Thursday, April 23, 2020

বছর ঘুরে আবার এলো রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস

 
।। ইমাম মাওলানা নুরুর রহমান।।

কবির পংক্তিমালা-
“রমযানু ইয়া রমযান
ইয়া শাহরাল কুরআন,
আক্ববালতা বিল বুশরা
খায়রা ওয়াল গুফরান।”
রমযান, হে রমযান! হে কুরআনের মাস, তুমি আগমন করেছে ক্ষমা আর কল্যাণের সুসংবাদ নিয়ে। বছর ঘুরে আবার এলো মাহে রমজান। মাহে রমজান একমাস রোজা পালন করা ফরজ, এই মাসেই নাজিল হয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। তাই এই মাস হয়ে ওঠেছে আল্লাহর অফুরন্ত রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। বিশ্ব-মুসলিম এ মহান মাসকে অভিবাদন জানায় খোশ আমদেদ মাহে রমজান।

সাওম বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত বহুল প্রচলিত একটি শব্দ, যার উৎপত্তি ফার্সি ভাষা থেকে। আরবীতে যাকে সাওম, বহুবচনে সিয়াম বলা হয়। الصوم  ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অর্থ الإِدْرَاكُ وَالْإِمْسَاكُতথা বিরত থাকা । (আল-মুজামুল ওয়াসিত, পৃ. ২৫৬)

বিভিন্ন অভিধানে সাওম এর অর্থ করা হয়েছে যেভাবে-
ইসলামী বিশ্বকোষে সাওম এর অর্থ করেছে এভাবে- কোনও জিনিস হতে  বিরত থাকা এবং  ইহা পরিত্যাগ করা। (ইসলামী বিশ্বকোষ, পৃ. ২১০)

আফীফ আবুল ফাত্তাহ আত তাব্বারাহ বলেন- সাওম অর্থ হচ্ছে, কোনো কিছু থেকে বিরত থাকা। (রূহুদ্দীন আল ইসলামী, খণ্ড-১, পৃ. ২৫৩)

ইবনুল মানজুর সাওমের অর্থ করেছেন- খাদ্য, পানীয়, যৌনতা ও অনর্থক কথা বার্তা পরিহার করা। বিভিন্ন অভিধানেও সাওম বা সিয়াম শব্দের অর্থ বিরত থাকা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

এ ছাড়া সাওমের পারিভাষিক সংজ্ঞা বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে দিয়েছেন। যেমন-
ইসলামী পরিভাষায় সাওম হলো-
 ﴿هُوَ الْإِمْسَاكُ عَنِ الطَّعَامِ وَالشَّرَابِ والجماع مِنْ طُلُوْعِ الْفَجْرِ إِلَى غُرُوْبِ الشَّمْسِ مَعَ النِّيَّةِ.
অর্থাৎ সাওমের নিয়তে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় আহার, পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকাকে সাওম বলে। (আল-মুজামুল ওয়াসিত, পৃ. ২৫৭)

আফীফ আবুল ফাত্তাহ বলেনঃ আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে ফজর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় খাবার, পানাহার ও যৌন সংযোগ থেকে বিরত থাকার নামই হচ্ছে সাওম। (রূহুদ্দীন আল ইসলামী, খণ্ড-১, পৃ. ২৫৩)

“According to Sari’ah fasting means to abstain completely from foods, drinks and intimate intercourse before the break of the dawn till sunset”

অর্থাৎ- শরীয়তের পরিভাষায় সাওমের নিয়তে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় আহার, পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকাকে সাওম বলে। 
সারকথা হলো-
সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর এবাদত ও সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পানাহার, দাম্পত্য মিলন ইত্যাদি সকল সিয়াম বা রোযা ভঙ্গকারী কর্ম থেকে বিরত থাকা হল সিয়াম বা রোযা। আত্মার পরিশুদ্ধি, আধ্যাত্মিক উন্নতি, মানবিক মমতাবোধের বিকাশ, তাকওয়া ও সততা অর্জনের জন্য সকল যুগের সকল বিশ্বাসী মানুষের অন্যতম প্রধান অবলম্বন হলো সিয়াম।
মহান রাব্বুল আলামিন বলেন-
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
অর্থাৎ,তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৩)
রমজানের আগমনী বার্তা সবার মাঝে আনন্দ-উৎসবের আবহ সৃষ্টি করে। রমজানের চাঁদ দেখা থেকে এ আনন্দের সূচনা হয়। সারা মাস সিয়াম-সাধনা, সাহরী-ইফতার ও তারাবির নামাজ জামাতে আদায়, জিকির-আজকার ইত্যাদি ভালো কাজ সম্পাদনে সবার অংশগ্রহণ সমাজে এক জান্নাতি পরিবেশ সৃষ্টি করে। অন্তত এই মাসে সবাই কুরআন তেলাওয়াত ও ধর্মীয় বই-পুস্তক পড়ায় অধিক মনোযোগী হয়। আর বেশি বেশি দানখয়রাত করে। যারা সামর্থ্যবান তারা দুঃখীদের সাহায্য ও জাকাত দিয়ে তাদের অভাব মোচন করে। সেদিক থেকে রমজানের বিরাট প্রভাব রয়েছে।

