَ أَهْلَهُ فَيَخْتِمَهُ مَعَهُمْ﴾
অর্থাৎ আনাস ইবনু মালিক রা. রাতের বেলা কুরআন খতমের সময় হয়ে গেলে সকালের জন্য কিছু অংশ রেখে দিতেন। সকালে পরিবার পরিজনকে একত্রিত করতেন এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে কুরআন খতম করতেন। (আস-সুনান আদ-দারিমী, হাদীস নং-৩৪৭৩, খ. ২, পৃ. ৫৫৯)।
কাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
﴿كَانَ رَجُلٌ يَقْرَأُ فِى مَسْجِدِ الْمَدِينَةِ وَكَانَ ابْنُ عَبَّاسٍ قَدْ وَضَعَ عَلَيْهِ الرَّصَدَ ، فَإِذَا كَانَ يَوْمُ خَتْمِهِ قَامَ فَتَحَوَّلَ إِلَيْهِ
অর্থাৎ এক ব্যক্তি মদিনায় মসজিদে কুরআন তিলাওয়াত করতো। ইবনু আব্বাস রা. সেখানে একজন পর্যবেক্ষক নিযুক্ত করে রেখেছিলেন। কুরআন খতম হওয়ার সময় তিনি তার কাছে চলে যেতেন।(সুনান আদ-দারিমী, হাদীস নং-৩৪৭২, খ. ২, পৃ. ৫৫৯)।

আত্তিবইয়ান ফি আদাবি হামালাতিল কুরআন গ্রন্থে ইমাম নববি রহ. উল্লেখ করেন,
﴿يستحب حضور مجلس ختم القرآن استحبابا متأكدا فقد ثبت في الصحيحين أن رسول الله صلى الله عليه وسلم : أمر الحيض بالخروج يوم العيد ليشهدن الخير ودعوة المسلمين وروى الدارمي وابن أبي داود بإسنادهما عن ابن عباس رضي الله عنهما أنه كان يجعل رجلا يراقب رجلا يقرأ القرآن فإذا أراد أن يختم أعلم ابن عباس فيشهد ذلك وروى ابن أبي داود بإسنادين صحيحين عن قتادة التابعي الجليل صاحب أنس رضي الله عنه قال كان أنس بن مالك رضي الله عنه إذا ختم القرآن جمع أهله ودعا وروى بأسانيده الصحيحة عن الحكم بن عيينة التابعي الجليل قال قال أرسل إلي مجاهد وعتبة بن لبابة فقالا إنا أرسلنا إليك لأنا أردنا أن نختم القرآن والدعاء يستجاب عند ختم القرآن وفي بعض الروايات الصحيحة وأنه كان يقال أن الرحمة تنزل عند خاتمة القرآن وروى بإسناده الصحيح عن مجاهد قال كانوا يجتمعون عند ختم القرآن يقولون تنزل الرحمة﴾
অর্থাৎ কুরআন খতমের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাব। সহিহাইনের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঋতুবর্তী মহিলাদের ইদের দিনে ইদগাহে উপস্থিত হতে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে করে তারা অন্যান্যদের সাথে ইদের জামাআতে শামিল হয়ে কল্যাণের অধিকারী হতে পারেন। ইমাম দারিমী ও ইবনু আবু দাউদ উভয়ে ইবনু আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন তিনি (ইবনু আব্বাস) কুরআন পাঠক একজন লোকের জন্য একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করতেন যাতে কুরআন পাঠক যখন কুরআন খতম করবে তখন ঐ পর্যবেক্ষক যেন তাকে অবহিত করে, যাতে তিনি ঐ মজলিসে (কুরআন খতমের) উপস্থিত হতে পারেন। ইবনু আবু দাউদ দুটি বিশুদ্ধ সনদে আনাস রা. এর ঘনিষ্ঠ সহচর বিশিষ্ট তাবিয়ি কাতাদাহ রহ. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আনাস রা. যখন কুরআন খতম করতেন তখন পরিবার-পরিজনকে একত্রিত করে দুআ করতেন। আর তিনি তার অন্য আরেকটি সহিহ সনদে তাবিয়ি হাকাম ইবনে উয়াইনাহ রহ. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, মুজাহিদ ও উতবা ইবনু লুবাবাহ কে আমার নিকট পাঠানো হলো। তারা বললেন, কুরআন খতম করতে আমরা আপনার নিকট প্রেরিত হয়েছি। বিশুদ্ধ রেওয়ায়েতে বর্ণিত যে, কুরআন খতমের সময় রহমত নাযিল হয়। মুজাহিদ রহ. থেকে সহিহ সনদে বর্ণিত যে, তারা কুরআন খতমের সময় একত্রিত  হতেন এবং বলতেন কুরআন খতমের সময় রহমত নাযিল হয়।(আত্তিবইয়ান ফি আদাবি হামালাতিল কুরআন খ. ১ পৃ. ১৫৯-১৬০)।

