Wednesday, May 6, 2020

আমার নামাজ আমার অনুভুতি


 
।। মুন্সি আব্দুল কাদির।।

নামাজ বান্দা আল্লাহর মধ্যে একক আলাপের সেতু বন্ধন। যেখানে আরো কারো কথা বলা হয় না। কোন আল্লাহ ওয়ালার দোহাই দেওয়া হয় না। অন্য কোন নেক আমলের কথা ভাবা হয় না। নিজেকে হীন থেকে হীনতর ভাবা হয়। নিজের দুনিয়াবী অহংকার, দেমাগ ভুলে গিয়ে মাওলার কাছে মাথা নত করে দেই। মন এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ালেও একমাত্র মাওলার কাছেই মাথা লুটিয়ে দেই। তাইতো প্রতিদিন মাওলা আমাকে তাঁর নিকট হাজিরা দেওয়ার জন্য পাঁচবার ডেকে নেন। আমি যেন তাঁর সামনে লুটিয়ে পড়ি, এই লুটিয়ে পড়া তাঁর নিকট খুব প্রিয়। পরকালেও এই নামাজের হিসাবই সবার আগে নেওয়া হবে। 

যার নামাজের হিসাব ঠিক হয়ে যাবে তার অন্যান্য হিসাব সহজ করে দেওয়া হবে। আর যে নামাজে আটকিয়ে যাবে। তার অন্যান্য নফল নামাজে খুঁজে দেখা হবে। নফল দিয়ে ফরজের ঘাটতি পূরণ করা হবে। তাইতো আল্লাহর প্রিয়গণ নামাজের ব্যাপারে সবচেয়ে সচেতন ছিলেন, যত্মশীল ছিলেন। নামাজে দাঁড়াতেন খুব আদবের সাথে। নামাজে তাদের নড়াচড়া থেমে যেত। মগ্ন হয়ে যেতেন মাওলার এশকে। চিন্তা করুন নামাজে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পা ফুলে যেত। মৃত্যুর পূর্বক্ষণেও বার বার নামাজের কথা বলেছেন। 

আবু বকর সিদ্দিক রাঃ আনহু কাঁদতে থাকতেন। মুয়াবিয়া ইবনে খুদাইজ রাঃ ওমর রাঃ এর নিকট প্রশ্ন করলে ওমর রাঃ মুয়াবিয়া ইবনে খুদাইজ রাঃ কে বলেন, হে মুয়াবিয়া আমি যদি দিনে ঘুমাই তাহলে তো আমি আমার প্রজাদেরকে ধ্বংস করে ফেলব আর যদি রাতে ঘুমাই তবে আমি নিজেকে ধ্বংস করে ফেলব। উসমান রাঃ রাতের শুরুতে একটু ঘুমাতেন আর বাকি সারা রাত ইবাদতে কাটাতেন। 

হজ্জের সময়ে হাজরে আসওয়াদের পাশে দাঁড়িয়ে এক রাকাত নামাজেই পুরো কোরআন খতম করতেন। আলী রাঃ আশতারে নাখালী বলেন, একবার গভীর রাত আমি আলী রাঃ এর নিকট গেলাম। দেখলাম তিনি নামাজে মশগুল। আমি আলী রাঃ লক্ষ্য করে বললাম, দিনে রোজা রাখা, রাতে জাগরণ, অন্য সময় দৌড়ঝাঁপ করেন কী করে? আলী রাঃ জবাব দিলেন, যেহেতু আখেরাতের সফর অনেক দীর্ঘ তাই রাতের আঁধারে তা অতিক্রম করার জন্য সামান্য কসরত করছি মাত্র। ইমাম আবু হানিফা রাহঃ ইবাদাত সম্পর্কে ইমাম যাহাবী রাহঃ বলেন, ইমাম আবু হানিফার তাহাজ্জুদ গুযারী এবং রাত্রি জাগরণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, রাত জেগে নামাজে দাঁড়িয়ে থাকার কারনে মানুষ তাঁকে খুঁটি বলতেন।
 
