।। হাফিজ মুফতি মোস্তফা সোহেল হিলালী।।
শবে বরাত। আরবী ফারসি মিলে গঠিত শব্দ। যার অর্থ মুক্তির
রজনী। বাংলায় অনেকে একে ভাগ্য রজনী বলে থাকেন বা শবে বরাত বলতে তারা ভাগ্য রজনী
বুঝেন। মূলত শবে ক্বদরের সাথে তাল গুল পাকিয়ে ১৫ শাবানের রাতকেই ভাগ্য রজনী অর্থেই
বাংলাদেশে এর ব্যবহার হয় এবং বাংলাদের সাধারণ মানুষেরা তাই বুঝে থাকেন এবং এই
বুঝেই আমল করেন। অধিকাংশ মসজিদের ইমাম ও বক্তা এই অর্থেই ফযিলতের নসীহত করে
মানুষের মাঝে এই
রাতের গুরুত্ব, মাহাত্ম্য তুলে ধরেন। তাই সাধারণ মানুষের
মাঝে ক্বদরের রাত্রির চেয়ে এই রাতের গুরুত্ব বেশি এবং এই রাতকে ক্বদরের চেয়ে অনেক
বেশি মূল্যায়ন করে পালন করতে দেখা যায়। এখানে যে বিষয়গুলো লক্ষ্যণীয়:
প্রথমত: ভাগ্য রজনী বলতে ১৫ শা‘বান উদ্দেশ্য নেয়া একেবারেই ভুল ও কুরআনের
স্পষ্ট বিরোধি। মূলত সূরা দুখানের ৩-৫ আয়াত যা শবে ক্বদর সংক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে
স্পষ্ট, অপব্যাখ্যার মাধ্যমে তালে গুল পাকিয়ে সেগুলোকে নিয়ে
১৫ শা‘বানের উপর প্রয়োগ থেকেই ১৫ শা‘বানকে
ভাগ্য রজনী মনে করার ধারণার জন্ম নিয়ে তা বিশ্বাসে রুপান্তরিত হয়। এই ভুল বিশ্বাস
খণ্ডনার্থে যে সমস্ত আলেম বলেন, শবে বরাত বলতে কিছু নেই,
তাদের বলা ও আলোচনা যথার্থ এবং সঠিক। এতে কোনো সন্দেহ বা দ্বীমত
পোষণের কারণ নেই। এতে দ্বীমত পোষণ করা সুর্যকে অস্বীকার করার নামান্তর।
দ্বিতীয়ত: শবে বরাত বলতে মূল অর্থ হিসেবে একে মুক্তির রজনী বলা। ফারসি
এই শব্দের আরবী হলো ‘লাইলাতুল
বারাআত’ বা মুক্তির রাত। কুরআন বা হাদীসের কোথায়ও কোনো রাতকে
এই নামে আখ্যায়িত করা হয়নি। হ্যাঁ ১৫ শা‘বানের রাতে ক্ষমা
করার কথা একটি হাদীসে এসেছে বলে আমরা হয়ত একে মুক্তির রাত
বলছি। তবে হাদীসে এই রাতকে মুক্তির রাত বলা না হলেও মুক্তির ফযিলতের হাদীস থেকে এই
রাতকে মুক্তির রাত বলা যথার্থতা আমাদেরকে ভেবে দেখা দরকার। কেননা এই রাতের ফযিলতের
ব্যাপারে অনেক হাদীস বর্ণিত হলেও মাত্র একটি হাদীসকেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন
উলামায়ে কেরাম। এই হাদীসটিও এককভাবে সহীহ নয়। বরং বিভিন্ন তরীক্বায় আসার কারণে
তাকে সহীহ গণ্য করা হয়েছে বা সহীহ হাদীসের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। তাই আরবের যে সমস্ত
আলেমরা বলেন, এ ব্যাপারে কোনো সহীহ হাদীস নেই, অনুসন্ধান ছাড়াই অনেকেই তাদের কথার উপর হেয়মূলক আপত্তি করেন। আলবানী রহ.
