Wednesday, April 8, 2020

দ্বীন প্রতিষ্ঠা বনাম দ্বীনকে রাষ্ট্রীয় আইনে রূপ দান


 

।। মুফতি মোস্তফা সোহেল হিলালী।।

দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও দ্বীনকে রাষ্ট্রীয় আইনে রূপ দান দুটো ভিন্ন জিনিস। তবে দুটো যদিও ভিন্ন, কিন্তু একটির সাথে অপরটির সম্পর্ক নিবিড়। যেমন দা এবং দায়ের হাতল দুই ভিন্ন জিনিস হলেও একটির সাথে অপরটির সম্পর্ক নিবিড়। বরং দ্বীনকে রাষ্ট্রীয় আইনে রূপ দান দ্বীন প্রতিষ্ঠার চুড়ান্তি। কিন্তু আমরা এই দুটো বিষয় বোঝতে দুই ধরণের ভুল করি। কেউ কেউ দুটোকেই একেবারে ভিন্ন মনে করি এবং রাষ্ট্রীয় আইনে দ্বীনকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা আমাদের প্রয়োজনের মাঝে পড়ে বলে মনে করি না।

আবার কেউ কেউ দুটোকেই এত অভিন্ন চোখে দেখি যে, আমরা মনে করি রাষ্ট্রীয় আইনে দ্বীন নাফিয বা বাস্তবায়ন করার নামই দ্বীন প্রতিষ্ঠা বা ইকামাতে দ্বীন। তাই অন্য কোনো কাজকে দ্বীন প্রতিষ্ঠা মনে করি না বা দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ মনে করি না। এমনকি অনেকে নিজে দ্বীনের উপর উঠার চেয়ে রাষ্ট্রীয় আইনে দ্বীন নাফিয করাকে নিজের জীবনের সর্বোচ্চ সাধনা মনে করেন এবং দ্বীনের বাকী সকল কাজকে অবহেলার সাথে দেখেন।

আমি আজ একটি দিক নিয়ে কিঞ্চিত আলোকপাত করবো:

নাবীদেরকে আল্লাহ তাআলা দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন এবং সবাই দ্বীন প্রতিষ্ঠা করেছেন। এটাই আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস। কেউ দ্বীন প্রতিষ্ঠা করেননি বা করতে পারেননি, এ কথা আমরা বলতে পারি না। বললেও তা বাস্তব বিরোধ হবে। তবে রাষ্ট্রীয় আইনে দ্বীনকে নাফিয বা বাস্তবায়ন করেছেন মাত্র কয়েকজন নাবী, তম্মধ্যে মুহাম্মাদ (সা.) ছাড়া অন্য কেউ সর্বশ্রেষ্ঠ নাবীদের তালিকায় নেই।
কুরআনের যে আয়াতটি ইকামাতে দ্বীন ফরয ও নির্দেশিত হওয়ার বেলায় একটি মূল, সে আয়াতটি হলো,
﴿شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ
অর্থাৎ, “তিনি তোমাদের জন্যে দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না।(সূরা আশ-শূরা, আয়াত:১৩)

এই আয়াতটিতে আল্লাহ তাআলা দ্বীন প্রতিষ্ঠার নির্দেশের উদাহরণ স্বরূপ সর্বশ্রেষ্ঠ পাঁচজন নাবীর নাম এনেছেন, যে পাঁচজন নাবী সর্বশ্রেষ্ঠ এবং ইকামাতে দ্বীনের বেলায় সর্বোচ্চ আদর্শএই পাঁচজনের মধ্যে একজন হযরত মুহাম্মাদ (সা.)হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ছাড়া বাকী চার জনের কেউই রাষ্ট্রীয় আইনে দ্বীন প্রয়োগ করতে পারেননি। তাই বলে কি তারা দ্বীন প্রতিষ্ঠা করেননি? হ্যাঁ, নিশ্চয় করেছেন। শত শত, হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ তাদের আদর্শ গ্রহণ করে আল্লাহ তাআলার বিধান মোতাবিক চলেছে, এরই নাম দ্বীন প্রতিষ্ঠা। হযরত নূহ (আ.), হযরত ইবরাহীম (আ.), হযরত মূসা (আ.), হযরত ঈসা (আ.) এই চারজনের কেউই রাষ্ট্রীয় আইনে দ্বীন নাফিয বা বাস্তবায়ন করতে পারেননি, অথচ রাসূল (সা.) কে এদের পদাঙ্ক অনুসরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এদেরকে উলুল আযমী মিনার রুসুল বলা হয়েছে।
আবার হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কি কেবল মদীনায় দ্বীন প্রতিষ্ঠা করছেন বা মদীনায় গিয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করেছেন? মদীনায় যাওয়ার মক্কায় দ্বীন প্রতিষ্ঠা করেননি, বা মক্কার তের বছর দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ করেননি? নিশ্চয়। তিনি মক্কায়ও দ্বীন প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেমন মদীনায় দ্বীন প্রতিষ্ঠা করেছেন। মক্কায় দ্বীন প্রতিষ্ঠা করেছেন দেখেই শত শত সাহাবা একমাত্র দ্বীনের কারণে নিজের পিতা-মাতা, নিজের সন্তান, নিজের স্ত্রী, নিজের স্বামী সর্বোপরি নিজের সহায় সম্বল ভিটে মাটি ছেড়েছেন। এরই নাম দ্বীন প্রতিষ্ঠা। তবে মদীনায় যেমন দ্বীন প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমনি দ্বীন প্রতিষ্ঠা ব্যাপকতা লাভ করায় রাষ্ট্রীয় আইনে আল্লাহ তাআলার সকল বিধান ধীরে ধীরে নাফিয বা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন।

