Friday, April 24, 2020

অভিজ্ঞতার নামে প্রচলিত খতমের বৈধতা: শরয়ী দৃষ্টিকোণ



।। হাফিজ মুফতি মোস্তফা সোহেল হিলালী।।

খতমকে কি অভিজ্ঞতা বলা যায়?

রাসূল (সা.) এর সুন্নায় নেই এমন অনেক আমল আমাদের অনেকে বৈধ করতে মরিয়া। বিদআত নয় প্রমাণ করতে অনেকে ধর্মীয় আমলকেও অভিজ্ঞতার নামে বৈধ করেন। এতে আকীদার বিদআত সৃষ্টি হয়, যা আমলী বিদআতের চেয়ে মারাত্মক। অথচ ইবনু তাইমিয়া (রহ.) আজ থেকে ৮০০ বছর আগেই বিষয়গুলো স্পষ্ট করে গেছেন। আমি তার বক্তব্যের আলোকে প্রচলিত বিভিন্ন খতম বিষয়ক বিস্তুর  আলোচনা করেছি। 

অভিজ্ঞতা বনাম ধর্মীয় অনুভূতি

এ পর্যন্ত যে খতমগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা নবী করীম () এর শিক্ষা বহির্ভুত এবং খেলাফে সুন্নাত একথা অনেকে স্বীকার করেন। খেলাফে সুন্নাত স্বীকার করা সত্তেও তারা মনে করেন এগুলো জায়েয। এসব খতম পড়তে শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো সমস্যা নেই। এর পক্ষে তাঁরা যে দলীল পেশ করেন তা হলো, তাজরিবাহ বা অভিজ্ঞতা।

উলামাদের এক শ্রেণী ঈসালে ছওয়াবের খতমে অংশ নেন না। আরেক শ্রেণি অংশ নিলেও তা বিদআত মনে করেন। কেননা তারা জানেন যে, খাইরুল কুরুনে খতমের মাধ্যমে ঈসালের কোনো পদ্ধতি ছিল না। উল্লেখিত দুটি শ্রেণি ঈসালে ছওয়াব ছাড়া অন্যান্য সমস্যার কারণে যে কোনো খতম পড়তে বা পড়াতে কোনো সমস্যা রয়েছে বলে মনে করেন না। তাঁদের যুক্তি হলো, এটি একটি তাজরিবাহ বা অভিজ্ঞতার বিষয়। এর সাথে বিদআতের কোনো সম্পর্ক নেই। কেননা বিদআতের সম্পর্ক ইবাদতের সাথে। খতম যদি ইবাদতের উদ্দেশ্যে না করা হয়, বরং রোগমুক্তি বা অন্য উদ্দেশ্যে করা হয় তবে না-জায়েয হওয়ার কোনো কারণ নেই। এগুলো বিভিন্ন বুযুর্গের অভিজ্ঞতা মাত্র। অভিজ্ঞতার আলোকে অমুক খতমে অমুক ফল দেখা গেছে, তাই আমরা সেই আশায় খতম পড়ছি।

এবার আবার তাঁদের এই যুক্তিগুলো নিয়ে একটু পর্যালোচনা করার চেষ্টা করব ইন-শা-আল্লাহ। আমরা জানতে চেষ্টা করব যে তাজরিবাহ বা অভিজ্ঞতার আলোকে খতমের বৈধতা দেয়া কতটুকু যুক্তিসংগত।

যে কোনো খতমই পড়তে কোনো সমস্যা নেই একথা কতটুকু গ্রহণযোগ্য?  আমরা দেখি যে, অনেক খতম এমন রয়েছে যেগুলো আলেম দূরের কথাকোনো মুসলমানই তা পড়তে পারে না। কেননা এগুলো তাকে শিরকের  মত ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। অতএব যে কোনো খতম পড়তে পড়াতে কোন সমস্যা নেই এমন কথা অজ্ঞতা বা উদাসিনতার প্রকাশ বলে আমরা বুঝতে পারছি। 
 
