Saturday, April 25, 2020

মাহে রমজানে কুরআন পড়ুন-কুরআন বুঝুন

 
।। মাজহারুল ইসলাম জয়নাল।।

শিল্পীর কন্ঠে সুমধুর ধ্বনি-
আল-কুরআনের পথ, এই পথই আসল পথ,
অন্য পথে অন্য মতে নেই যে, রহমত।”

ঝামেলাপূর্ণ সংক্ষিপ্ত জগতের পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে ভূষিত, আল্লাহ প্রদত্ত মহা নেয়ামত আল-কুরআন। নফল ইবাদতের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াত সর্বোত্তম। একটি হরফের বিনিময়ে ১০ টি নেকি পাওয়া যায়। কুরআন নাজিলের মাস রমজানে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করুন এবং প্রয়োজনীয় সুরা ও আয়াতসমূহ মুখস্থ করুন।

বিদায় হজের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, “আমি তোমাদের মধ্যে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি : কিতাবুল্লাহ তথা আল-কুরআন আর সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ তথা আল-হাদিস। যত দিন তোমরা এ দুটিকে আঁকড়ে ধরবে, তত দিন পথভ্রষ্ট হবে না।”

কুরআন আঁকড়ে ধরে রাখার অর্থ শুধু তিলাওয়াত করা নয়। বরং আঁকড়ে ধরার অর্থ হলো কুরআন শুদ্ধভাবে পরিমাণ মতো তিলাওয়াত, কুরআন বোঝার উদ্দেশ্যে অধ্যয়ন, কুরআনি বিধিবিধান নিজের জীবনে বাস্তবায়ন এবং যথাসাধ্য অন্যের কাছে পৌঁছানো।
কুরআনের তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন এবং কুরআনের অনুশাসন মেনে চলাকে আল্লাহ তাঁর বান্দার জন্যে সহজ করে দিয়েছেন-  আল্লাহ তায়ালা বলেন-
﴿وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآَنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ﴾
অর্থাৎ, ‘‘আর আমি নিশ্চয়ই কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, অতএব কোনো উপদেশ গ্রহণকারী আছে কি?” (সুরা আল-কামার, আয়াত: ২২)

কুরআনের অর্থ বা মর্ম বুঝা, আমাদের জন্য যে কত জরুরী উপরের আয়াতে কারিমা হতে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। 

একটি উদাহরণ দিলে কুরআনের অর্থ জানার গুরুত্ব আরো সহজে প্রতিয়মান হবে।

যেমন, একজন অফিসারের নিকট ইংরেজি লেখা একটি চিঠি আসলো মন্ত্রণালয় হতে, তিনি চিঠি খুললেন ইংরেজি পড়লেন ঠিকই ; কিন্তু তার বাংলা কি হয় তা জানেন না। তাহলে এবার আপনি বলুন? মন্ত্রণালয় হতে আসা চিঠিটির কোনো বক্তব্য বা নির্দেশনা তিনি যেহেতু বুঝেন নাই, সেহেতু তার প্রতি মন্ত্রণালয় হতে কী দিকনির্দেশা ছিলো তা তিনি অবগত নন।

ঠিক তদ্রূপভাবে আপনি কুরআন পড়লেন, পড়ার ছওয়াব পাইলেন। কিন্তু আপনার প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে আপনার প্রতি কী দিকনির্দেশা ছিলো তা আপনি জানলেন না, তাই পড়লেন ঠিকই কিন্তু কুরআনের অর্থ বা অনুবাদ না জানার কারণে আপনার প্রতিপালকের আদেশ-নিষেধ, বিধি-বিধান সম্পর্কে আপনি কিছুই জানলেন না, তা কি হয়?
আপনি জীবনে অনেক কিছুই পড়েছেন, ক্লাসের পড়া থেকে শুরু করে নিয়ে কত ধরনের বই, যেমন ইতিহাস, সাধারণ জ্ঞান, সহ অতিরিক্ত জ্ঞান লাভের জন্য কত বইই না পড়েছেন। কিন্তু আপনার জীবনের গাইড লাইন কুরআনের মর্ম অনুধাবন করলেন না, তা কি হয়?

তাই, এই রামাযানে  টার্গেট করুন, আমার জীবনের সংবিধান, যুগ জিজ্ঞাসার সঠিক সমাধান, মানব জাতির হেদায়ত সমেত মহা নেয়ামত আল কুরআনের  আয়াত/সুরাসমূহের অর্থ শিখবো। না বুঝে সারাজীবনই তো কুরআন পড়লাম এবারের এই অবসর সময়টাকে কুরআন বুঝার কাজে ব্যয় করব।