সুতরাং বলা যায় যে, ধীরস্থিরভাবে তাজবিদের সাথে তিলাওয়াতের আদব রক্ষা করে কুরআন খতম করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।
খতমে কুরআনের প্রয়োজনীয় সময়
ইমাম মুহাম্মদ ইবনু ইয়াযিদ ইবনু মাজাহ রহ. তারঁ সুনান গ্রন্থে কুরআন খতমের সময় সম্পর্কে একটি অধ্যায় সংযোজন করেন। তা- হলো فِي كَمْ يُسْتَحَبُّ يُخْتَمُ الْقُرْآنُ অর্থাৎ কতদিনে কুরআন খতম করা মুস্তাহাব। এ ব্যাপারে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রা. থেকে বর্ণিত যে,
﴿أَمَرَنِى رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- أَنْ لاَ أَقْرَأَ الْقُرْآنَ فِى أَقَلَّ مِنْ ثَلاَثٍ﴾
অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, আমি যেনো তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম না করি।” (সুনান আদ-দারিমী,  হাদীস নং ৩৪৮৭, খ. ২, পৃ. ৫৬২)। অপর এক হাদিসে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
﴿لَمْ يَفْقَهْ مَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ فِي أَقَلَّ مِنْ ثَلَاثٍ﴾
অর্থাৎ যে ব্যক্তি তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করে সে কুরআনের মর্ম বুঝেনি।(সুনান ইবনু মাজাহ, খ. ১, পৃ. ৯৬)

উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় হাফিয জালালুদ্দিন সুয়তী রহ. উল্লেখ করেন, এখানে لَمْ يَفْقَهْ দ্বারা বুঝার নফি করা হয়েছে। সাওয়াবের নিষেধ করা হয়নি। আলেমদের কেউ মাসে এক খতম, কেউ দশ দিনে এক খতম, কেউ কেউ সাত দিনে এক খতম, কেউ তিন দিনে এক খতম করতেন। ব্যক্তি বিশেষের ভিন্নতার কারণে খতমের সময়ের ভিন্নতা হতে পারে। গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে, চল্লিশ দিনের অধিক সময়ে কুরআন খতম মাকরূহ আবার তিনদিনের কম সময়ে কুরআন খতম মাকরূহ। (মিসবাহুয যুযাজাহ, খ. ১, পৃ. ৯৬)

অন্য এক হাদিসে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেন,
﴿جَمَعْتُ الْقُرْآنَ فَقَرَأْتُهُ كُلَّهُ فِي لَيْلَةٍ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنِّي أَخْشَى أَنْ يَطُولَ عَلَيْكَ الزَّمَانُ وَأَنْ تَمَلَّ فَاقْرَأْهُ فِي شَهْرٍ فَقُلْتُ دَعْنِي أَسْتَمْتِعْ مِنْ قُوَّتِي وَشَبَابِي قَالَ فَاقْرَأْهُ فِي عَشْرَةٍ قُلْتُ دَعْنِي أَسْتَمْتِعْ مِنْ قُوَّتِي وَشَبَابِي قَالَ فَاقْرَأْهُ فِي سَبْعٍ قُلْتُ دَعْنِي أَسْتَمْتِعْ مِنْ قُوَّتِي وَشَبَابِي فَأَبَى﴾
অর্থাৎ আমি কুরআন মুখস্থ করলাম। অতঃপর একরাতে সম্পূর্ণ কুরআন পাঠ করে নিতাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমার ভয় লাগছে তোমার যখন বয়স বেশি হবে তখন তোমার বিরক্তি আসবে, সুতরাং তুমি এক মাসে কুরআন সম্পূর্ণটুকু পাঠ কর। আমি (আব্দুল্লাহ ইবনে আমর) বললাম, আপনি আমাকে সুযোগ দিন যাতে আমার শক্তি ও যৌবন থেকে উপকৃত হতে পারি। তিনি (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তাহলে দশদিনে পুরো কুরআন পাঠ কর। আমি বললাম আপনি আমাকে সুযোগ দিন যাতে আমার শক্তি ও যৌবন থেকে উপকৃত হতে পারি। তখন তিনি বললেন, তাহলে সাত দিনে সম্পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত কর। আমি বললাম আমাকে সুযোগ দিন যাতে আমার শক্তি ও যৌবন থেকে উপকৃত হতে পারি। তখন তিনি তা অস্বীকার করলেন। (সুনান ইবনু মাজাহ, খ. ১, পৃ. ৯৫-৯৬) সহিহুল বুখারীতে وَلَا تَزِدْ عَلَى ذَلِكَ শব্দটি অতিরিক্ত বাড়িয়ে বলা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে সাত দিনের কমে কুরআন খতম করো না। (সহীহুল বুখারী, খ. ৪, পৃ. ১৯২৭, হাদিস নং, ৪৭৬৭)
উপরোক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতী রহ. উল্লেখ করেন যে, কাসতালানি রহ. এর মতে, এখানে নহি দ্বারা তাহরিম উদ্দেশ্য নয়। আসহাবে যাওয়াহিরর কেউ কেউ বলেন, তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম করা হারাম। ইমাম নববি ও অধিকাংশ আলেমের মতে, এটি দ্বারা তিলাওয়াতের পরিমাণ ঠিক করা হয়েছে। আগ্রহ ও সামর্থের উপর নির্ভর করে মানুষের অবস্থা ও ব্যক্তির ভিন্নতায় তা ভিন্ন হতে পারে। আহলে ফহমদের জন্য মুস্তাহাব হচ্ছে এমন সময় নিয়ে তিলাওয়াত করা যাতে মাসআলা-মাসায়েল বের করা সহজ হয়। আর যারা ইলমি গবেষণা তথা দ্বিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত তাদের জন্য মুস্তাহাব হলো এমনভাবে কুরআন খতম করা যাতে তিলাওয়াতের হক আদায়ে সমস্যা না হয়।

