রোগ প্রতিরোধে
ইসলামী দৃষ্টিকোণ: প্রেক্ষিত করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি
ইসলাম আমাদেরকে এমন একটি জীবন পদ্ধতি
প্রদান করেছে যে, যদি কোনো মানুষ ইসলামের
এ নিয়মগুলো ন্যূনতমভাবেও মেনে চলে তবে সুস্বাস্থ্য লাভ করতে পারবে। অসুস্থতার অন্যতম
কারণ হচ্ছে- অপরিচ্ছন্নতা খাদ্যাভ্যাস, অশ্লীলতা, অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন ও অলসতা ইত্যাদি। মানুষের কর্মদোষে অসুস্থতা
মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দৈহিক ও মানসিক সুস্থতাময় একটি
সুন্দর জীবনের জন্য অশ্লীলতা, অলসতা ও পাপ বর্জন,
পরিমিত খাদ্য গ্রহণ, পরিশ্রম, বিশ্রাম, বিনোদন, স্বাস্থ্য সতর্কতা, নিয়মিত ইবাদত ও দুআ ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা প্রত্যেকেরই
একান্ত কর্তব্য। ইসলাম মানুষকে সুস্থ জীবন গঠনের নানা উপায় বাতলিয়ে দিয়েছে। সালাত,
সিয়াম ও কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি ইবাদত মানুষকে সুস্থ
রাখতে সহায়তা করে। এছাড়া ইসলাম দৈনন্দিন জীবনাচরণের যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে তাও মানুষের
সুস্বাস্থ্য গঠনে অবশ্যই সহায়ক।
আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হই। এ বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা কী? আলোচ্য নিবন্ধে এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত:
রোগ কী?
রোগ শব্দটি বিশেষ্য। এর অর্থ পীড়া,
ব্যাধি, অসুখ বা ব্যারাম। সুতরাং বলা যায়,
শারীরিক ও মানসিক ব্যারামই হলো রোগ। রোগের কারণে মানব
জীবন অশান্তিময় হয়ে উঠে। এ সব রোগ প্রতিকারের জন্য মানুষ বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি
গ্রহণ করলেও রোগ প্রতিরোধের তৎপরতা খুব একটা দেখা যায় না।
সুস্থতা শব্দটি বিশেষণ। এর অর্থ
শরীরের ভালো অবস্থা, রোগশূণ্যতা বা স্বাচ্ছন্দ্য।
অন্যভাবে বলা যায়, শারীরিক ও মানসিক রোগ
থেকে মুক্ত থাকাই সুস্থতা। সুস্থতা মানব জীবনকে সুন্দর ও আনন্দময় করে তুলে। এটি আল্লাহ
তাআলার পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামত। উক্ত নিয়ামতের জন্য সকল মুমিনকে অবশ্যই
সতর্ক থাকতে হবে। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
﴿نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنْ النَّاسِ الصِّحَّةُ
وَالْفَرَاغُ﴾
অর্থাৎ, “দুটি নিয়ামতের বিষয়ে অধিকাংশ মানুষই অসতর্ক ও প্রতারিত তা
হলো সুস্থতা ও অবসর।” (বুখারী, হাদীস নং-৫৯৩৩)
সুস্থতা ও অসুস্থতা উভয়ের মধ্যেই
মুমিনের কল্যাণ নিহিত। তবে সুস্থ, সবল, কর্মঠ ও পরিশ্রমী যে
বান্দা মানসিক ও ঈমানি দিক থেকে অধিক শক্তিশালী আল্লাহ তাআলা তাকে অধিকতর ভালোবাসেন।
মানুষ সাধারণত দুধরনের অসুস্থতায়
ভোগে:-
এক: শারীরিক, যেমন- জ¦র, সর্দি,
কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া ডায়াবেটিস,
গ্যাস্ট্রিক, আলসার, ক্যান্সার, এলার্জি, এইডস ও দন্তরোগ ইত্যাদি
দুই: মানসিক ও স্নায়ুবিক যেমন- উণ্মাদনা,
বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা,
দুশ্চিন্তা ও মৃগীরোগ ইত্যাদি।
অসুস্থতার অনেক কারণ রয়েছে,
যেমন-
(১) অপরিচ্ছন্নতা;
(২) খাদ্য বা খাদ্যাভ্যাস
জনিত- খাদ্যের অভাব, ক্ষতিকর খাদ্য গ্রহণ
