Saturday, May 16, 2020

ইবলিশের সাক্ষাতকার

 
।। মুন্সি আব্দুল কাদির।।

মানুষ সৃষ্টির ইতিহাস যত পুরনো ইবলিশের সাথে মানুষের দুশমনিও তত পুরনো। সেই আদিকাল থেকে মানুষের সাথে তার চরম শত্রুতা। সে কখনো চায় না, মানুষ ভাল কাজ করুক। আল্লাহর প্রিয় হোক। জান্নাত পেয়ে যাক। তার সব সময়ের চিন্তা আর পেরেশানী কিভাবে মানুষকে বিপথগামী করা যায়। তার অনুসারীদের সে মানুষের পিছনে সব সময় লেলিয়ে দেয়। তাদের প্ররোচনায় মানুষ যদি কোন অন্যায় করে বসে তবে তারা ইবলিশের কাছে পুরস্কৃত হয়। তাতে ব্যর্থ হলে তারা তিরস্কৃত হয়।

রমজান আসলে  ইবলিশ বন্দি হয়ে যায়। তার আর কোন কাজ করার সুযোগ থাকে না। তার মন বিষিয়ে যায়, দুঃখ ভারাক্রান্ত থাকে। এই অবস্থায় একদিন এক আল্লাহ ওয়ালা আলেমের সাথে ইবলিশের সাক্ষাত হয়। আলেম দেখে ইবলিশ বন্দি তারপরও তার মন বেশ ফুরফুরে। ইবলিশের তো বন্দি অবস্থায় এমন ফুরফুরে মেজাজে থাকার কথা নয়। আলেম সাহেব বেশ অবাক। ব্যাপার কী? সে বন্দি। টার্গেট অনুযায়ী কোন কাজ করতে পারছে না? অথচ মনের আনন্দে সে গান গাইছে। আলেম সাহেব আর কৌতুহল থামাতে পারলেন না। আলেম সাহেব একটু উঁচু সুরে ডাক দিলেন, কি হে ইবলিশ, খুব ভালইতো আছ। বেশ মনের সুখে গান গাচ্ছিলে?

ওহ দিলেনতো সব মাটি করে। আমার এই সুরটা যে আর সহজে আসবে না! না না কোন চিন্তা নেই! বেশ বেশ ভালই আছি। তবে আচ্ছা কি মনে করে আমাকে দেখতে এলেন?

না তোমাকে দেখতে আসি নি। এই দিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখি তুমি বন্দি হয়েও মনের সুখে গান গেয়ে যাচ্ছ! তাই কৌতুহল সামলাতে পারলাম না, তোমাকে দেখতে এলাম। রমজানে তুমি বন্দি থাক। আমার মাওলা চান, এই রহমত, মাগফেরাত, নাজাতের মাসে তুমি যেন কাউকে কষ্ট দিতে না পার। কাউকে ধোকায় ফেলতে না পার। তার জন্য তোমার মন খারাপ থাকার কথা উল্টো তুমি সুখের গান গাচ্ছ! আশ্চর্য!

ও আচ্ছা এই কথা।

আলেমের এই কথা শোনে তার ফখরের দরিয়া উথলে উঠে। তার বড়ত্বের অহমিকা আরো বেড়ে যায়। সে বলে আমি বন্দি হলেও আমার মিশন সফল। সফলতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজকের দিনের চেয়ে আগামীকাল আরো বেশী সুখী হবো। সে তার বড়ত্বের গুণগান গাইতে থাকে।
 
কারো যখন হিংসা আর অহংকারের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। মনের অজান্তে অনেক সত্য খুব সহজে বলে দেয়। আলেম সাহেব এই সুযোগটি বুদ্ধিমত্তার সাথে গ্রহণ করেন।

আচ্ছা ইবলিশ, তোমার খুশি দেখে আমার তো হিংসা হচ্ছে, এই বিপদের মধ্যেও কিভাবে হাসা যায়?