রোজা অন্যান্য ইবাদতের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ইবাদত, যার মাধ্যমে মানুষের দৈহিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধি পরিপূর্ণভাবে সাধিত হয়। কারণ, শুধুমাত্র পানাহার ত্যাগ করলেই রোজা পালন হয় না; সেই সঙ্গে সর্বপ্রকার অবৈধ কাজ, কথা ও ব্যবহার থেকেও আমাদের বিরত থাকতে হবে। পবিত্র মন নিয়ে পবিত্রভাবে রোজার যাবতীয় আদব রক্ষা করতে হবে। তা না হলে ক্ষুধা-তৃষ্ণার যন্ত্রণা ভোগ করা ছাড়া আর কিছুই জুটবে না।

রোজা পালন করার মাধ্যমে একজন মানুষ সত্যিকার মানুষরূপে নিজেকে গঠন করতে পারে। রোজা পালনের মাধ্যমে ধনীরা দরিদ্র-ক্ষুধার্ত মানুষের দুঃখ-কষ্ট সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা অর্জন করে লোভ-লালসা থেকে মুক্ত হয়; সহমর্মিতা ও ধৈর্যের শিক্ষায় উজ্জীবিত হয়। প্ররোচনা ও শয়তানের প্রতারণা হতে বাঁচার দিক-নির্দেশনা দেয় রোজা। রোজা হচ্ছে মুত্তাকীদের জন্য লাগাম স্বরূপ। রোজা মানুষের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সবধরনের বিনষ্টকারী কাজ থেকে বিরত রাখে। বিরত রাখে সর্বপ্রকার পাপ এবং পঙ্কিলতা থেকে। রাসুল (সা.) বলেছেন,
﴿حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مَسْلَمَةَ عَنْ مَالِكٍ عَنْ أَبِي الزِّنَادِ عَنْ الْأَعْرَجِ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ الصِّيَامُ جُنَّةٌ فَلَا يَرْفُثْ وَلَا يَجْهَلْ وَإِنْ امْرُؤٌ قَاتَلَهُ أَوْ شَاتَمَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي صَائِمٌ
অর্থাৎ,রোজা মুমিনের জন্য ঢাল স্বরূপ। তাই তোমাদের যে কেউ রোজা রাখবে সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে আর শোরগোল বা উচ্চবাচ্য না করে। কেউ যদি তাকে গালি দেয় বা কটু কথা বলে অথবা তার সাথে ঝগড়া করতে চায়, সে যেন বলে দেয়, ‘আমি রোজাদার।” (বুখারি, খণ্ড-৬, পৃ. ৪৫৭, হাদীস নং ১৯০৪)
তিনি আরো বলেন:
﴿اَلصِّيَامُ جُنَّةٌ مِنَ النَّارِ كَجُنَّةِ أَحَدِكُمْ مِنَ الْقِتَالِ وَصيَامٌ حَسَنٌ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ﴾
অর্থাৎ,যুদ্ধে তোমাদের যেমন ঢাল থাকে, তেমনি জাহান্নামের আগুন থেকে ঢাল হলো সিয়াম। আর প্রতি মাসে তিন দিন সিয়াম পালন করা ভাল। (ইবনু খুযাইমা, আস-সহীহ, খণ্ড-৩, পৃ. ১৯৩; আলবানী, সহীহুত তারগীব, খণ্ড-১, পৃ. ২৩৮। হাদীসটি সহীহ)
অপর এক হাদীসে বলা হয়েছে,
﴿حَدَّثَنَا خَالِدُ بْنُ مَخْلَدٍ حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ بِلَالٍ قَالَ حَدَّثَنِي أَبُو حَازِمٍ عَنْ سَهْلٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ فِي الْجَنَّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرَّيَّانُ يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لَا يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ يُقَالُ أَيْنَ الصَّائِمُونَ فَيَقُومُونَ لَا يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ فَإِذَا دَخَلُوا أُغْلِقَ فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ﴾
অর্থাৎ, "হযরত সাহল (রাঃ) থেকে বর্ণিততিনি বলেনরাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- জান্নাতের রাইয়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন রোজা পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তাদের ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেয়া হবেরোজা পালনকারীরা কোথায়তখন তারা দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। যাতে করে এ দরজাটি দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে"। (বুখারী, আস সহীহ, খণ্ড-৬, পৃ. ৪৬১, হাদীস নং ১৭৬৩)

