Monday, May 11, 2020

আমার দেখা বিদগ্ধ আলোচক ও বহুগ্রন্থ প্রণেতা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)

 
।। ইমদাদুল হক যুবায়ের।।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া এর ঐতিহ্যবাহী, স্বনামধন্য বিভাগ আল-হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ।  আমি ২০০৫-২০০৬ শিক্ষা বর্ষে এ বিভাগে অনার্সে ভর্তি হই। ভর্তি হয়েই অনার্সের উদ্বোধনী ক্লাসে নূরানী চেহারার অধিকারী আমার প্রিয় স্যার ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) এর বক্তব্য শুনার সুযোগ হয়েছিল। সেদিন তিনি তাঁর বক্তব্যে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে সহীহ নিয়্যত এর গুরুত্বের উপর কথা বলেছিলেন। আজো মনে আছে তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্যের সারকথাগুলো। ২০১২ সালের মে মাস পর্যন্ত সরাসরি তার একজন গর্বিত ছাত্র হওয়ার সুযোগ লাভে নিজেক ধন্য করেছিলাম। আল হামদুলিল্লাহ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকেই স্যার এর খুব কাছে যাওয়ার আমার সুযোগ হয়। আমার ডিপার্টমেন্ট এর সিনিয়র এক ভাই আমাকে স্যার সম্পর্কে জ্ঞান দিলেন এবং ঝিনাইদহ তাঁর নিজ বাসায় গিয়ে স্যারের বই লেখালেখি তথা গবেষণার কাজে আমাকে অংশগ্রহণের অফার করলেন। আমি সুযোগটা হাত ছাড়া করিনি। এই সুযোগে স্যারের বাসায় দিন-রাত অবস্থান করে সেখানে স্যারের সাথে স্যারের বই প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে অনেক কাজ করেছি। অনেক কিছু শিখেছি। অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। সুদীর্ঘ ছয়-সাত বছর লেখালেখির সুযোগে স্যারের একজন সহযোগি হিসেবে খুব কাছে থেকে আমি যতটুকু স্যারকে দেখেছি, জেনেছি, শিখেছি আলহামদুলিল্লাহ এটা আজ বিশাল নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে আসার পরও স্যারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সবই আজ শুধু ইতিহাস সবকিছুই শুধই স্মৃতি।  

আমরা স্যারের উৎসাহে কিছু দিন ২০০৫-২০০৬ শিক্ষা বর্ষের কয়েকজন বন্ধু মিলে স্যারের ঝিনাইদহ বাসায় ব্যক্তিগতভাবে সপ্তাহে কয়েকদিন গিয়ে স্যারের বিশাল লাইব্রেরীতে বসে বুখারী দারস পড়েছি। স্যার এতই আগ্রহী ছিলেন যে, হাজারো ব্যস্ততার মধ্যে স্যার আমাদেরকে সময় দিয়ে ধন্য করেছিলেন। 

স্যার আমাকে অনেক কাজ দিতেন। আমি কাজ করে যখন স্যার এর কাছে নিয়ে যেতাম তখন স্যার উৎসাহ পূর্ণ কয়েকটি কথা বেশি বলতেন। মাশাআল্লাহ, বারাকাল্লাহ, আর বেশি আরেকটা কথা বলতেন, আল্লাহ ভরসা। যেকোনো কাজেই তিনি বলতেন, “তুমি তো অনেক সুন্দর করেছ, অনেক ভালো করেছ, তাড়াহুড়া করার দরকার নাই, আস্তে আস্তে কর।” এসব শব্দ বলার পর আমার কাজের তথা লেখালেখি করার মধ্যে স্প্রীট বেড়ে যেত। ঘন্টার ঘন্টার পর ঘন্টা কম্পিউটারে বসে কোনো ক্লান্তিই অনুভব করতাম না।  আল্লাহ তাকে এর উত্তর জাজা দান করুন।

স্যার সম্পর্কে লিখতে হলে একটা যোগ্যতার প্রয়োজন। এতো বড় একজন মহান ব্যক্তি সম্পর্কে লেখা বিশেষ করে নিজ চোখে দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা কঠিন একটি বিষয়। কারণ আবেগ সেটা করতে দেবেনা। লিখতে গিলে চোখের পানি ছল ছল করে। বাকরূদ্ধ হয়ে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

আমাদের একাডেমিক ক্লাসের শেষের দিকে স্যার আমাদেরকে উম্মুক্ত প্রশ্ন করার সুযোগ দিতেন। টিভিতে মানুষ অনেক প্রশ্ন চাইলেও করতে পারে না। আমরা ইচ্ছামতো বহুবিধ প্রশ্ন করতাম। আমাদের বন্ধুরা ইসলাম, দেশীয় আন্তর্জাতিক সব বিষয়ে প্রশ্ন করতো। স্যার সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন। যেন জ্ঞানের এক মহাসাগর ছিলেন। কোনো দিন এমন হয়নি যে, স্যার কোনো বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমাদের বলেছেন যে, “বিষয়টি জটিল, দেখে বলতে হবে, বা আমার খিয়াল নেই। এ রকম কোনো শব্দ তাঁর কাছ থেকে কখনো শুনতে হয়নি।

মজার বিষয় হলো আলিম হয়েও তিনি ইংরেজি বিষয়ে ছিলেন মহা পণ্ডিত। আমাদের একটি কোর্স ছিল Translation of Hadith in to English এ বিষয়ে যখন তিনি পড়াতেন তখন ভেবে অবাক হতাম যে, একজন হুজুর আবার ইংরেজিতে এতো পারদর্শী কীভাবে হতে পারেন। মাদরাসা পড়ুয়া মানে ইংরেজিতে দুর্বল এ বিষয়টির ধারণা তাঁকে দেখেই দুর হয়েছিল। বিশেষ করে ইংরেজি গ্রামার এর বিষয়গুলো চমৎকারভাবে তিনি উপস্থাপন করতেন।


স্যারের সব চেয়ে দেখার মত যে বিষয়টি ছিল সেটা হলো হাস্যজ্বল চেহারা। আমরা কখনো স্যারের চেহারায় কোনোদিন চিন্তা ও কষ্টের ভাব দেখতে পাইনি। যে কোনো বিষয়ের সমাধান সাথে সাথেই দিতেন। একদিন মোবাইলে কথা বলতে বলতে ক্লাসে প্রবেশ করছেন। দেখলাম যে, একজনের সাথে কথা বলছেন। এবং তালাক্ব বিষয়ে। মোবাইলে কথা বলা শেষ করে বললেন, তালাকের একটি মাসআলা একজন জিজ্ঞাস করছিলো। এ বিষয়ে বলতেছিলাম। সে দিন তাঁর ইলম এর গভীরতা আমাকে অভিভুত করেছিল। ইসলামের কী স্পর্শকাতর বিষয়ে তিনি যখন তখন সমাধান দিতে সক্ষম ছিলেন।