তুমি বুঝবে কি করে। আমার সব সময়ের চিন্তা থাকে কিভাবে তোমাদেরকে গায়েল করা যায়। তবে ইদানিং খুব একটা কষ্ট করতে হয় না। মাঝে মাঝে এক দুইটা ট্যাবলেট খাওয়াতে পারলেই কেল্লা ফতে। আগে খুব কষ্ট করতে হতো। এগার মাস আমি তোমাদের পিছনে কষ্ট করতাম। এগার মাস কষ্ট করে তোমাদের দ্বারা যত মন্দ করাতাম। তোমরা রমজানের একমাস রোজা রেখে সব মাফ করিয়ে নিতে এমন কি আরো অনেক বোনাস তোমরা পেয়ে যেতে। এই নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম। কেননা আল্লাহর সাথে আমার কথা ছিল, তোমার বান্দাদেরকে আমি বিপথগামী করার জন্য ডান দিক থেকে বাম দিকে থেকে পিছন থেকে সামনে থেকে আমি হামলা চালাব। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তুই আমার বান্দাদের দ্বারা যতই পাপ কাজ করাস না কেন, আমার বান্দারা যদি মাফ চায় আমি মাফ করে দেব। আল্লাহ তায়ালার এই কথায় আমি হেরে যাই, চিন্তিত হয়ে পড়ি, পেরেশানী বেড়ে যায়। তবে আধুনিক প্রযুক্তির সুবাদে আমার অনেক কাজ সহজ হয়ে গেছে।

তাহলেতো তোমার আর কোন চিন্তা নেই। আলেম আবার তাকে কথার ফাকে একটু খোঁচা দেয়।

চিন্তাতো একটু থাকেই। তবে শাসক, ধনী আর আলেম শ্রেণীর কাছে আমি তিনটি জিনিস পুরোপুরি বিক্রয় করতে পেরেছি। এতে করে আমার খুব কষ্ট করতে হয় না। একটু খেয়াল রাখতে হয়। মাল যেন বেহাত হয়ে না যায়, বা মালের গুণাগুণ যেন সব সময় অটুট থাকে। ঔষধের কার্যকারীতা নষ্ট হয়ে গেলে এই ঔষধ সেবনে হিতে বিপরিত হতে পারে।

আচ্ছা তুমি কার কাছে কী বিক্রয় করেছ?

এখনো বুঝতে পারছ না। তুমি আবার আলেম? আলেম সাহেবকে সুযোগ পেয়ে একটু কটাক্ষ করে বসে। আলেম সাহেব তাতে রাগ না করে বলেন, আমি বুঝবো কি করে, তুমি কি আমার কাছে কিছু বিক্রয় করেছ ?

না তোমার কাছে না, তবে তোমাদের কাছে।

একবার বলো না, আমরা তোমার কাছ থেকে কেমন দাম দিয়ে কি কিনেছি।
শোন, তোমাদের কাছে আমি খুব চড়া দামে হিংসা বিক্রয় করেছি। শাসকদের কাছে জুলুম বিক্রয় করেছি আর ধনীদের কাছে কৃপণতা বিক্রয় করেছি। এমনিতেই আমার কোন কাজ নেই,  আমার প্রডাক্ট ঠিকভাবে কাজ করছে কি না সব সময় তার খোঁজ রাখতে হয় আর কি। কখনো কোন সার্ভিসিং এর প্রয়োজন হলে যত দ্রুত সম্ভব ঠিক করে দিয়ে প্রডাকশন ঠিক রাখতে হয়।

আর আমার প্রডাক্টের আরো একটি বৈশিষ্ট হল, যত জায়গাই আমি আমার প্রডাক্ট সাপ্লাই দিয়েছি, আমার ক্রেতাদের ঐ প্রডাক্টের সার্ভিসের কোন হেরফের হয় কি না, তা আমাকে জানাতে হয় না। সব সময় আমার লোক সেখানে উপস্থিত থাকে। যাতে কখনো কোন বিগ্ন দেখা দিলে সাথে সাথে মেরামত করে দিতে পারে।

তোমার তিনটি প্রডাক্টইতো খুব মূল্যবান। এই তিনটি দিয়ে তুমি পুরো পৃথিবীকে কাবু করে ফেলেছ। তোমার প্রডাক্টের কোন তুলনা হয় না।