ও অতিভোজন ইত্যাদি।
(৩) অশ্লীলতা;
(৪) অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন;
(৫) অলসতা,
পরিশ্রমহীনতা;
(৬) অতি পরিশ্রম;
(৭) মানসিক অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠা
এবং
(৮) অসতর্কতা। এছাড়া আর্থিক
অসচ্ছলতার কারণে পুষ্টিকর খাবারের চাহিদা পূরণে ব্যর্থতা,
দারিদ্র এবং অর্থনৈতিক সমস্যাও অসুস্থতার জন্য অনেকাংশে
দায়ী। আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা স্বরূপও মুমিন বান্দাগণ অসুস্থতার সম্মুখীন হতে পারেন।
অপরিচ্ছন্নতার কারণে নানা রোগের
জন্ম হয়। যেমন-ডায়রিয়া, এলার্জি,
কাশি, খোস-পাচঁড়া, চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গু জ্বর, মুখে দূর্গন্ধ ও কৃমি
ইত্যাদি। তাই পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্বারোপ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেন,
﴿الطُّهُورُ شَطْرُ الْإِيمَانِ﴾
অর্থাৎ, “পবিত্রতা ঈমানের অর্ধাংশ।” (মুসলিম, খণ্ড-১, হাদীস নং, ৩২৮)
অসুস্থতার অন্যতম কারণ অপরিচ্ছন্নতা
যা ইসলামে নিষিদ্ধ। পরিচ্ছন্নতা ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর অন্যতম ও ঈমানের অংশ। এটি
এমন একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আমল যা অন্য কোনো ধর্মে পরিলক্ষিত হয় না। ইসতিনজা,
মিসওয়াক, ওযু, গোসল ও পোশাক-পরিচ্ছদের
পবিত্রতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যদি মুমিন সঠিকভাবে সুন্নাহ নির্দেশিত পদ্ধতি অনুসরণ করেন
তবে তিনি সহজেই অপরিচ্ছন্নতা জনিত রোগব্যাধি থেকে নিরাপদ থাকতে পারেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের অনেকেই পায়খানার
পর শুধু টয়লেট পেপারের ব্যবহার যথেষ্ট ভাবছেন না বরং সাথে সাথে পানি ব্যবহার না করলে
লিঙ্গ ক্যান্সার, ভগন্দর,
চর্ম রোগ, ফুসফুসের সংক্রমন প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হওয়ার
সম্ভাবনা রয়েছে বলে সতর্ক করছেন। মুখগহবরের পরিচ্ছন্নতার জন্য মিসওয়াক ব্যবহার করা
সুন্নাত। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
﴿السِّوَاكُ مَطْهَرَةٌ لِلْفَمِ مَرْضَاةٌ لِلرَّبِّ﴾
অর্থাৎ, “মিসওয়াক মুখ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করার উপকরণ,
প্রতিপালকের সন্তুষ্টির কারণ।” (আহমদ ইবন হাম্বল, মুসনাদ, হাদীস
নং ২৮৫)
ইসলাম পরিচ্ছন্নতার যত উপায় বাতলিয়ে
দিয়েছে সবগুলোই মানুষকে রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। ওযু রোগব্যাধি অনুপ্রবেশের রাস্তাসমূহের
অতন্ত্র প্রহরী। হাত ধৌত করা, কুলি করা, নাকে পানি দেওয়া, মুখ ধৌত করা, মাথা মাসেহ করা ও পা ধৌত করা ইত্যাদি সকল পদ্ধতিই বিভিন্ন রোগের
প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। যেমন- চর্ম, ঘামাচি, টনসিল, সর্দি-কাশি, মুখের ব্রণ, চক্ষুরোগ, গলার রোগ, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুবিক এবং ডায়াবেটিস ইত্যাদি।
খাদ্যাভ্যাস
জনিত রোগ ও তা প্রতিরোধের উপায়
খাদ্যের অভাব,
ক্ষতিকর খাদ্য গ্রহণ ও অতিভোজন ইত্যাদি কারণে নানা রোগের
সৃষ্টি হয়। যেমন- ডায়াবেটিস, রক্তস্বল্পতা,
ক্ষুধামন্দা, হৃদরোগ, আলসার ও ক্যান্সার ইত্যাদি। তাই অতিভোজন ও ক্ষতিকর খাদ্য গ্রহণের
