Saturday, May 30, 2020

আমার বেড়ে উঠা ও স্বাধীন বাংলাদেশের চার দশক-- পর্ব—২১


।। মাওলানা সৈয়দ ফয়জুল্লাহ বাহার।।

পূর্ব প্রকাশিত হওয়ার পর -----

পর্ব- ২০ এর লিংক

পর্ব -২১

--- ---১৯৯৭ সালের  সেপ্টেম্বর মাসে নিয়োগলাভ ও কর্মস্থলে যোগদান করলেও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের তখনকার সংস্কৃতি অনুসারে চার মাস বিলম্বে ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এমপিও ভূক্ত হই। নভেম্বরের মাঝামাঝি এক দিন দি সিলেট ইসলামিক সোসাইটির সম্মানিত চেয়ারম্যানের সাথে দেখা হলে তিনি অবহিত করেন যে, আমাদের দ্বীনি ভাই এডভোকেট জিয়া উদ্দিন নাদের তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদী গিয়েছিলেন। তিনি নরসিংদী জামেয়া কাসেমিয়া কামিল মাদ্রাসা হয়ে আসার সময় তারা তার সাথে আমার জন্য একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। তাতে তারা আমাকে জামেয়া কাসেমিয়ায় আরবী প্রভাষক পদে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
 
জিয়া ভাই চিঠিটি সোসাইটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফজলুর রহমান সাহেবের কাছে পৌঁছে দেন। ফজলুর রহমান সাহেব আমাকে বললেন যে, আপনার জন্য নরসিংদীতে একটি জব অফার আছে। তবে আমাদের পরামর্শ,  আপনি যাবেন না। উনাদের পরামর্শ মত আমি সেখানে যোগ দেয়া থেকে বিরত থাকি। এভাবেই জব ফিল্ডে আমার বিচরণ চলতে থাকে।

সে সময় দেশে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। তাদের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো আন্দোলন মূখর সময় অতিক্রম করছিল। এ সময় সিলেটে একটা অর্থবহ ঘটনা সংঘটিত হয়যা আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং প্রধান বিরোধী দলগুলোকে এক কাতারে নিয়ে আসে। সেটা ছিল শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও ভবনগুলোর বিতর্কিত নামকরণ। ১৯৯৯ সালের শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ রুমীর মা জাহানারা ইমামের নামে একটি হলের নামকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জাহানারা ইমাম শহীদ জননী হিসেবে সম্মানের পাত্র হলেও অন্য কারণে ধর্মীয় মহলে অগ্রহণযোগ্য ছিলেন। তা ছিল তার ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভানেত্রীর পদবী এবং এই সংগঠনের ইসলামী আদর্শ ও সংস্কৃতি পরিপন্থী নানা বক্তব্য ও আচরণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট তার নামে একটি হলের নামকরণের সিদ্ধান্ত নিলে সিলেটের ধর্মীয় ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক মহল সমালোচনা মূখর হয়ে উঠেন।
 
আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠি বন্ধুবর জাহেদুর রহমান চৌধুরী বিষয়টি আমার নজরে আনলে আমরা সিলেট যুব ফোরামের নামে প্রথমে প্রিন্ট মিডিয়ায় বিবৃতি পাঠাই। পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রথম বিবৃতি ছিলো এটি। দৈনিক সিলেটের ডাক, জালালাবাদ, সিলেট বাণী ও যুগভেরি পত্রিকায় বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে যুব ফোরামের তখনকার সভাপতি সৈয়দ ফয়জুল্লাহ বাহার,  সেক্রেটারি হাফেজ আব্দুল মালিক এজহারী এবং সাংগঠনিক সম্পাদক  এ এইচ এম আব্দুল বাসিত জাহানারা ইমামের নামে নামকরণ বাতিল করে তখনকার জাতীয় সংসদের স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর মাতা, বিদূষী মহিলা সিরাজুন নেসা চৌধুরীর নামে হলের নামকরণের দাবী জানান।

ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এ দাবীতে সোচ্চার হয়ে উঠে। যুবনেতা তোফা ভাইয়ের নেতৃত্বে স্থানীয় কোর্ট পয়েন্টে বিতর্কিত নামকরণ বিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সিলেট যুব ফোরামের পক্ষে আমি বক্তব্য পেশ করি। তাতে আমি বিতর্কিত নামকরণ বাতিল করে সিরাজুন্নেসা চৌধুরীর নামে হলের নামকরণের দাবী জানাই। সিলেটের ছাত্রসমাজ ও বিতর্কিত নামকরণ বাতিল করার দাবী জানায়। গঠিত হয় "বিতর্কিত হল ও ভবনের নামকরণ বিরোধী  ছাত্র আন্দোলন"। এর নেতৃত্বে ছিলেন খালেদ নূর ও আহমদ রিপন মন্ডল। এক পর্যায়ে প্রথম সারির ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে চলে আসে।

খালেদ নূর বর্তমানে একজন ব্যারিস্টার এবং তিনি লন্ডনে বসবাস করছেন।  ছাত্র দল, ছাত্র শিবির,  ছাত্র মজলিস এবং তালামিযে ইসলামিয়া ছিল ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় সংগঠন। একপর্যায়ে ছাত্র-যুবক ও সামাজিক সংগঠনগুলোর এ আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলো সম্পৃক্ত হলে আন্দোলন নতুন রূপ লাভ করে। এক পর্যায়ে এ আন্দোলন এক শক্তিশালী সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে উন্নীত হয়। দাবী আদায়ে মিছিল, মিটিং, হরতাল ও অবরোধ পালিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একগুয়েমীর কারণে এ আন্দোলনে জন সম্পৃক্ততা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে তা খুবই জনপ্রিয় আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। আন্দোলনের এক পর্যায়ে প্রশাসন বলপ্রয়োগ করে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। মিছিল ও অবরোধ পালনকারী জনতার উপর গুলি বর্ষণ করা হয়। তাতে মাদ্রাসা ছাত্র আব্দুল মুনিম বেলাল শাহাদাত লাভ করে। সেদিন ছিল ১৯৯৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর। শহীদ বেলাল ছিল সরাসরি আমার ছাত্র। সে নগরীর শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসার আলিম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করতো।

আন্দোলন তুংগে উঠে এবং তাতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ শরীক হোন। বি এন পি নেতা এম এ হক, খেলাফত মজলিস নেতা মাওলানা হাবীবুর রহমান, জামায়াত নেতা ডাক্তার শফিকুর রহমান, জাতীয় পার্টি নেতা এডভোকেট গিয়াস উদ্দিন, আল ইসলাহ নেতা গৌসুল হক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এক পর্যায়ে তাতে ফুলতলীর পীর সাহেব মাওলানা আব্দুল লতিফ চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবি ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, প্রাক্তন এমপি আব্দুল মুকিত খান সম্পৃক্ত হন। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য্য ও রাষ্ট্রপতি হস্তক্ষেপ করেন এবং বিতর্কিত নামকরণ বাতিল ঘোষণা করা হয়। 

(চলবে)

লেখক:
ভাইস-প্রিন্সিপাল, শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া কামিল (এম.এ) মাদরাসা,
পাঠানটুলা, সিলেট।


শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here