Monday, April 13, 2020

আপদ কালীন সময়ে মসজিদে ছালাতের জামায়াত ও শরয়ী দৃষ্টিভঙ্গি


।।সৈয়দ জিল্লুর রহমান।।

মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করছেন। তিনি তাদের জন্য খাদ্য দ্রব্যের ন্যায় অনেক অনুগ্রহের যেমন ব্যবস্থা করেছেন, তেমনি তাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য সৃষ্টি করেছেন রোগ-বালাই ও মহামারী। তবে সে রোগ ও মহামারীর শিকার শুধুমাত্র অপরাধী জনগোষ্ঠীই হয় না। অনেক সময় ঈমানদার ও কল্যাণমুখী জনগোষ্ঠীও সে মহামারীর শিকার হতে পারে। যদি কোনো ঈমানদার সে মহামারীর শিকার হয়ে মারা যায় কিংবা ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তাহলে মহান আল্লাহ তাদেরকে পুরষ্কারের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দান করেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে:
﴿عَنْ عَائِشَةَ أَنَّهَا قَالَتْ سَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ الطَّاعُونِ فَأَخْبَرَنِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ كَانَ عَذَابًا يَبْعَثُهُ اللَّهُ عَلَى مَنْ يَشَاءُ فَجَعَلَهُ رَحْمَةً لِلْمُؤْمِنِينَ فَلَيْسَ مِنْ رَجُلٍ يَقَعُ الطَّاعُونُ فَيَمْكُثُ فِي بَيْتِهِ صَابِرًا مُحْتَسِبًا يَعْلَمُ أَنَّهُ لَا يُصِيبُهُ إِلَّا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَهُ إِلَّا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ الشَّهِيدِ
অর্থাৎ, “আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে মহামারী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) আমাকে জানালেন যে, এটি একটি শাস্তি, আল্লাহ যাকে চান তার উপর তা প্রেরণ করে থাকেন। অতঃপর তিনি এটাকে মুমীনদের জন্য রহমতে পরিণত করেন। অতএব কোনো ব্যক্তি যদি মহামারী আক্রান্ত এলাকায় পড়ে যায় এবং নিজ বাড়িতে ধৈর্য্য সহকারে, সাওয়াবের নিয়তে এ বিশ্বাস নিয়ে অবস্থান করে যে, মহান আল্লাহ তার তাকদীরে যা লিখে রেখেছেন, তার বাইরে কোনো কিছু তাকে আক্রান্ত করবে না। (অত:পর সে যদি আক্রান্ত হয়ে মারা যায়), তাহলে তার জন্য রয়েছে শহীদের সমান পুরষ্কার। (মুসনাদু আহমাদ, হাদীস নং ২৬১৩৯)

এ হাদীছে তো স্বীকার করা হেয়েছে যে, মহামারীর কারণে নিরপরাধ কোনো ঈমানদার ব্যক্তিও মারা যেতে পারেন। তখন আল্লাহ তাকে শহীদের মত পুরষ্কার দান করবেন। মহামারীর কারণে যে ঈমানদার লোকেরা ধ্বংস হতে পারেন, সেকথা কুরআন মজীদেও বলা হয়েছে। 
মহান আল্লাহ বলেন:
 ﴿قُلْ أَرَأَيْتَكُمْ إِنْ أَتَاكُمْ عَذَابُ اللهِ بَغْتَةً أَوْ جَهْرَةً هَلْ يُهْلَكُ إِلَّا الْقَوْمُ الظَّالِمُونَ
অর্থাৎ, “তুমি বল, তোমরা কি ভেবে দেখেছ, যদি হঠাৎ করে অথবা প্রকাশ্যভাবে তোমাদের কাছে আল্লাহর শাস্তি চলে আসে, তখন কি শুধু অত্যাচারী জন্যগোষ্ঠীই ধ্বংস হবে? (সূরা আল আনআম, আয়াত:৪৭)

