Thursday, May 14, 2020

আত্মহত্যা: প্রেক্ষিত বৈশ্বিক মহামারী


।। মুহাম্মদ জিয়াউর রহমান।।

ভূমিকা
মহান আল্লাহ তাআলা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই মানুষের আত্মা ও দেহের একমাত্র মালিক। তাই মানুষের জীবন মৃত্যুর সিদ্ধান্ত একান্ত আল্লাহরই; কোনো মানুষের নয়। আত্মহত্যা অবাধ ব্যক্তি স্বাধীনতার অন্যতম পরিণাম। মানুষ আত্মা সৃষ্টিকারী নয়, তাই তা বিনাশের অধিকারও তার নেই। আত্মহত্যার কারণে সংশ্লিষ্ট অন্য অনেকেই পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় আট লক্ষেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে, অর্থাৎ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও একজন মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। বাংলাদেশে ২০১০ সাল হতে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে ৮০ হাজারেরও অধিক আত্মত্যার ঘটনা সংগঠিত হয়। এ হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে বছরে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার এবং দিনে গড়ে প্রায় ২৯ জনের বেশি মানুষ আত্মহত্যার করছে। সমস্যায় নিপতিত ব্যক্তি সমাধানের পথ খুঁজে না পেয়ে মৃত্যুকেই সমাধানের পথ মনে করে। তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধে পৃথিবীর নানা দেশ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। সম্প্রতি ব্রিটেন সরকার আত্মহত্যা প্রতিরোধে প্রথমবারের মতো মন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছে, কারণ সে দেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যার পথ বেঁছে নেয়। 

আলোচ্য প্রবন্ধে আত্মহত্যার কারণ ও তা প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।

আত্মহত্যার পরিচয়
আত্মহত্যা শব্দটি বিশেষ্য এর আভিধানিক অর্থ: আত্মনাশ; আত্মহনন, আত্মঘাত; স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশ। নিজের বড় রকমের অনিষ্ট সাধন। ইংরেজি প্রতিশব্দ Suicide। এটি ল্যাটিন শব্দ সুই সেইডিয়ার থেকে এসেছে। সুই (sui) নিজেকে, সিডস (caeds) অর্থ হত্যা। অর্থাৎ আত্মহত্যা মানে নিজেকে নিজে খুন করা।  এর আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে انتحار 

সুতরাং, আত্মহত্যা বলতে নিজ উদ্যোগে এমন কার্যক্রম পরিচালনা করাকে বুঝায় যা দ্বারা নিজের জীবনের বিনাশ সাধিত হয়।

সাধারণত, দুইভাবে আত্মহত্যা সংঘটিত হয়ে থাকে। 
প্রথমত, পরিকল্পনার মাধ্যমে আত্মহত্যা। আর 
দ্বিতীয়ত, তাৎক্ষণিক উত্তেজনা বা তাড়নার বশবর্তী হয়ে আত্মহত্যা।
আত্মহত্যার কারণ
আত্মহত্যার বিভিন্ন ঘটনা পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা থেকে এর নানাবিধ কারণ প্রতীয়মান হয়। এগুলোর মধ্যে কতিপয় কারণ নিম্নে তুলে ধরা হলো।

বৈশ্বিক মহমারী
ইতিহাস পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, বৈশ্বিক মহামারীর সময়ও আত্মহত্যা প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ২০০০ সালে সার্স মহামারীর সময়ে আত্মহত্যার প্রবণতা উল্লেখযোগ্যহারে বেড়ে গিয়েছিল। বর্তমান করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতেও আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। অনেকে আতংকে আত্মহত্যা করছেন। আবার অনেকে নানাবিদ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আত্মহত্যা করছেন।

পারিবারিক কলহ
পরিবারের সদস্যদের মধ্যকার ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি, বিশেষ করে দাম্পত্য কলহের কারণে অনেক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মা-বাবার মধ্যকার কলহজনিত হতাশার কারণেও ছেলে-মেয়েরা আত্মহত্যার পথ  বেঁছে নেয়। সন্তানকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা, অবহেলা, সন্তানের চাহিদা পূরণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে উদাসীনতা, ধর্ষণ, অবাধ যৌনাচার, পরকীয়া, যৌতুক, আত্মসম্মানবোধ, স্বামীর উপর অভিমান ইত্যাদি আত্মহত্যার জন্য অনেকাংশেই দায়ী। এছাড়া বড় পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া, একাকিত্বও আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত।