আমি প্রতি রাকাতেই মাওলাকে বলতে থাকি সিরাতাল্লাজিনা আন আমতা আলাইহিম। অথচ সবচেয়ে নেয়ামত প্রাপ্ত আল্লাহ তায়ালার প্রিয়, দুনিয়ায় থাকতেই জান্নাতের সুসংবাবদ প্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদিনগণের নামাজের দিকে তাকানোর ফুসরৎ পাই না। নামাজে তারা কী স্বাদ পেতেন? নামাজের মাধ্যমে তারা আল্লাহ তায়ালার নৈকট্যে ডুবে যেতেন। হারিয়ে যেতেন পৃথিবীর সব জঞ্জাল থেকে। যেন তারা এই দুনিয়ায় নেই। মাওলার সাথে কথা বলায় তারা এক্কেবারে বিভোর হয়ে যেতেন। যেন অনেক আশার প্রেমাস্পদকে কাছে পেয়েছেন। তাঁর থেকে আর সরে যেতে মন চাচ্ছে না। 

ওমর রাঃ একদিন একটি বাগান দেখতে গেলেন, ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেল। এসে দেখলেন জামাত হয়ে গেছে। এই অনুতাপে তিনি তৎক্ষণাত এই বাগানটি দান করে দিলেন। যে যেই বাগান আমার নামাজে দাড়াতে বিলম্ব করে দিয়েছে। তাকে আর রাখা যায় না। তিনি তো বিক্রয় করে দিতে পারতেন। কিন্তু না কাফফারা আদায় করে দিলেন। আর আমার অবস্থা কী? আমার কি খানিকটাও লজ্জা আসা উচিত নয়। যে বার বার পড়ছি, মাওলার কাছে চাচ্ছি, সিরাতাল্লাজিনা আন আমতা আলাইহিম। কিন্তু তাঁদের মত হওয়ার জিকির ও ফিকির আমার মধ্যে সামান্যতম নেই। দুনিয়ার উপকারী, লাভজনক ছোট একটি কাজ আমার হাতে থাকলেও জামাতে হাজির না হওয়ার ফন্দি আটতে থাকি। উজর পেশ করতে থাকি। আফসোস! আল্লাহ তায়ালা যদি আমাকে বলেন, যে তুমিতো সিরাতাল্লাজিনা আন আমতা আলাইহিম প্রতিদিন প্রতি রাকাতে পড়তে সে পড়া অনুযায়ী এই পথে চলেতে চেয়েছ কি না? চেষ্টা করেছ কি না? আসলে আমি কি সেদিন কোন জবাব দিতে পারব?

আমার মধ্যে আরো একটি রোগ পেয়ে বসেছে, যখন কোথাও কয়েকজন ভাই থাকি কোন আলাপ আলোচনায় বা কোন প্রোগ্রামে। ওদিকে জামাত হাজির। পাশেই মসজিদে জামাত শুরু হতে যাচ্ছে। তখন প্রোগ্রাম বা আলাপ আলোচনাই আমার কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে। এখানেও আমি সুযোগ খুঁজতে থাকি, আমরা কয়েকজন আছি পরে জামাত পড়ে নেব। আসলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে, খোলাফায়ে রাশেদীনদের যুগে কি এরূপ হয়েছে

আমি আমার প্রয়োজনের চেয়ে নামাজের গুরুত্ব বেশী দিচ্ছি না। অথচ প্রতি রাকাতে তোতা পাখির মত আউড়াতে থাকি সিরাতাল্লাজিনা আন আমতা আলাইহিম। আজ আমার চিন্তায় আসা উচিত আমার পড়ার সাথে আমার কাজের মিলের দিকে। পুরোটা জীবনইতো সিরাতাল্লাজিনা আন আমতা আলাইহিম পড়েই গেলাম কিন্তু তাঁদের মত হতে চাইলাম না, চেষ্টা করলাম না। আর কত বেখেয়াল আর গাফেল থাকব? যে কোন সময় আজরাইল এসে হানা দিবে। তখন দম ফেলানোর মত কোন ফুসরৎ পাওয়া যাবে না।
লেখকঃ 
কবি ও প্রাবন্ধিক
সিনিয়র অফিসার ও জিবি ইনচার্জ
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ



শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here