স্যার বই লেখালেখিতে খুব ব্যস্ত থাকতেন। টিভি আলোচনায়ও তিনি থাকতেন মশগুল। কিন্তু তাঁর ক্লাস শিডিউলে কোনো সমস্যা হতো না। সব শিডিউল এর মধ্যে সবগুলো ক্লাস তিনি ক্লাসের হক আদায় করে গ্রহণ করতেন। ব্যস্ততার কারণে একাডেমিক পড়াশোনায় কোনো বিরূপ প্রভাব পড়তে দেখিনি। ডিপার্টমেন্টের সবাই এটা স্বীকার করতো যে আর যাই হোক আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যার এর ক্লাস মিস হবে না এবং মিস করবোনা। তার ক্লাস করার জন্য সবাই উদগ্রীব থাকতো।


বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই আলেমে দ্বীন ১৯৫৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তাঁর মায়ের নানাবাড়ি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা থানার অন্তর্গত দ্বিগনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঝিনাইদহ শহরের ‘ভুটিয়ারগাতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেন। তারপর ঝিনাইদহ ‘সিদ্দিকীয়া আলিয়া মাদরাসায়’ ফাযিল পর্যন্ত অধ্যয়ন করে ১৯৭৯ সালে ঢাকা আলিয়া থেকে প্রথম শ্রেণিতে অষ্টম স্থান অধিকার করে হাদীস বিষয়ে কামিল পাশ করেন। মাদরাসায় অধ্যয়নের পাশাপাশি তিনি মাগুরা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজ থেকে এস.এস.সিএইচ.এস.সি পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সাথে যশোর বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এ সময় বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ডে যারা প্রথম স্থান অধিকার করেছিলোতৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় সম্মাননার অংশ হিসেবে তাদেরকে নিয়ে নৌ ভ্রমণে বের হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে যশোর শিক্ষাবোর্ডের প্রথম স্থান অধিকারি হিসেবে মরহুম ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরও ছিলেন।

কামিল পড়ার পর ঝিনাইদহ সদরের নাসনা ‘নূরনগর সিদ্দিকীয়া দাখিল মাদরাসায়’ প্রায় দুই বছর শিক্ষকতা করেন। অতঃপর তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য সৌদি সরকারের বৃত্তি নিয়ে ১৯৮১ সালে সৌদি আরবের রিয়াদস্থ ‘জামিয়াতুল ইমাম মুহাম্মাদ বিন সাউদ আল ইসলামী’ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৮৬ সালে অনার্স১৯৯২ সালে মাস্টার্স ও ১৯৯৮ সালে নাহব (আরবী ব্যাকরণ)-এর ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

উল্লেখ্য  যেসেখানে তিনি চূড়ান্ত পরীক্ষায় ৯৬% নাম্বার পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং সেখানে অধ্যয়নকালে বর্তমান সৌদি বাদশা ও তৎকালীন রিয়াদের গভর্নর সালমান বিন আব্দুল আজীজের হাত থেকে পর পর দুবার সেরা ছাত্রের পুরস্কার গ্রহণ করেন। সৌদি আরবে যে সকল শায়েখের কাছে তিনি হাদীস ও ফিকহ্ শিখেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেনশায়েখ আব্দুল আযীয বিন বায রাহ.শায়েখ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান আল-জিবরীনমুহাম্মাদ ইবন সালিহ ইবনে মুহাম্মাদ আলউছাইমীন রাহ.শায়েখ সালেহ ইবন ফাওযান  প্রমুখ।

এছাড়াও তিনি আরবের হানাফী আলেমদের মধ্যে শায়েখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.-কে অত্যন্ত পছন্দ করতেন এবং তাঁর রচনাসমূহ প্রচুর পরিমাণে অধ্যয়ন করতেন। উপমহাদেশের আলেমগণের মধ্যে শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানী দা.বা. ও তাঁর মানহাজকে খুব পছন্দ করতেন এবং বিভিন্ন ইলমী বিষয়ে তাঁর বক্তব্যকে উদ্ধৃতি হিসেবে পেশ করতেন। তিনি ইবনে তাইমিয়া রাহ.ইবনুল কায়্যিম রাহ.শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রাহ. ও আব্দুল হাই লখনবী রাহ.-এর রচনাসমূহ ও চিন্তা-চেতনা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন এবং তাখাসসুসের ছাত্রদের বিভিন্ন দরসে তাদের আলোচনা করতেন। তবে ফিক্হ বিষয়ে আদর্শ হিসেবে শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহ.-এর অনুসরণ করতেন।

রিয়াদে অধ্যয়নকালের শেষ সময়ে তিনি উত্তর রিয়াদ ইসলামি সেন্টারে দাঈ ও সৌদি আরবে বসবাসকারী মার্কিন সৈন্য ও ইংরেজি ভাষাভাষীদের মাঝে দাওয়াতী কাজে দোভাষী হিসেবে প্রায় তিন বছর কর্মরত ছিলেন। এছাড়াও তিনি রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে অনুবাদক হিসেবে কাজ করেছিলেন। মাস্টার্সে পড়াকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কুরআনুল কারিমের ১৮ পারা মুখস্ত করা নির্ধারিত ছিল। তিনি উক্ত ১৮ পারা মুখস্ত করেন। তারপর বাকি পারাগুলো বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও এ্যাম্বেসীতে যাওয়া-আসার পথে গাড়িতে বসেই প্রায় চল্লিশ বছর বয়সে হিফজ সম্পন্ন করেন এবং দেশে এসে পুরোপুরি ইয়াদ করেন।

তিনি রিয়াদে থাকাকালীন নিজ পরিমণ্ডলে সুপরিচিত ছিলেন। কারণ তিনি কুল্লিয়াতুল লোগার মুমতাজ ছিলেন। কোনো সৌদি ‘কুল্লিয়াতুল লোগা আলআরাবিয়ায়’ মুমতাজ হওয়া খুবই বিরল। বাংলাদেশী ছাত্রদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম সৌদি আরব থেকে পিএইচ ডি করেছিলেন। উল্লেখ্যতিনি আরবীবাংলা এবং ইংরেজিতে সমান পারদর্শী ছিলেনযা তাঁর লেখনী ও বক্তৃতায়বিশেষতঃ মিশনারী অপতৎপরতা বিষয়ক দাওয়াতী কাজে অত্যন্ত সহায়ক হয়েছে।

