।। মাহফুজ আল মাদানী।।
কারো প্রয়োজনে এগিয়ে যাওয়া বা সাহায্য করার নামই সেবা। আর
সৃষ্টি বলতে মহান আল্লাহ তায়ালার সব সৃষ্টিকেই বোঝানো হয়েছে। অতএব সৃষ্টির সেবা
অর্থ সৃষ্টির প্রয়োজনে দয়া ও সাহায্য নিয়ে সহযোগিতা করা এবং এমন কাজ করা যা তাদের
উপকারে আসে। সৃষ্টির সেবা জগতের মধ্যে অন্যতম উত্তম বা পুণ্যময় কাজ। মানুষ মানুষের
সেবা বা সৃষ্টির সেবার মাধ্যমে-প্রিয় হতে পারে। যে সৃষ্টির সেবা করবে, আল্লাহ নিজেই তার করুণা
দ্বারা বান্দাকে আচ্ছাদন করে রাখবেন। এজন্য সৃষ্টির সেবা বান্দার জন্য অতীব
গুরুত্বপূর্ণ এবং মহৎ কাজ।
আর সৃষ্টির প্রতি দয়া বা অনুগ্রহের মাধ্যমে বান্দা
আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ প্রাপ্ত হয়। অন্যের প্রতি দয়া করা ছাড়া দয়া পাওয়া যায় না।
হাদিস শরিফে এসেছে, ‘হজরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) হতে
বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
এরশাদ করেছেন, আল্লাহ সে ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ করেন না,
যে মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করে না’।-বোখারি-৬০১৩,
মুসলিম-৬৫, আবু দাউদ-৫২১৮, আহমদ-১০৬৭৩, মিশকাতুল মাসাবিহ-৪৯৪৭)।
মহিয়ান আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টিরাজিকে অতি যত্ন, আদর আর মমতা দিয়ে
লালন-পালন করেন। তার মাখলুকাতের কেউই তার অনুগ্রহের বাইরে নয়। এই সৃষ্টিরাজি তার
পরিবারতুল্য। তাই যদি কেউ তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি অনুগ্রহ বা দয়া প্রদর্শন
এবং কল্যাণে এগিয়ে আসে আল্লাহ তার প্রতি খুশি হন, রাজি হন।
হাদিস শরিফে এসেছে, ‘সৃষ্টি আল্লাহর পরিবারের সমতুল্য। অতএব
আল্লাহর নিকট সে অধিক প্রিয় যে তার পরিবারের প্রতি উত্তম আচরণকারী’ (মিশকাতুল মাসাবিহ-৪৯৯৮, আল বিররু ওয়াস সিলাহ লিল
ইবনুল জাওযি-৪২৪)।
সৃষ্টির সেবার গুরুত্ব অপরিসীম। বান্দা তার অন্য ভাইয়ের
সাহায্যে এগিয়ে এলে আল্লাহ তার সাহায্য ইহ ও পরকালে করে থাকেন। বান্দা তার ভাইয়ের
কষ্ট, বিপদ
মুহূর্তে সহযোগিতা করলে আল্লাহ তার কষ্ট বিপদে সহযোগিতা করেন। হাদিসে তার বর্ণনা
হয়েছে এভাবে, ‘হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি পার্থিব জগতে কোনো মুমিনের দুনিয়ার বিপদসমূহ থেকে একটি বিপদ
দূর করবে, আল্লাহ তায়ালা তার কিয়ামত দিবসের কষ্টসমূহ হতে একটি
কষ্ট দূর করে দেবেন।
যে ব্যক্তি কোনো অভাবীর একটি অভাব সহজ করে দেবে, আল্লাহ তায়ালা ইহ ও পরকালে তার সব অভাব সহজ করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো
মুসলমানকে (তার দোষ-ত্রুটি বা দেহকে) ঢেকে রাখবে, আল্লাহ তায়ালা
দুনিয়া ও আখিরাতে তাকে (তার দোষ-ত্রুটি বা দেহকে) ঢেকে রাখবেন। আর আল্লাহ বান্দার
সাহায্যে ততক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে
থাকে’-(মুসলিম)। তাই কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো মানুষের সেবায়
এগিয়ে এলে আল্লাহ তায়ালা তাকে সহযোগিতা করবেন। অন্ততপক্ষে নিজের কথা বিবেচনা করে
মানবতার কল্যাণে এগিয়ে আসা আমাদের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য।
শুধু মানবজাতি নয়, আল্লাহর সৃষ্টির যেকোনো সৃষ্টির প্রতি দয়া,
মায়া ও দরদ দেখালে আল্লাহ তায়ালার কাছে তার প্রতিদান মিলবে। মিলবে
জান্নাত। সৃষ্টির সেবার মাধ্যমে জান্নাত লাভ সহজতর হয়ে ওঠে। এজন্য আমাদেরকে
সৃষ্টির সেবায় মনোনিবেশ করা উচিত। আল্লাহর সৃষ্টি একটি কুকুরকে পানি পান করানোর জন্য
এক ব্যক্তি আল্লাহর ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়। যা, যেকোনো বান্দার
জন্য পরম সৌভাগ্যের।
হাদিসের ভাষ্যমতে, ‘হজরত আবু হুরায়রা
(রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম এরশাদ করেছেন, একদা এক ব্যক্তি পথ চলতে চলতে তার
ভীষণ পিপাসা লাগল। সে একটি কূপ দেখতে পেয়ে তাতে নামল এবং পানি পান করে উঠে এলো।
তখন সে দেখল যে, একটি কুকুর পিপাসার্ত হয়ে হাঁপাচ্ছে এবং
ভিজা মাটি চাটছে। লোকটি মনে মনে বলল, আমি যেমন পিপাসার্ত
হয়েছিলাম, কুকুরটিরও তদ্রুপ পিপাসা লেগেছে। সে পুনরায় কূপে
নামল এবং তার মোজা ভর্তি করে পানি তুলে তা নিজের দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে ওপরে এলো এবং
কুকুরটিকে তা পান করালো। আল্লাহ তার এই কাজ কবুল করলেন এবং তাকে ক্ষমা করে দিলেন।
সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাহ! পশুর জন্যও কি আমাদেরকে সওয়াব দেওয়া হবে? তিনি
বললেন, প্রতিটি প্রাণধারী সৃষ্টির সেবার জন্য সওয়াব রয়েছে’-(বোখারি, মুসলিম, আবু দাউদ,
ইবনে মাজাহ, আহমদ, ইবনে
হিব্বান)।
আমরা যদি আমাদের সমাজের অনাথ, মিসকিন, এতিম,
অসহায়, নিরীহ, দুস্থজনের
পাশে দাঁড়াই তাহলে এটা আমাদের ইহ ও পরকালের জন্য কল্যাণকর হবে। বিশেষ করে
বর্তমান করোনার মহামারীর এ দুর্যোগের সময় অসহায়, সম্বলহীনদের পাশে দাঁড়ানো বর্তমান সময়ে আমাদের সকলের জন্য অতীব জরুরি। তাদের
দুঃখের সময়ে আমাদের সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করার মাধ্যমে আল্লাহর প্রিয় হতে
পারি। তার মাধ্যমে আমরা যখন কোনো বিপদের সম্মুখীন হব, তখন
আমাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো মানুষ থাকবে।
আসুন আমরা সব মানুষের সেবা করি, সৃষ্টির সেবা করি। আমাদের সমাজ হবে বসবাস উপযোগী আদর্শ সমাজ।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
0 coment rios:
You can comment here