অর্থনৈতিক দীনতা
দরিদ্রতা অনেক সময় মানুষের জীবনে অভিশাপে রূপ নেয়। যার ফলে অনেক সময় মানুষ ধৈর্যহারা হয়ে কুফরির দিকে ধাবিত হয়। মাঝে মাঝে এমন ঘটনাও পরিলক্ষিত হয় যে, সন্তানের ভরণপোষনে ব্যর্থ হয়ে মা-বাবা সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করছে। এছাড়া বেকারত্ব, ব্যবসায়িক দেউলিয়াপনা এবং অপ্রত্যাশিত চাকুরিচ্যুতির কারণেও মানসিক চাপ সামলাতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যা করে থাকে।

গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা
বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগব্যাধি অনেক মানুষের জীবনকে দূর্বিসহ করে তুলে। ফলে গুরুতর রোগে আক্রান্ত অনেকেই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। আবার দীর্ঘায়ুপ্রাপ্ত মানুষও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পার্থিব জীবনে নিষ্পেসিত হয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর পথ বেঁছে নেয়। বর্তমানে অনেক দেশে চিকিৎসকদের সহায়তায় স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরণ করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

হতাশা
অপ্রাপ্তিই হতাশার জন্ম দেয়। মানব জীবনে যে কোনো ব্যর্থতার পরিণামই হতাশা। কোনো পরিস্থিতিতে মানুষ যখন ধৈর্য হারিয়ে ফেলে তখনই হতাশা তাকে গ্রাস করে ফেলে। আর বর্তমান যুগে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন যিনি জীবনে কখনো হতাশায় ভুগেননি। তাই এ হতাশাই অনেকের জন্য মহাবিপদে রূপ নিয়ে স্বহস্তে জীবন নাশে উৎসাহ দেয়। ।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয়

ধৈর্য ধারণ করা
অসুস্থতা ও বিপদাপদ মুমিন বান্দাদের জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এক ধরনের পরীক্ষা। আল্লাহ তাআলা বলেন, অর্থাৎ আমি তোমাদেরকে কিছু ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ ও জীবনের ক্ষতি ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব। আপনি সুসংবাদ প্রদান করুন ধৈর্যশীলদের, যারা তাদের উপর বিপদ আসলে বলে, ‘আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।এরাই তো তারা যাদের প্রতি তাদের রবের কাছ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ এবং রহমত বর্ষিত হয়, আর এরা সৎপথে পরিচালিত।(আল-কুরআন, ২:১৫৫-১৫৭)

উপরিউক্ত আয়াতসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তাআলা বিপদাপদ, অসুস্থতা, অভাব অনটন ইত্যাদি দ্বারাও অনেক সময় মানুষকে পরীক্ষা করেন। আর এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পন্থা হলো ধৈর্য ধারণ।

অধৈর্য মূলত, মনের কষ্ট কমায় না; বরং বাড়িয়ে দেয়। পক্ষান্তরে ধৈর্য মূল বিপদের কষ্ট না কমালেও সহনীয় করে তোলে, ফলে বড় ধরনের যে কোনো বিপদে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়। আর যে ব্যক্তি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে, সে কখনও আত্মহত্যা করতে পারে না। সুতরাং বিপদ-আপদ, ব্যর্থতা, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, অপমান ইত্যাদিতে ধৈর্য ধারণ করাই প্রকৃত সমাধানের জন্য উত্তম পন্থা।

আল্লাহর স্মরণ
বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের গবেষণায় পরিলক্ষিত হয় যে, আত্মহত্যার চেষ্টাকারীদের অধিকাংশই মানসিক রোগে আক্রান্ত। বহুদিন ধরে মনের মধ্যে চেপে রাখা ক্ষোভ, অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা, নিরাপত্তাহীনতা, ভয়ভীতি, সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক দীনতা, দাম্পত্য কলহ, বেকারত্ব এবং অনিয়ন্ত্রিত আবেগ ইত্যাদি নানাবিদ কারণে মানসিক বিকৃতি ঘটতে পারে, ফলে আত্মহত্যার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটে। এ থেকে উত্তরণের সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে আল্লাহর যিকর। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের ঘোষণা, “আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়।(আল কুরআন, ১৩:২৮)

