।। সুহাইল আহমাদ (আবু
গালিব)।।
সাদাক্বাতুল ফিতর
কী?
রামাদ্বানে সিয়াম পালনকারী বাজে কথা ও অশ্লীল কথা (ছোটখাটো
অপরাধ) থেকে পবিত্রতা লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট খাদ্য সামগ্রী, নির্দিষ্ট পরিমাণে মিসকিনদেরকে বাধ্যতামূলক
ধনী ব্যক্তিরা যা দান করতে হয় তাকে সাদাক্বাতুল ফিতর, যাকাতুল ফিতর বা সাদাক্বাতু রামাদ্বান বলা হয়।
সাদাক্বাতুল ফিতর
আদায় করা কী?
সাদাক্বাতুল ফিতর আদায় করা ফরজ বা জরুরী।
কখন আদায় করবেন?
ঈদুল ফিতরের সালাত আদায় করার পূর্বে।
সালাতের পর আদায়
করলে কী আদায় হবে?
হ্যা আদায় হবে তবে সাদাক্বাতুল ফিতর হিসেবে নয়
এটা সাধারণ একটি সাদাক্বা হিসেবে গণ্য হবে।
কাকে দান করবেন?
দরিদ্রদের দান করবেন।
সাদাক্বাতুল ফিতর
কেন দান করবেন?
সিয়াম পালনকারী বাজে কথা, অশ্লীল কথা (ইত্যাদি ছোটোখাটো অপরাধ) থেকে পবিত্রতা লাভ করে
এবং দরিদ্র মানুষেরা যেন খাদ্য লাভ করে, এই উদ্দেশ্যে দান
করবেন।
এসব প্রশ্নের উত্তর এক সাথে রাসূল সা. এর নিম্নের হাদীস থেকে
জেনে নেই।
فرض رسول الله ص زکاة الفطر طهرة للصاٸم من اللغو والرفث
وطعمة للمساکین من اداها قبل الصلاة فهی زکاة مقبولة و من اداها بعد الصلاة فهی
صدقة من الصدقات
রাসূলুল্লাহ সা. যাকাতুল ফিতর ফরয করেছেন, যেন সিয়াম পালনকারী বাজে কথা, অশ্লীল কথা (ইত্যাদি ছোটোখাটো অপরাধ)
থেকে পবিত্রতা লাভ করে এবং দরিদ্র মানুষেরা যেন খাদ্য লাভ করে। যে ব্যক্তি সালাতুল
ঈদের আগে তা আদায় করবে তার জন্য তা কবুলকৃত যাকাত বলে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি সালাতুল
ঈদের পরে তা আদায় করবে, তার জন্য তা একটি
সাধারণ দান বলে গণ্য হবে। (আবুদাউদ, খণ্ড- ২, পৃ. ১১১)
কী দিয়ে আদায় করবেন?
১. ত্বায়াম-খাদ্য (যে দেশের যে প্রধান খাদ্য)।
২. শায়ীর-যব।
৩. তামর-খেজুর।
৪. আক্বিত্ব-পনির।
৫. যাবীব-কিসমিস।
৬. ক্বামহ/হিনত্বাহ/বুর সবটির বাংলায় গম আটা বা ময়দা বলা
হয়।
কতটুকু দিবেন?
১. চাল (প্রধান খাদ্যহিসেবে)
২. যব
৩. খেজুর
৪. পনির
৫. কিসমিস
ইমাম আবু হানিফা রা. এর মতে এই পাঁচ প্রকার খাদ্যের যে কোনো
একটির এক সা বা ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম। গম, আটা বা ময়দা নিসফু
সা বা ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম।
কারা দিবেন?
এক কথায় ধনী ব্যক্তি তিনি নিজে ও পরিবারের পুরুষ মহিলা ছোট
বড় সবার পক্ষ থেকে আদায় করতে হবে।
খাদ্য ছাড়া তার মূল্য
দিয়ে আদায় করলে আদায় হবে কি?
