।। প্রফেসর ডক্টর সৈয়দ মাকসুদুর রহমান।।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে প্রথম প্রতিষ্ঠিত
বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া বাংলাদেশে। এ বিশ্ববিদ্যালয়
যখন মাত্র ১১টি বিভাগ চালু ছিল। তখন আল হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ ১২তম বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে । ১৯৯১-৯২
সেশনে মাত্র ৬০জন ছাত্র ছাত্রী ভর্তি করার মাধ্যমে বিভাগের যাত্রা শুরু হয়।
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যার (রহ.) এ বিভাগের
৯ম শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। আমি এবং আমার এক সহকর্মী খন্দকার কবির উদ্দীন ২০০১ সালে
১২ই এপ্রিল এ বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি। তখন এ বিভাগের সভাপতি ছিলেন বরেণ্য
শিক্ষাবিদ ও আমার শিক্ষক ড. মুহাম্মদ রুহুল আমীন স্যার। বিভাগীয় প্রথম সভায় অত্যন্ত
হাস্যজ্জল চেহারায় অভিনন্দন জানান এ প্রিয় মানুষটি। এরপর আমাদের একসাথে চলার দীর্ঘ
ইতিহাস।
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যার (রহ.) প্রায় ১৮ বছর এ বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তার জীবনের
যত ভালোবাসা এ বিভাগকে বিলিয়ে দেন। নিজ দায়িত্ব
পালন করার পাশাপাশি বিভাগের অনেক বিষয়ে অবদান রাখতে সক্ষম হন। আবিষ্কার করেন অসংখ্য
মেধাবী ও গবেষক ছাত্র ছাত্রী। অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদবি
অধ্যাপক পদে উন্নীত হন।
১৯৯৮ সালে 'ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
কুষ্টিয়া এর 'আল-হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৯ সালে
তিনি একই বিভাগে প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ১১মে ২০১৬ মাগুরায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায়
তিনি মারা যান। ব্যক্তি জীবনে তিনি অত্যন্ত সদালাপী, বিনয়ী, হাস্যোজ্জল মুসলিম
উম্মাহর জন্য অত্যন্ত দরদী ছিলেন।
তিনি অত্যন্ত মুখলিস
একজন আলিম ছিলেন। ছাত্রদের সর্বদা নিয়ত সহিহ করার পরামর্শ দিতেন। মুসলিম জাতির
কল্যাণ কামনার তাগিদ দিতেন। অপরের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। মুসলিম জাতির ঐক্য
প্রতিষ্ঠিত করতে সর্বদা চেষ্টা করতেন। জাতির যুগ সচেতন, ভারসাম্যপূর্ণ, উম্মাহর ঐক্য ভাবনায়
বিভোর, প্রাজ্ঞ ও পণ্ডিত হিসেবে সব মহলে
সমাদৃত হয়েছিলেন।
এই দীর্ঘ যাত্রা পথের যাত্রী ছিলেন বিভাগের সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ
ও ছাত্র ছাত্রীরা। আমার স্মৃতিচারণ অনেক আনন্দ এবং বেদনার। বলা বাহুল্য এ ঐতিহ্যবাহী বিভাগের বরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যার (রহ.) সর্ব প্রথম মতুবরণ করেন। তিনি মারা যাওয়ার পর বিভাগীয়
ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীদের এবং ছাত্র ছাত্রীদের এক অব্যক্ত বেদনার যন্ত্রনা উপলব্ধি লক্ষ্য করা যায়। এ প্রিয় মানুষটিকে এভাবে হারানোর কথা কেউ চিন্তা করতে পারিনি। তার শূন্যতা বোধ হবে
অনন্তকাল এ বিভাগের জন্য।
আমার যত স্মৃতি আছে এ সল্প পরিসরে উপস্থাপন করা সম্ভব হবে
না। সংক্ষিপ্ত পরিসরে কিছু স্মৃতি হয়তবা আমার ছাত্র ছাত্রীদের ও বাংলাদেশ এবং বিশ্বে