প্রতি ইসলামে নিষেধ করা হয়েছে। খাবার গ্রহণের বেলায় মধ্যম পন্থা অবলম্বনের প্রতি উৎসাহ
প্রদান করে আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿كُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ﴾
অর্থাৎ, “তোমরা খাও ও পান কর এবং অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের
পছন্দ করেন না।” (আল-কুরআন, ৭: ৩১)
উক্ত আয়াতে পরিমিত খাবার গ্রহণ
করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং অতিরিক্ত পানাহারকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। অতিভোজন মানুষের
অধিকাংশ রোগব্যাধির কারণ। সুতরাং পরিমিত আহার রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত
জরুরী।
মাদকদ্রব্য
ও মদ্যপান
ইসলামে সকল প্রকার মাদকদ্রব্য ও
মদ্যপান হারাম। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন,
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ
وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ
تُفْلِحُونَ﴾
অর্থাৎ, “হে মানুষ (তোমরা যারা ঈমান এনেছো তোমরা জেনো রেখো) মদ,
জুয়া, পূজার বেদী ও ভাগ্যনির্ণায়ক শর হচ্ছে ঘৃণিত শয়তানের কাজ। অতএব
তোমরা তা (সম্পূর্ণরূপে) বর্জন করো। যা করে তোমরা সফলকাম হতে পার।” (আল-কুরআন, ৫:৯০)
বিভিন্ন মাদক দ্রব্যের প্রতি আসক্তিই
হচ্ছে মাদকাসক্তি। মাদক সেবনের ফলে নানা রোগের সৃষ্টি হয়। যেমন- রক্তসল্পতা,
ক্ষুধামন্দা, হৃদরোগ, আলসার ও ক্যান্সার ইত্যাদি। সমাজে হত্যা,
ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, সমকামিতা, বিয়ে-বিচ্ছেদসহ অনেক অপরাধই মাদকের কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজেকে
ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া ও সম্পদ বিনষ্ট করার প্রতি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তাই ধুমপান
ও তামাক সেবন থেকে বেঁচে থাকলে আশা করা যায় শরীর সুস্থ থাকবে ও সম্পদের অপচয় থেকে রক্ষা
পাওয়া যাবে।
অশ্লীলতা জনিত
রোগ ও এর প্রতিরোধ
অশ্লীলতার কারণে নানা রোগের সৃষ্টি
হয়। যেমন- এইডস, গণোরিয়া ও সিফিলিস ইত্যাদি।
আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতায় অশ্লীলতার পথ খোলা রেখে অশ্লীলতা প্রসূত রোগব্যাধি নিয়ন্ত্রণের
চেষ্টা করা হয়। এ হচ্ছে ট্যাংকির নিচে ছিদ্র রেখে পানি সংরক্ষণের ব্যর্থ চেষ্টার মতই
অবাস্তব কর্ম। অশ্লীলতা নিজেই একটি মারাত্মক ব্যাধি। এর মাধ্যমে মানুষ নানা ধরনের দৈহিক ও মানসিক রোগে
আক্রান্ত হয়। তাই আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا
بَطَنَ﴾
অর্থাৎ, “বল, আমার প্রতিপালক হারাম (নিষিদ্ধ) করেছেন সকল প্রকার অশ্লীলতা,
তা প্রকাশ্য হোক আর অপ্রকাশ্য হোক।” (আল কুরআন, ৭:৩৩)
ব্যভিচারের কারণে সামাজিক শৃঙ্খলা
ভেঙ্গে পড়ার পাশাপাশি চুরি-ডাকাতি, নারী নির্যাতন ও হত্যার মত জঘন্যতম অপরাধসমূহ সংঘটিত হচ্ছে।
অশ্লীলতা এক দিকে যেমন সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তার অন্তরায়। অন্যদিকে যৌনব্যাধিসহ
নানা রোগবালাই সৃষ্টির কারণ। তাই ব্যভিচার বর্জনের মাধ্যমে মানুষ শান্তিময় জীবন পরিচালনার
পাশাপাশি নানা জটিল রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। বর্তমানে এইডস রোগ প্রতিরোধের জন্য