সহজ কথাঃ হাদীসের আলোকে সাদাক্বাতুল
ফিতরের একটি উদ্দেশ্য হল, দরিদ্রদের খাদ্য
দান। খাদ্যের মূল্য রাসূল সা. এর যোগে দেওয়ার সুযোগ থাকার পরেও কেউ দেননি। যেহেতু ধনী
লোকের সাথে ঈদে গরীব লোকেরা খাদ্য খেয়ে ঈদ উৎসব পালন করবে, সুতরাং খাদ্যই দিতে হবে। মূল্য দিলে উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত
হবেনা। এখানে যাকাতের মতো সচ্ছলতা উদ্দেশ্য নয়।
মনে করেন একটি ফিতরার বিপরীতে ৭০ টাকা দিলেন। ঐ গরীব লোক
এই ৭০ টাকা দিয়ে খাবার কিছু না কিনে চোখ লজ্জায় ঋণ পরিশোধ বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু
ক্রয় করে নিল। কিন্ত খাদ্য হিসেবে কিছু কিনলনা। এ দিকে পাশের ধনী লোক খাদ্য খেয়ে ঈদের
আমেজ করছেন, আর গরীব লোক বা তার সন্তানরা ধনীদের
আনন্দ শুধু দেখছেন। এটা অসামাজিক ও দৃষ্টি কঠো কাজ। এজন্য সর্ব যুগের শ্রেষ্ঠ সমাজ
বিজ্ঞানী, মনো বিজ্ঞানী রাসূল সা. সাদাক্বাতুল
ফিতর খাদ্য দিয়ে আদায় করাই নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে ধনী গরীব সবাই অন্তত ঈদের দিন খাদ্য খেয়ে ঈদের উৎসব
পালন করতে পারেন।
বিনিময় দিলে অনেকের মতে জায়েজ হতে পারে। কিন্তু কখনো সুন্নত
সম্মতভাবে আদায় হবেনা। যেহেতু কোনো নস নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইজমা কিয়াসে সুন্নত সাব্যস্ত হয়
না। সুন্নত সাব্যস্ত হতে হলে হুবুহু রাসূল সা., সাহাবী ও তাবেয়ীদের আমলের দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে।
উপরের প্রশ্ন গুলোর উত্তর ও আলোচনার সার সংক্ষেপ নিম্নের
দুটি হাদীস পড়ে জেনে নেই।
فرض النبی ص صدقة الفطر-او قال:رمضان-علی الذکر والانثی،والحر
والمملوک،صاعا من تمر او صاعا من شعیر، فعدل الناس به نصف صاع من بر. فکان ابن عمر
یعطی التمر فاعوز اهل المدینة من التمر فأعطی شعیرا. فکان ابن عمر یعطی عن الصغیر
والکبیر حتی ان کان یعطی عن بنی. وکان ابن عمر رضی الله عنهما یعطیها للذین یقبلونها
وکانوا یعطون قبل الفطر بیوم او یومین
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক পুরুষ, মহিলা, আযাদ ও গোলামের পক্ষ থেকে সাদাক্বাতুল ফিতর অথবা (বলেছেন)
সাদাক্বাতু রামাদ্বান হিসাবে এক সা’ খেজুর বা এক সা’ যব আদায় করা ফরয করেছেন। তারপর লোকেরা
অর্ধ সা’ গমকে এক সা’ খেজুরের সমপরিমাণ দিতে লাগল। (রাবী
নাফি রহ. বলেন) ইবনে উমর রা. খেজুর (সাদাক্বাতুল ফিতর হিসাবে) দিতেন। এক সময় মদীনায় খেজুর
দুর্লভ হলে যব দিয়ে তা আদায় করেন। ইবনে উমর রা. প্রাপ্ত বয়স্ক ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক সকলের
পক্ষ থেকেই সাদাক্বাতুল ফিতর আদায় করতেন, এমনকি আমার সন্তানদের
পক্ষ থেকেও সাদাক্বার দ্রব্য গ্রহীতাদেরকে দিয়ে দিতেন এবং ঈদের এক দু’ দিন পূর্বেই আদায় করে দিতেন। (বুখারী
হাদীস নং ১৫১১) অন্য এক হাদীসে এসেছে-
ابا سعید الخدری رضی الله عنه یقول:کنا نخرج زکاة الفطر
صاعا من طعام، او صاعا من شعیر،او صاعا من تمر، او صاعا من اقط، او صاعا من زبیب.
আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা এক সা’ পরিমাণ খাদ্য অথবা এক সা’ পরিমাণ যব অথবা এক সা’ পরিমাণ খেজুর অথবা এক সা’ পরিমাণ পনির অথবা এক সা’ পরিমাণ কিসমিস দিয়ে সাদকাতুল ফিতর
আদায় করতাম। (বুখারী হাদীস নং ১৫০৬)
সৌদি সভ্যতাঃ
সাদাক্বাতুল ফিতর টাকা দিয়ে আদায় করা এটা আমাদের সভ্যতা হিসেবে
ধরে নিয়েছি। রাসূল সা. এর সুন্নত পদ্ধতি খোঁজার কল্পনাও করিনা। এটা এক তো রাসূল সা.