হতাশা ও দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন
বিভিন্ন কারণে মানুষের মনে হতাশার সৃষ্টি হয়। আর শয়তানের প্রথম সবকই হলো হতাশা। সে হতাশা ও দুশ্চিন্তাকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেই মানুষকে বিপথগামিতার দিকে নিয়ে যায়। এসব বিপথগামী মানুষই আত্মহত্যার মতো ঘৃণিত সর্বনাশের সিদ্ধান্ত নিতে মোটেও দ্বিধা করে না। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন, “শয়তান তোমাদের দারিদ্রের ভয় দেখায় এবং অশ্লীলতার নির্দেশ দেয়। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর ক্ষমা এবং অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।(আল কুরআন, ২:২৬৮)

বিপদ-আপদ, লাঞ্ছনা-বঞ্চনা, শোক-দুঃখ ইত্যাদি মানুষের জীবনে থাকবেই। তাই কোনো অবস্থাতেই হতাশ হওয়া যাবে না; বরং ইসলামি শিক্ষা ও আদর্শের বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে হতাশামুক্ত জীবন গঠন করতে হবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন, “বলুন, হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজেদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ তাআলা সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।(আল কুরআন, ৩৯:৫৩)।

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,“মানুষকে যখন দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে আমাকে ডাকতে শুরু করে, এরপর আমি যখন তাকে আমার পক্ষ থেকে নিয়ামত দান করি, তখন সে বলে, এটা তো আমি পূর্বের জানা মতেই প্রাপ্ত হয়েছি। অথচ এটা এক পরীক্ষা, কিন্তু তাদের অধিকাংশই বোঝে না।(আল কুরআন, ৩৯:৪৯)।

বিপদকালীন সময়ে করণীয় সম্পর্কে বিশ্বনবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিম্নোক্ত দুআ শিক্ষা দিয়েছেন,
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْبُخْلِ وَالْجُبْنِ وَضَلَعِ الدَّيْنِ وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ
অর্থাৎ হে আল্লাহ আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি দুশ্চিন্তা, দুঃখ-বেদনা, মনোকষ্ট, অক্ষমতা, অলসতা, কৃপনতা, কাপুরুষতা, ঋণের বোঝা এবং মানুষের প্রাধান্য বা প্রভাবের অধীনতা থেকে।(সহীহুল বুখারী, হাদীস নং-২৭৩৬)।

উপরিউক্ত হাদিস থেকে বুঝা যায়, বিপদাপদ, দুঃখ-বেদনা, রোগ ব্যাধি ইত্যাদি মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দুআর মাধ্যমে দৈহিক ও মানসিক সুস্থতাময় হতাশামুক্ত একটি সুন্দর ভারসাম্যপূর্ণ জীবন গঠন সম্ভব।
পারিবারিক ও সামাজি বন্ধন
পরিবার মানুষের সর্বপ্রথম পাঠশালা এবং আশ্রয়স্থল। মানুষ মৌলিক শিক্ষা পরিবার থেকেই গ্রহণ করে থাকে। পারিবারিক শিক্ষা ও পরিবেশ মানুষের সামগ্রিক জীবনে প্রতিফলিত হয়। তাই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক, আস্থা, বিশ্বাস, ভালোবাসা, সহানুভূতি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বিদ্যমান থাকা আবশ্যক। আর সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও কার্যক্রমের মাধ্যমেই সুস্থ-সুন্দর পারিবারিক পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব। পরিবারের সদস্য হিসেবে প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা প্রয়োজন।

আর্থিক স্বচ্ছলতায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ
মানসিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার অন্যতম নিয়ামক অর্থনৈতিক মুক্তি। আর আর্থিক স্বচ্ছলতার মাধ্যমেই অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব। এ ক্ষেত্রে দারিদ্র বিমোচনই প্রথম এবং প্রধান কাজ। দারিদ্র বিমোচনে জাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি। জাকাত অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনার করালগ্রাস থেকে পরিত্রাণ দিয়ে সুখী, সমৃদ্ধশালী ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক। দেশীয় সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, জাকাতের সুষ্ঠু আদায় ও বণ্টনের মাধ্যমে দারিদ্রের কষাঘাত থেকে নাগরিকদের পরিত্রাণ সম্ভব। এছাড়া জাকাতের টাকা থেকে স্থায়ী স্বাবলম্বীকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। আর ঋণ পরিশোধে প্রবলভাবে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন, “জাকাত তো কেবল নি:স্ব, অভাবগ্রস্ত ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণে ভারাক্রান্তদের, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য, এটা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।(আল কুরআন, ৯:৬০)।

