Thursday, April 23, 2020

তারাবিহ নামাযে কুরআন খতম: শরয়ী দৃষ্টিকোণ


 

।। মুহাম্মদ জিয়াউর রহমান।।

ভূমিকা
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন লাওহে মাহফুযে সংরক্ষিত বিশ্বজাহানের একমাত্র প্রতিপালক মহান আল্লাহ তাআলার অবিনশ্বর কালাম। মানবজাতির হেদায়তের অভিনব ও অপূর্ব এ মহাগ্রন্থ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর অবতীর্ণ হয়, যা বিশ্বনবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সর্বশ্রেষ্ঠ মুজিযা। মানবজাতির সর্বময় কল্যাণের এ আলোকবর্তিকা ইসলামি শরিআতের প্রথম ও প্রধান উৎস। মহান রাব্বুল আলামিনের এ পবিত্র কালাম  তিলাওয়াতে যেমন রয়েছে অফুরন্ত কল্যাণ তেমনি এর বিধিবিধান অনুসরণেও মুসলমান মাত্রেরই বাধ্যবাধকতা রয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করেছেন ঠিক সেভাবেই সাহাবিদেরও তিলাওয়াতের নির্দেশ দিয়েছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআন পবিত্র রমযান মাসে তারাবিহ সালাতে খতমের মধ্যে রয়েছে সওয়াব। তবে এ ক্ষেত্রে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবাদের নির্দেশিত পদ্ধতিতেই তারাবিহে কুরআন খতম করা প্রয়োজন। 

আলোচ্য নিবন্ধে এ বিষয়েই আলোকপাত। ওয়াবিল্লাহিত তাওফীক।

তারাবিহ
রমযান মাসের অন্যতম সুন্নাত কর্ম হলো তারাবীহের সালাত আদায় করা। আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে ছাওয়াবের উদ্দেশ্যে রমযান মাসে তারাবির সালাত আদায় করবে, তার অতীতের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (সহীহুল বুখারী)

তারাবিহ শব্দ তারবিহা শব্দের বহুবচন। আভিধানিক অর্থ, বিশ্রাম, স্বস্তি, শান্তি ও প্রশান্তি। রমযান মাসে এশার সালাতের পর যে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ বিশ রাকআত সালাত আদায় করা হয় তাই তারাবিহ। (আল-কামুসুল ফিক্হ)

মুসলিম বিশ্বে প্রতি রমযানে ২০ রাকআত তারাবীহের সালাতে কুরআনুল করীমের খতম করা হয়। আর তারাবীহের সালাতে পবিত্র কুরআনুল কারিম খতম করা সুন্নাত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করেছেন আর আমি তোমাদের জন্য তারাবির সালাত সুন্নাত করেছি; অতএব যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে ছাওয়াবের আশায় রমযানে দিনে সিয়াম পালন করবে ও রাতে তারাবির সালাত আদায় করবে, সে গোনাহ থেকে এমন পবিত্র হবে; যেমন নবজাতক মাতৃগর্ভ থেকে নিষ্পাপ অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়। (সুনান আন-নাসাঈ, খ. ১, পৃ. ২৩৯)

খতমে তারাবিহ
রমযান মাসে তারাবিহের সালাতের মধ্যেও পবিত্র কুরআন খতম করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রেও কুরআন খতমের সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসরণের বিষয়টি খুব কমই পরিলক্ষিত হয়। কুরআন খতমের জন্য প্রয়োজনীয় সময় সম্পর্কে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত হচ্ছে কমপক্ষে তিন দিন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাতে ধীরেস্থিরে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। প্রতিটি পারার জন্য কমপক্ষে এক ঘণ্টা সময় নিয়ে তিলাওয়াত করলে মোটামুটি ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করে তিলাওয়াত করা যায়। আর ৩৫-৪০ মিনিটে তিলাওয়াত করলে আশা করা যায় যে, এতে তিলাওয়াতের হক আদায় হয়ে যাবে।