কোনো এলাকায় মহামারী দেখা দিলে সে এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়াও ঠিক নয়। কারণ এ ধরণের আচরণের মাধ্যমে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে এবং আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়ার কারণ হবে। এ রকম ক্ষেত্রে কি করতে হবে, সেকথাও হাদীছে রয়েছে। বর্ণিত আছে:
﴿عَنْ يَحْيَى بْنِ سَعْدٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ ذُكِرَ الطَّاعُونُ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ رِجْزٌ أُصِيبَ بِهِ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ فَإِذَا كَانَ بِأَرْضٍ فَلَا تَدْخُلُوهَا وَإِذَا كَانَ بِهَا وَأَنْتُمْ بِهَا فَلَا تَخْرُجُوا مِنْهَا
অর্থাৎ, “ইয়াহইয়া বিন সায়ীদ (রাহ.) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট মহামারীর বিষয়ে আলোচনা হলে তিনি বললেন: “এটি একটি শাস্তি, যা তোমাদের পূর্বের লোকেরা ভোগ করেছে। এটি কোনো এলাকায় থাকলে, তোমরা সে এলাকায় প্রবেশ করবে না। আর যখন তোমরা নিজেরা সে এলাকায় থাকবে, তখন তোমরা সে এলাকা থেকে বের হবে না।” (মুসনাদু আহমাদ, হাদীস নং ১৪৯১)

এ হাদীছ থেকে বর্তমানে প্রচলিত লকডাউনের সমর্থন পাওয়া যায়। শুধু সমর্থন নয়, বরং বলা যায় আধুনিক লকডাউন থিওরীটি এ হাদীছ থেকেই এসেছে।

লকডাউন করা হয় এ কারণে যে, এক জনের শরীর থেকে যাতে করে অপর লোকের শরীরে রোগ জীবানু না ছড়ায় এবং সংক্রামক কোনো রোগের বিস্তার থেকে অন্য এলাকার জনগণকে রক্ষা করা যায়। মসজিদে ছালাতের জামায়াতে অনেক লোকের সমাগম ঘটে। এখন যদি জামায়াতে ছালাত আদায় অব্যাহত থাকে, তাহলে রোগটি এক জনের শরীর থেকে অপর লোকদের শরীরে সংক্রামিত হবে এবং আক্রান্ত একজন থেকে অনেক লোক আক্রান্ত হবে। এজন্য দৈনিক পাঁচ বেলার জামায়াত এবং জুমার জামায়াত মসজিদে আদায় না করে সবাইকে নিজ নিজ বাড়িতে আদায় করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল মসজিদে জামায়াত বন্ধ করে বাড়িতে আদায় করার এ প্রস্তাব শরীয়ত সম্মত কি না। আসুন আলোচনা করি।
 
