Saturday, April 18, 2020

মরহুম ডাঃ মঈন উদ্দিন ও কিছু স্মৃতি



।। মোঃ জাহির আলী।।

যদিও  ডাক্তার মঈন উদ্দিন স্যার ও আমার বাড়ি একই থানায়, কিন্তু উনার সাথে মুলত সম্পর্ক হয় প্রায় ১০ বছর আগে  উনার ইবনে সিনার সিলেট চেম্বারে। কারণ তিনি  রোগ এর তথ্য  সংগ্রহ করার পাশাপাশি অন্যান্য ব্যক্তিগত হাল অবস্থার খুঁজ খবর নিতেন, বিশেষ  করে বাড়ি ছাতক হলে তো আর কথাই নেই। যাক ২০১৩ সাল থেকে বাসস্থানের দিক থেকে ও উনার প্রতিবেশী হওয়ার সুবাদে সম্পর্ক আরও কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়।

বিশেষ  করে আমার  যে কোন পারিবারিক আনুষ্ঠানে উনাকে ও উনার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের আমার বাসায় পেয়েছি। উল্লেখ্য  যে উনার পরিবারে ৬ জন ডাক্তার সবাই সাদা মনের মানুষ ও সামাজিক। বিশেষ করে  উনার শশুড় প্রবীণ ডাক্তার জনাব সি এম নুর আহমদ প্রায়ই আমার বাসায় বেড়াতে  আসেন।
তাছাড়া  হাউজিং এস্টেটের ২ নম্বর রোডে আমি, ডাক্তার সাব, সম্মানিত কাউন্সিলর জনাব কয়েছ লোদী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডিজিএম জনাব তৈয়ব স্যার, ট্রাস্ট ব্যাংকের ইভিপি জনাব মাসুদ স্যার, আইবিবিএল এর মোস্তাফা ভাই, ইঞ্জিনিয়ার সফিক ভাই গ্যাস অফিসের ম্যানেজার সাইফুল ভাই, সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির মাসুদ ভাই, বিমান এর আকবর স্যার ও লতিফ মন্ডল, ব্যাবসায়ী আকসার ভাই, আব্দুল হাই আজাদ ভাই ও আলমগীর ভাই, গ্লোব ফামাসিউটিকেলস এর আঞ্চলিক প্রধান পাটোয়ারী ভাই, ও আহমদ ভাই সহ আরও  অনেকেই দলবদ্ধ ভাবে  সকালে হাটতাম সেই সুবাদে প্রায় প্রতিদিনই উনার সাথে দেখা হতো। তন্মধ্যে ব্যক্তিগত, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় আলোচনা হতো বিশেষ করে স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ ছিল অন্যতম।
যাক সেদিকে না গিয়ে যে স্মৃতিগুলো সারা জীবন আমাকে পীড়া দিবে সেগুলোর কিছু উল্লেখ করছি।

১. ২০১৬ সালের দিকে আমার প্রচন্ড জ্বর অনুভব করলে ৩ দিন পর আমি উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ এ আউটডোর এ দেখাই, কিন্তু ব্যবস্থা পত্র  এমন ছিল যে ৯ ধরনের ওষুধ ও টেস্ট তো আছেই। এদিন এ ওষুধ আমার খেতে ইচ্ছা করলনা এবং খেলামনা। পরেরদিন সকাল ৮.০০টায় আমি ডাক্তার সাবকে মোবাইলে কল দিলে রিসিভ হয়নি। পরে সকাল ৮.৫০ এ তিনিই  কল ব্যাক করে জানতে চান কল কি জন্য দিছিলাম, আমি আমার সমস্যার কথা বল্লে আমাকে এস এম এস এর মাধ্যমে ২টি ওষুধ আর ১টা টেস্ট দিয়ে বল্লেন ওষুধ খান সম্ভব হলে টেস্ট টা করিয়ে বিকেলে  আমাকে দেখাবেন। উনার সুন্দর ব্যবহার ও ব্যবস্থাপত্রে ওইদিনই আমার প্রায় অনেক টাই সুস্থতা অনুভব করি।এভাবে এ ক'বছর ধরে কত যে সেবা গ্রহণ করেছি তা ভাষায় ব্যাক্ত করতে পারবনা।

২.  আমার  পরিবারের কোনো সদস্য  অসুস্থ হলে আমি সবার আগে উনার পরামর্শ নিতাম। রোগটি উনার সাথে সম্পর্কিত হলে বলতেন আমার চেম্বারে পাঠিয়ে দিয়েন আমি  দেখে দিব। আর অন্য বিভাগের হলে নিজ দায়িত্ব মনে করে রেফার করতেন এবং ওই ডাক্তারকে  ফোনে বলে দিতে ভুলতেন না। উল্লেখ্য  যে আমার পরিবারের কারো ভিজিট আমার জানামতে দিতে পারিনি এমনকি অন্য কাউকে আমি পাঠলেও উনি ভিজিট কম রাখতেন।

৩. আমার জানামতে তিনি কখনো ওষুধ কোম্পানির কমিশন গ্রহণ করেননি এবং ওষুধের স্যম্পল যদিও কোন কোম্পানি দিত তিনি সেগুলো গরীব রোগীদের দিয়ে দিতেন। রোগীদের অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করতে দিতেন না।

