Friday, April 17, 2020

আল্লাহ তা’আলা উপর ভরসা করি, মনোবল বৃদ্ধি করি এবং নিয়ম মেনে চলি


।। প্রফেসর ডক্টর সৈয়দ মাকসুদুর রহমান।।                            

আল্লাহ তাআলা উপর ভরসা করি, মনোবল বৃদ্ধি করি এবং নিয়ম মেনে চলি 

ভুমিকা:

আমারা দুর্যোগ এবং মহামারী অবস্থায় আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করি। আল্লাহ তাআলাকে বেশি স্মরণ করি। 
কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آَيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ
মুমিন তো তারা, যাদের অন্তরসমূহ কেঁপে উঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আর যখন তাদের ওপর তার আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং তারা তাদের রবের ওপরই ভরসা করে।(সূরা আনফাল : ২)
﴿أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়। আল্লাহ তাআলা স্মরণ মানুষের যনোবল বৃদ্ধি করে। (সূরা রাদ : ২৮)
﴿وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ
যে আল্লাহর উপর ভরসা করে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট।(সূরা ত্বলাক : ৩)

মনোবল কী?
এ ব্যাপারে আমারা বলতে পারি, কর্মীরা যেখানে কাজ করে সেই কাজের মূল বিষয় বা উদ্দ্যেশ্যের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা সামষ্টিক আচরণগত কাঠামোই হলো মনোবল। এগিয়ে যাওয়ার অপর নাম উৎসাহ। কিন্তু আমাদের সমাজে কিছু ব্যক্তি আছে, যাদের ভেতর উৎসাহ দেয়ার প্রবণতা না থাকলেও এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা দেয়ার প্রবণতা প্রবল। তারা কোনো ব্যক্তির উন্নতি দেখলে তার সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে। তাদের কাজ হয়ে দাঁড়ায় কোথায় কার, কী ভুল হয়েছে তার বিশ্লেষণ করা। কিন্তু সেই ভুলের সমাধান কেউ দেয় না। মানুষকে ভালো কাজে এগিয়ে যাওয়ার পথে উৎসাহ দিতে না পারলেও মন্দ কাজে উৎসাহ দেয়ার মতো কিছু মানুষ আমাদের সমাজে বসবাস করে এখনও। জীবনের অনেক ক্ষেত্রে এমনকি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্যও জরুরি।
ইসলামের বিধিবিধানগুলো সুন্দরভাবে পালন করার জন্যও স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা প্রয়োজন। কারণ শারীরিক শক্তি ও মানসিক মনোবল ছাড়া ইবাদতেও মন বসে না মানবজীবনের অন্যতম নেয়ামত স্বাস্থ্য। এটি এমন এক সম্পদ যা আমাদের ব্যবহারিক জীবনের অনেক ক্ষেত্রে এমনকি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্যও জরুরি। ইসলামের বিধিবিধানগুলো সুন্দরভাবে পালন করার জন্য ও স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা প্রয়োজন।কারণ শারীরিক শক্তি ও মানসিক মনোবল ছাড়া ইবাদতেও মন বসে না। তা ছাড়া আল্লাহর পথে উপর টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন যনোবল শক্তিশালী করা। তাই সুস্থ সবল মুমিন আল্লাহর কাছে অবশ্যই অধিক প্রিয়।

রাসূল  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম :আবূ হুরাইরা রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহু   থেকে ইরশাদ করেন,
﴿عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَلَا تَعْجَزْ وَإِنْ أَصَابَكَ شَيْءٌ فَلَا تَقُلْ لَوْ أَنِّي فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللَّهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ
দুর্বল মুমিনের তুলনায় শক্তিশালী মুমিন অধিক কল্যাণকর ও আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। তবে উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে(সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৬৯৪৫)
এ ছাড়া হাদিসে আছে,
﴿عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنْ النَّاسِ الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ
 ‘ইবন আব্বাস রাদি আল্লাহ তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দুটি নেয়ামতের বিষয়ে বেশির ভাগ মানুষ অসতর্ক ও প্রতারিত।সুস্থতা ও অবসর।(বুখারি শরিফ ৫/২৩৫৭)

