Tuesday, April 28, 2020

মাহে রমজানে ইবাদতের হিসাব নিকাশ

 
।। মুন্সি আব্দুল কাদির।।

আল্লাহ তায়ালা সকল মুমিনগণকে তাঁর প্রিয়পাত্র বানাতে মাহে রমজান দিয়েছেন। মানবজাতিকে দুর্বল ও তাঁর মুখাপেক্ষি করে বানিয়েছেন । কিন্তু মানুষ সে কথা ভুলে যায়। ভুলে যায় তার স্রষ্টাকে। এই ভুলে যাওয়ার কারনে স্রষ্টার সাথে প্রতিনিয়ত তার দুরত্ব বাড়তে থাকে। সে হয়ে যায় আল্লাহর নাফরমান। সেই নাফরমান যখন আল্লাহর একত্ববাদ ও রাসুলের রেসালতে বিশ্বাসের ঘোষণা দেয়, সাথে সাথে হয়ে যায় আল্লাহর প্রিয়। তখন তার আর কোনো গুনাহ থাকেনা। অপরদিকে মুমিনগনও শয়তানের কুমন্ত্রণায় ও প্রবৃত্ত্বি তাড়নায় অনেক ভুল করে বসে। এই ভুলগুলো শোধরিয়ে প্রভুর পথে অবিচল থাকার বা পাপ পংকিল কুৎসিত রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা রোজা নামক এক মহা চিকিৎসা ব্যবস্থা দিয়েছেন । 

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে রমজান মাসে রোজা রাখা। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরয করে দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ﴾
অর্থাৎ, "হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর"। (সূরা বাকারা, আয়াত:১৮৩)

হাদিস শরীফের মধ্যে এসেছে রোজার বদলা আল্লাহ নিজ হাতে দিবেন। এমনকি রোজাদারের জন্য জান্নাতে রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে যেটা দিয়ে সে জানাতে প্রবেশ করবে। বুখারী শরীফের হাদিসে এসেছে-
﴿حَدَّثَنَا خَالِدُ بْنُ مَخْلَدٍ حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ بِلَالٍ قَالَ حَدَّثَنِي أَبُو حَازِمٍ عَنْ سَهْلٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ فِي الْجَنَّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرَّيَّانُ يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لَا يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ يُقَالُ أَيْنَ الصَّائِمُونَ فَيَقُومُونَ لَا يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ فَإِذَا دَخَلُوا أُغْلِقَ فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ﴾
অর্থাৎ, "হযরত সাহল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- জান্নাতের রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন রোজা পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তাদের ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেয়া হবে, রোজা পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। যাতে করে এ দরজাটি দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে"। (বুখারী, আস সহীহ, খণ্ড-৬, পৃ. ৪৬১, হাদীস নং ১৭৬৩)