এবার আমরা দেখতে চেষ্টা করব, যেসব খতমে শব্দগত কোন আপত্তি নেই তার কথা। অভিজ্ঞতার আলোকে এমন খতমাদিকে শুদ্ধ বলে চালানো কতটুকু গ্রহণযোগ্য

অভিজ্ঞতা ও ধর্মীয় অনুভূতি দুটি বিষয়ের পার্থক্য না জানার ফলেই আমরা এমন কথা বলি এবং অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে অবৈধকে বৈধ করা চেষ্টা করি। অথচ অভিজ্ঞতা ও ধর্মীয় অনুভূতি দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিষ। উভয়ের মাঝে আকাশ পাতাল ব্যবধান। ইবনে তাইমিয়া রাহ. বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন। ইবনে তাইমিয়া রাহ. এর বক্তব্যটি একেবারে সহজে বুঝে নেয়ার জন্য তাঁর আলোচনা পেশ করার আগে প্রথমে আমরা বিষয়টি অনুধাবনের চেষ্টা করব ইন-শা-আল্লাহ। 

অভিজ্ঞতা ও ধর্মীয় অনুভূতি এই দুটি বিষয়ের পার্থক্য বুঝে নিলেই আমরা বুঝে নিতে পারব যে, অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে খতমকে জায়েয বলার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু।

মূলত কোনো জিনিষের সাথে বারংবার সম্পৃক্ত হওয়া, সেই বস্তুকে নিয়ে গবেষণা, পরীক্ষা-নিরিক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে উক্ত বস্তুর ভিতর বাস্তব যে প্রতিক্রিয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় তাকে বলে অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতার আলোকে কোনো কিছু প্রমাণিত হলে তা উক্ত বস্তুর খাস্সা বা বৈশিষ্ট বলে পরিগণিত হয়। বৈশিষ্ট চিহ্নিত হলে তা অস্বীকারের কারো কোনো উপায় থাকে না। পাগল ছাড়া কেউ তা অস্বীকার করতে পারে না। যে অস্বীকার করবে সে সবার কাছে বিবেক ও বুদ্ধিহীন বলে গণ্য হবে। কেউ স্বীকার করুক বা নাই করুক, বিশ্বাস করুক বা নাই করুক, উক্ত বস্তু তার কাজ করেই যাবে। এখানে ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। 

যেমন ধরুন,
আগুনের ভিতর জ্বালানোর বৈশিষ্টতা মানুষ প্রথমে অভিজ্ঞতার আলোকেই পেয়েছে। আগুন জ্বালায় এ কথা সবাই মানেন। এভাবে যে কোনো রোগের ঔষধ অনেক পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়েছে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে অমুক ঔষধ খেলে অমুক রোগ ভালো হওয়ার বৈশিষ্টতা আল্লাহ সেই ঔষধে রেখেছেন। অভিজ্ঞতায় প্রমানিত হলে মুসলিম, খ্রীস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, আস্তিক, নাস্তিক সবাই তা স্বীকার করেন। কেননা এটা সেই বস্তুর নিজস্ব বৈশিষ্ট। তাই অভিজ্ঞতা সঠিক হলে সবাই তা স্বীকার করতে বাধ্য। 

অপরদিকে ধর্মীয় অনুভূতি এমন যা একজন বিশ্বাস করলে অপরজন করেন না। যেমন ধরুন, একটি অতি সুন্দর পাথর, হিন্দু ধর্মের ব্যক্তি তাকে খুবই শ্রদ্ধা করছেন। তিনি বলছেন, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে এই পাথর থেকে এই ফল পাওয়া যায়, এর অসম্মান করলে এই ক্ষতি হয়। অপর ব্যক্তি যিনি এই ধর্মে বিশ্বাসী নন তিনি এই পাথরকে লাথি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছেন। কেননা হিন্দু ব্যক্তি যে বিশ্বাস পোষণ করেন তিনি তা পোষণ করেন না। পাথরকে লাথি মারলেও তার কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। হিন্দু ব্যক্তির কথাটি বাস্তব হলে লাথি মারলে এই ব্যক্তিরও ক্ষতি হওয়ার কথা ছিল। এখানে হিন্দু ব্যক্তির ধারণাকে আমরা অভিজ্ঞতা বলতে পারি না। বরং তা তার একটি ধর্মীয় বিশ্বাস বলে ধরে নেই। পাথরে বিশ্বাসী লোকটি যদি পাথরকে শ্রদ্ধার কারণে কোনো লাভ, অপমান করার কারণে কোনো ক্ষতির বাস্তব ঘটনা শুনায় তবুও মুসলিম তা উড়িয়ে দিবেন, এমনকি তা নিয়ে হাসির কৌতুকও রচনা করতে পারেন। তিনি বলবেন মূলত লাভ ক্ষতি অন্য কারণে হয়েছে, হিন্দু ব্যক্তির বিশ্বাস তাকে এদিকে টেনে নিয়ে গেছে। এই হলো অভিজ্ঞতা এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের পার্থক্য। 