প্রতিদিন সালাতে সুরা ফাতেহা পড়েন কিন্তু অর্থ জানেন না! তা কি হয়? যদি কুরআনের অর্থ জানতেন, তাহলে আপনার জীবনের চিত্র সত্যিই পাল্টে যেতো। জীবনে অনেক বই পড়লেন, এবার আল্লাহর দেয়া বই কিতাবুল্লাহ বুঝে বুঝে পড়ুন। যত পড়বেন ততই কুরআন প্রেমে পড়বেন। আর জীবন মহাসত্যের অমীয় বাণীতে শান্তিময় হবে।
আসুন আমরা কুরআনের মাস রমজান উপলক্ষ্যে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা করি। 
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
﴿خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ﴾
অর্থাৎ,তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করে ও শিক্ষা দান করে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। (সহীহ বুখারী, খণ্ড-, পৃ. ১৯১৯)
﴿مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا﴾
অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি কুরআনের একটি বর্ণ পাঠ করবে সে একটি পুণ্য বা নেকী অর্জন করবে। পুণ্য বা নেকীকে দশগুণ বৃদ্ধি করে প্রদান করা হবে। (তিরমিযী,খণ্ড-, পৃ. ১৭৫, হাদীস নং ২৯১০)  হাদীসটি সহীহ। অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
﴿الْمَاهِرُ بِالْقُرْآنِ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ وَالَّذِي يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَيَتَتَعْتَعُ فِيهِ وَهُوَ عَلَيْهِ شَاقٌّ لَهُ أَجْرَانِ﴾
অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াতে সুপারদর্শী সে সম্মানিত ফিরিশতাগণের সঙ্গে। আর কুরআন তিলাওয়াত করতে যার জিহবা জড়িয়ে যায়, উচ্চারণে কষ্ট হয়, কিন্তু কষ্ট করে অপারগতা সত্ত্বেও সে তিলাওয়াত করে তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ পুরস্কার।” (সহীহ বুখারী,খণ্ড-, পৃ. ২৭৪৩, সহীহ মুসলিম, খণ্ড-, পৃ. ৫৪৯)
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
﴿اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لأَصْحَابِهِ﴾
অর্থাৎ, “তোমরা কুরআন পাঠ করবে; কারণ কুরআন কিয়ামতের দিন তার সঙ্গীদের (কুরআন পাঠকারীগণের) জন্য শাফাআত করবে।” (সহীহ মুসলিম, খণ্ড-১, পৃ. ৫৫৩)
কুরআন সাধারণভাবে দিবারাত্র সকল সময়ে পাঠ করা যায়। আর মুমিনের কুরআন পাঠের বিশেষ সময় হলো রাত্রে কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াত করা। কুরআন কারীমে এরূপ তিলাওয়াতকে মুমিনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রমজানের রাত্রিতে সালাতুল্লাইল আদায় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। কিয়ামুল্লাইল বা তারাবীহে এক বা একাধিকবার পূর্ণ কুরআন  তিলাওয়াত বা শ্রবণ করাও গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। এরূপ রাতের তিলাওয়াতের কথাই রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
﴿اَلصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَقُوْلُ الصِّيَامُ رَبِّ إِنِّيْ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّرَابَ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِيْ فِيْهِ وَيَقُوْلُ الْقُرْآنُ رَبِّ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِيْ فِيْهِ فَيُشَفَّعَانِ.
অর্থাৎ,রোযা ও কুরআন বান্দার জন্য শাফাআত করবে। রোযা বলবে: হে রব্ব, আমি একে দিনের বেলায় খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত রেখেছি, কাজেই তার পক্ষে আমার শাফাআত কবুল করুন। কুরআন বলবে: হে রব্ব, আমি রাতের বেলায় তাকে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, কাজেই তার পক্ষে আমার শাফাআত কবুল করুন। তখন তাদের উভয়ের শাফাআত কবুল করা হবে। (মুসতাদরাক হাকিম, খণ্ড-, পৃ. ৭৪০, মুসনাদ আহমদ, খণ্ড-, পৃ. ১৭৪, আত-তারগীব, খণ্ড-, পৃ. ১০, ৩২৫, মাজমাউয যাওয়াইদ,খণ্ড-১০, পৃ. ৩৮১, হাদীসটি সহীহ)

উপরোক্ত হাদীসের দ্বারা কুরআন পড়া ও বুঝার গুরুত্ব দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার। তাই আর দেরি  না করে আজই শুরু করুন, সুরা ফাতেহার অনুবাদ দিয়ে। কুরআন বুঝার জন্য বিখ্যাত বাংলা তাফসীর গ্রন্থসমূহ সংগ্রহ করুন। মনে রাখবেন, ‍কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াত আপনার জীবনের জন্যেই। আমাদের জীবনে শান্তির জন্যে যা যা প্রয়োজন তার সবটুকুই আমাদের মালিক আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলে দিয়েছেন।
তাই কুরআন পড়ুন, কুরআন বুঝুন, আল কুরআনের আলোকে শান্তিময় জীবন গড়ুন।

আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।


লেখকঃ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট


শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here