১৯৯৮ সালে  দেশে এসে তিনি প্রথমে ‘দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ে’ কয়েক মাস শিক্ষকতা করেন। তারপর কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ‘লেকচারার’ হিসেবে  যোগদান করেন। ১৯৯৯ সালে ‘সহকারী অধ্যাপক’, ২০০৪ সালে ‘সহযোগী অধ্যাপক’ ও ২০০৯ সালে তিনি ‘অধ্যাপক’ পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আল ফিক্হ বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি পাবনা জেলার পাকশীতে অবস্থিত ফুরফুরা দরবারের ‘জামিআতুল কুরআনিল কারীম’ মাদরাসা ও ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত ‘দারুস সালাম’ মাদরাসায় শায়খুল হাদীস হিসেবে সহীহ বুখারীর দরস দিতেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত তাখাসসুস বিভাগদ্বয়েও নিয়মিত দরস দিতেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি একজন সফল শিক্ষক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও যেসকল প্রতিষ্ঠানে তিনি পড়িয়েছেন সেখানকার ছাত্র-সহকর্মীদের আবেগ-অনুভূতি ও অভিব্যক্তি প্রকাশের মধ্য দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এছাড়াও ২০০৩ সাল থেকে তিনি ঝিনাইদহ জেলার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতীব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ২০/০১/২০১১ খ্রিস্টাব্দে সমাজসেবা ও দ্বীনের বহুমুখী কাজ যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্য ‘আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে তাঁর রেখে যাওয়া সকল দ্বীনী কাজ উক্ত প্রতিষ্ঠানের অধীনে সূচারুরূপে পরিচালিত হচ্ছে।

তিনি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার আহ্বানে দ্বীনী দাওয়াতের উদ্দেশ্যে ইন্দোনেশিয়াসংযুক্ত আরব-আমিরাতলিবিয়া ও তুরস্কসহ বিশ্বের অনেক  দেশে সফর করেছেন। বহুবার তিনি হজ্ব পালন করেছেন।

তিনি সর্বদা মানুষকে দ্বীনমুখী করার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন।  এজন্য তিনি এলাকার মুসলামানদের দ্বীনী শিক্ষাকে সহজ করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দ্বীন-শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেন। এক্ষেত্রে তিনি ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্যই পৃথকভাবে পর্দার সাথে কুরআন হিফ্জ করা ও অন্যান্য দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করেন। এছাড়াও সাধারণ শিক্ষিত মানুষদের দ্বীনী জ্ঞান লাভ সহজ করার লক্ষ্যে বাংলাভাষায় ধর্মীয় বই-পুস্তক রচনা করেছেন। তাঁর মধ্যে একটি ফিকির ছিলো সমাজের মানুষের পরিবর্তন দরকারমহিলাদের পরিবর্তন দরকার। তাদেরকে খারাপ পরিবেশ থেকে বাঁচিয়ে ভালো কাজে সম্পৃক্ত করা দরকার। এজন্য এলাকাবাসীদের নিয়ে তাঁর মসজিদে নিয়মিত মাসিক মাহফিলের পাশাপাশি বার্ষিক মাহফিলের আয়োজন করতেন। এলাকার অন্যান্য মসজিদেও মাসিক মাহফিল আয়োজনের চেষ্টা করেছেন এবং তিনি নিজে বা তাঁর প্রতিনিধি পাঠিয়ে মাহফিলগুলোর মাধ্যমে মানুষের মাঝে দ্বীনী সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করতেন। বাংলাদেশে ধর্মান্তকরণ ফেতনা ও খ্রিস্টান মিশনারীদের অপতৎপরতার প্রতিরোধে তিনি অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। ওয়াজ-মাহফিল ও বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে তিনি তাদের সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করার প্রয়াস পেয়েছেন। এছাড়াও স্থানীয় আলেম ও ইমামগণকে নিয়ে ইলমী ইজতিমার আয়োজন করেন। 

ঝিনাইদহ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কওমী ও আলিয়া ধারার ছাত্রদেরকে যোগ্য আলেম হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৪৩৩ হিজরীতে ‘উচ্চতর হাদীস গবেষণা বিভাগ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও মুসলিম-অমুসলিম সকলের মাঝে দাওয়াতী কাজের যোগ্য লোক তৈরি করাখ্রিস্টান মিশনারীদের অপতৎপরতা ও অপপ্রচার প্রতিরোধে যোগ্য দাঈ তৈরি করা এবং সাধারণ মুসলিমদেরকে এ বিষয়ে সচেতন করার লক্ষ্যে ১৪৩৪ হিজরীতে ‘উচ্চতর দাওয়াহ ও তুলনামূলক ধর্মবিজ্ঞান বিভাগ’ প্রতিষ্ঠা করেন।

আল ফারুক একাডেমী’ নামে আলিয়া মাদরাসার আদলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠান ও একটি হিফ্জ খানা চালু ছিলো। এই প্রতিষ্ঠানের শিশু ও কেজি শ্রেণিতে বিভিন্ন কিন্ডার গার্টেনের জন্য রচিত অপেক্ষাকৃত ভালো বই পড়ানো হতো। ইতঃপূর্বে প্রতিষ্ঠানটি দাখিল বা দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছিলো এবং আলিয়া ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের দ্বারা পাঠদান করানো হতো।

এছাড়াও এলাকার শিশুদের দ্বীনের মৌলিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যে প্রাইমারী শিক্ষার ক্ষেত্রে কিন্ডার গার্টেন বাদ দিয়ে জানুয়ারী ২০১৫ থেকে যোগ্য শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে হাটহাজারী নূরানী বোর্ডের অধীনে চার বছর মেয়াদী আবাসিক-অনাবাসিক নূরানী মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। নূরানী মক্তবে বর্তমানে প্রায় আড়াইশ ছাত্র-ছাত্রী দ্বীনী শিক্ষা লাভ করছে। এছাড়াও তিনি ঝিানাইদহ জেলার হরিশঙ্করপুর ইউনিয়নের ভোজঘাট গ্রামে ও চুয়াডাঙ্গা জেলার পদ্মবিলা ইউনিয়নের সুবদিয়া গ্রামে ‘মারকাযুস সুন্নাহ’ নামে দুটি নূরানী মক্তব পরিচালনা করতেন।

ঝিনাইদহ এলাকায় ইসলামী জ্ঞানে অভিজ্ঞ এবং তাকওয়াআখলাকআদব ও সমাজ সচেতন নারী তৈরি করার লক্ষ্যে ১৪৩৫ হিজরীতে পর্যায়ক্রমে সম্পূর্ণ পৃথক ব্যবস্থাপনায় বালিকা হিফজ বিভাগ ও কিতাব বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন।