রাসূলুল্লাহ (ছা.) মহামারীর কারণে মসজিদে ছালাতের জামায়াত বন্ধ করেছেন বলে কোন বর্ণনা পাওয়া যায় নি। কারণ তাঁর জীবদ্দশায় মাদীনায় কোনো মহামারীর ঘঠনা ঘটে নি। কিন্তু বিরূপ আবহাওয়ার কারণে মসজিদে জামায়াতে ছালাত আদায় বন্ধ করেছিলেন বলে হাদীছে বর্ণনা রয়েছে। যেমন বর্ণিত হয়েছে:
﴿عَنْ ابْنِ عُمَرَ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُنَادِي مُنَادِيهِ فِي اللَّيْلَةِ الْمَطِيرَةِ أَوْ اللَّيْلَةِ الْبَارِدَةِ ذَاتِ الرِّيحِ صَلُّوا فِي رِحَالِكُمْ
অর্থাৎ, “হজরত আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন বৃষ্টির রাতে অথবা কনকনে শিতের রাতে ঝড়ো বাতাস হলে রাসূলুল্লাহ (ছা.) এর মুয়াজ্জিন ঘোষণা করতেন- “তোমরা নিজ নিজ বাসস্থানে ছালাত আদায় করে নাও।” (ইবনু মাজাহ, হাদীস নং-৯২৭)
শুধু তাই নয়, জুমার জামায়াত আদায় না করে তিনি বাড়িতে ছালাত আদায় করার জন্য বলেছিলেন বলেও হাদীছ রয়েছে। যেমন- বর্ণিত হয়েছে:
 ﴿عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ فِي يَوْمِ جُمُعَةٍ يَوْمِ مَطَرٍ صَلُّوا فِي رِحَالِكُمْ
অর্থাৎ, “ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি নাবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (ছা.) বৃষ্টি কবলিত জুমার দিনে বললেন: ”তোমরা তোমাদের নিজ নিজ বাসস্থানে ছালাত আদায় করে নাও।(ইবনু মাজাহ, হাদীস নং ৯২৮) জুমার দিন আজান দেয়ার সময়ে حَيَّ عَلَى الصَّلَاةِ (ছালাতের দিকে আস) না বলে তদস্থলে صَلُّوا فِي بُيُوتِكُمْ (তোমরা নিজ নিজ বাড়িতে ছালাত আদায় করে নাও) বলে আজান দেয়ার নির্দেশ দেন রাসূলুল্লাহ (ছা.) এর অতি প্রিয় ছাহাবী উম্মাতের নিকট রায়ীসুল মুফাসসিরীন বলে খ্যাত ছাহাবী হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.)। যেমন বর্ণিত হয়েছে:
﴿قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ لِمُؤَذِّنِهِ فِي يَوْمٍ مَطِيرٍ إِذَا قُلْتَ أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ فَلَا تَقُلْ حَيَّ عَلَى الصَّلَاةِ قُلْ صَلُّوا فِي بُيُوتِكُمْ فَكَأَنَّ النَّاسَ اسْتَنْكَرُوا قَالَ فَعَلَهُ مَنْ هُوَ خَيْرٌ مِنِّي إِنَّ الْجُمْعَةَ عَزْمَةٌ وَإِنِّي كَرِهْتُ أَنْ أُحْرِجَكُمْ فَتَمْشُونَ فِي الطِّينِ وَالدَّحَضِ
অর্থাৎ, “আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) তাঁর মুয়াজ্জিনকে বললেন: তুমি যখন আজানের সময়ে أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ বলবে, তারপরে حَيَّ عَلَى الصَّلَاةِ (ছালাতের দিকে আস) বল না বরং তদস্থলে তুমি বল صَلُّوا فِي بُيُوتِكُمْ (তোমরা নিজ নিজ বাড়িতে ছালাত আদায় করে নাও)। এভাবে আজান দেয়ার পরে লোকেরা সমালোচনা শুরু করলে তিনি বললেন: ”এভাবে আজান দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি আমার চেয়ে অনেক শ্রেষ্ঠ ছিলেন অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সা.)। নিশ্চয়ই জুমা একটি জরুরী কাজ। আর আমি তোমাদেরকে মাটি ও কাদা মাড়িয়ে জুমার জন্য বের করতে অপছন্দ করলাম।” (বুখারী, হাদীস নং-৮৫০)

বৃষ্টিতে জুমায় হাজির না হওয়ার অনুমতি প্রসঙ্গে ঝড়-বৃষ্টির জন্য জুমার ছালাত বন্ধ রেখে বাড়িতে জুহরের ছালাত আদায় করার অনুমতি থাকলে মহারারীর জন্য সে অনুমতি অতি সহজেই থাকবে, সে ব্যাপারে কেউ দ্বিমত করবেন না বলেই আমাদের ধারণা। কারণ ইসলাম হল সহজ। মহান আল্লাহ তার গোলামদেরকে কঠিন কোনো বিষয়ের নির্দেশ দেন নি। তিনি তার গোলামদের প্রতি হলেন খুবই মেহেরবান।
 