আমরা অনেকেই মনে করি যে, দিনের বেলায় উপোস করার নাম রোজা। আসলে প্রকৃত পক্ষে শুধু উপোস থাকার নাম রোজা নয়। বরং উপোস থাকার পাশাপাশি আপনার সমস্ত অঙ্গ প্রতঙ্গের রোজা আছে। যেমন, হাত, চোখ, কান, জবান ও পায়ের রোজা ইত্যাদি। এই সবকিছুকে আপনি খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে। যেহেতু রোজার অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা। এমনকি রমজান মাসে দিনের বেলায় অনেক হালাল কাজও হারাম হয়ে যায়। বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিসে এসেছে-
﴿عن ابى هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قال - قال رسول الله () - قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلاَّ الصِّيَامَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ فَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ يَوْمَئِذٍ وَلاَ يَسْخَبْ فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ﴾
অর্থাৎ, "আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)  বলেছেন- মানব সন্তানের প্রতিটি নেক কাজের সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়। মহান আল্লাহ বলেন, আদম সন্তানের যাবতীয় আমাল তার নিজের জন্য কিন্তু রোজা বিশেষ করে আমার জন্যই রাখা হয়। আর আমি নিজেই এর প্রতিদান দিব। রোজা পালনকারীর জন্য তা ঢাল স্বরূপ। সুতরাং যখন তোমাদের কারো রোজার দিন আসে সে যেন ঐ দিন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে এবং অনর্থক শোরগোল না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে বিবাদ করতে চায়, সে যেন বলে, আমি একজন রোজাদার"। (বুখারী, আস-সহীহ, খণ্ড-২, পৃ. ৬৭৮; মুসলিম, আস-সহীহ, খণ্ড-২, পৃ. ৮০৭) বুখারী ও মুসলিম শরীফে আরো এসেছে-
﴿حَدَّثَنَا آدَمُ بْنُ أَبِي إِيَاسٍ حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي ذِئْبٍ حَدَّثَنَا سَعِيدٌ الْمَقْبُرِيُّ عَنْ أَبِيهِ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ﴾
অর্থাৎ, "হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তাঁর এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই"। (বুখারী, আস-সহীহ, খণ্ড-৬, পৃ. ৪৭২, হাদীস নং ১৭৭০)
উপরোক্ত আয়াতে কারীমা ও হাদিসে রাসুল (সা.) এর দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। আমরা প্রতি বছর রোজা পালন করছি। এই আয়াত ও হাদিসের সাথে আমাদের ব্যক্তি বা সমাজ জীবনের বাস্তবতা কতটুকু? রোজার মাধ্যমে আমরা কতটুকু লাভবান হচ্ছি? রোজা নামক ঔষধ সেবনে আমার এগার মাসে আদরে আহলাদে পালিত স্বাস্থ্যবান পাপ পঙ্কিলতা পূর্ণ প্রবৃত্তি দমন করতে পারছি কিনা? বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই উত্তর না সূচক হবে। কিন্তু কেন? এতো কষ্ট করে সুবহে সাদিক থেকে সন্ধা পর্যন্ত ত উপোষ থাকায় আমার কি লাভ ? কেনইবা উপোষ থাকব? এই কেন এর উত্তর জানা খুবই জরুরী, তবেই আমি আল্লাহ ওয়ালা হতে পারব এবং হতে না পারলেও ঐ পথে চলা শুরু করতে পারব ।

আমার বয়স অনুপাতে যদি হিসাব করি, তবে দেখি যে বর্তমানে আমার বয়স ৪০ বৎসর। তাহলে অন্তত: ২৫ বৎসর আমি পুরোপুরি পুরো মাস রোজা রেখেছি। এই হিসেবে প্রতি বৎসর যদি আমি শতকরা ৪% আল্লাহ ওয়ালা বা মুত্তাক্বীর গুণ অর্জন করতে পারতাম তবে বর্তমানে এসে আমি ১০০% আল্লাহ ওয়ালা হয়ে যাওয়ার কথা। যার বয়স ৬৫ বৎসর, তিনি অন্তত ৫০ বৎসর পুরোপুরি রোজা আদায় করেছেন। তিনি যদি প্রতি বৎসর ২% মুত্তাক্বীর গুণাবলী অর্জণ করতে পারতেন তাহলে ৫০ বৎসরে ১০০% আল্লাহ ওয়ালা হয়ে যাওয়ার কথা। এই অনুপাতে সমাজে বেশীর ভাগ মুসলমানই আল্লাহর ওলি থাকার কথা। সমাজের বেশীর ভাগ মুসলমানই জান্নাতী হতেন। সমাজের আবহ জান্নাতী ঘ্রাণে সুবাসিত হত। কিন্তু প্রশ্ন আমি কত ভাগ মুত্তাক্বীর গুণাবলী অর্জন করেছি? উত্তর খুবই হতাশাজনক। প্রতি বছর রমজানে রোজা রেখে আমি যতটুকু ভালো হওয়ার চেষ্টা করি, পরবর্তী এগারো মাসে সেই গুণসমূহ আর আমার মধ্যে থাকেনা। ফলে প্রতি বছর পুনরায় আমাকে শূন্য থেকে এমনকি ঋণাত্মক অবস্থা থেকে গুণাবলী অর্জন শুরু করতে হয়।