আমাদের সমাজে তারাবিহের সালাতের সংখ্যা নিয়ে বিদ্যমান বিতর্ক মোটেও কাম্য নয়। কিন্তু তারাবিহের সালাতে কুরআন তিলাওয়াতের সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি অনুসরণ হচ্ছে কি না এ বিষয়ে তেমন একটা আলোচনা করতে দেখা যায় না। অনেকের মধ্যে এমন মনোভাব পরিলক্ষিত হয় যে, তারাবিহ মানে তাড়াতাড়ি তিলাওয়াত। আমাদের দেশের অধিকাংশ মসজিদে এতই দ্রুত তিলাওয়াত করা হয় যা শ্রোতা হিসেবে অনেক কুরআনে হাফিযের ও পুরোপুরি লক্ষ্য করা কষ্টকর হয়।

শহরাঞ্চলের কিছু কিছু মসজিদে ধীরস্থিরভাবে তিলাওয়াত করতে দেখা যায়। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মসজিদে এত দ্রুত তিলাওয়াত করা হয় যা লক্ষ্য করা একেবারেই কঠিন। যেখানে ধীরস্থিরভাবে, চিন্তা করে তিলাওয়াত করলে এক পারা তিলাওয়াতে এক ঘণ্টা সময় দরকার সেখানে দেখা যায় এক ঘণ্টার মধ্যেই ইশা ও বিতরসহ বিশ রাক্আত তারাবিহ্-র নামায শেষ হয়ে যায়।

হিসাব করে দেখা যায় যে, বিশ রাকাত তারাবিহ্-র নামাযে মোটামুটি ধীরেস্থিরে সানা, রুকু, সিজদাহ, কওমা, জলসা ও শেষ বৈঠক আদায় করতেই প্রায় ২২ মিনিট সময় ব্যয় হয়। আর এক পারা কুরআন তাজবিদের সাথে হদর পদ্ধতিতে তিলাওয়াত করলে প্রায় ৪০ মিনিট সময় ব্যয় হয়। ইশার ফরজ, সুন্নত ও বিতর নামায আদায়ে প্রায় ১৮ মিনিট সময় ব্যয় হয়। তারাবিহের প্রতি চার রাকাআত পর পর সমপরিমাণ সময় বিশ্রাম করা   মোস্তাহাব। (বেহেশতী জেওর, খ. ২, পৃ. ১৬৬) 

তারাবিহের চার রাকাআত নামায আদায় করতে প্রায় ১২ মিনিট সময় ব্যয় হয়। তাই সুন্নাহ সম্মতভাবে কুরআন তিলাওয়াত করলে ও বিরতিতে মুস্তাহাব পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক তারাবিহ নামায আদায় করলে ইশা ও বিতরসহ প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় হওয়ার কথা। হারামাইন শারিফাইনে তারাবিহ্ আদায়ের পদ্ধতি পর্যালোচনা করলে এমন চিত্র ফুটে উঠে।

নামাযে অংশগ্রহণকারী মুসল্লিদের কষ্ট হওয়া বা মুসল্লি কম হওয়ার আশংকায় চার রাকআত অন্তর অন্তর বিরতিতে মুস্তাহাব পদ্ধতি অনুসরণ না করে নামায আদায় করলে এবং তিলাওয়াত তাজবিদের যথাযথ অনুসরণে ধীরেস্থিরে আদায় করলে ইশা ও বিতরসহ দেড়ঘণ্টারও অধিক সময় ব্যয় হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশের অনেক মসজিদে এত দ্রুত তিলাওয়াত করা হয় যা সুন্নাতের পরিপন্থী।

ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুমে বলা হয়েছে যে, তারাবিহ্ নামাযে এত দ্রুত তিলাওয়াত করা যে বুঝে আসে না-এরূপ তিলাওয়াতে সাওয়াবের পরিবর্তে গোনাহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। (আহকামে যিন্দেগী, পৃ. ২২৪) এরকম তিলাওয়াত মোটেও কাম্য নয়।
হারাম শারিফের ইমাম শায়খ আব্দুর রহমান সুদাইসী দামাতবারাকাতুহু- এর তিলাওয়াত শ্রবণে পরিলক্ষিত হয় যে, তাঁর এক পারা তিলাওয়াতে ৩৭ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড ব্যয় হয়েছে। শায়খ মিশারি বিন  রশিদ আল আফাসি দামাত বারাকাতুহু এর এক পারা তিলাওয়াত শ্রবণে পরিলক্ষিত হয় যে, তার এক পারা কুরআন তিলাওয়াতে ব্যয় হয়েছে ৫৪ মিনিট ২৮ সেকেন্ড।