অতএব ইকামাতে দ্বীন বা দ্বীন প্রতিষ্ঠা বোঝতে আমাদেরকে এই পাঁচ নাবীর আদর্শের বাহিরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা যেই দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করবো সেই দ্বীন প্রতিষ্ঠায় রততবে ব্যাপকহারে দাওয়াত দিয়ে সমাজ পরিবর্তন করে রাষ্ট্রীয় আইনে দ্বীন নাফিয বা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্য পানে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, আল্লাহ তাআলার দ্বীন ও বিধানের মাঝে কোনো পরিবর্তন আসবে না। কিন্তু দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথ ও পন্থায় যুগের সাথে পরিবর্তন আসবে। রাসূল (সা.) জীবনে অনেক জিহাদ করেছেন, কিন্তু সব জিহাদের রুলস এক ছিলো না। অনেক সময় নিজের চিন্তা পরিবর্তন করে সাহাবাদের চিন্তা গ্রহণ করেছেন। যেমন খলীফা নির্বাচন একটি জরুরী বিষয়। কিন্তু এর পথ পন্থা রাসূল (সা.) নির্ধারণ করে যাননি, মানুষের চাহিদার ভিত্তিতে ও সকল মেনে নেওয়ার ভিত্তিতে তা হয়েছে। ইসলামের প্রথম পাঁচ খলিফা পাঁচ পদ্ধতিতে নির্বাচিত হওয়া এর সুস্পষ্ট প্রমাণ। 
এভাবে দ্বীনকে রাষ্ট্রীয় আইনে নিয়ে যাওয়া হবে দ্বীন প্রতিষ্ঠার চুড়ান্ত লক্ষ্য। কিন্তু এর পদ্ধতি যেমন- হযরত সুলাইমান (আ.),হযরত দাঊদ, হযরত ইউসুফ হযরত মুহাম্মাদ (সা.) গংদের বেলায় এক ছিলো না এবং সামাজিক বিবর্তনের কারণে থাকা সম্ভবও নয়, তদ্রুপ রাষ্ট্রিয় আইনে দ্বীন প্রতিষ্ঠার পন্থাও এক থাকবে না এবং থাকা সম্ভব নয়।

রাসূল (সা.) ঘোড়া, বল্লম, তরবারী দ্বারা জিহাদ করেছেন, এখন কেউ সেই সুন্নাত আকঁড়ে ধরে ঘোড়া, বল্লম, তরবারী দিয়ে জিহাদ জরুরী মনে করলে বড় ভুল করবে। কারণ উপকরণ পরিবর্তনশীল। মুয়াবিয়া (রা.) স্বীকৃত খলীফা ছিলেন, কিন্তু এখন কেউ উনার নিয়মে খলীফা হওয়ার স্বপ্ন দেখলে ভুল করবে, তবে সবাই মেনে নিলে ভিন্ন কথা। হযরত ইউসুফ (আ.) দ্বীনকে রাষ্ট্রীয় আইনে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন, এখন যদি কেউ মনে করে আমি ইউসুফ নাবীর নিয়মে রাষ্ট্রীয় আইনে দ্বীন নিয়ে চলে যাবো, তবে তার এই স্বপ্ন ভুল হবে, কারণ আজ থেকে অনুমানিক সাড়ে তিন হাজার বছর আগে যে নিয়মে তিনি রাষ্ট্রে পৌঁছে যেতে পেরেছেন, সাড়ে তিন হাজার বছর পর একই নিয়মে রাষ্ট্রে পৌঁছা সম্ভব নয়। হাজার বছর আগের উপকরণ হাজার বছর পর এপ্লাই করলে কী দশা হবে আল্লাহ তাআলা ভালো জানেন।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।

লেখকঃ পরিচালক ও প্রধান মুফতি, 
ইমাম আবু হানিফা রহ. ফতোওয়া ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, 
সিলেট।


শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here