সামাজিকভাবে দেখা যায় রমজানের প্রথম দশদিন একটি পবিত্র আবহ সমাজে বিরাজ করতে থাকে। এক জান্নাতি সমিরণে হৃদয়ে শান্তির ফোয়ারা বইতে থাকে। কারণ প্রথমদিকে মুসলিম সবাই রোজা রাখার চেষ্টা করে। তখন মুসজিদসমূহও থাকে ভরপুর, কোলাহল পূর্ণ। জান্নাতের ফেরেশতারা যেন প্রত্যেক মুসলিমের মাথায় শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়।  আস্তে আস্তে দিন গুজরান হয়। সাথে সাথে রোজায় ভাটা পড়তে শুরু করে। মসজিদগুলো খাঁ খাঁ করতে থাকে। মানুষজন ইবাদত মুখি না হয়ে শপিংমল মুখি হয়ে পড়ে। পবিত্রতা তখন বেহায়াপনার প্রতিযোগীতায় রূপ নেয়। ভালো ইমানদারের পক্ষে তখন কোনো শপিংমল পূর্ণ এলাকায় যাওয়াও কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়ে।
অন্য দিকে রমজান মাসে মহিলাগণ সারা দিন ইফতারীর বিভিন্ন আইটেম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ইফতারীতে কত যে ফর্দ তার হিসাব মেলা ভার। ইফতারী ও সাহরীর খাবারের হিসাব করলে দেখা যায়, আমরা রমজান মাসে অন্যান্য মাসের তুলনায় খাবার কমাচ্ছিনা, শুধু খাবার গ্রহণের সময়ের পরিবর্তন করছি এবং তাতে খাদ্য মান এবং খরচ অন্যান্য মাসের তুলনায় অনেক গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছি। এক্ষেত্রে সংযমের বড়ই অভাব ।

অপরদিকে দেখা যায়, যাদের পর্যাপ্ত সময় রয়েছে, তারা সময় পার করার জন্য টেলিভিশন দেখা, খেলাধুলা ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অথচ তিনি সেই সময়টুকু কোরআন অধ্যয়ন করতে পারতেন, তার ইসলামী সাহিত্য পড়ার সুযোগ ছিল।

আরো দুঃখ জনক নামাজের ক্ষেত্রে, নামাজ মুমিনদের মিরাজ, আল্লাহর সাথে বান্দার একান্ত কথোপকথন, সর্বোত্তম বন্ধুর নিকট সব কিছু চাওয়া পাওয়ার উপযোগী সময়। আমরা জানি পৃথিবীর সকল কাজে যে যত পারদর্শী, অভিজ্ঞ, সেই কাজ ঐ ব্যক্তি তত দ্রুত ও নির্ভুলভাবে করতে পারে। কিন্তু নামাজ এর ব্যতিক্রম। নামাজে একজন মুমিন যত পারদর্শী হবে, সে তত বেশী ধীরস্থির হবে।

কারণ প্রিয়পাত্রের সাথে মানুষ যত বেশী সম্ভব সময় নিতে চায়। সহজে বিচ্ছিন্নতা চায় না । শত বাধা পেড়িয়ে প্রেমাস্পদের সাক্ষাৎ লাভ করতে মন সব সময় উতলা থাকে। কিন্তু আমাদের সমাজে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এর উল্টো দেখা যায়। বিশেষত তারাবিহর নামাজের ক্ষেত্রে। বিষয়টি এমন রূপ লাভ করেছে যে, যে নামাজ খুব তাড়াতাড়ি পড়তে হয়, সে নামাজের নাম যেন তারাবিহ। বেশীর ভাগ মসজিদে ও অন্যান্য জামাতে আজকাল খতমে তারাবিহ হয়। এটা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু হাফেজ সাহেবের ক্বেরাতে আয়াতের শেষ শব্দ ছাড়া বেশীর ভাগই মুসল্লিগণ বুঝতে পারেননা যে, হাফেজ সাহেব কি পড়ছেন। রুকু সেজদাও এত তাড়াতাড়ি করেন যে তাছবীহসমূহ সঠিকভাবে পড়া দুস্কর। আর যে ইমাম যত তাড়াতাড়ি নামাজ শেষ করতে পারেন, সেই ইমামই বেশী প্রিয়। এতে করে আমাদের নামাজ হচ্ছে কি না, না মাওলার সাথে তামাশা করছি ভেবে দেখার দরকার। এই নামাজ কি তারাবিহ, কিয়ামুল লাইল কিছু হচ্ছে ?
আমাদের বেলায় দেখা যায়, মসজিদ যেন এক আজাবের জায়গা এখানে ৫ মিনিট বেশী থাকা যাবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মমজিদ থেকে বের হতে হবে। নামাজে একটু সময় বেশী নিলে ইমাম সাহেবের উপর অনেক সময়  দারোগাগিরী করতেও কুসুর করিনা।

ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে রোজার মাস হল, ব্যবসার মাস। বাকি এগারো মাস লাভ যাই করুক না কেন এই মাসে লাভের ষোলো আনা পূর্ণ করতে হবে। আমাদের দেশে রোজার মাস আসার আগেই দ্রব্য সামগ্রীর দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। এর লাগাম টেনে ধরার কেউ নেই। সাধারণ মানুষের ক্রয় সীমার বাইরে চলে যায় জিনিসপত্রের দাম। তারপরও আরো চাই, আরো চাই। তবে এই মজুদদার পাইকাররা সমাজে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত। তারা সমাজ হিতৈসী, দানবীর, গরীবের বন্ধু কত কি উপাধী। মসজিদে তাদের অবস্থান সামনের কাতারে। তাদের ছাড়া সমাজ চলার কল্পনাও করতে পারেনা। এ ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কেনো অপরাধবোধও জাগ্রত হতে দেখা যায়না। সত্যিকার অর্থে এই মাস ব্যবসার মাস তবে আমাদের দুনিয়াবী ব্যবসা হয়। এই ব্যবসা হল আল্লাহ ওয়ালা হওয়ার ব্যবসা। আল্লাহ ওয়ালা হতে আমার যত ঘাটতি রয়েছে, এসব পুষিয়ে নেওয়ার ব্যবসা। তাই এই মাসে কম লাভ করে রোজাদারদের প্রতি ইহসান করা উচিৎ।

আমাদের জীবনে প্রতি বছরই একবার  রমজান আসে। যত দিন বেচেঁ থাকব এই বরকতময় মাস, রহমতের মাস আসবেই। রহমতের বসন্তে ফুলের সুবাসে চারিদিক মাতুয়ারা হবেই। বসন্তকাল এসে আমাদের জীবনে সুবাস ছড়াবেই। কিন্তু আমাদের দৃষ্টি শক্তি যদি হয় ক্ষিণ বা অন্ধ, কর্ণকুহরে যদি আওয়াজ পৌঁছার অবস্থা না থাকে। দুর্গন্ধ শুকতে শুকতে যদি সুবাস আর দুর্গন্ধ পার্থক্য করার শক্তি হারিয়ে ফেলি। দেমাগ যদি কুচিন্তা-কুভাবনায় আচ্ছন্ন থাকে। নুরী আর পাথরের তুলনা করতে যদি আমি হই অপারগ। চোখ দুটো যদি পর্দায় ঢাকা পড়ে যায়। তাহলে বসন্তের ফুলেল ধরা, মৌ মৌ সৌরভ আমার কি কাজে লাগবে। মরু সাইমুমের বালি ঝড়ে আমার মাথার উপর পাহাড় গড়বেই।