ডাক্তারগণও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
অলসতা, পরিশ্রমহীনতা
এবং অতি পরিশ্রম জনিত রোগ ও এর প্রতিরোধ
অলসতা,
পরিশ্রমহীনতা এবং অতি পরিশ্রম বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে।
যেমন- ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ ইত্যাদি। অলসতা
পরিত্যাগ করা, নিয়মিত পরিশ্রম ও ব্যায়াম
করা সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই প্রয়োজন। ইসলামে অলসতার কোনো স্থান নেই। পরিশ্রমের পাশাপাশি
নিয়মিত বিশ্রামও অত্যন্ত জরুরী।
স্বাস্থ্য
বিষয়ক অসতর্কতা ও করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি
বিভিন্ন হাদীসে স্বাস্থ্য বিষয়ে
সতর্কতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন খাদ্য ও পানীয় আবৃত করে রাখার জন্য
যেমন তাগিদ দেওয়া হয়েছে তেমনি খাদ্য বা পানীয়ের মধ্যে ফুঁৎকার দেওয়া বা শ্বাস-প্রশ্বাস
নির্গত করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। অপরিস্কার হস্ত পানিতে প্রবেশ না করা এবং
খাবার গ্রহণের পূর্বে ভালোভাবে উভয় হাত ধৌত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অসুস্থতা মহামারী দিয়ে আল্লাহ তাআলা মানুষকে পরীক্ষা করেন। এছাড়া
মানুষ যখন আল্লাহ তাআলার অবাধ্য হয়ে যায় তখন অসুস্থতা, ভূমিধস, মহামারী ইত্যাদি দিয়ে
তিনি গজব নাজিল করেন; যাতে মানুষ তাদের ভুল
বুঝতে পেরে তাওবার মাধ্যমে আবার ফিরে আসতে পারে। এই গজব বা মহামারী আসলে তখন করণীয়
হলো মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহবায়ে কেরামের নির্দেশিত পথে চলা।
আমরা জানি, কিয়ামতের নিদর্শনগুলোর
একটি হলো মহামারী।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কিয়ামতের আগের ছয়টি নিদর্শন গণনা করে রাখো। আমার মৃত্যু, অতঃপর বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়, অতঃপর তোমাদের মধ্যে ঘটবে মহামারী, বকরির পালের মহামারির মতো, সম্পদের প্রাচুর্য, এমনকি এক ব্যক্তিকে একশ’ দিনার দেয়ার পরও সে অসন্তুষ্ট থাকবে। অতঃপর এমন এক ফিতনা আসবে, যা আরবের প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করবে। অতঃপর যুদ্ধবিরতির চুক্তি, যা তোমাদের ও বনি আসফার বা রোমকদের মধ্যে সম্পাদিত হবে। অতঃপর
তারা বিশ্বাসঘাতকতা করবে এবং ৮০টি পতাকা উড়িয়ে তোমাদের বিপক্ষে আসবে; প্রতিটি পতাকার নিচে থাকবে ১২ হাজার সৈন্য। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩১৭৬)
বিশ্বব্যাপী মানুষের
মধ্যে প্রাচুর্য বেড়েই চলছে। নতুন নতুন রোগ আর মহামারী আত্মপ্রকাশ করছে। তাই আমাদের
কর্তব্য হলো রাসুল নির্দেশনার যথাযথ অনুসরণ করা। মহামারি প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
এটি আল্লাহর গজব বা শাস্তি, বনি ইসরাঈলের এক গোষ্ঠীর ওপর এসেছিল, তার বাকি অংশই হচ্ছে মহামারি। অতএব, কোথাও মহামারি দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থানরত থাকলে সে জায়গা থেকে চলে এসো না। অন্যদিকে কোনো এলাকায় এটা দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থান না করলে সে জায়গায় যেয়ো না। (তিরমিজি , হাদিস নং ১০৬৫)