তিনি ছোট-বড় ত্রিশের অধিক অনুবাদব্যাখ্যা ও গবেষণামূলক মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর মৌলিক গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ইহইয়াউস সুনান’, ‘রাহে বেলায়াত’, ‘খুতবাতুল ইসলাম’ এবং সর্বশেষ অনবদ্য রচনা ‘পবিত্র বাইবেল : পরিচিতি ও পর্যালোচনা’; যেটি ছাপানোর কাজে ঢাকায় যাওয়ার পথেই তিনি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ইন্তেকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)

তিনি তাঁর রচনাসমূহে যে কোনো বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মৌলিক ও প্রাচীন গ্রন্থসমূহের ওপর নির্ভর করতেন। সালাফী দাওয়াত দ্বারা প্রভাবিত অনেক যুবকের মাঝে তাঁর বইপত্রগুলো বেশ সমাদৃত হচ্ছে। আমরা মনে করিতাদের  উচিত মরহুমের জীবনের শেষের দিকের গৃহীত চিন্তাধারা ও কর্মপন্থাকে গুরুত্ব দেওয়া। 

প্রতি ইংরেজি মাসের প্রথম শুক্রবার আস-সুন্নাহ জামে মসজিদে মাসিক মাহফিলের আয়োজন করতেন। উক্ত মাহফিলে তিনি নিজেই মাগরিব থেকে এশা পর্যন্ত আলোচনা করতেন এবং এশার নামাযের পর মানুষের বিভিন্ন  প্রশ্নের উত্তর দিতেন। উক্ত মসজিদের নীচ তলায় মাহফিলের আয়োজন করা হতো আর দ্বিতীয় তলায় মহিলাদের জন্য পৃথকভাবে বসে ওয়াজ শোনার ব্যবস্থা থাকত। মহিলাদের মাঝে দ্বীনী চেতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে তাঁর নেয়া প্রথম পদক্ষেপ ছিলো পরিপূর্ণ পর্দার সাথে মহিলাদের ওয়াজ শোনার ব্যবস্থা করা। পর্দা রক্ষার্থে মহিলাদের আসা-যাওয়ার রাস্তাও পৃথক ছিলো। তিনি সাধারণত মহিলাদেরকে ওয়াক্তিয়া নামায মসজিদে না এসে ঘরে আদায় করার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। কিন্তু বাজারস্টেশন বা জনসমাগমপূর্ণ রাস্তার পার্শ্ববর্তী মসজিদসমূহে মহিলাদের পৃথকভাবে নামাযের ব্যবস্থা রাখার ব্যাপারে গুরুত্ব দিতেনযেন মহিলাদের নামায কাযা না হয়ে যায়। তবে জুমার বয়ান শোনার উদ্দেশ্যে কেবল শুক্রবারে মহিলাদেরকে তাঁর মসজিদে আসার কথা বলতেন। (যদিও উক্ত বিষয়ে আলিমদের দলিলভিত্তিক ভিন্নমত রয়েছে।)

ঝিনাইদহ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক খালেছ দ্বীনী প্রতিষ্ঠান না থাকার কারণে এলাকার অনেক মসজিদে অশুদ্ধ তিলাওয়াত ও ধর্মীয় জ্ঞানশূন্যতা ব্যাপক। তাই তিনি ঝিনাইদহ জেলার সকল থানার বিভিন্ন মসজিদের ইমাম ও মুয়াযযিনদের নিয়ে নিজ প্রতিষ্ঠানস্থ মসজিদে প্রায় মাসেই ‘ইলমী ইজতিমা’-এর আয়োজন করতেন। এখানে নির্দিষ্ট দিন আসরের পর থেকে পরবর্তী দিন সকাল আটটা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ও প্রশিক্ষণকুরআন মশকপ্রশ্নোত্তর পর্ব ও ইমামগণের প্রশিক্ষণমূলক আলোচনার মাধ্যমে মজলিসটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠতো। 
উল্লেখ্যপ্রতি ‘ইলমী ইজতিমায় একটি বই নির্ধারণ করে দেয়া হতো যে বইটি পাঠ করার পর পরবর্তী ‘ইলমী ইজতিমায় সে বিষয়ক পর্যালোচনা ও পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে ইমাম ও মুয়াযযিনগণের ইলমী জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াস চালানো হতো। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী সকলকে পুরস্কৃত করা হতো এবং প্রথমদ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীগণকে আকর্ষণীয় পুরস্কার প্রদান করা হতো। উক্ত অনুষ্ঠানে তিনি নিজে পর্যাপ্ত সময় দেয়ার পাশাপাশি তাঁর প্রতিষ্ঠানের যোগ্য উলামায়ে কেরামগণ দ্বারা বিষয়ভিত্তিক আলোচনার ব্যবস্থা করতেন।

তিনি সর্বদা দেশ ও মুসলিম উম্মাহকে নিয়ে ভাবতেন। মুসলিম উম্মাহর প্রতি তাঁর যে দরদ আমি দেখেছিসেটি তাঁর কাছের লোকদের কাছে অস্পষ্ট ছিলো না। বর্তমানে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মুসলিমকে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকগণ কুরআন সুন্নাহ্ বিকৃতি ও অপব্যাখ্যার মাধ্যমে ঈসায়ী মুসলিম বা ঈসায়ী তরীকার মুরিদ হওয়ার নামে ধর্মান্তরিত করছে। এ সকল অপপ্রচারের প্রতিরোধ ও বিভ্রান্ত জনগোষ্ঠীকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করার জন্য  তিনি ছোট-বড় একাধিক মৌলিক গ্রন্থ লিখেছেন: 

(ক) ‘ইযহারুল হক (গুরুত্বপূর্ণ টীকাসহ অনূদিত ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত)। 

(খ) ‘কিতাবুল মোকাদ্দসইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম তাতে খ্রিস্টধর্ম অনুসারীদের পক্ষ থেকে ইসলাম ও মুসলিমদের ওপর আরোপিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর ও খ্রিস্টধর্মের অসারতা তাদের ধর্মগ্রন্থের আলোকে প্রমাণ করেছেন। 

(গ) ‘পবিত্র বাইবেল: পরিচিতি ও পর্যালোচনা এটি বাইবেলের প্রকৃত ইতিহাসউৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে একটি মৌলিক গ্রন্থ। বইটিতে তিনি বাইবেলের অসারতা প্রমাণে ইহুদী-খ্রিস্টান বা পাশ্চাত্য বাইবেল গবেষক ও সমালোচকদের মতামত মূল ইংরেজি উদ্ধৃতিসহ উল্লেখ করেছেন। 