ইসলামের দৃষ্টিতে, ‘অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করার চেয়ে সুস্থ অবস্থায় স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উত্তম।ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো,  ‘(الوقية خير من العلاج) বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞান ইসলামের সেই থিউরি স্বীকার করে ঘোষণা করে, ‘রোগ প্রতিরোধ রোগ নিরাময়ের চেয়ে উত্তম।বর্তমানে এ কথাও বলা হয় যে, ‘রোগ প্রতিরোধ রোগ নিরাময়ের চেয়ে সস্তা।

আধুনিক বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার এই যুগে বিজ্ঞান যা আবিষ্কার করছে মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সা: আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে তা বলে দিয়ে গেছেন। তিনি ঘোষণা করে গেছেন,
﴿قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ أَوَّلَ مَا يُسْأَلُ عَنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ  يَعْنِي الْعَبْدَ مِنْ النَّعِيمِ أَنْ يُقَالَ لَهُ أَلَمْ نُصِحَّ لَكَ جِسْمَكَ وَنُرْوِيَكَ مِنْ الْمَاءِ الْبَارِدِ
কিয়ামতের দিন বান্দাকে  সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি করা হবে তা হলো তার সুস্থতা সম্পর্কে। তাকে বলা হবে আমি কি তোমাকে শারীরিক সুস্থতা দিইনি?’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ৩৩৫৮)

চিকিৎসা নেয়ার গুরুত্ব :

রোগাক্রান্ত হলে অনতিবিলম্বে চিকিৎসা নেয়া ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে জরুরি। চিকিৎসা নেয়াকে তাকওয়া পরিপন্থী মনে না করে আরোগ্য লাভের জন্য চিকিৎসা নেয়ার জন্য রোগীকে উৎসাহিত করেছে ইসলাম। রাসূলুল্লাহ সা: নিজে অসুস্থ হলে চিকিৎসা নিতেন। লোকদের চিকিৎসা নিতে উৎসাহিত করতেন। তিনি বলতেন,
﴿حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ إِسْمَعِيلَ حَدَّثَنَا حَمَّادٌ عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ عَمْرٍو عَنْ أَبِي سَلَمَةَ عَنْ أَبِي هُرَيْرِةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنْ كَانَ فِي شَيْءٍ مِمَّا تَدَاوَيْتُمْ بِهِ خَيْرٌ فَالْحِجَامَةُ

'আল্লাহর বান্দারা! তোমরা চিকিৎসা নাও, কেননা মহান আল্লাহ তায়ালা এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি যার প্রতিষেধক তিনি সৃষ্টি করেননি। তবে একটি রোগ আছে যার কোনো প্রতিষেধক নেই, তাহলো বার্ধক্য।(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৮৫৭)

অন্য হাদিসে আছে, হজরত আনাস ইবনে মালেক রাদি আল্লাহ তায়ালা আনহু   শিঙ্গা দান কারীর শিঙ্গার বিনিময় উপার্জন হালাল কি না জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: শিঙ্গা নিতেন। আবু তায়বাহ তাকে শিঙ্গা লাগান। রাসূলে কারিম সা: তাকে দুই সা (একটি নির্দিষ্ট ওজনের নাম) খাদ্যদ্রব্য দেয়ার নির্দেশ দেন। এবং তার মালিক পক্ষের সাথে আলোচনা করে তার ট্যাক্সের পরিমাণ কমিয়ে দেন। আর বলেন, ‘যা কিছু দ্বারা তোমরা চিকিৎসা কর তার মধ্যে উত্তম হলো শিঙ্গা লাগানো।(মুসলিম শরিফ, ২/২২ হাদিস নং ৪০০৭)
আরেকটি হাদিসে আছে,
﴿عَنْ أُسَامَةَ بْنِ شَرِيكٍ قَالَ قَالَتْ الْأَعْرَابُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلَا نَتَدَاوَى قَالَ نَعَمْ يَا عِبَادَ اللَّهِ تَدَاوَوْا فَإِنَّ اللَّهَ لَمْ يَضَعْ دَاءً إِلَّا وَضَعَ لَهُ شِفَاءً أَوْ قَالَ دَوَاءً إِلَّا دَاءً وَاحِدًا قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا هُوَ قَالَ الْهَرَمُ
হজরত সাদ (রা:) বলেন, ‘আমি একবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখন রাসূলুল্লাহ সা: আমাকে দেখতে এসে তাঁর হাত মোবারক আমার বুকের ওপর রাখেন। আমি অন্তরে এর শীতলতা অনুভব করি। অতঃপর তিনি বলেন, তুমি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছ। তুমি ছাকীফ গোত্রের হারেস ইবনে কালদার কাছে যাও। সে (এই রোগের) চিকিৎসা করে।(আবু দাউদ হাদিস ২/৫৪১, হাদিস নং ৩৮৬৯, মাজমাউয যাওয়াইদ ৫/১৪৪-১৪৫ হাদিস নং ৮৩০০)