অসুস্থতায় করণীয় 
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানব জীবনকে সুন্দর আনন্দময় করে তুলতে ও সুস্থতার সাথে জীবন যাপনে ইসলাম দৈনন্দিন জীবনে পালনীয় সার্বিক বিধি-বিধান প্রণয়ন করেছে। ইসলামের এসব বিধি-বিধান পালনেই মানব জীবন শান্তিময় ও কল্যাণে ভরপুর হয়ে উঠে। মানবজাতির দৈহিক, মানসিক সুস্বাস্থ্যের পাশাপাশি আত্মিক সুস্থতা দ্বারা ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তিই হলো কুরআন নাযিলের অন্যতম উদ্দেশ্য। মারাত্মক ও কষ্টদায়ক অসুখে চিকিৎসার পাশাপাশি আল্লাহ তাআলার কাছে অনুনয়-বিনয়সহ আরোগ্য কামনা করতে হবে। সুস্থ এবং অসুস্থ উভয় অবস্থায়ই মুমিনের জন্য কল্যাণকর। আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা হিসেবেও অনেক সময় মানুষ রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘‘আর অবশ্যই আমি তোমার পূর্বে বিভিন্ন কওমের কাছে রাসুল প্রেরণ করেছি। অত:পর আমি তাদেরকে দারিদ্র ও দুঃখ দ্বারা পাকড়াও করেছি, যাতে তারা অনুনয় বিনয় করে।(আল কুরআন, ৬:৪২)।

আত্মহত্যার পরিণতি
আত্মহত্যা ঘৃণিত ও নিন্দনীয় কর্ম। ইসলামে শিরকের পরেই আত্মহত্যা সবচেয়ে বড় অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত। এটি এমন একটি অপরাধ যার জন্য তাওবাহ ও কাফ্ফারাহ এর কোনো সুযোগই বিদ্যমান থাকে না। ফলে এর শাস্তি কেবল পরকালীন জীবনেরই প্রাপ্র্য হয়ে ওঠে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, মৃত্যু জীবনের সমাপ্তি নয়; বরং এটিই চিরস্থায়ী জীবনের সূচনা। তাই দুনিয়ার জীবনের পরিসমাপ্তির অধিকার চর্চা কোনো মানুষের জন্যই বৈধ হতে পারে না। ইসলামে আত্মহত্যা তো দূরের কথা একই আত্মা থেকে বিস্তার লাভ করে একে অপরকে হত্যার মতো ঘৃণিত কর্মে জড়িত হওয়া জঘন্যতম মহাপাপ।
পবিত্র কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতি দয়ালু। এবং যে কেউ জুলুম করে, অন্যায়ভাবে তা করবে, অবশ্য আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করবো, আল্লাহর পক্ষে তা সহজসাধ্য।(আল কুরআন, ৪:২৯-৩০)। আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান নয়; বরং এটি ফিৎনার মহাদ্বার উম্মোচনকারী এক ভয়ংকর ব্যাধি, যা গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।

আত্মহত্যার পরিণাম সম্পর্কে  রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “কোনো মুমিনের উপর লানত (অভিসম্পাত) তাকে হত্যা করার শামিল। যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো বস্তু দ্বারা আত্মাহত্যা করে কিয়ামতের দিন তাকে ঐ বস্তু দ্বারাই শাস্তি দেয়া হবে।(সুনানু দারিমী, খ. ২, হাদিস নং ২৩৬১)।

উপরিউক্ত হাদিসের প্রথম অংশে লানত তথা অভিসম্পাতকে হত্যার মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধের সাথে তুলনা করা হয়েছে। লানত বা অভিসম্পাত হলো কোনো ব্যক্তির পক্ষে অপর ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের জন্য আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়ার কামনা করা। এটি একটি জঘন্যতম কবিরাহ গোনাহ। হাদিসের দ্বিতীয় অংশে পরকালীণ জীবনে আত্মহত্যার ভয়াবহ শাস্তির কথা বিবৃত হয়েছে। সুতরাং, লানত তথা অভিসম্পাত ও আত্মহত্যার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা অতীব জরুরি।