এর কথা দিয়ে যারা দলীল দেওয়া দূরের কথা, বরং তাকে ভ্রান্ত
ভাবলেও এই জায়গায় তারা একক আলবানী রহ. এর রেফারেন্সেই হাদীসকে সহীহ বলে দাবী করেন।
বিভিন্ন তরীক্বায় এসে সহীহ হাদীসের মর্যাদায় উপনীত হাদীসটি
হলো: “মধ্য
শা‘বানের (১৪ তারিখ দিবাগত রাত) রাতে আল্লাহ তা‘আলা তার সৃষ্টির ওপর অবহিত হন, অতএব শিরকে লিপ্ত ও বিদ্ধেষ পোষণকারী ছাড়া তার সমস্ত সৃষ্টিকে ক্ষমা করেন।”
(মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ, ইবনু হিব্বান) প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ শুআইব আল
আরনাউত্ব এই হাদীসটির মন্তব্যে বলেন, “শাওয়াহিদের মাধ্যমে
হাদীসটি সহীহ)
যাই হোক, এই হাদীসটিকে ১৫ শাবানের ফযিলতের বেলায় সহীহ বা গ্রহণযোগ্য
বলে আলেমদের গবেষণা অনুযায়ী আমরা মেনে নেই। বাকী রইলো, এই
হাদীসের ভিত্তিতে এই রাতকে মুক্তির রাত বলার যথার্থতা প্রসঙ্গ।
আলেমেদের গবেষণা থেকে আমরা পাই যে, ১৫ শাবানের ফযিলতের
ক্ষেত্রে এই একটি মাত্র হাদীসই সহীহ। তবুও মৌলিকভাবে সহীহ নয়, বরং বিভিন্ন ত্বরীকায় হাদীসটি বর্ণিত হওয়ায় তাকে সহীহ গণ্য করা হয়েছে।
এবার আমরা একটি সহীহ হাদীস দেখি:
সহীহ মুসলিম সহ হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে একেবারে নির্ভরযোগ্য
যে সহীহ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে সেটি হলো,
يَنْزِلُ اللَّهُ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا
كُلَّ لَيْلَةٍ حِينَ يَمْضِي ثُلُثُ اللَّيْلِ الأَوَّلُ فَيَقُولُ أَنَا
الْمَلِكُ أَنَا الْمَلِكُ مَنْ ذَا الَّذِي يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيبَ لَهُ مَنْ
ذَا الَّذِي يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ مَنْ ذَا الَّذِي يَسْتَغْفِرُنِي
فَأَغْفِرَ لَهُ فَلا يَزَالُ كَذَلِكَ حَتَّى يُضِيءَ الْفَجْرُ
“প্রত্যেক রাতের প্রথম তৃতীয়াংশ যাওয়ার পর আল্লাহ
তা‘আলা দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, আমি বাদশাহ, আমি বাদশাহ, কে
আছে আমার কাছে দু‘আ করবে, আমি তার দু‘আ কবুল করব। কে আছে আমার কাছে আবেদন করবে, আমি তার
আবেদন পুরো করব। কে আছে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। ফজর
পর্যন্ত এমনভাবে ঘোষণা হতে থাকে।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস:১৮০৯)
উভয় হাদীস নিয়ে আমরা একটু পর্যালোচনা করলে ১৫ শা‘বানকে মুক্তির রজনি বলে
নির্ধারিত করার বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে।
এক: রাসূল সা. কোনো
রাতকে মুক্তির রাত এমন কোনো শব্দ তথা লাইলাতুল বারাআত বলেননি।
দুই: হাদীসে রাতে
মুক্তির কথা বর্ণনা করেছেন।
তিন: প্রতিদিন মুক্তির হাদীস
সহীহ গ্রহণযোগ্য হওয়ার বেলায় কারো কোনো দ্বীমত নেই।
চার: ১৫ শাবানের
হাদীস সহীহ হওয়ার বেলায় দ্বীমত সহ সব মিলিয়ে সহীহ ধরা হয়েছে।
এখন হাদীসের আলোকে সন্দেহাতিতভাবে প্রমাণিত মুক্তির রাতকে
আমরা মুক্তির রাত না বলে আপেক্ষিক দুর্বলভাবে প্রমাণিত ফযিলতের রাতকে মুক্তির রাত
বলা কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
কথায় বা কর্মে কোনো দিন বা রাতকে বিশেষ কোনো ফযিলতের সাথে
নির্ধারণ করার অধিকার একমাত্র রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ও সাল্লামের। আমাদের
এর কোনো অধিকার নেই। আমরা যাতে এখানে হস্তক্ষেপ না করি তাই রাসূল সা. কেবল জুমুআর
রাতে ইবাদত আর জুমুআর দিন রোযা রাখতে নিষেধ করে বলেন, “তোমরা সব রাতের মাঝে
জুমুআর রাতকে কিয়ামের জন্য নির্ধিারিত করো না এবং সব দিনের মাঝে জুমআর দিনকে রোযার
জন্য নির্ধারিত করো না”। (সহীহ মুসলিম:২৭৪০) জুমুআর