এভাবে যে ব্যক্তি নিয়মিত মাজারে আসা যাওয়া করে, মাজারকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে, তাকে আপনি এর খারাবী বুঝাতে চেষ্টা করলে বা এখানে এসে কোনো লাভ নেই বললে, সে আপনাকে তার অনেক লাভ দেখিয়ে দিবে। সে বলবে, আমি মাজারে আসার কারণে এই পেয়েছি, সেই পেয়েছি। শাহজালাল বাবার কাছে চাইলে পাওয়া যায় বলে আমার কাছে অনেক প্রমাণ রয়েছে। 
 
এ কথাগুলো কোন কাল্পনিক বা ধরে নেওয়ার ভিত্তিতে নয় বরং বাস্তব। আমার নিজ কানে সিলেটের অনেককেই বলতে শুনেছি, এত লোক কি এখানে এমনিতেই আসে? নিশ্চয় তারা কিছু পায়। আমাদের ঘরের জিনিষ তাই আমরা এর ক্বদর তথা মূল্যায়ন করি না। 

এখানে সে তার অভিজ্ঞতা দেখালেও সহীহ আক্বীদা পোষণকারী মুসলিম তা বিশ্বাস করেন না। মাজার বিশ্বাসী লোকটির এমন কথা আপনার হাসি ও আক্ষেপকেই বৃদ্ধি করে। আপনি এটিকে তার একটি বোকামী বলেই দেখছেন। কেননা এটা তার মনের তৈরী একটি বিশ্বাস যার কোনো প্রমাণ নেই। প্রথমে বিশ্বাস তৈরীর পর সে তার লাভ ক্ষতিকে মাজার কেন্দ্রিক টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সে যতই অভিজ্ঞতার কথা বলুক না কেন আপনাকে তা বিশ্বাস করাতে পারবে না। তার কারণ হলো, এটাকে অভিজ্ঞতা নাম দিলেও প্রকৃতপক্ষে অভিজ্ঞতার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। বরং এটিও তার একটি ধর্মীয় অনুভূতি বা বিশ্বাস। 

এভাবে হাজারো উদাহরণ চিন্তা করলে আপনি নিজেই বের করতে পারবেন, যেখানে ধর্মীয় বিশ্বাসকে অভিজ্ঞতার নাম দিয়ে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। কুরআন হাদীসের বিপরীত যত ভ্রান্ত আক্বীদা বা ধর্ম রয়েছে তার অধিকাংশই এমনকি সিংহভাগই এ পর্যায়ের। 

আরেকটি উদাহরণ দেখুন:
বিসমিল্লাহবলে খাওয়া শুরু করলে খাবারের মাঝে বরকত হয় বলে আমরা মুসলিম হিসেবে বিশ্বাস করি। কেননা আমাদের নবী করীম () তা বলে গেছেন। যে ব্যক্তি তাঁকে নবী বলে অস্বীকার করে সে এটি বিশ্বাস করবে না। মুসলিম ব্যক্তি বাস্তবে এই বরকত উপলব্ধি করলেও তিনি এখানে অভিজ্ঞতার দলীল দিতে পারেন না। কেননা এটা অভিজ্ঞতার বিষয় নয়। বরং এটি মুসলিম ব্যক্তির একটি ধর্মীয় বিশ্বাস। অভিজ্ঞতার বস্তু হলে মুসলিম অমুসলিম সবাই তা বিশ্বাস করতে বাধ্য। নবী করীম () বলার কারণে মুসলিম ব্যক্তি এই বিশ্বাস পোষণ করেন। আল্লাহ বা রাসূল ছাড়া অন্য কেউ বললে এই একই ব্যক্তি তা উড়িয়ে দিতেন। কেননা ওহী ছাড়া ধর্মীয় বিশ্বাস পোষণ করা যায় না । ওহীর বাহিরের আক্বীদা মানেই ভ্রান্তি বলে তিনি জানেন। 