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, অন্য হাদিসে রাসুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি কোনো লৌহ নির্মিত (ধারালো) অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করবে (কিয়ামতের দিন) সেই লোহার অস্ত্রই তার হাতে দেয়া হবে। এর দ্বারা সে জাহান্নামের আগুনের মধ্যে অনন্তকাল নিজের পেটকে ফুটো করতে থাকবে। আর সে জাহান্নামই হবে তার চিরস্থায়ী বাসস্থান। আর যে ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করবে (কিয়ামতের দিন) সেই বিষ তার হাতে থাকবে। সে জাহান্নামের আগুনের মধ্যে অনন্তকাল তা চাটতে থাকবে। সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে। আর যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবে সে জাহান্নামের আগুনের মধ্যে চিরকাল এভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে এবং সেখানেই সে অনন্তকাল অবস্থান করবে।(সুনানু দারিমী, খ. ২, হাদিস নং ২৩৬২)

দূরারোগ্যে ব্যাধিতে আক্রান্ত বা বিপদগ্রস্ত হয়ে জীবন যন্ত্রনা থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে মৃত্যু কামনা করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমাদের কেউ যেন কোনো বিপদে পতিত হয়ে মৃত্যু কামনা না করে। মৃত্যু যদি তাকে প্রত্যাশা করতেই হয় তবে সে যেন বলে, হে আল্লাহ আমাকে সে অবধি জীবিত রাখুন, যতক্ষণ আমার জীবনটা হয় আমার জন্য কল্যাণকর। আর আমাকে তখনই মৃত্যু দিন যখন মৃত্যুই হয় আমার জন্য শ্রেয়।(সহীহুল বুখারী, খ. ৫, হাদীস নং-৫৩৪৭)

উপরিউক্ত হাদিস থেকে বুঝা যায়, কঠিন পরিস্থিতিতেও সুন্নাহ বিবর্জিত পন্থায় মৃত্যু কামনা করা বৈধ নয়। তাই  জীবন-মৃত্যু সংক্রান্ত চাওয়া পাওয়ার ক্ষেত্রেও সুন্নাহের যথাযথ অনুসরণ অত্যাবশ্যক।

আমাদের করণীয়
১. বৈশ্বিক মহামারীতে অভাব অনটনের কারণেও অনেক সময় মানুষ ধৈর্যহারা হয়ে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়। তাই মানুষকে কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার পাশাপাশি যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজ তথা রাষ্ট্রব্যবস্থাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

২. প্রেম-ভালোবাসা, পারিবারিক কলহ এমনকি বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কারণেও ইদানিং অনেকে আত্মহত্যা করছে, যা দিনে দিনে মহামারিতে রূপ নিচ্ছে। তাই এ থেকে পরিত্রাণের জন্য ধর্মীয় বিধি-বিধান মেনে চলার পাশাপাশি পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও সময়পোযোগী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরি।

উপসংহার
মৃত্যু পার্থিব জীবনাবসানের মাধ্যমে পরকাালীণ জীবনে প্রবেশের সিঁড়ি মাত্র। আর আখেরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, ভোগ-বিলাস ইত্যাদি সকল কিছু প্রাপ্তির একমাত্র স্থান জান্নাত যা চিরস্থায়ী ও সর্বোত্তম। কিন্তু চিরস্থায়ী এ সুখের ঠিকানা জান্নাত প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায় হলো আত্মহত্যা। তাই আত্মহত্যা সম্পর্কে মানবীয় মনে পরিপূর্ণ ইমানি সচেতনতা আবশ্যক। এছাড়া আইনের শাসন, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক সুসম্পর্ক, ইতিবাচক চিন্তা ভাবনা প্রভৃতি বিষয়গুলো আত্মহত্যা প্রতিরোধে অতীব প্রয়োজনীয়।

লেখকঃ
শিক্ষক,
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,
লিডিং ইউনিভার্সিটি,
সিলেট।
ও পিএইচডি গবেষক, ইবি, কুষ্টিয়া।   
ইমেইল: zia1290@gmail.com
মোবাইলঃ 01715610866


শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here