এটি আল্লাহর গজব বা শাস্তি, বনি ইসরাঈলের এক গোষ্ঠীর ওপর এসেছিল, তার বাকি অংশই হচ্ছে মহামারি। অতএব, কোথাও মহামারি দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থানরত থাকলে সে জায়গা থেকে চলে এসো না। অন্যদিকে কোনো এলাকায় এটা দেখা দিলে এবং সেখানে তোমরা অবস্থান না করলে সে জায়গায় যেয়ো না। (তিরমিজি , হাদিস নং ১০৬৫)
মহামারী আল্লাহর গজব হলেও এতে আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিকে পাপী-জাহান্নামি
মনে করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর ভাষায় মহামারিতে মারা যাওয়া ব্যক্তিও শহীদ। আবু হুরাইরা
(রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “পাঁচ প্রকার মৃত শহীদমহামারিতে মৃত, পেটের পীড়ায় মৃত, পানিতে ডুবে মৃত, ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে মৃত এবং যে আল্লাহর পথে শহীদ হলো।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নং: ২৮২৯) অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মহামারিতে মৃত্যু হওয়া প্রতিটি মুসলিমের জন্য শাহাদাত।” (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৮৩০)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় তিনবার বলবে ‘বিসমিল্লা-হিল্লাজী লা ইয়াদ্বুররু মাআসমিহি শাইউন ফিল আরদ্বি
ওয়ালা ফিস সামা-ই, ওয়াহুয়াস সামী‘উল আলীম’, অর্থাৎ ‘আল্লাহর নামে, যাঁর নামের বরকতে আসমান ও জমিনের কোনো বস্তুই ক্ষতি করতে পারে
না, তিনি সর্বশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী’; সকাল হওয়া পর্যন্ত তার প্রতি কোনো হঠাৎ বিপদ আসবে না। আর যে
তা সকালে তিনবার বলবে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার ওপর কোনো হঠাৎ বিপদ আসবে না। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৮৮)
এছাড়া রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহামারি থেকে বাঁচতে বেশি বেশি এই দোয়া পড়তে
বলেছেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা
মিনাল বারাসি, ওয়াল জুনুনি, ওয়াল জুযামি, ওয়া মিন সাইয়িইল আসক্কাম’। উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য হলো সচেতন থাকা, দুআ করা ও বেশি বেশি তাওবা করা।
আল্লামা জালাল উদ্দিন রুমি (রহ.) তার মসনদে রুমি গ্রন্থে লিখেন, একবার প্রচণ্ড ঝড়ের সময় এক ব্যক্তি একটি বড় গাছের নিচে এসে দাঁড়ালে
অপর এক লোক তাকে এসে সাবধান করে বলল, ভাই ঝড়ের সময় বজ্রপাত হলে সাধারণত গাছের নিচে এসে পড়ে সুতরাং
এখান থেকে তুমি সরে দাঁড়াও। সে বলল, আল্লাহ আমার রব, তিনিই আমাকে বাঁচাবেন।
কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় আরেকজন এসেও তাকে সতর্ক করল। সে এবারও একই
উত্তর দিল, আল্লাহর ওপর আমার পূর্ণ
তাওয়াক্কুল রয়েছে। আল্লাহ তাআলাই আমাকে বাঁচাবেন।
এর কিছু পরে তৃতীয় আরেক ব্যক্তি এসে একইভাবে সতর্ক করল। গাছের
নিচে দাঁড়ানো লোকটা উত্তরে বলল, তোমাদের তো আল্লাহর ওপর
ভরসা নেই, আমি আমার মাওলার ওপর
পূর্ণ ভরসা রাখি। আমার মালিক আমাকে অবশ্যই রক্ষা করবেন। তৃতীয় লোকটি সেখান থেকে চলে
যাবার পরপরই আকাশ থেকে একটি বজ্রপাতে লোকটি মারা গেল।
চতুর্থ আরেকজন আল্লাহর বান্দা এ পুরো দৃশ্য দেখছিলেন। তিনি বিস্ময়
প্রকাশ করে বললেন, কিছুই বুঝতে পারলাম না, আল্লাহর ওপর তার এমন ভরসা অথচ আল্লাহ তাকে রক্ষা করলেন না?
