Tuesday, April 21, 2020

বর্তমান সঙ্কটময় পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায়


 
।। মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম।।

বর্তমান বিশ্ব বিশাল এক সঙ্কটময় মুহূর্ত অতিক্রম করছে। ছোট-বড়, ধনী-গরিব, মুসলিম-অমুসলিম কেউ বাদ নেই। সকলেই মারাত্মক রকমের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। সাধারণ লোক তো দূরে থাক, রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরাও এই ঝুঁকি থেকে মুক্ত নেই। মানুষ সামাজিক জীব হওয়া সত্ত্বেও একে অন্যের থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে। এ যেন অন্য এক পৃথিবীতে আমাদের বিচরণ।

গোটা পৃথিবী যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁকে কেউ বলে স্রষ্টা, কেউ বলে গড, কেউ বলে রাম, আর আমরা মুসলিমরা বলি 'আল্লাহ্' বা 'রব'। যিনি রব তিনিই তো পালনকর্তা, তিনি দয়াময়, পরম করুণাময়। তাহলে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন জাতি-জনগোষ্ঠীর উপর কেন বিপদ নেমে আসে। এর প্রকৃত কারণ খোঁজলে কুরআন ও হাদীসের কী কী বক্তব্য পাওয়া যায়।

আসুন, তাহলে দেখা যাক কী কারণে আল্লাহ্ তা'লা আমাদেরকে বিপদে আপতিত করেন তথা বর্তমানের আমরা যে কঠিন সঙ্কটময় মুহূর্ত অতিক্রম করছি এর কারণ কী আর তা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী হতে পারে?

মানুষকে সতর্কীকরণঃ
মানুষ ভুলে যায় তার একজন স্রষ্টা আছেন। তাকে জবাবদিহি হতে হবে তার সকল কৃতকর্মের জন্য। সে ভুলে যায় পৃথিবীতে অন্যায়-অবিচার করলে পরকালীন জীবনে তাকে শাস্তি পেতে হবে। আল্লাহকে ভুলে গিয়ে মানুষ মানুষকে হত্যা করে, হত্যা করার পরিকল্পনা করে, সন্ত্রাসী করে, চাঁদাবাজি করে, রাহাজানি করে, অন্যের অধিকার হনন করে। 
এমতাবস্থায় মহান আল্লাহ্ তা'লা বিভিন্ন প্রকার বিপদ দিয়ে মানুষকে সতর্ক করেন যে, সাবধান হয়ে যাও, তোমাদের মধ্যে ত্রুটি আছে, শুধরে যাও, আল্লাহর পথে ফিরে এসো। আল্লাহ্ তা'লা বলেন-
﴿وَلَنُذيقَنَّهُم مِنَ العَذابِ الأَدنىٰ  دونَ العَذابِ الأَكبَرِ لَعَلَّهُم يَرجِعونَ
অর্থাৎ, “গুরু শাস্তির পূর্বে আমি অবশ্যই তাদেরকে লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে।” (সূরা সাজদাহ, আয়াতঃ ২১)

অবাধে অশ্লীলতার কারণে
ইসলামে শুধু ব্যভিচারকে নিষেধ করা হয় নি; বরং ব্যাভিচারের নিকটে নিয়ে যায় বা ব্যাভিচারের পথ খুলে দিতে পারে এ জাতীয় সকল কর্ম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে নগ্নতা আর অশ্লীলতা যেন একটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে। অথচ এর ভয়াবহতা অনেক কঠিন। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ্ তা'লা বলেন-
﴿قل إِنَّما حَرَّمَ رَبِّىَ الفَوٰحِشَ ما ظَهَرَ مِنها وَما بَطَنَ﴾
অর্থাৎ, “বল আমার প্রতিপালক নিষিদ্ধ করেছেন সকল প্রকার অশ্লীলতা। তা হোক প্রকাশ্য অথবা অপ্রকাশ্য।” (সূরা আরাফ, আয়াতঃ ৩৩) আল্লাহ্ তা'লা আরো বলেন-
﴿وَلا تَقرَبُوا الزِّنىٰ ۖ إِنَّهُ كانَ فٰحِشَةً وَساءَ سَبيلًا﴾
অর্থাৎ, “আর ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াতঃ ৩২) সবচেয়ে জঘন্যতম বর্বরতা হলো ধর্ম এবং বিভিন্ন দিবস উদযাপনের নামে নগ্নতা বা অশ্লীলতা। আল্লাহ্ তা'লা বলেন-
﴿وَإِذا فَعَلوا فٰحِشَةً قالوا وَجَدنا عَلَيها ءاباءَنا وَاللَّهُ أَمَرَنا بِها ۗ قُل إِنَّ اللَّهَ لا يَأمُرُ بِالفَحشاءِ ۖ أَتَقولونَ عَلَى اللَّهِ ما لا تَعلَمونَ﴾
অর্থাৎ, “তারা যখন কোন মন্দ কাজ করে, তখন বলে আমরা বাপ-দাদাকে এমনি করতে দেখেছি এবং আল্লাহও আমাদেরকে এ নির্দেশই দিয়েছেন। আল্লাহ মন্দকাজের আদেশ দেন না। এমন কথা আল্লাহর প্রতি কেন আরোপ কর, যা তোমরা জান না?” (সূরা আরাফ, আয়াত ২৮)