খ্রিস্টান মিশনারীদের অপতৎপরতা প্রতিরোধে একদল অভিজ্ঞ লোক তৈরির জন্য ‘উচ্চতর দাওয়াহ ও তুলনামূলক ধর্মবিজ্ঞান বিভাগ’ চালু করেছেন। উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে ঝিনাইদহ ও পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহের মিশনারী কার্যক্রম কবলিত এলাকাগুলোতে দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল ও ব্যক্তিগত আলোচনায় মিশনারীদের অপতৎপরতা ও বিভ্রান্তির বিষয়ে তথ্যভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে উলামায়ে কেরাম ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করতেন। এ বিষয়ে যে কোনো কাজে  দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে কেউ আহ্বান করলে নিজের কাজ মনে করে তাতে তিনি শরীক হওয়ার চেষ্টা করতেন। 

মরহুম আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহ. বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ইসলামী অনুষ্ঠানে ‘আলোচক’ হিসেবে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। জাতি ও সমাজ-গঠণমূলক অনুষ্ঠানের তুলনায় টিভি চ্যানেলগুলো যেহেতু অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার প্রচার-প্রসারে বেশি ব্যবহৃত হয় তাই এ বিষয়ে তিনি অত্যন্ত সজাগ ছিলেনযেন ইসলামী অনুষ্ঠান দেখার নামে কেউ অশ্লীলতার কবলে পড়ে না যায়। এজন্য তিনি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ও মাহফিলে তাঁর রচিত ধর্মীয় গ্রন্থগুলো পড়তে মানুষকে উৎসাহিত করলেও ‘টিভি প্রোগ্রামগুলো’ দেখতে কাউকে উৎসাহিত করতেন না। তাঁর সমাজ-গঠনমূলক অনুষ্ঠানগুলো পরিবারস্থ লোকজনকে দেখানোর জন্য নিজের বাসায়ও কোনো টিভি ছিলো না। তিনি প্রায়ই বলতেনযারা টিভিতে সারাক্ষণ নাচ-গান দেখে তারা যেন এর ফাঁকে ভালো কিছু দেখে বা দেখতে চাইলে দেখতে পারে সে জন্যই সেখানে যাওয়াযদি এর মাধ্যমে কেউ সঠিক পথ লাভ করে!

বই লেখা ছিল যেন তাঁর এক নেশা। তিনি কম্পিউটারের বিভিন্ন প্রোগ্রাম সম্পর্কে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন এবং নির্ভুলভাবে খুব দ্রুত লিখতে পারতেন। এজন্য তাঁর লেখালেখিতে অনেক বরকত হয়েছে। ইন্টারনেটঅনলাইনভিত্তিক টিভি চ্যানেলওয়েবসাইটও অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তিকে (অনিবার্য খারাবী থেকে যথাসাধ্য বেঁচে) দ্বীনী দাওয়াতের কাজে ব্যবহার করতেনযেন এসবের মাধ্যমে মানুষ হেদায়েত লাভ করতে পারে।

তিনি খুব সহজ-সরল ভাষায় আলোচনা ও ওয়াজ করতেন। আলোচনা ও লেখনীতে অনেক কঠিন ও জটিল বিষয়কে সহজ সরল বাংলায় সর্বসাধারণের বোধগম্যভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন। ইংরেজি বলা ও লেখায় যথেষ্ট পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও আলোচনায় ইচ্ছাকৃতভাবে ইংরেজি শব্দ পরিহার করতেন যেন সাধারণের বুঝতে অসুবিধা না হয়। 

র্শিকবিদআতসুন্নাতের গুরুত্ব ও সুন্নাহ অনুসরণবান্দার হক্বআত্মীয়তার হক্বসমকালীন প্রসঙ্গসামাজিক ও পারিবারিক বিষয়সহ অন্যান্য সমাজ ও জীবনঘনিষ্ঠ প্রয়োজনীয় বিষয় সহজ ও সাবলীলভাবে আলোচনা করতেন। সাধারণত আলোচনায় আকীদা ও ফিকহী জটিল বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন প্রসঙ্গে যুবকদেরকে সম্বোধন করে আলোচনা করতেন। তাদের আবেগ-অনুভূতি ও বিভ্রান্তির বিষয়গুলো তুলে ধরে দরদমাখা ভাষায় সংশোধনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। এ কারণে যুবকদের বড় একটি শ্রেণি তাঁর ভক্ত ছিলো। 

তাঁর আলোচনার শেষে সাধারণত একটি প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকতো। তিনি মানুষের লিখিত বিভিন্ন প্রশ্নের দলিলভিত্তিক উত্তর দিতেন। কোনো বিষয়ে জানা না থাকলে উত্তর দিতেন না। টিভিতে বা মাহফিলের প্রশ্নোত্তর পর্বে তালাক সংক্রান্ত বিষয়ে উত্তর না দিয়ে স্থানীয় আলেমদের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিতেন। এছাড়াও তিনি তাঁর ওয়াজ-মাহফিল এবং সেমিনারগুলোর আলোচনায় আধুনিক শিক্ষিত সালাফী ব্যক্তিবর্গকে প্রান্তিকতা পরিহার করে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে মধ্যপন্থা অবলম্বনের জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন।

সাধারণত মাহফিলগুলোর মাধ্যমে সাময়িকভাবে মানুষের মাঝে দ্বীনী চেতনার সৃষ্টি হয়কিন্তু তাঁর একান্ত কামনা ছিলো মানুষের মাঝে বিশেষত মহিলাদের মধ্যে স্থায়ী দ্বীনী চেতনা সৃষ্টি করা। এজন্য প্রয়োজন ছিলো প্রাত্যহিক ব্যবস্থাপনার অধীনে দ্বীন শেখানো। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে সাধারণ শিক্ষিত ও দুঃস্থ মহিলাদের মাঝে দ্বীনী শিক্ষা ও দ্বীনী চেতনা প্রসারে আমাদের উদাসীনতার সুযোগে দেশী-বিদেশী এনজিওসমূহ বিভিন্নভাবে তাদেরকে দ্বীন ও ঈমানী চেতনা থেকে বিচ্যুত করছে। 