বস্তুতভাবে রমজান মাস আসে প্রভূত কল্যাণ নিয়ে, মহান রবের করুণা নিয়ে। এ মাস পূণ্যার্জনকারীদের জন্য অন্যতম। অন্য হাদীসে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
﴿أَخْبَرَنَا بِشْرُ بْنُ هِلَالٍ قَالَ حَدَّثَنَا عَبْدُ الْوَارِثِ عَنْ أَيُّوبَ عَنْ أَبِي قِلَابَةَ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَتَاكُمْ رَمَضَانُ شَهْرٌ مُبَارَكٌ فَرَضَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ تُفْتَحُ فِيهِ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَتُغْلَقُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَحِيمِ وَتُغَلُّ فِيهِ مَرَدَةُ الشَّيَاطِينِ لِلَّهِ فِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ مَنْ حُرِمَ خَيْرَهَا فَقَدْ حُرِمَ ﴾
অর্থাৎ, তোমাদের নিকট রমজান মাস এসেছে। এই মাসটি বরকতময়। আল্লাহ তোমাদের উপর এই মাসের সিয়াম ফরয করেছেন। এই মাসে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। এবং এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই মাসে দুর্বিনীত শয়তানদেরকে শৃঙ্খলিত করা হয়। এই মাসে এমন একটি রাত আছে যা এক হাজার রাত অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি সেই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত সে একেবারেই বঞ্চিত হতভাগা।” (নাসাঈআস-সুনান, খণ্ড-৪পৃ. ১২৯আলবানীসহীহুত তারগীব, খণ্ড-১পৃ. ২৪১। হাদীসটি সহীহ)

রোজা শারীরিক শক্তির হেফাজতের সহায়ক একটি মাধ্যম। রোজা সামাজিকভাবেও বেশ ভূমিকা রাখে। গড়ে তুলে তাকওয়াপূর্ণ পরিবেশ। মানুষের মনে সৎ ও সুন্দরভাবে চলার প্রেরণা জাগে। তাওবা, ভয় এবং আল্লাহ-প্রেমের প্রতি স্বাভাবিক প্রবণতা সৃষ্টি হয়। সুতরাং আমরা যদি রমজানের সিয়াম-সাধনার পূর্ণ বাস্তবায়ন আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারি, তাহলে আমরা আমাদের গোটা জীবনকে তাকওয়াপূর্ণ করতে পারবো, হতে পারবো আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহ এ মাসের মর্যাদা ও পবিত্রতা রক্ষা করার তাওফিক দান করুন।
রামযানে কতিপয় করণীয়:

দিনে সিয়াম পালন করা;
রাতে তারাবীহ সালাত করা;
সাহুর ও ইফতার খাওয়া;
কুরআন তিলাওয়াত করা;
দান-সদকা করা;
বেশী বেশী দুয়া করা;
অন্যকে ইফতার করানো;
আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা;
উমরা আদায় করা;
শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করা;
ইতিকাফ করা;
ফিতরা প্রদান করা;
অযথা ও অশ্লিল কথা-কাজ থেকে দূরে থাকা;
ঝগড়া-ফাসাদ বর্জন করা;
দাওয়াতী কাজ করা;
চরিত্র সুন্দর ও পরিমার্জিত করা ও
নিজের দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করে তা সংশোধন করা।

আসুন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে তাক্বওয়া অর্জনের এ মাসে সঠিকভাবে সাওম পালন এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আমিনের সন্তুষ্টি হাসিলের প্রানান্তকর চেষ্ট করি।

সাওম যায়, সাওম আসে
বদলে নাতো মানুষ !
যেমন ছিল, তেমন থাকে
ফিরে নাকো হুঁশ ।

তাই আসুন, রহমতমাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানকে কাজে লাগাই।আল্লাহ তায়ালা আমাকেসহ আমাদের সবাইকে উক্ত মাহে রমজানে নেকীর কাজগুলো করার তাওফীক প্রদান করুন। আমীন।
লেখক: বহুগ্রন্থ প্রণেতা
সেক্রেটারি:
শারীয়া কাউন্সিল ব্যাডফোরড ও মিডল্যনড ইউ কে- 
ইমাম ও খাতিব:
মাসজিদুল উম্মাহ লুটন ইউ কে
সত্যয়ান কারী চেয়ারম্যন:
নিকাহ নামা সার্টিফিকেট ইউ কে
 প্রিন্সিপাল:
আর রাহমান একাডেমি ইউ কে
পরিচালক:
আর-রাহমান এডুকেশন ট্রাস্ট ইউ কে
📞07476136772 📞 07476 961067
nrahmansky@googlemail.com
Arrahmaneducationtust@gmail.com
https://www.facebook.com/Imam.Nurur
https://www.facebook.com/ARET.OR.UK/
https://www.youtube.com/user/nurur9




শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here