কেউ কেউ হয়ত মনে করতে পারেন যে, কুরআন দ্বারা যা ফরজ হয়েছে, হাদীছ দিয়ে কি তা বাতিল করা হচ্ছে? আদতে তা নয়। কারণ মানুষের জীবন বাঁচানোটা বেশী জরুরী। আল্লাহ তো কাফেরদের জন্য কোনো আজাব দিলে, সে আজাবে ঈমানদারও পড়ে যেতে পারেন। কুরআন মজীদেই মহান আল্লাহ সে ব্যাপারে বলে রেখেছেন, যা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। সেজন্য বুদ্ধি বিবেক কাজে লাগিয়ে পূর্ণ সতর্কতার সাথে চলতে হবে। সে সতর্কতা পালন করার জন্য আল্লাহই নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন:
﴿قَدْ جَاءَكُمْ بَصَائِرُ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ أَبْصَرَ فَلِنَفْسِهِ وَمَنْ عَمِيَ فَعَلَيْهَا وَمَا أَنَا عَلَيْكُمْ بِحَفِيظ
অর্থাৎ, “তোমাদের নিকট তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে অনেকগুলো চোখ এসেছে। যে চোখ মেলে দেখবে, সে তার নিজের স্বার্থ রক্ষা করবে আর যে অন্ধ হয়ে যাবে, সে তার পরিণতি ভোগ করবে। আর সেক্ষেত্রে আমি তোমাদেরকে রক্ষাকারী হব না।” (সূরা আল আনআম, আয়াত:১০৪) তাছাড়া ছালাতের জামায়াত কায়েম করার জন্য নিরাপদ পরিবেশ থাকা শর্ত। মহান আল্লাহ বলেন:
﴿فَإِذَا اطْمَأْنَنْتُمْ فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا 
অর্থাৎ, “অত:পর যখন তোমরা নিরাপত্তা লাভ করবে, তখন তোমরা ছালাত কায়েম কর। নিশ্চয়ই মুমিনদের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে ছালাত আদায় করার বিধানটি লিখে দেয়া হয়েছে।” (সূরা আন নিসা, আয়াত:১০৩) 

উপরোক্ত পর্যালোচনা থেকে একথা প্রমাণীত হয়েছে যে, আপদকালীন সময়ে মসজিদে জামায়াতে ছালাত কায়েম করা জরুরী নয় বরং এক্ষেত্রে বাড়িতে ছালাত আদায় করার অনুমতি ইসলামী শরয়ীতে রয়েছে। এটি ইজতেহাদী কোনো বিষয়ও নয় বরং স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছা.) তা পালন করে উম্মাতের জন্য নজীর স্থাপন করেছেন।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে বিষয়টি অনুধাবন করার তাফীক দান করুন এবং পূর্ণ ইতমিনানের সাথে পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে নিজ বাসস্থানে ছালত কায়েম করার তাওফীক দিন। হে আল্লাহ রাহমানুর রাহীম, তুমি মুসলিম উম্মাহসহ সমগ্র বিশ্ববাসীকে হেফাজত কর। তুমি গজব ও আজাব দিয়ে আমাদেরকে ধ্বংস কর না। তুমি বরং আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও।
﴿اللَّهُمَّ لَا تَقْتُلْنَا بِغَضَبِكَ وَلَا تُهْلِكْنَا بِعَذَابِكَ وَعَافِنَا قَبْلَ ذَلِكَ
অর্থাৎ, “হে আল্লাহ তোমার গজব দিয়ে আমাদেরকে হত্যা কর না এবং তোমার শাস্তি দিয়ে আমাদেরকে ধ্বংস কর না। আর এর পূর্বে তুমি আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও।” (তিরমিযী, হাদীস নং-৩৩৭২; মুসনাদু আহমাদ, হাদীস নং ৫৫০৩)

ওমা আলাইনা ইল্লাল বালাগ।
লেখকঃ বহুগ্রন্থ প্রণেতা ও
সিনিয়র এ্যাসিস্টেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট
এবং শাখা প্রধান,
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড,
বিয়ানী বাজার শাখা।


শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here