তাই মহিলাদের মধ্যে স্থায়ী দ্বীনী চেতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদেরকে দ্বীন শেখানোর ব্যবস্থা করেন। এ লক্ষ্যে সাধারণ শিক্ষিত ও দুঃস্থ মহিলাদের মাঝে দ্বীনী শিক্ষা ও দ্বীনী চেতনার প্রসারে ছয় মাস ব্যাপী কুরআন তিলাওয়াত সহীহ করা ও দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলো শেখানোর পাশাপাশি স্থানীয় সমাজ-সেবা অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ প্রশিক্ষিকার মাধ্যমে সেলাই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সেখানে প্রতিদিন দুই ঘন্টাব্যাপী ক্লাসের অর্ধেক সময় ধর্মীয় বিষয়াদির জন্য বরাদ্দ ছিলো। প্রশিক্ষণ শেষে তাদেরকে সনদপত্র দেয়ার ক্ষেত্রেও দ্বীনী ক্লাসে নিয়মিত অংশগ্রহণ শর্ত ছিলো। পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে কয়েকজনকে পুরস্কার স্বরূপ সেলাই মেশিন ও সেলাই উপকরণ প্রদান করা হয়।

আর্ত মানবতার সেবা ও মানুষদেরকে দ্বীনী পরিবেশের সাথে পরিচিত করার মাধ্যমে দ্বীনমুখী করার লক্ষ্যে প্রতি শুক্রবার মাদরাসায় স্থানীয় সরকারী হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসক দ্বারা রোগী দেখার ব্যবস্থা করেন। সেখানে রোগীদেরকে বিনামূল্যে ব্যবস্থাপত্র ও জরুরি ঔষধ প্রদান করা হয়।

তিনি নওমুসলিমদের প্রতি সবিশেষ খেয়াল রাখতেন এবং বেশ কয়েকজন নওমুসলিমকে তাঁর তত্ত্বাবধানে রেখে পড়াশোনা ও অন্যান্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
লম্বা ও সুন্দর চেহারার এই মানুষটিযাকে হাজারো মানুষের ভিড়ে চেনা যেতব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত সদালাপী ও বিনয়ী ছিলেন। আন্তরিকভাবে নিজেকে ছোট হিসেবে পেশ করতেননিজের আলাদা একটা ভাব বা শান রাখতেন নাসাদামাটা জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। যারাই তাঁর সাথে কিছু সময় কাঁটিয়েছে তারা তাঁর ব্যবহারে মুগ্ধ না হয়ে পারেনি। উত্তম চরিত্রের অধিকারী এই মানুষটি কথাবার্তা ও চালচলনে পরিপূর্ণ সুন্নাহ অনুসরণের চেষ্টা করতেন। সাক্ষাতে আগে সালাম দিতেন। তিনি সর্বদা ফরয নামায মসজিদে আদায় করতেনঘরে বা অন্য কোথাও আদায় করতেন না। 

সুন্নাতের প্রতি ভালোবাসাতাকওয়া ও পরহেযগারীপোশাক-পরিচ্ছদ ও চালচলনে সালাফে সালেহীনের অনুসরণ এবং পরিবারস্থ সকলকে পরিপূর্ণ দ্বীন অনুযায়ী পরিচালনা ও দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করা আসলেই তাঁর মত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ডক্টরেট ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বিরল।  তিনি ব্যক্তি নয় বরং কর্মের সমালোচনা করতেন। আমি কখনো তাঁকে তাঁর আপনজন বা চরম বিরোধীদেরও সমালোচনা করতে দেখিনি। বরং কখনো তাদের প্রসঙ্গ উঠলে বা তাদের বক্তব্যের জবাব দিতে হলে তাদের জন্য দুআ করে তারপর জবাব দিতে দেখতাম। মানুষের সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়ওয়াজ মাহফিল বা টিভি প্রোগ্রামে সাধারণ ও জটিল বিষয়ের আলোচনার ক্ষেত্রে তাঁর মুখে সর্বদা হাসি লেগেই থাকতো। হাসিটা যেন তার মুখেরই অংশ ছিলো। মৃত্যুর পরেও তাঁর মুখে এ হাসির ছাপ অটুট ছিল!

তাঁর মৃত্যুর পর আলিম ও সাধারণ সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে তাঁর উত্তম আখলাকের কথা স্মরণ করে অঝোরে কাঁদতে দেখেছি। এরূপ আখলাকী মানুষ বর্তমান সময়ে সত্যিই বিরল!

তাঁর একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো ‘আকায়েদ-ইবাদত ও আখলাকের’ ক্ষেত্রে হুবহু সুন্নাহর অনুসরণ। এ সকল ক্ষেত্রে তিনি সর্বাগ্রে সুন্নাহকে সামনে নিয়ে আসতেন। নির্দিষ্ট বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা সাহাবায়ে কেরাম রা. থেকে কোনো আমল আছে কি নাসেটা তালাশ করতেন এবং পাওয়া গেলে তিনি সেটাই পালন করার চেষ্টা করতেন। ইবাদত পালন এবং ইবাদতের পারিভাষিক বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার ও তাবীরের ক্ষেত্রে তিনি হুবহু সুন্নাহ সমর্থিত শব্দগুলো ব্যবহার করা পছন্দ করতেন। যেমন ‘নামায-রোযার’ পরিবর্তে ‘সালাত-সাওম’, ‘শবে বরাত’ শব্দের পরিবর্তে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’, প্রভৃতি ব্যবহার করতেন। যিকর ও দুআর ক্ষেত্রে হাদীসে বর্ণিত শব্দগুলোই ব্যবহার করতেন এবং অন্যদেরকে এই শব্দগুলো ব্যবহার করার জন্য উৎসাহিত করতেন। এই বিষয়ে তার কিতাব রাহে বেলায়েত এবং যিকর ও ওযীফা কিতাব দুটি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।

কোনো ধরনের ইলমী গোঁড়ামী তাঁর মধ্যে ছিলো না। তিনি সবসময় হক বিষয়টি কবুল করে নিতেননিজের মত আঁকড়ে থাকতেন না। যখনই কোনো বিষয় তাঁর সামনে দলিলভিত্তিক উপস্থাপন করা হয়েছে এবং বিষয়টি তিনি বুঝতে পেরেছেনতৎক্ষণাৎ তাঁর পূর্বের মত থেকে ফিরে এসেছেন। 

ওয়াজ মাহফিলে বা সাধারণ মানুষদের মজলিসে যদি কেউ ‘উলামায়ে কেরামের’ সমালোচনা করতো তাহলে তিনি খুব কষ্ট পেতেন। তিনি বলতেন, ‘উলামায়ে কেরামের’ দোষ-ত্রুটি খায়েরখাহির সাথে কেবল তাঁদের মজলিসেই বলা যেতে পারে। তাহলে তাঁদের সংশোধনের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সাধারণ মানুষদের সামনে তাঁদের সমালোচনা করলে কিছু মানুষ খুশি হয়। কারণ এই লোকগুলো উলামায়ে কেরামের সমালোচনার অপেক্ষায় থাকেতাঁদের সমালোচনা শুনতে পছন্দ করে। তাছাড়া সাধারণ মজলিসে এরূপ সমালোচনার কারণে আলেম ও জনগণের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। উলামায়ে কেরামের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা নষ্ট হলে সাধারণ মানুষ দ্বীন থেকে দূরে সরে যায়। সুতরাং যে কাজ সাধারণ মানুষকে দ্বীন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়একজন আলেমের এমন কাজ করা উচিত নয়।