যারা তাকে চেনেন ও জানেন এবং তাকে নিয়ে গবেষণা করছেন তাদের জন্য উপকারে আসবে।
আমরা যোগদান করার কিছুদিন পর একাডেমিক কমিটিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আন্তর্জাতিক
সেমিনার করা হবে। একাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ড. আব্দুল্লাহ
জাহাঙ্গীর স্যার। বিষয়টি ইংরেজি ভাষায় করা হলো। চমৎকার প্রবন্ধ উপস্থাপন করলেন। উল্লেখ্য
যে ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিব। এ অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব
করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর
রহমান ।
সফল সেমিনারের জন্য সর্ব মহল থেকে প্রশংসা করা হয়। বিভাগীয়
সিলেবাস তৈরি এবং একাডেমিক ও গবেষণা কর্মে তাঁর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। বিভাগীয় বেশ
কিছু সেমিনার অনুষ্ঠিত হলে অধিকাংশ তার মতামত গুরুত্বপূর্ণ হতো। পিএইচ.ডি ডিগ্রি প্রদানের
শর্ত পূরণ করতে যে সেমিনার অনুষ্ঠিত হতো সে বিষয়ে তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য অনেকেই অপেক্ষা
করতেন। তাঁর কর্মজীবনে পরিলক্ষিত কয়েকটি গুণাবলী আলোচনা করা হলো -
১। তিনি অপ্রয়োজনীয়
কথা বলতেন না। দীর্ঘ কর্মজীবনে তাকে অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে শুনিনি।
২। তিনি, তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত
সরল সহজেই উপস্থাপন করতেন।
৩। সহকর্মীদের অত্যন্ত
সম্মান করতেন। অনেক সময় তার জুনিয়রদের স্যার হিসেবে সম্মোধন করতেন।
৪। বিভাগের কোন বিষয়ে
নিজের পান্ডিত্য উপস্থাপন করতেন না।
৫। মতের মিল না হলে
চুপ থাকতেন।
৬। অর্পিত দায়িত্ব
আমানতের সাথে পালন করতেন।
৭। আর্থিক বিষয়ের সুবিধাদির
ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না।
৮। যথাসম্ভব বিতর্ক এড়িয়ে যেতেন।
৯। কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলতেন না।
১০। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক
পদের কোন মোহ ছিল না। একবার তাকে একটা হলের প্রভোষ্ট করার প্রস্তাব দিলে তিনি বিনয়ের
সাথে অসম্মতি জানান।
১১। অফিসিয়াল কর্মকান্ডে
তিনি তদবির পছন্দ করতেন না।
১২। ইলমি বিষয়ে সবাইকে
উৎসাহ প্রদান করতেন।
১৩। বিভাগে কোন আর্থিক আদান প্রদান করতেন না।
১৪। ছাত্র-ছাত্রীদের বিষয়ের উপর দক্ষতা অর্জন করতে উদ্যোগী
করতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নের জন্য তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈদেশিক যোগাযোগ রক্ষা করতে আরব দেশের নিকট পত্র প্রেরণ করেন।
তিনি সব সময় মুসলমানদের সমস্যা ও সমাধান করার বিষয়ে চিন্তা করতেন।
আত্মপ্রচার বিমুখ এই মহান মানুষটির যখন আমরা লাশ গ্রহণ করতে
যাই তখন দেখতে পেলাম তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। আল্লাহ তা’আলা তার সকল খেদমত কবুল করুন। আল হাদীস এন্ড ইসলামিক বিভাগের
তাঁর সহকর্মীগণ এবং ছাত্র ছাত্রীদের কাছে তিনি প্রেরণার উৎসাহ হয়ে থাকবেন চিরকাল। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আমীন।
লেখকঃ
প্রফেসর,
আল-হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ, বাংলাদেশ।
0 coment rios:
You can comment here