এই জন্যইতো যখন আদমকে  সেজদা করতে বলা হলো, আমি সেজদা দিতে অস্বীকার করলাম। তোমারা মাটির আর আমি আগুনের তৈরী। বল আমি কি করে আদমকে সেজদা করব। আমার একটা সম্মান আছে না।

আলেম সাহেবের এখনো কিন্তু এই রমজানে তার ফুরফুরে মেজাজের কারণ জানা হয়নি। তাই প্রতিউত্তরে অন্য কিছু না বলে, আছেতো প্রত্যেকেরইতো একটা সম্মান আছে। এই রমজানে তুমি এতো খুশি কেন?

ওহ সে কথাতো বলতে ভুলেই গিয়েছি, শোন।

আগে রমজান আগমনের কথা মনে হলেই ঘাবড়ে যেতাম, আমার সারা বছরের পরিশ্রম একমাসেই শেষ। কিন্তু এখন এক মহা সুযোগ পেয়েছি। দেখ তোমাদের রাসুল বলেছেন, যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা, খারাপ কাজ ছাড়তে পারল না, তার পানাহার ত্যাগ করার আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। দেখ গিবত, পরনিন্দা, অহংকার, হিংসা, আমি এই কাজটিই সফলতার সাথে করতে পেরেছি।

যখন প্রযুক্তি ছিল না। তখনও আমি এই কাজটি করতাম। তখন এতো সফলতা পেতাম না। তোমরা যেমন প্রযুক্তি দ্বারা খুব সহজে মানুষের কাছে পৌঁছে যাও, আমি প্রযুক্তি দ্বারা খুব সহজে আমার কাজ সাধন করে ফেলি। এই ধর রমজানের আগের কয়েকদিন আমার গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ের মধ্যে আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হয়। আমার কাজটি এই সময়ে সঠিকভাবে করতে পারলে এগার মাসের ফলাফলও আমার নষ্ট হয় না। এমনকি রমজান মাসে বন্দি থাকলেও আমার কোন সমস্যা হয় না। আমার খুব সুখেই দিন কাটে।

তুমি সব জেনে যাচ্ছ?

আমি একজন জানলে তোমার আর কি ক্ষতি হবে? বরং তোমার গুনগান করতে পারব। আলেম সাহেব বলেন।

শোন তাহলে, রমজানের এক দুই দিন আগে আমার চাল খেলি ফেলি। এই সময়ে তোমাদের কারো মাথায় ছোট একটি জিনিস আমি ঢুকিয়ে দেই অথবা তোমাদের কোন অনুসারীর মাথায় ঢুকিয়ে দেই। বিষয়টি কোন প্রশ্নের আকারে বা কাজের আকারে তোমাদের সামনে আসে।
ছোট্ট বিষয় কেন? আলেম প্রশ্ন করেন।

কারণ বড় বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য নেই বললেই চলে। ছোট বিষয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। আমি এই সুযোগটি গ্রহণ করি। যেমন তারাবিহ আট রাকাত না বিশ রাকাত, আমিন জোরে বলা বা আস্তে বলা, বুকে হাত বাঁধা বা নাভীর নিচে হাত বাঁধা, নফল নামাজে কোরআন দেখে পড়া বা না পড়া, রাফই ইয়াদাইন করা বা না করা ইত্যাদি।

আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু তুমি বাস্তবায়ন কর কি করে।

আমার বাস্তবায়ন খুব সহজ। তোমাদের কারো মুখ থেকে যখন এই বিষয়ে কোন মাসয়ালা বের হয়। তখন তোমাদের পক্ষের আলেমরা একে ঠিক রাখার জন্য উঠেপরে লেগে যায়। তারা বিভিন্ন দলিল আর যুক্তির বন্যা বইয়ে দেয়। তার অনুসারীরা হাত তালি দেয়। অন্যকে খুব খারাপ ভাষায় গালি দিতেও কুসুর করে না। অপর দিকে বিপক্ষের  আলেমরা এর বিপরীত যত দলিল আর যুক্তি আছে সব এনে দাঁড় করায়। তারাও নেট দুনিয়া মাতিয়ে ফেলে। শুরু হয় নেট দুনিয়ায় তুমুল যুদ্ধ। তোমাদের এই যুদ্ধ আমি খুব উপভোগ করি।