মনে করুন, আমি বাহ্যত বুযুর্গির এক পর্যায়ে পৌঁছে যদি বলি ক্বুল হুয়াল্লাহু...পড়ে খাবার শুরু করলে খাবারে বরকত হয়। এখন দেখা যাবে আমার কিছু অন্ধ ভক্ত একথা বিশ্বাস করবেন এবং তারাও এর আলোকে আমল শুরু করবেনএকথা বিশ্বাস করতে কোনো সমস্যা নেই দাবী করে দলীল হিসেবে বলবেন, এটা উনার অভিজ্ঞতা। তবে যিনি মুহাক্বিক আবার অন্ধ ভক্ত নন, বরং শরীয়তের সীমার ভিতরে থেকে ভক্তি করেন, তিনি এ কথা মেনে নিবেন না। কেননা তিনি জানেন যে, এটা অভিজ্ঞতার বিষয় নয়। এখানে একটি বিশ্বাসকে অভিজ্ঞতার নাম দেয়া হয়েছে। ওহীর বাহিরে এমন কথা তিনি মেনে নিবেন না। তবে বিসমিল্লাহএর বরকত ওহী দ্বারা প্রমাণিত, তাই তিনি তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন এবং আমল করেন। 

আশা করি ধর্মীয় বিশ্বাস এবং অভিজ্ঞতার মাঝে পার্থক্য বুঝতে আর কোন উদাহরণের প্রয়োজন নেই। এবার পাঠক নিজেই বিভিন্ন খতমের ব্যাপারে ফায়সালা করুন। এই খতমে এই হয়, সেই খতমে সেই হয়, তা কি অভিজ্ঞতার বিষয়? না কি একটি ধর্মীয় বিশ্বাস? আপনি অন্ধ ভক্ত না হলে নিশ্চয় বলবেন, এটিতো ধর্মীয় বিশ্বাস ছাড়া কিছু নয়। এবার বলুন, ওহী ছাড়া আমরা এমন বিশ্বাস কেমনে পোষণ করতে পারি ও তার উপর কীভাবে আমল করতে পারি?

এবার একটি ঘটনা দেখুন: 

চট্টগ্রামের জনৈক ব্যক্তি লন্ডন বসবাস করেন। দেশে আসলেই তিনি সিলেট আসেন এবং শাহজালাল রাহ. এর মাজার যিয়ারত করেন। দেশে আসলে কোনোবারই নাকি তার এই সফর মিস হয় না। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ভাই আপনি কেন আসেন? এর প্রতি উত্তরে লোকটি বলল, “বাবা আঁরে লন্ডন ফাটাইয়ি ইতাল্লাই আঁই ফতিবার এডে আঁইঅর্থাৎ শাহজালাল বাবা আমাকে লন্ডন পাঠিয়েছেন, তাই আমি প্রত্যেকবার তথা দেশে আসলেই এখানে আসি।

লোকটির বিশ্বাস দেখুন। সে তার এ কথাগুলো অভিজ্ঞতার আলোকেই বলছে বলে তার নিজের মুখের কথা। কেননা সে এখানে এসেছে এবং লন্ডন যাবার জন্য দুআ করেছে এবং যেতে পেরেছে। একজন সহীহ আক্বীদা পোষণকারী হিসেবে আপনি লোকটির এই কথাগুলো কিভাবে নিবেন? আপনি সহীহ আক্বীদা পোষণকারী নিশ্চয় বলবেন, তার লন্ডন যাবার অনুমোদন প্রাপ্ত হওয়ার যাবতীয় জরুরী কাগজপত্র, ভিসা, পাসপোর্ট ইত্যাদি শর্ত মোতাবেক হয়েছে বলে অল্লাহর ইচ্ছায় সে যেতে পেরেছে। লন্ডন যাবার অনুমোদনের শর্তাদি পুরো না হলে একবার কেন শতবার মাজারে আসলেও সে যেতে পারত না। অপরদিকে কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মাজারে না এসেও লন্ডন যাচ্ছে।