আল্লামা রুমি কাব্যের ভাষায় লিখেন, মূলত আল্লাহ তাকে তো বাঁচাতেই চাচ্ছিলেন। এজন্য ঐ তিনজনকে আল্লাহই
পাঠিয়ে ছিলেন। লোকটি অজ্ঞতার কারণে এমন হঠকারিতা করেই মৃত্যুমুখে নিপতিত হয়েছে।
করোনা ভাইরাসের সময়ে এখনও যারা এমন তাওয়াক্কুলের কথা বলে যাচ্ছেন
তাদের এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া উচিৎ। হ্যাঁ, তাওয়াক্কুল তো অবশ্যই, তবে সচেতনতার সাথে। পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, চিকিৎসকগণ, বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী
চিন্তাবিদগণ ও দেশের সরকার যেসব সতর্কতার কথা বলছে তা অবলম্বন করা সতর্ক ও সাবধান হওয়া আমাদের জন্য অপরিহার্য্য।
বর্তমান সময়ে হাদীসের
আলোকে আলেম-উলামাদের মতামত পর্যালোচনা সাপেক্ষে প্রতীয়মান হয় যে, ঘরে অবস্থান করা, বারবার হাত ধৈৗত করা, প্রয়োজনে বের হলে
মাস্কা ব্যবহার করা, সামাজিক দূরত্ব বজায়
রাখা ইত্যাদি কার্যক্রমগুলো রোগ প্রতিরোধেরই অংশ। তাই আমাদের উচিত এসব বিষয়ে সচেতন
হওয়া।
মানসিক অস্থিরতা
জনিত রোগ ও এর প্রতিরোধ
মানসিক রোগের অনেক কারণ রয়েছে।
বহুদিন মনের মধ্যে চেপে রাখা ক্ষোভ, মানসিক অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা, নিরাপত্তাহীনতা ও ভয়ভীতি ইত্যাদি নানাবিধ কারণে মানসিক অস্থিরতা
সৃষ্টি হতে পারে। যেমন- সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক দৈন্যতা, দাম্পত্য কলহ, বেকারত্ব এবং অনিয়ন্ত্রিত আবেগ। মানসিক অস্থিরতার ফলে স্ট্রোক,
মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা এমনকি আত্মহত্যার মত জঘন্য
ঘটনাও ঘটতে পারে।
অসুস্থতা ও বিপদাপদ মুমিন বান্দাদের
জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এক ধরনের পরীক্ষা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوفْ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ
مِّنَ الأَمَوَالِ وَالأنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ الَّذِينَ إِذَا
أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُواْ إِنَّا لِلّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعونَ أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِّن رَّبِّهِمْ
وَرَحْمَةٌ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ﴾
অর্থাৎ “আমি তোমাদেরকে কিছু ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ ও জীবনের ক্ষতি ও ফল-ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা
করব। আপনি সুসংবাদ প্রদান করুন ধৈর্যশীলদের, যারা তাদের উপর বিপদ আসলে বলে,
আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। এরাই তো তারা যাদের প্রতি তাদের রবের কাছ থেকে বিশেষ
অনুগ্রহ এবং রহমত বর্ষিত হয়, আর এরা সৎপথে পরিচালিত।” (আল-কুরআন, ২:১৫৫-১৫৭)
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমাদের করণীয় কী তাহলে নিচে