তিনি বলতেন, আলেম হওয়ার জন্য মাদরাসায় পড়তে হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি এ বিষয়ে জোরালো বক্তব্য রাখতেন যেদ্বীন সম্পর্কে সাধারণভাবে কিছু জানা বা কিছু ধর্মীয় বই পড়া আর আলেম হওয়া এক জিনিস নয়। ডাক্তার হতে হলে যেমন একজন ব্যক্তিকে অভিজ্ঞ ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে দীর্ঘদিন নিয়মতান্ত্রিকভাবে পড়ালেখা করতে হয়এরপর ইন্টার্নি করতে হয়। তেমনি আলেম হতে হলে তাকে অভিজ্ঞ আলেমদের তত্ত্বাবধানে দীর্ঘদিন পড়ালেখা করতে হয় এবং অনেক বিষয় অভিজ্ঞ আলেমের নিকট থেকে হাতে-কলমে শিখতে হয়।

তিনি সময়ানুবর্তিতার সাথে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। কোনোভাবেই সময়ের অপচয় করতেন না। তাঁর ব্যক্তিগত সমৃদ্ধ লাইব্রেরী ছিলোযেখানে তাফসীরহাদীসফিকহউসূল ও আরবী সাহিত্য বিষয়ক মৌলিক গ্রন্থাদির পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণ বাংলা-ইংরেজি বইও ছিলো। তিনি প্রচুর পড়াশোনা করতেনযা তাঁর তথ্যবহুল লেখনী ও আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়। এছাড়াও আমি উক্ত লাইব্রেরীর কিতাবপত্র ব্যবহারের সময়ও দেখেছি অনেক কিতাবের প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি অনেক জায়গায় সংক্ষিপ্ত নোট লিখেছেনযা তাঁর অধ্যয়নের ব্যাপকতার পরিচয় বহন করে।


আত্মীয়দের হক আদায়ে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। ওয়ারিশসূত্রে প্রাপ্ত সকল সম্পদ ফারায়েয অনুযায়ী তাঁর বোনদের মাঝে ভাগ করে দেন এবং বোনেরা সেগুলো বুঝে নেয়। তাঁর তিনতলা-বিশিষ্ট বাড়ির নীচতলায় তাঁর অসুস্থ মা ও প্রতিবন্ধী বোন থাকেন। তাদের  চলাফেরা ও আত্মীয় স্বজনদের সাথে সাক্ষাতের সুবিধার্থে এই ব্যবস্থা করা হয় এবং সেখানে তাদের সেবাযত্মের জন্য আলাদা খাদেমার ব্যবস্থা করেছিলেন। আর তিনি তৃতীয় তলায় তাঁর স্ত্রীসহ ছোট  মেয়েকে নিয়ে থাকতেন। একমাত্র ছেলে ও বিবাহিত বড় দুই মেয়ের জন্য দ্বিতীয় তলায় থাকার ব্যবস্থা করেন। স্ত্রী-সন্তানদের জন্য আলাদা খাদেমা রেখেছিলেন। বাড়ির বাইরের কাজের জন্য একজন লোক রাখা ছিলো। মাদরাসায় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার পথে তাদের সাথে দেখা করতেন। তাঁর মা কখনো কোনো প্রয়োজনে ফোন করলে খুব গুরুত্ব দিতেন এবং সাথে সাথে সমাধানের জন্য অস্থির হয়ে যেতেন।

বহু ব্যস্ততার মাঝেও তিনি পরিবারকে যথেষ্ট সময় দিতেন। মাঝেমধ্যে তাদের নিয়ে বিনোদনের উদ্দেশ্যে বেড়াতে যেতেন। এছাড়াও চট্টগ্রামখুলনাকক্সবাজার প্রভৃতি স্থানের মাহফিলগুলোতে যাওয়ার সময় কখনো কখনো পরিবারস্থ লোকজনকে সাথে নিয়ে যেতেন এবং তাদেরকে হোটেলে রাখার ব্যবস্থা করে দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখাতেন।

সংসার জীবনে তিনি ফুরফুরার মরহুম পীর আবুল আনসার মুহাম্মাদ আব্দুল কাহহার সিদ্দিকী রাহ.-এর সেজ কন্যাকে বিবাহ করেন এবং সেই সুবাদে ফুরফুরার দাওয়াতী কার্যক্রমে তাওহীদ ও সুন্নাহর প্রসারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হন।

জীবনের শেষ দশকে কওমী আলেমদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিশেষত ‘মারকাযুদ্ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা’-তে তাঁর যাওয়া-আসা এবং সেখানকার ইলমী গবেষণা দ্বারা তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হন। ‘মারকাযুদ দাওয়াহ্র প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি প্রায়ই বলতেন, “আমার ছাত্ররা বড় অফিসার হওয়ার চেয়ে অল্প আলোতে বসে কুরআন-হাদীস নিয়ে গবেষণা করবেকিতাবপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করবেআমি মনে করি দুনিয়া ও আখিরাতে এটাই আমার বড় পাওয়া।” এ লক্ষ্যেই তিনি পর্যায়ক্রমে ‘তাখাসসুস’  ‘কিতাব বিভাগ’ চালু করেন। পরবর্তীতে তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় এক সফরে গেলে সেখানকার নূরানী শিক্ষাব্যবস্থা দ্বারা অত্যন্ত মুগ্ধ হন এবং সে বছরই কিন্ডার গার্টেন বাদ দিয়ে নূরানী পদ্ধতিতে প্রাইমারী শিক্ষা চালু করেন।

তিনি সকল ধারার উলামায়ে কেরাম ও দ্বীনদার লোকজনকে নিয়ে চলতেন। কওমীআলিয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র ও আধুনিক শিক্ষিতদের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করতেন। এ লক্ষ্যেই তিনি ‘আততাখাসসুস ফী উলূমিল হাদীস’  ‘আততাখাসসুস ফিদ দাওয়াহ’ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে সুন্দর ব্যবস্থাপনায় কওমীআলিয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী এবং যোগ্যতাসম্পন্ন ছাত্ররা পড়াশুনা করছে। আমাদের দেশে যারা আলিয়া বা বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক পড়াশোনা বা শিক্ষকতা করেনসাধারণত তারা নিজেদেরকে দ্বীনের খেদমতের সাথে সম্পৃক্ত না করে চাকরিকেই তাদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে ফেলেন। আবার অনেকে তাদের দ্বারা দ্বীনের খেদমত করা সম্ভব বলেও মনে করেন না। কিন্তু আলিয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও শিক্ষকতা করার পাশাপাশি দ্বীনের বহুমুখী খেদমত করাও যে সম্ভবমরহুম তাঁর বৈচিত্র্যময় কর্মবহুল জীবন দ্বারা সেটি প্রমাণ করে গেছেন।