কিন্তু এমন লোককে যদি আপনি বলেন: ভাই, এখানে শাহজালাল সাহেবের কী সম্পর্ক? আপনারতো লন্ডন যেতে পারা যাবতীয় শর্তাদি সঠিকভাবে পূরণ হওয়ার কারণে হয়েছে। সে বলবে, কাগজপত্র সবকিছু বাবার ওসিলায় ঠিক হয়েছে। আপনি তাকে কোনোভাবেই বুঝাতে পারবেন না। তার বদ্ধমূল ভ্রান্ত বিশ্বাসকে দূর করতে আর কিছু বললে সে আপনাকেই ভ্রান্ত ভাববেআপনাকে আল্লাহর ওলীদের দুশমন, আপনার মাঝে ওলীদের প্রতি শ্রদ্ধা নেই, আপনি একটি বেয়াদব আরো কত কিছু। 

এভাবেই অতিভক্তির মাধ্যমে মানুষ বিশ্বাসের ধোঁকায় নিপতিত হয়। অতিভক্তি তার বিশ্বাসকে এদিক থেকে ওদিকে নিয়ে যায়। বাস্তবতা থেকে অবাস্তবতার দিকে নিয়ে যায়, অথচ সে টেরই পায় না। আমাদের অবস্থা এমন হচ্ছে কি না তা নিয়ে ভেবে দেখা দরকার নয় কি? দ্বীনের জন্য একটু ভাবলে ক্ষতিই বা কী? বরং এতে আমার অনেক লাভ রয়েছে। ভাবার কারণে নিশ্চয় ছওয়াব পাব। তাই আমি সঠিক পথে রয়েছি মনে করলেও ভাবতে দুষের কী আছে?

এবার আমরা ইবনে তাইমিয়া রাহ. এর বক্তব্যটি উপস্থাপন করছি। তিনি লিখেন,

" ثم قد يكون سبب قضاء حاجة هؤلاء الداعين الدعاء المحرم؛ لشدة ضرورته لو دعا الله بها مشرك عند وثن لاستجيب له لصدق توجهه إلى الله تعالى ". ) المنهج القويم في اختصار اقتضاء الصراط المستقيم১-৯৬)
এরপর অনেক সময় এসব প্রার্থনাকারী যারা হারাম প্রার্থনা করে তার কঠিন প্রয়োজনের কারণে আল্লাহ তার প্রয়োজন পূর্ণ করেন, যদি কোনো মুশরিক একটি মুর্তির কাছে গিয়ে এই প্রয়োজনের প্রার্থনা করত তার প্রার্থনা ক্ববুল করা হত, কেননা (সে মুর্তির কাছে হলেও) তার পূর্ণ মনোযোগ আল্লাহর দিকে।” 
 
ইবনে তাইমিয়া রাহ. এখানে যে কথাটি বুঝাতে চেয়েছেন তা অত্যন্ত স্পষ্ট। প্রার্থনাকারী হারাম বস্তু কামনা করছে, আল্লাহ তার মনের আহাজারী, কাতর অবস্থা দেখে এমন প্রার্থনাও শুনছেন। তবে এই বস্তু পেয়ে যাওয়া তার কামনা জায়েয হওয়ার দলীল নয়। এভাবে মুর্তির কাছে গিয়েও সে যে প্রার্থনা করে, তার কান্নাকাটি, আহাজারী, মনের অবস্থার দিকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তার দুআ শুনেন। তবে দুআ কবুল করা মুর্তির কাছে যাওয়ার কারণে নয়, বরং তার মনের করুণ অবস্থার কারণে। কিন্তু প্রার্থনাকারী লোকটি তার বিশ্বাসকে মুর্তির দিকে নিয়ে গিয়ে ফিতনায় পতিত হয়। সে মনে করে মুর্তির কাছে এসে কিছু চাইলে পাওয়া যায়।