সংক্ষেপে আলোকপাত করছি।
আমাদের করণীয়
এক: ইসলাম পরিচ্ছন্ন জীবন যাপনের নির্দেশ দিয়েছে। এ নির্দেশ মেনে
চললে অপরিচ্ছন্নতা থেকে সৃষ্ট রোগব্যাধি প্রতিরোধ সম্ভব।
দুই: ইসলামে পরিমিত খাদ্য গ্রহণের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। এ বিষয়টির
যথাযথ অনুসরনের মাধ্যমে খাদ্যাভ্যাস জনিত রোগ প্রতিরোধ সম্ভব।
তিন: ইসলাম সর্বপ্রকার নেশাজাতীয় দ্রব্য হারাম ঘোষণা করেছে। এর উপর
আমল করলে এর থেকে সৃষ্ট শারীরিক ও মানসিক রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। তাই আমাদের করণীয় হচ্ছে,
মাদকমুক্ত পরিবার, সমাজ ও জাতি গঠনে চেষ্টা করা।
চার: যৌনতার ক্ষেত্রে ইসলাম নিয়ন্ত্রিত ও বৈধ যৌন আচরণের নির্দেশ
দিয়েছে এবং ব্যভিচার ও সমকামিতাকে সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করেছে। ইসলাম নির্দেশিত
পন্থা অবলম্বন করে এ জাতীয় অপকর্ম থেকে সৃষ্ট এইডস রোগসহ অনেক জটিল রোগ প্রতিরোধ সম্ভব।
তাই অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও ধর্ষণ ইত্যাদির
মূলোৎপাটনের জন্য আমাদের প্রত্যেককেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সোচ্চার হতে হবে।
আলোচনার প্রান্তটিকায় এসে বলতে
পারি যে, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানব জীবনকে সুন্দর আনন্দময় করে তুলতে
ও সুস্থতার সাথে জীবন যাপনে ইসলাম দৈনন্দিন জীবনে পালনীয় সার্বিক বিধি-বিধান প্রণয়ন
করেছে। ইসলামের এসব বিধি-বিধান পালনেই মানব জীবন শান্তিময় ও কল্যাণে ভরপুর হয়ে উঠে।
মানবজাতির দৈহিক, মানসিক সুস্বাস্থ্যের
পাশাপাশি আত্মিক সুস্থতা দ্বারা ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তিই হলো কুরআন নাযিলের
অন্যতম উদ্দেশ্য।
বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি প্রতিরোধে কুরআন-সুন্নাহ
নির্দেশিত পন্থা অবলম্বন করা প্রত্যেক মানুষের জন্য কল্যাণকর। শয়তান সর্বদা মানুষকে
শিরকে নিপতিত করার মাধ্যমে মনে হতাশা ঢুকিয়ে দুনিয়ার জীবন দুর্বিষহ করে পরকালে জাহান্নামে
নিয়ে যেতে চায়। তাই সুস্থতার সাথে জীবন যাপনের জন্য সর্বদা আল্লাহর যিকর,
দুআ ও ইবাদত করা কর্তব্য।
অসুস্থতায় নিপতিত মুমিন বান্দাকে
ধৈর্যের সাথে তা থেকে উত্তরণের জন্য সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতিতে চেষ্টা চালাতে হবে। কোনো
অবস্থাতেই অবৈধ কোন পন্থায় বিপদ-আপদ ও রোগ মুক্তির চেষ্টা করা ঠিক নয়। সর্বাবস্থায় রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম এবং মুজতাহিদ ইমামগণের অনুসৃত পদ্ধতি
অবলম্বন করা উচিত। এতে করেই দুনিয়া ও আখিরাতের সামগ্রিক কল্যাণ সাধিত হয়। আল্লাহ
আমাদেরকে তাওফকী দান করুন। আমীন।
পি.এইচডি গবেষক ও শিক্ষক
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,
লিডিং
ইউনিভার্সিটি,
সিলেট।
ইমেইল: zia1290@gmail.com
মোবাইলঃ
01715610866
0 coment rios:
You can comment here