বুঝ না। আমার কি যে আনন্দ। দলিল আর পাল্টা দলিল, যুক্তি আর পাল্টা যুক্তি, গালি আর পাল্টা গালি মোটামুটি রমজানের আগ থেকে সারা রমজান মাস এমন কি রমজানের পরেও তার রেষ চলতে থাকে।

বল আলেম, এতে করে তোমাদের কারো কি আর রোজা ঠিক থাকে? তোমাদের কারো মনে কি আল্লাহর ভয় জিন্দা থাকে। কেউ কি আল্লাহর ভয় লালন কর। শুধু যুদ্ধ আর যুদ্ধ। তুমুল যুদ্ধ। ভয়ানক যুদ্ধ। কি মজা কি মজা। দেখ তো তোমরা কত বোকা।

তোমাদের আদি পিতা মাতাকে খুব সহজে ধোকা দিয়ে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছি। আবার তোমাদেরকেও খুব সহজেই ধোকা দিয়ে যাচ্ছি। তোমাদের মধ্যে এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে যুদ্ধ লেগে যায়। গালিগালাজ শুরু হয়।

বলতো আলেম, আমি যে বিষয়গুলো বললাম এগুলো কি তোমার দ্বীনের কোন বড় বিষয়। উভয় পক্ষেইতো কম বেশী দলিল আছে। এই বিষয়গুলো দিয়ে আমি অতি সহজে তোমাদের ঐক্যের ঘরের ফাটলটাকে আরো অনেক বড় করে দেই যাতে করে আর মেরামত করতে না পারো।

কি বলো? আমার কাজের শক্তি দেখেছ। এক দুই ট্যাবলেটে পুরো জাতি কাত হয়ে যায়।

তুমি এই সময়টাকে বেছে নেও কেন?

না তোমাকে আর বলা যাবে না।

সবইতো বললে, এই টুক বাকি রেখে লাভ কি?
 
শোন রমজানের বেশী আগে যদি আমি চাল খেলি, তাহলে রমজান আসতে আসতে বাসী হয়ে যাবে। সব কিছুতো গরম গরমই ভাল। আমি রমজানের দু একদিন আগে কাজটি করে ফেললে পুরো রমজান তোমরা এ নিয়ে ব্যস্ত থাক। বিশেষ করে রহমতের দশক ও ক্ষমার দশকে তোমরা পক্ষে বিপক্ষের দলিল নিয়ে ব্যস্ত থাক। তোমাদের অনুসারীরা গালাগালি আর হাত তালি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। রহমত আর ক্ষমার চিন্তা করার সময় থাকে না। যখন একটু ভাটা পরে তখন নাজাতের দিনগুলো চলে আসে। তখন আর প্রস্তুতির সময় থাকে না। তোমরা প্রস্তুত হতে হতে রমজান মাস বিদায় হয়ে যায়।

আর একটি কথা আমার সাঙ্গ পাঙ্গ যত আছে সকলে এই কাজগুলোকে তদারকির জন্য রমজানের আগ থেকে খুব ব্যস্ত থাকে। বুঝতে পারছ তো এটা পুরো বছরের হিসাব-নিকাশ। ওদের সারা বছরের কাজের হিসাব এই মাসে করতে হয়।

এই কথা শেষ করে ইবলিশ মনের সুখে আবারো গান ধরে। আর আলেম সাহেব চিন্তা করতে করতে নিজের পথ ধরেন। আর মনে মনে বলতে থাকেন, হাফ আফসুস! আমরা যদি বুঝতে পারতাম। কতইনা ভাল হতো।

লেখকঃ 
কবি ও প্রাবন্ধিক
সিনিয়র অফিসার ও জিবি ইনচার্জ
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ


শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here