রাসূল সা: অসুস্থ ব্যক্তিকে অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা করাতে এবং এ ব্যাপারে সবিশেষ সতর্ক থাকতে নিদের্শ দিতেন। (যাদুল মাআদ) হারাম বস্তু ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করতে নিষেধ করতেন। রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা রোগও নাজিল করেছেন রোগের প্রতিষেধকও নাজিল করেছেন। প্রত্যেক রোগের চিকিৎসা রয়েছে। সুতরাং তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ কর। তবে হারাম বস্তু দ্বারা চিকিৎসা নিয়ো না।

তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘হারাম বস্তুতে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য আরোগ্য বা রোগমুক্তি রাখেননি।(যাদুল মাআদ) এই সব হাদিস দ্বারা বুঝা যায় ইসলামের দৃষ্টিতে চিকিৎসা গ্রহণ করা শুধু বৈধই নয় বরং তা গ্রহণ করাই কাম্য।

সুস্থ থাকার ইসলাম নির্দেশিত উপায় :

যেসব কারণে মানুষ অসুস্থ হতে পারে ইসলামি শরিয়ত সেসব থেকে বেঁচে থাকার জোর তাগিদ দিয়েছে। তাই ইসলামি শরিয়ত কতৃর্ক নির্দেশিত স্বাস্থ্যনীতি মেনে চলা ও অসুস্থ হলে চিকিৎসা নেয়া প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য জরুরি।
খাদ্য পানীয় মানুষের রোগব্যাধির অন্যতম কারণ। হাদিস শরিফে আছে, ‘পেট সব রোগের কেন্দ্রস্থল। ইসলাম এ বিষয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে নির্দেশ দিয়েছে এবং অতিভোজন করতে নিরুৎসাহিত করেছে। সাথে সাথে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর খাদ্য নিষিদ্ধ
করেছে। পবিত্র কুরআনে আছে,
﴿كُلُوا وَاشْرَبُوا هَنِيئًا بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
 ‘তোমরা খাও ও পান কর এবং অপচয় কর না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।(সূরা আরাফ : ৩১)

হাদিস শরিফে আছে, রাসূলে কারিম সা: বলেছেন-
﴿حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مُعَاوِيَةَ الْجُمَحِيُّ حَدَّثَنَا ثَابِتُ بْنُ يَزِيدَ عَنْ هِلَالِ بْنِ خَبَّابٍ عَنْ عِكْرِمَةَ عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَبِيتُ اللَّيَالِي الْمُتَتَابِعَةَ طَاوِيًا وَأَهْلُهُ لَا يَجِدُونَ الْعَشَاءَ وَكَانَ عَامَّةَ خُبْزِهِمْ خُبْزُ الشَّعِيرِ
[ ش - ( طاويا ) أي خالي البطن جائعا . ( العشاء ) أي طعام العشاء .(عن أنس ابن مالك قال لبس رسول الله صلى الله عليه و سلم الصوف واحتذى المخصوف
وقال أكل رسول الله صلى الله عليه و سلم بشعا ولبس خشنا
فقيل للحسن ما البشع ؟ قال غليظ الشعير . ماكان يسيغه إلا بجرعة ماء
في الزوائد هذا إسناد ضعيف . لأنه نوح بن ذكوان متفق على تضعيفه . قال أبو عبد الله الحاكم يروى ,

পেটের এক-তৃতীয়াংশ খাদ্য দিয়ে, এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখবে(সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস নং ৩৩৪৯)

রাসূল সা: কখনো পেটপুরে খেতেন না। পরিমিত খাবার গ্রহণে অভ্যস্থ হলে সব ধরনের রোগব্যাধি থেকে মুক্ত থাকা যায়।

উপসংহার :
মহামারী যেন আমাদের অমানুষ না করে। আমরা পারস্পরিক আমানত লক্ষ্য রাখি, অপরকে গালি থেকে বিরত থাকিগর্ভধারিনী মাকে রাস্তায় ফেলে না আসি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে বিপদ থেকে রক্ষা করুন, আমীন।

লেখকঃ
প্রফেসর,
আল হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,
কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here