হারাম উপার্জন বা অবৈধ ভক্ষণঃ
হারাম উপার্জন থেকে ভক্ষণ করার পর মানুষের আত্মা পবিত্র থাকে না। কোন উপার্জন হারাম আর কোন উপার্জন হালাল তা এই স্বল্প পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। তবে এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে অবৈধ উপার্জনের দুটি ক্ষেত্র আমি উল্লেখ করছি-

(ক) সুদ: আমাদের সমাজে ব্যাপকহারে সুদের প্রচলন ঘটেছে। এনজিও থেকে শুরু করে ব্যাংক পর্যন্ত সব যায়গায় সুদের ছড়াছড়ি। অথচ আল্লাহ্ তা'লা বলেন-
﴿الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا فَمَنْ جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّهِ فَانْتَهَى فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ وَمَنْ عَادَ فَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ﴾
অর্থাৎ, “যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতে দন্ডায়মান হবে, যেভাবে দন্ডায়মান হয় ঐ ব্যক্তি, যাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলেছেঃ ক্রয়-বিক্রয় ও তো সুদ নেয়ারই মত! অথচ আল্লাহ তাআলা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা তার। তার ব্যাপার আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। আর যারা পুনরায় সুদ নেয়, তারাই দোযখে যাবে। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে।” (সূরা বাকারাহ, আয়াতঃ ২৭৫)
(খ) ঘুষ: অবৈধ উপার্জনের অন্যতম পদ্ধতি ঘুষ, হাদীসে এসেছে-
﴿حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ يُونُسَ حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي ذِئْبٍ عَنْ الْحَارِثِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ عَنْ أَبِي سَلَمَةَ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الرَّاشِي وَالْمُرْتَشِي﴾
অর্থাৎ, “রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘুষ গ্রহিতা এবং ঘুষদাতা উভয়কে লানত বাঅভিসম্পাত প্রদান করেছেন।” (সুনানু আবি দাউদ, খণ্ড-৯, হাদীস নং ৩১০৯)

পাপ মোচনের উদ্দেশেঃ
আল্লাহ্ তা'লা চান কোনো মুসলমান জাহান্নামে না যাক। আল্লাহ্ তা'লা মুসলিমদের জন্যই জান্নাত তৈরি করেছেন। এই জান্নাত আল্লাহ্ ফাঁকা রাখবেন না, মুসলিমদের দিয়েই তা ভরপুর করবেন। কিন্তু মুসলমানের আমলে ত্রুটি থাকে, ঈমানে ত্রুটি থাকে এবং বিভিন্ন ধরনের পাপ থাকে। সেই পাপ বা ত্রুটি জান্নাতে যাওয়ার জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তখন আল্লাহ্ তা'লা বিপদ-আপদ দিয়ে সেই পাপ মোচন করে দিয়ে জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম করে তোলেন। তাই বিপদ আসা মুসলিমদের জন্য অকল্যাণকর নয়; বরং কল্যাণকর। বিপদ দ্বারা আল্লাহ্ তা'লা মুসলিমদের পাপ মোচন করেন। হাদীসে এসেছে-
﴿حَدَّثَنِي عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مُحَمَّدٍ حَدَّثَنَا عَبْدُ الْمَلِكِ بْنُ عَمْرٍو حَدَّثَنَا زُهَيْرُ بْنُ مُحَمَّدٍ عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ عَمْرِو بْنِ حَلْحَلَةَ عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَا يُصِيبُ الْمُسْلِمَ مِنْ نَصَبٍ وَلَا وَصَبٍ وَلَا هَمٍّ وَلَا حُزْنٍ وَلَا أَذًى وَلَا غَمٍّ حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا إِلَّا كَفَّرَ اللَّهُ بِهَا مِنْ خَطَايَاهُ﴾
অর্থাৎ, “এমনকী একটা কাঁটা বিঁধলেও তার বিনিময়ে গোনাহ মোচন হয়।” (মুসলিম, হাদীস নং ৫২১০)

মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যেঃ
এবার এক শ্রেণির ভাই-বোন প্রশ্ন করবেন, বুঝলাম যারা আল্লাহকে ভুলে যায় এবং তাঁর রাসুলকে ভুলে যায় তাদের উপর বিপদ আসতে পারে। তাহলে সাধারণ মানুষ, নিরীহ নারী-পুরুষ, নিষ্পাপ শিশু-কিশোর এদের দোষ কী?

জ্বী, আপনার জন্য উত্তর হচ্ছে, আল্লাহ্ তা'লা তাঁর প্রেরিত নবী-রাসুলদেরকেও বিভিন্ন সময়ে বিপদে আপতিত করেছেন। এর অর্থ এই নয় যে, নবী-রাসুলগণও পাপ করেছেন। এ কথা শতসিদ্ধ যে, সকল নবী-রাসুলগণ সব ধরনের পাপ থেকে মুক্ত বা নিষ্পাপ। তাঁরা কেউই পাপের সাথে সম্পৃক্ত নন, তারপরও কেন তাদের উপর বিপদ দিলেন?

এর কারণ হলো মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় বান্দাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চান। সুতরাং কিয়ামত অবধি যারা নিষ্পাপ থাকা সত্ত্বেও বিপদে পড়বেন তাঁদের জন্য সুখবর যে, মহান রব চাচ্ছেন তাদের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি হোক। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
﴿حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ زَيْدٍ عَنْ عَاصِمِ بْنِ بَهْدَلَةَ عَنْ مُصْعَبِ بْنِ سَعْدٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَيُّ النَّاسِ أَشَدُّ بَلَاءً قَالَ الْأَنْبِيَاءُ ثُمَّ الْأَمْثَلُ فَالْأَمْثَلُ﴾
অর্থাৎ, সবচেয়ে কঠিন বিপদ এসে থাকে নবীগণের উপর, তারপর পর্যায়ক্রমে যে যত আল্লাহর নিকটতম তাঁর উপর সে হারে বিপদ এসে থাকে।” (সুনানু তিরমিযি, খণ্ড-৮, হাদীস নং ২৩২২)

এছাড়াও আরও অনেক জানা অজানা কারণ রয়েছে যার জন্য আল্লাহ্ তা'লা আমাদের উপর বিপদ আপতিত করে থাকেন কিন্তু আমরা নিজেদের অপকর্মের প্রতি উদাসীনতার দরুন অনুধাবন করতে পারি না।

আল্লাহ্ প্রদত্ত বিপদ  থেকে মুক্তির উপায়ঃ
উপরের বিষয়গুলো যথাযথ মেনে সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার, যুলুম-নির্যাতন, ঘুম, খুন, রাহাজানি, হত্যা, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, মানুষের অধিকার নষ্ট করা, এতিমের সম্পদ ভক্ষণ করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা জাতীয় কাজ থেকে বিরত থেকে একমাত্র সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করে তাঁর কাছে চাইলে সকল প্রকার বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
 
বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে হবে, অধৈর্য হলে চলবে না। মুমিন মাত্রই বিশ্বাসী। সকল প্রকার বৈরি পরিবেশে আমাদেরকে এটা বিশ্বাস রাখতে হবে যে, যা কিছু হচ্ছে বা হবে তা আল্লাহ্ তা'লার পক্ষ থেকেই হবে। আল্লাহ্ তা'লা আমাদের সবাইকে সকল ধরনের বিপদ থেকে মুক্ত রাখুন এবং আমাদেরকে পুনরায় স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ প্রদান করুন। আমীন।


লেখকঃ
মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম,
অনার্স, মাস্টার্স
আল-হাদীস বিভাগ,
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
মোবাইল: 01712-353643
ইমেইল: shofiq.islam.99@gmail.com


শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here