ইতকানে আবুল লাইস থেকে বর্ণিত, তিনি বুস্তান গ্রন্থের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, কুরআন পাঠকারী কমপক্ষে বছরে দুইটি খতম করবে যদি এর অতিরিক্ত সম্ভব না হয়। হাসান ইবনে যিয়াদ ইমাম আবু হানীফা রহ. থেকে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি বছরে দুটি খতম করবে সে কুরআন খতম করলো, কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুর বছর জিবরাইলের সামনে দুটি খতম করেছেন। অন্যান্যরা বলেছেন চল্লিশ দিনের বেশি সময়ে কুরআন খতম করা মাকরূহ। (মিসবাহুয  যুযাযাহ, খ. ১, পৃ. ৯৬)

এ থেকে বুঝা যায় যে, কুরআন তিলাওয়াতের বেলায় কোনোরূপ তাড়াহুড়া না করা; বরং ধীরস্থিরভাবে তিলাওয়াত করা। এভাবে তিলাওয়াত করলে কুরআন খতমের মাসনুন পদ্ধতি ও আদব অনুসরণ করা হয়। সুতরাং হাদিসের বর্ণনা ও বিশ্লেষণ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কুরআন খতমের উত্তম পদ্ধতি হচ্ছে কুরআন খতমে চল্লিশ দিনের অধিক সময় ব্যয় না করা আর তিন দিনের কম সময়ে কুরআন খতম না করা।

আমাদের করণীয়
১. কুরআন নাযিলের এ মাসে আমাদের করণীয় হলো বেশি বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করা।

২. কুরআনুল কারিমের অর্থ ও ব্যাখ্যা বোঝার চেষ্টা করা। বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে কুরআনের মর্ম বুঝে তদানুযায়ী নিজের জীবন গঠন অঙ্গিকারবদ্ধ হওয়া ও পূর্বের পাপ কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।

৩. আমাদের মধ্যে যারা কুরআন তিলাওয়াত জানিনা তাদের কর্তব্য হলো  কুরআন তিলাওয়াত শিখার চেষ্টা করার অব্যাহত রেখে অন্য তিলাওয়াতকারীর পাশে বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট দূরত্বে বসে ভক্তি, আগ্রহ ও আন্তরিকতা সহকারে তিলাওয়াত শ্রবণ করা। কেউ যদি সাগ্রহে যথাযথ ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা নিয়ে পাশে বসে শ্রবণ করে তাহলে সেও সাওয়াবের অধিকারী হবে। এ ছাড়া মোবাইল, ইউটিউব ইত্যাদি থেকে কুরআন তিলাওয়াত শোনা যেতে পারে।
উপসংহার
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাথী সঙ্গীদের প্রদর্শিত পদ্ধতির অনুসরণেই মানবজাতির ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি নিহিত। কুরআন তিলাওয়াত করা ও তা শ্রবণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। উক্ত ইবাদতের বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে। তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত রাসুলুলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশিত পদ্ধতি অনুসরণ পূর্বক উক্ত ইবাদত পালনে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হওয়া।
লেখকঃ
পি.এইচডি গবেষক ও শিক্ষক
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,
 
লিডিং ইউনিভার্সিটি,
সিলেট।
ইমেইল: zia1290@gmail.com
মোবাইলঃ 01715610866


শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here