 তিনি আরো লিখেন:
ومن هنا يغلط كثير من الناس يبلغهم أن بعض الأعيان الصالحين عبد عبادة، أو دعا دعاء وجد أثره، فيجعل ذلك دليلا على استحباب تلك العبادة والدعاء، ويجعلون ذلك العمل سنة كأنه قد فعله نبي، وهذا غلط عظيم لما ذكرناه خصوصا إذا كان العمل إنما كان أثره بصدق قام في قلب فاعله حين الفعل ثم تفعله الأتباع صورة، فيضرون به.
এখান থেকেই অনেক মানুষ ভুলের মধ্যে পতিত হয়, যখন তাদের কাছে খবর পৌঁছে, কোনো নেক মানুষ একটি ইবাদত করেছেন, অথবা একটি দুআ করে তার ফল পেয়েছেন, অতঃপর এটিকে ঐ ইবাদত এবং দুআ মুস্তাহাব হওয়ার দলীল বানিয়ে দেয়া হয়, এবং তারা সেই আমলটিকে সুন্নাত বানিয়ে নেয়, যেন তা কোনো নবী করেছেন। আর এটা মারাত্বক ভুল যা আমরা উল্লেখ করেছি। বিশেষ করে যখন আমলটির ফল কর্মের সময় আমলকারীর মনের নিষ্ঠার কারণে ছিল, পরবর্তীতে অনুসারীরা শুধুমাত্র বাহ্যিক আমল হিসেবে তা করে থাকে, ফলে তারা এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”  

পাঠক, আশা করি ইবনে তাইমিয়া রাহ. এর বক্তব্য থেকে বিষয়টি আমাদের সামনে আরো স্পষ্ট হয়ে গেল যেকোনো বুযুর্গ নির্দিষ্ট কোনো দুআর আমলের মাধ্যমে কিছু পেলে আমরা তা সেই দুআর প্রতিফল ভাবতে পারি না। কেননা ওহী ছাড়া এমন কথা বলা যায় না। তবে নেক বুযুর্গ তিনি যে প্রতিফল পেয়েছেন এটা মূলত তাঁর মনের অবস্থার প্রতিফল। যে কোনো মুমিন মনের আবেগ নিয়ে সকাতরে আল্লাহর কাছে যে কেউ দুআ করুক না কেন আল্লাহ তাঁর প্রতিফল দেন বলে আমরা জানি। হাদীসে রয়েছে,
" مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَنْصِبُ وَجْهَهُ لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ فِي مَسْأَلَةٍ إِلَّا أَعْطَاهَا إِيَّاهُ إِمَّا أَنْ يُعَجِّلَهَا لَهُ وَإِمَّا أَنْ يَدَّخِرَهَا لَهُ ". (مسند احمد، حديث أبي هريرة، رقم:৯৭৮৫، الادب المفرد، الأذكار، باب ما يدخر الداعي من الاجر والثواب، رقم:৭১১)

যে মুমিনই কোনো কিছু চাওয়ার বেলায় নিজেকে আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণরুপে  সঁপে দেয়, আল্লাহ তাকে তাঁর বাসনা দিয়ে দেন। হয়ত দ্রুত (দুনিয়াতে) দিয়ে দেন, নতুবা তাঁর জন্য তা (আখিরাতে) সঞ্চয় করে করে রাখেন 

এমনকি সকাতরে কাফের ব্যক্তিও যখন আল্লাহর কাছে কিছু চায় আল্লাহ তার প্রতিফল দেন বলে কুরআনে তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন। 

আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বস্তু উপলব্ধি করার তওফিক দান করুন। শুধুমাত্র সুন্নাতের মধ্যেই সফলতা দেখার তওফিক দান করুন। আমীন। 

লেখকঃ পরিচালক ও প্রধান মুফতি, 
ইমাম আবু হানিফা রহ. ফতোওয়া ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, 
সিলেট।



শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here