পৃথিবী যতদিন টিকে থাকবে ততদিন এই মাস আবৃত হবেই। রহমত, নাজাতের মাগফেরাতের পত্র পল্লবে পৃথিবী ভরে উঠবে। মাঠ ঘাট ফুল ফসলে ভরা থাকবে। আমি ফুলের সুবাস নেব কি না? নবান্নের ফসল ঘরে তুলতে প্রস্তুত কি না তা আমাকেই ভাবতে হবে। কারণ আমার কবরে আমি একাকীই যাত্রী। আমার হিসাব আমাকেই দিতে হবে। আমার শাস্তি বা শান্তি আমাকেই পেতে হবে। এখানে কোনো সহযোগী, সমব্যথী, শান্তনা দাতা কেউ নেই ।
রোজা হল আল্লাহকে পাওয়ার মধ্য মেয়াদী ট্রেনিং কোর্স, সবচেয়ে শর্ট কোর্স হল হজ্জ ও আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাৎ, দীর্ঘ মেয়াদী কোর্স হল, পুরো জীবন দ্বীনের পথে অটল থাকা। এই মধ্যমেয়াদী ট্রেনিং কোর্স সফলতার সাথে আঞ্জাম দিতে পারলে দীর্ঘ মেয়াদী ট্রেনিং কোর্সও সফলতার স্বাক্ষর রাখায় সহায়ক হবে। তাই আমাদের উচিত ভেবে চিন্তে রোজা রাখা ।

আমরা দেখি মানুষ যত কাজ করে, কাজ করার শেষে প্রত্যেকটি কাজের পর্যালোচনা করে যে, কাজটা কতটুকু সুন্দর হয়েছে। একজন কৃষক জমি চাষ করার পর আইলে উঠে দেখে জমির চাষ সুন্দর হয়েছে কি না। একজন ছাত্র পরীক্ষায় উত্তরসমূহ লিখে উত্তরপত্র জমা দেওয়ার আগে দেখে নেয় তার উত্তরগুলো যথাযথ হয়েছে কি না। একজন ব্যাংকার নির্দিষ্ট সময় গ্রাহক সেবা দেওয়ার পর হিসাব মিলিয়ে দেখে সব ঠিকঠাক করা হয়েছে কিনা। একজন ব্যবসায়ী দিন শেষে হিসাবে দেখে দেয় তার কত টাকা বিক্রয় হয়েছে আর কত টাকা লাভ হয়েছে। কিন্তু ইবাদতের বেলায় আমরা বেখবর। ইবাদতকে মনে করা হয় আল্লাহর কাজ। আল্লাহতো আর কারো মুখাপেক্ষী নন। তাই যেন তেনভাবে ইবাদত করলেই হয়ে যাবে। আসলে কি তাই? ইবাদততো একমাত্র আমার কাজ। যাতে অন্য কেউ শরীক নেই। অথচ ইবাদতের পর দেখা হয়না যে, ইবাদতটি কতটুকু সুন্দর হয়েছে? ইবাদতের হক কতটুক আদায় হয়েছে? ইবাদত করতে গিয়ে আমার কী কী ত্রুটি হয়েছে?
আসুন ইবাদত করি জীবন্তভাবে। কোরআন, তাসবীহ তাহলীল, দুরুদ ইস্তেগফার পড়ি গভীর মনোনিবেষ বা ধ্যানের সাথে। আর প্রত্যেকটি ইবাদতের পর পর্যালোনা করি আমি একাকি কি কতটুকু করতে পেরেছি। আর মাওলার দরবারে আকুতি নিয়ে ধরণা দেই ।

আজকের দিনে আমার ইবাদতে হতে হবে একনিষ্ট, আমার খাদ্য, পানীয় বর্জনের সাথে সাথে, আমার দেমাগকে করতে হবে কুচিন্তা, কুভাবনা মুক্ত। আমার কান শুনবেনা কোনো গিবত, অপবাদ। আমার জিহবা দ্বারা কোনো মিথ্যা, অপবাদ, কুৎসা, গিবত উচ্চারিত হবে না। আমার হাত কোনো খারাপ কাজে লাগবেনা। আমার পা খারাপের দিকে চলবেনা। কোন হারাম দ্বারা আমার উদর পুর্তি হবেনা। আমার চোখ নাজায়েজ কোনো জিনিস দেখবে না। এভাবে সর্বাত্মক রোজা রাখতে পারলেই আমরা পুরোপুরি সফলকাম হতে পারব ইনশাআল্লাহ । তাই বলি,

ভেবে চিন্তে রাখলে রোজা
জান্নাত পাওয়া খুবই সোজা ।
লেখকঃ কবি ও প্রাবন্ধিক
সিনিয়র অফিসার ও জিবি ইনচার্জ
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ


শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here