দিনের বিশেষ ফযিলত বা ক্ষমার কথা শুনে মানুষ তার নিজের বিবেক দিয়ে যেন অতিরিক্ত
কিছু না করে, এদিকে সতর্ক করতেই রাসূল সা. মূলত এই ফযিলতের
দিনের রাতে ইবাদাত ও দিনে রোযার জন্য নির্ধারণ করতে বারণ করেন।
তৃতীয়ত: ১৫ শা‘বানের রাতের ইবাদত। যিনি অন্য কোনো রাতে ইবাদাত করেন না তার
জন্য কেবল এই রাতের ইবাদাত করা কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা উপরোক্ত হাদীস ও আলোচনা থেকে
একেবারে স্পষ্ট।
এছাড়া প্রতি রাতের মুক্তির যে একেবারেই সহীহ হাদীস রয়েছে, সেই হাদীসে ইবাদাতের কথা
রয়েছে। যেমন বান্দা এই সময় আল্লাহকে ডাকবে অর্থাৎ তার ইবাদাত করবে, তার কাছে চাইবে, তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে,
করলে আল্লাহ তার ইবাদাত কবুল করবেন, তার আবেদন
পুরো করবেন, তার গোনাহ ক্ষমা করবেন। পক্ষান্তরে ১৫ শা‘বানের যে হাদীসটি সহীহ বলে গণ্য করা হয়েছে তাতে ইবাদাতের কোনো কথা নেই।
বরং এই রাতে আল্লাহ তার মাখলুকের অবস্থার উপর অবগত হয়ে মুশরিক এবং বিদ্ধেষী ছাড়া
সবাইকে ক্ষমা করেন। এটি একটি পর্যবেক্ষণের ন্যায়। পর্যবেক্ষণে যাদেরকে পাবেন এই
দুই মন্দ গুণ মুক্ত, তারা ঐ রাত ঘুমালেও ক্ষমা পেয়ে যাবে।
কেননা সে ঘুমে থাকলেও তার মাঝে এই দুই সিফাত আছে কি না, আল্লাহর
জানা আছে। আর এরই ভিত্তিতে ক্ষমা পাওয়া এই রাতের
ফযিলত।
অপরদিকে যার মাঝে শিরক ও বিদ্ধেষ রয়েছে, সে এই রাতের পুরো রাত্রিই
ইবাদাত করে কাটালে, আল্লাহ তা‘আলার
কাছে ক্ষমা চাইলে এই রাতের বিশেষ ক্ষমা সে পাবে না। হ্যাঁ, তবে যদি এই রাত আসার
আগেই বা রাত শেষ হওয়ার পূর্বেই খালিস তাওবার মাধ্যেমে নিজেকে শিরক ও বিদ্ধেষ থেকে
মুক্ত করে নেয়, তবে সে এই রাতের ফযিলত পাওয়ার তালিকায় প্রবেশ
করবে।
আমাদের অনেকেই বিদ‘আতের চুড়ান্ত বিরোধি হওয়া সত্বেও ফযিলতের
আশায় কেবল এই রাতের ইবাদতে কোনো সমস্যা মনে করেন না। তাদের কথা, একাকি একজন বান্দা ইবাদাত করবে এতে সমস্যা কি? আশাকরি
উপরোক্ত আলোচনা থেকে তাদের ভুল ভাঙ্গবে। কেননা যিনি ইবাদত করে মুক্তি পাওয়ার দিনে
ইবাদাত করেন না, তিনি এই দিনে কেন ইবাদাত করেন, যে দিন ইবাদাত করার কথা রাসূল বলেননি বা রাসূল সা. কোনো আমল দ্বারা এই
রাতকে বিশেষিত করেননি? অন্য দিন ইশরাক পড়া সওয়াবের কাজ হলেও
ঈদের মত ফযিলতের দিন ইশরাক পড়া না-জায়েয বলে আমরা জানি। কেননা রাসূল সা. ফযিলত
বলার সাথে সাথে তিনি যা করেছেন, ফযিলত পেতে আমাদেরকে সেই
কাজই করতে হয়। ঈদের দিনের ফযিলতের কথা বলেও তিনি ইশরাক পড়েননি, তাই আমাদের জন্যও পড়া না-জায়েয। এটা সহজেই বুঝলে আমরা ঐটা কেন বুঝি না।
নাকি এটা আমাদের কিতাবে আছে তাই বুঝি, আর ঐটা কিতাবে নাই তাই
বুঝি না।
আরেকটি জিনিষ আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, সব বিদআতের শুরু
স্বাভাবিক দিয়ে হয়েছে। শুরুতেই বিদআতের কল্পনা করা হয় না। একজন একটু ইবাদত করি মনে
করেই হয়ত সুন্নাতের বাহিরে কিছু করেছেন একেবারে স্বাভাবিক নিয়মে। এই অঙ্কুর থেকে
দানা বেঁধে গাছ হয়ে শাখা প্রশাখা দিয়ে বিশালকার বিদআতে রূপ নিয়েছে। আপনি যুক্তি
দিয়ে সুন্নাত থেকে সামান্য সরলে আরেকজন যুক্তিতে আরেকটু যুগ করে আরেক ধাপ আগালো।
এভাবে বিদআত যখন বিশাল আকারে রূপ নিলো তখন আপনি আমি সেটা রোধ করার চেষ্টা করছি,
তবুও জড় থেকে এর মুলোৎপাটন করতে চাচ্ছিনা। তাই বিরেধিতা করেও কাজ
হচ্ছে না। সবাই বুযুর্গের দলীল উপস্থাপন করছে। তাই আসুন বিদআতকে চিন্থিত করে তাকে
জড় থেকে কেটে সুন্নাতের সামনে নিজেকে পুরো নিয়োজিত করি। আল্লাহ তা‘আলা তাওফীক দিন। আমিন।
লেখকঃ পরিচালক ও প্রধান মুফতি, ইমাম আবু
হানিফা রহ. ফতোওয়া ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, সিলেট।
0 coment rios:
You can comment here