তিনি আলিয়া মাদরাসার ছাত্র ছিলেন এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। এতদসত্ত্বেও এসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ও লেখাপড়ার মানের যৌক্তিক সমালোচনা করতেন। সেখানে গিয়ে কওমী মাদরাসা ও আলিয়া মাদরাসার দ্বীনদার ছেলেদের কেবল চাকরিমুখী চেতনাআখলাক ও সীরাত-সুরতের পরিবর্তন (তথা দাড়িটুপিইসলামী লেবাস ছেড়ে অনৈসলামিক পরিবেশের শ্রোতে মিশে যাওয়ার বিষয়গুলো) তাঁকে চিন্তিত করতো। তাদেরকে এ সমস্ত খারাবী থেকে বাঁচানোর পাশাপাশি তাদের মাঝে যে কোনো অবস্থায় দ্বীনী খেদমতমুখী চেতনা গড়ে তোলা ও ইলমী যোগ্যতাকে আরও পরিশীলিত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে আমাদের সাথে তাঁর মনের অস্থিরতার কথা প্রকাশ করতেন এবং কীভাবে ও কোন্ উপায়ে তাদেরকে রক্ষা করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ করতেন।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘জামিআতুস সুন্নাহ’ ঝিনাইদহে ‘উলূমুল হাদীস বিভাগ’ খোলার অন্যতম কারণও ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবীযোগ্যতাসম্পন্ন ও দ্বীনদার ছেলেদের ইলমী ও তাহকীকী মেযাজ  তৈরি করা ও অনৈসলামিক শ্রোতে থেকে তাদেরকে রক্ষা করা। এছাড়াও মাদরাসা থেকে আগত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ মানের ছাত্রদের জন্য স্বল্পকালীন দ্বীনী বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন কোর্স খোলার কথা আমাদেরকে অনেক সময় বলতেন কিন্তু রিজাল ও ওসায়েলের অভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে উঠেনি।

তিনি বলতেন, আমার কাছে সবচেয়ে জরুরি মনে হয় র্শিক-কুফর বিদআতআল্লাহর হক্ববান্দার হক্বফরযওয়াজিবহালাল-হারাম ইত্যাদি। এরপর এখতেলাফ থাকবে। আমি এ ব্যাপারে শিথিলতা প্রদর্শন করি। এজন্য যারা র্শিক-কুফরবিদআত ও মাজার পূজায় লিপ্ত যেমনশিয়া-কাদিয়ানীআটরশিচন্দ্রপাড়ামাইজভাণ্ডারী এবং ঐসব রেজভী-বেরলভীযারা আকীদা ও আমলের বিভিন্ন শিরকে লিপ্ত। এদের কারও সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমার লেখালেখি ও আলোচনার মূল বিষয়ই হলো তাদের গোমরাহী থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করে তাওহীদ ও সুন্নাহর দিকে ফিরিয়ে আনা। 

তবে যারা মৌলিকভাবে কুরআন-সুন্নাহ মেনে চলে এরূপ সকল রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দলকে আমি পছন্দ করিকিন্তু আমি কোনো দলের সাথে সম্পৃক্ত নই। বাংলাদেশের এরূপ দলগুলোর পারস্পরিক ঐক্য এবং মৌলিক বিষয়গুলোতে তারা একত্রে কাজ করুক এটা আমি কামনা করি এবং তাদের পারস্পরিক বিরোধ নিরসনই আমার প্রত্যাশা। এজন্য তাদের কেউ ভালো কোনো কাজে আমাকে ডাকলে আমি তাদের ডাকে সাড়া দেই। আবার আমি আমার লেখায় ও আলোচনায় তাদের ভালো গুণগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি তাদের কোনো ভুল থাকলে সেটাও উল্লেখ করি।

বিগত ১১ মে ২০১৬ ঈ. রোজ বুধবার আনুমানিক সকাল আটটার দিকে এই খ্যাতনামা আলেমেদ্বীন ঝিনাইদহ থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে মাগুরা সদর উপজেলার পারনান্দুয়ালী এলাকার ঢাকা  রোডের ‘৩নং ব্রিজ’ নামক স্থানে বিপরীত দিক থেকে আসা ‘রাইফ কার্গো সার্ভিস’-এর কাভার্ডভ্যানের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে তিনি ও তাঁর গাড়ির ড্রাইভার তৎক্ষণাৎ ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন)। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিলো আটান্ন বছর। বিভিন্ন কারণে অনাকাক্সিক্ষতভাবে তাঁর নামাযে জানাযা দেরি হয়ে যায়। 

পরদিন ১২ মে বাদ মাগরিব ঝিনাইদহ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের বিশাল মাঠে জানাযার নামাযের ঘোষণা দেয়া হয়। এদিন দুপুর থেকেই প্রচ- রোদ ছিলো। কিন্তু আসরের সময় আকাশ মেঘলা হয়ে যায় এবং দু’nএক ফোঁটা বৃষ্টি ও মৃদুমন্দ বাতাস হাজারো মানুষের পদভারে ধূলিধূসরিত মাঠের পরিবেশকে শীতল ও ধূলামুক্ত করে দেয়। এরূপ মেঘলা শীতল পরিবেশে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ তাঁর জানাযার নামায আদায় করে। স্মরণকালের বৃহত্তম এই জানাযার মত আর কোনো জানাযা ঝিনাইদহবাসী দেখেনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত আস-সুন্নাহ জামে মসজিদের নিকটে পিতার কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। আল্লাহ তাআলা তাঁর রেখে যাওয়া সকল ভালো কাজ কবুল ও মাকবূল করুন এবং তাঁকে জান্নাতে উঁচু মাকাম দান করুন। আমীন।

সংকলন ও সম্পাদনায়:
ইমদাদুল হক যুবায়ের
প্রাবন্ধিক ও গবেষক
শিক্ষক
জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজসিলেট।
মোবাইল: 01712374650
ইমেইল: zubairjcpsc@gmail.com
facebook: Imdadul Haque Zubair

Facebook Page ইমদাদুল হক যুবায়ের


শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here