সুতরাং তিলাওয়াতকারীকে অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত যাতে করে তিলাওয়াতের তিন পদ্ধতির (তারতীল, তাদবির, হদর) কোনো একটি পদ্ধতিতে তিলাওয়াত হয়। অতএব, খতম তারাবিহ- এ তিলাওয়াতের বেলায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশিত পন্থা অবলম্বন জরুরি। রাসুলুল্লাহসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবদ্দশায় তারাবিহের সালাত আদায়ে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন মর্মে হাদিসে বর্ণিত। সুতরাং এ থেকে বুঝা যায় যে, তারাবিহের সালাত ধীরেস্থিরে তিলাওয়াতের মাধ্যমে আদায় করলেই সুন্নাত পদ্ধতির অনুসরণ হয়।

বর্তমানে মহামারির এ পর্যায়ে বিশ্বের বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদগণ ঘরে তারাবীহের সালাত আদায়ের পরামর্শ দিচ্ছেন। বিশেষ করে আল্লামাহ আরশাদ মাদানী দামাত বারাকাতুহুমও ঘরে তারাবিহ আদায়ের পরামর্শ দিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে আমরা বাড়ীতে ২/৩ জন মিলে জামাআতের সাথে তারাবীহের সালাত আদায় করতে পারি। কিন্তু বাড়ীতে তারাবিহের সালাত আদায়ে কুরআন খতম করা অনেকটা কষ্টসাধ্য। আমরা প্রতিটি ঘরে কুরআনের হাফিয তৈরি করতে ব্যর্থ।

আমরা দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের নাগরিক হলেও ক্ষুদ্র পরিসরে রাষ্ট্রীয়ভাবে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কুরআন তিলাওয়াত শিখানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা মুসলিম হিসেবে প্রত্যেকের কর্তব্য যত কষ্টই হোক পবিত্র কুরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শিক্ষা করে যতটুকু সম্ভব কুরআনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা জানার, বুঝার ও আমল করার চেষ্টা করা।
আল্লাহ না করুক যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয় তবে, তারাবিহের সালাত মসজিদে আদায় করে কুরআন খতম অংশীদার হওয়া আমাদের জন্য সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে আমরা বাড়ীতে কুরআন তিলাওয়াত ও খতমের সুন্নাহসম্মত পদ্ধতির অনুসরণ করে কুরআন খতমের চেষ্টা অব্যাহত রাখব।

আমাদের উচিত, করোনা ভাইরাসের মতো মহামারী থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। প্রয়োজনে বাড়ীতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছোট্ট পরিসরে জামাতের সাথে ফরজ সালাত ও তারাবিহের সালাত আদায় করার চেষ্টা করা।

উপসংহার
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাথী সঙ্গীদের প্রদর্শিত পদ্ধতির অনুসরণেই মানবজাতির ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি নিহিত। তাই তারাবিহ সালাতে কুরআন তিলাওয়াত করা ও তা শ্রবণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তবে তা হতে হবে শরয়ী নিয়ম অনুসারে। তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত রাসুলুলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশিত পদ্ধতি অনুসরণ পূর্বক তারাবিহ নামায সহ যাবতীয় ইবাদত পালনে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হওয়া।

আমরা আল্লাহর কাছে দুআ করি, আল্লাহ যেন আমাদেরকে ক্ষমা করে কুরআন নাযিলের মাসে তারাবিহের সালাতে কুরআন খতমের সুযোগ করে দেন। আমীন।
লেখকঃ
পি.এইচডি গবেষক ও শিক্ষক
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,


লিডিং ইউনিভার্সিটি,
সিলেট।
ইমেইল: zia1290@gmail.com
মোবাইলঃ 01715610866



শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here