৪. মরহুম ডাক্তার মঈন উদ্দিন প্রায়ই সকালে আমার বাসায় আসতেন আমার অফিসে যাওয়ার আগে অনেক সময় অনলাইনে টাকা প্রেরনের জন্য, বিশেষ করে আইবিবিএল আম্বরখানা শাখায় উনার ওয়াকফ একাউন্টে প্রতিমাসে ৫০০০ টাকা জমা দিতেন। গেল ফেব্রুয়ারি ২০২০ এর ১২ তারিখ আমার বাসায় আশির অধিক বয়স্ক শশুড় সকাল ৯.০০ টায় অসুস্থ হয়ে পড়লে চিন্তায় পড়ে যাই কী করব ভেবে পাচ্চিলাম না, এমতাবস্থায় ডাক্তার সাব আমার বাসায় এসে হাজির উনার ওয়াকফ একাউন্টের টাকা নিয়ে আমি মনে মনে খুশী হলাম এবং ব্যাপারটা জানালে তিনি বাসায় আমার শশুড়কে চেক আপ করে বললেন, তেমন সমস্যা না সেরে যাবে এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিলেন এবং সেই সাথে আরও বললেন অবস্থার পরিবর্তন না হলে বা যেকোনো অসুবিধায় যোগাযোগ করলে তিনি আবার এসে দেখে যাবেন।

৫. ডিসেম্বর ২০১৯ এর কোন এক শুক্রবার নামাজ শেষ হলে বাসায় আসলে একটু পরে গেইটে কেউ নক করছে মনে করে নীচে গিয়ে দেখি উনার কাজের মেয়ে একটি বোলে করে অনেক গুলো দেশী মাছ শোল, কইসহ ও আরও অনেক মাছ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করতেই বলল ডাক্তার সাবের গ্রামের বাড়ির পুকুরের মাছ আপনাকে পাঠাইছেন।

৬. গেল জানুয়ারি ২০২০ এর কোনো একদিন মসজিদে নামাজ শেষে দেখা হলে কুশল বিনিময়ের পরে বললেন, আপনাকে কিছু সবজি পাঠাইতে চাইছিলাম, দেখা হয়ে ভালোই হলো আপনি একটু কষ্ট করে আমার বাসার সামনে আসেন, যাওয়ার পর এক ব্যগ ভরা ফূল কপি, টমেটোসহ অনেক সবজি দিয়ে বললেন, নিয়ে যান আমি টুকের বাজারে নিজে গিয়ে ফ্রেশ সবজি এনেছি।

৭. সদ্য উনার শশুড়ের বাসার নিকটে ৭ শতকের ১টা আধা পাকা বাসা কিনেছেন যা কন্সট্রাকশনের কাজে শীঘ্রই হাত দিতে চান। দেখা  হলেই বলতেন আপনি আপনার বাসার কাজ করে অনেক অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন তাই আমার বাসার কাজের সময় আপনাকে কন্সাল্টেন্ট হিসেবে নিয়োগ করতে চাই। আপনি সময় পেলেই এসে গাইড দিবেন।

৮. বিগত মাসের মাঝ সময় একদিন সকালে হাটছিলাম, সাধারণত ডাক্তার সাব আসলেই আমাদের সাথে যোগ দেন কিন্তু এদিন আর আমাদের সাথে যোগ না দিয়ে সোজা হাটতে থাকেন এবং সাইফুল ভাইকে ডেকে নিয়ে বললেন, এইচ. ডব্লিউ এর নিদেশনা অনুযায়ী ৫ জন এক সঙ্গে হতে পারবেন না তাই এখন থেকে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে হাটতে হবে।

এভাবে আমরা আল্লাহর বান্দার মুখের বাণী শুনি এবং সাবধানতা অবলম্বন করে হাটতে লাগলাম। এর পরে  তিনি আর রাস্তায় হাটতে বের হননি আমি দেখতাম বিকেলে উনার বাসার ছাদে হাটতেন এবং আমার সাথে বাসার ছাদে থেকে কুশল বিনিময় হতো।

উনার সাথে সর্বশেষ কথা হয় মাচের ৩০ তারিখ এবং উনি আমার সাথে স্বাভাবিক কথাই বলছিলেন। এখন এসব স্রেফ স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাছাড়া আক্রান্ত হয়ে বাসায় ৩ দিন ছিলেন তখন প্রায় ১৫ ফুট দুরত্ব উনার বেড রুম হতে কাশীর শব্দ শুনতাম এবং বুঝতাম উনার খুব কষ্ট হতো কিন্তু সিস্টেমের কারণে আর উনার সাথে কথা বলতে পারিনি।

এপ্রিল মাসের ৭ তারিখ রাত ১০.০০ টায় শ্বাস কষ্ট শুরু হলে প্রথমে সামছুদ্দিন হাস্পাতাল ও পরে ঢাকা কর্মিটুলা জেনারেল হাস্পাতালে দীর্ঘ ১ সাপ্তাহ করোনা ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করে মহান মাবুদের ডাকে সাড়া দিয়ে ১৫ এপ্রিল ভোর বেলায় না ফেরার দেশে চলে গেলেন।

তাই সকলের কাছে বিনীত আরজ উনার জন্য দোয়া করবেন যেন মহান আল্লাহ শহীদের উচ্চ মাকামে উনাকে স্থান দেন এবং শোকাহত পরিবারকে শোক বহন করার তাউফিক দান করেন। আমিন।
লেখকঃ
সিনিয়র অফিসার, 
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, লালদিঘীর পার শাখা।   

শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here