এর উদ্দেশ্যের খেলাফ দ্বিতীয় তো আদায়ের সুন্নত সম্মত পদ্ধতি নয়। কিন্তু সুন্নতের খেলাফ
নয়। সুন্নতের খেলাফ যেটা সেটা বিদআত।এটা অন্য প্রসঙ্গ।
এদিকে আরবরা ফিতরা আদায়
করেন খাদ্য সামগ্রী ও নির্দিষ্ট ছয় প্রকার খাদ্য সামগ্রী দিয়ে। এর বাইরে তারা তাদের
মুদ্রা রিয়াল দিয়ে সাদাক্বাতুল ফিতর আদায় করার কল্পনাও করেননা।
আরবের জনগণ একটি মাজহাবকে অনুস্মরণ করে চলেন। তারা ইমাম আহমাদ
ইবনে হাম্বাল রাহি. এর সিদ্ধান্তের আলোকে চলেন। ব্যতিক্রম কিছু থাকতে পারে। হাম্বলী
বা হানাবালাদের রায় হলো এক সা এর পরিমাণ ২কেজি ২০০গ্রাম। তবে তারা সতর্কতার জন্য একটি
ফিতরা তিন কেজির বেশি দিয়ে অনেকে আদায় করেন। এবং অধিকাংশই চাল দিয়ে ফিতরা আদায় করেন।
এ ব্যাপারে সৌদি নাগরিক শায়খ আওদা (আবু বাসিল) এর কাছে জানতে
চাইলে তিনি বলেন আমরা সতর্কতার জন্য পরিমাণের চেয়ে বেশি দেই। বেশিটা অতিরিক্ত সাদাক্বা
হিসেবে পরিগণিত হবে। তিনি জামেয়া ইসলামীয়া মদীনার (মদীনা ইসলামী ইউনিভার্সিটি) ফারেগ
ও তাবুকস্থ আল হাসান বিন আলী রা. মাদরাসার মুদির (পরিচালক)।
আমাদের আদায়ের মাঝে
সুন্নতের সংমিশ্রণ নেই
কিন্তু তাদের আদায়ের মাঝে রাসূল সা. এর উদ্দেশ্যের বাস্তব
মিল পাওয়া যায়। এভাবে আদায় করা তাদের সভ্যতার সাথে মিশে আছে। তারা ছয় প্রকার খাদ্যের
যে কোনো খাদ্য দিয়েই আদায় করেন। এটা তাদের সামাজিক সভ্যতা ও রাসূল সা. এর সুন্নত। তারা
ঈদের দিনের এক বা দুই দিন পূর্বে আদায় করেন এটাই তাদের সভ্যতা এটাই ওমর রা. এর শিখানো
সুন্নত।
রাসূল সা. বলেছেন ঈদের জামাতের পূর্বে আদায় করতে। তা কত দিন
পূর্বে দিতে হবে তা উমার রা. এর আমল দ্বারা পেয়ে যাই। ১৫১১ নং হাদীসের শেষ দিকে দেখতে
পাই উমার রা. ঈদের একদিন অথবা দুইদিন আগে সাদাক্বাতুল ফিতর আদায় করতেন। এই সাদাক্বার
আরেক নাম সাদাক্বাতু রামাদ্বান তাই তা রামাদ্বানের ভিতরেই উমার রা. আদায় করতেন। এটার
আরেক নাম যাকাতুল ফিতর তাই রামাদ্বানে যাকাত আদায় করা বেশি সুয়াব। এই তিনটি নাম ও হাদীসের
ভাষ্য মতে সাদাক্বাতুল ফিতর ঈদের পূর্বে, রামাদ্বানে ও খাদ্য
সামগ্রী দিয়ে ফিতরা আদায় করা স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।
সম্মানিত পাঠক!
আসুন, আমরা শরীয়াত সম্মত পন্থায় সাদাক্বাতুল ফিতর আদায় করার
চেষ্টা করি। নিজে মাসআলা না বুঝলে যে বুঝে তার কাছ থেকে বুঝে নেই। অথবা সরাসরি
হাদীস অধ্যায়ন করে এ সমাধান খোঁজে বের করি। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে সাদাক্বাতুল ফিতর
আদায় করার তাওফীক দান করুন। আমীন
লেখক:
ইমামঃ
আল-বির মাসজিদ,ইয়ারমুক
সৌদি আরব, তাবুক
২৩ শে রামাদ্বান, শনিবার,
সৌদি
১৬ ই মে ২০২০ ঈসায়ী
0 coment rios:
You can comment here