।।
মুহাম্মদ জিয়াউর রহমান।।
ভূমিকা:
সুস্থতা আল্লাহ তাআলার অন্যতম একটি বড় নিয়ামত। মানুষের
অনিয়ম ও অসচেতনতা অসুস্থতার অন্যতম কারণ। এছাড়া আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে পরীক্ষা হিসেবেও
অনেক সময় মানুষ অসুস্থ হতে পারে। সুস্থ থাকার জন্য সাধারণত দু’টি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।
(১) প্রতিকার, অর্থাৎ অসুস্থ
হয়ে যাওয়ার পরে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হওয়া, (২) প্রতিরোধ, অর্থাৎ এমনভাবে জীবন যাপন করা যাতে রোগ তৈরিই না হয়। ইসলাম তথা কুরআন ও হাদীসে
যেসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এর উপর আমল করলে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা কমে আসবে।
আলোচ্য প্রবন্ধে কুরআন ও হাদীস এর উদ্ধৃতিসহ বর্ণনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংক্রামক
ব্যাধি ও তা প্রতিরোধ সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে।
সংক্রামক রোগ
একজন রোগীর দেহ থেকে অন্য রোগীর দেহে যে রোগ ছড়িয়ে
পড়ে তাই সংক্রামক রোগ। তা সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস, রক্ত, মল, মূত্র, থুথু ইত্যাদির মাধ্যমে অন্যের দেহে ছড়ায়।
সংক্রামক ব্যাধি সম্পর্কে ইসলামের
দৃষ্টিভঙ্গি
রোগ-ব্যাধি দেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআলা।
কাউকে আক্রান্ত করা বা মেরে ফেলার ক্ষমতা কোনো সংক্রামক ব্যাধির নেই। এ বিশ্ব জগতে
যা কিছু হয় সবই আল্লাহ তাআলার ফয়সালাতে হয়ে থাকে। এর পিছনে যেসব জিনিষকে বাহ্যিক কারণ
হিসেবে দেখা যায় এগুলো যদিও বাস্তব, তবে এসবের
কার্য ও ক্রিয়া করার ক্ষমতা আল্লাহ প্রদত্ত। আল্লাহ যদি ক্রিয়া করার ক্ষমতা না দেন
তাহলে এগুলো ক্রিয়া করতে পারবে না। যার বাস্তব উদাহরণ ইতিহাসে বিদ্যমান। আল্লাহর নবী
ইব্রাহিম আঃ কে নমরুদ কর্তৃক আগুনে নিক্ষিপ্ত করার পরও আল্লাহর হুকুম না হওয়ায় আগুন
কোনো ক্রিয়া করতে পারিনি। আমরা জানি, মানুষ নানা কারণে অসুস্থ
হয়। সংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে যাওয়াও অসুস্থতার অন্যতম কারণ হিসেবে গণ্য।
এটি একটি বাস্তব বিষয়। কিন্তু রোগের ক্রিয়া করার নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। আল্লাহ চাইলে
রোগাক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে যাওয়া লোকজন আক্রান্ত হবে অন্যথায় আক্রান্ত হবে না।
যার বাস্তব প্রমাণ আমরা দেখেতে পাচ্ছি, বর্তমান করোনা ভাইরাস
পরিস্থিতিতে। অনেকে সংস্পর্শে গিয়েও আক্রান্ত হচ্ছেন না। আমরা সংবাদ পত্রের মাধ্যমে
জানতে পারছি যে, সিলেটের প্রথম আক্রান্ত রোগী মরহুম ডা. মঈন উদ্দিন
(আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতবাসী করুক) এর পরিবারের কেউই করোনায় পজিটিভ শনাক্ত হননি।
ঠিক তেমনি গোয়াইঘাটের আক্রান্ত একজন রোগীসহ আরো অনেকে রোগীর সংস্পর্শে থেকেও তারঁ পরিবারের
কেউ আক্রান্ত নন। আবার অন্য দিকে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এসে পরিবারের সকলসদস্যসহ আরো অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন
এরকম খবরও প্রকাশিত হচ্ছে। তাই রোগের সংক্রমণের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি হাদীসে নিষেধ করা
হয়েছে।
বস্তুত শুধু রোগজীবানুর সংক্রমনেই যদি রোগ হতো তাহলে
আমরা সকলেই অসুস্থ হয়ে যেতাম; কারণ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রকারের
রোগজীবানু আমাদের দেহে প্রবেশ করছে। রোগজীবানুর পাশাপাশি মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ
ক্ষমতা, রোগ জীবানুর কর্মক্ষমতা ইত্যাদি অনেক কিছুর সমন্বয়ে মানুষের
দেহে রোগের প্রকাশ ঘটে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংক্রামক
ব্যাধি সম্পর্কে সতর্ক করে ইরশাদ করেন,
لا
يوردن ممرض على مصح
“অসুস্থকে সুস্থের মধ্যে নেওয়া হবে না (রুগ্ন
উট সুস্থ উটের কাছে নেবে না।) (সহীহুল বুখারী, খ. ৫, পৃ. ২১৭৭)
অন্য হাদীসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম বলেন,
إِذَا
سَمِعْتُمْ بِالطَّاعُونِ بِأَرْضٍ فَلَا تَدْخُلُوهَا وَإِذَا وَقَعَ بِأَرْضٍ وَأَنْتُمْ
بِهَا فَلَا تَخْرُجُوا مِنْهَا
“যদি তোমরা শুনতে পাও যে, কোনো জনপদে প্লেগ বা অনুরূপ মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তবে তোমরা তথায় গমন
করবে না। আর যদি তোমরা যে জনপদে অবস্থান করছ তথায় তার প্রাদুর্ভাব ঘটে তবে তোমরা সেখান
থেকে বের হবে না।” (সহীহুল বুখারী, খ. ৫,
পৃ. ২১৬৩)।
এভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে সংক্রমন প্রতিরোধে বিচ্ছিন্নকরণ ব্যবস্থার নির্দেশ প্রদান
করেন। মুমিন বিশ্বাস করেন যে, সকল বিষয়ের ন্যায় রোগের ক্ষেত্রেও
আল্লাহর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এজন্য সংক্রমনের ভয়ে অস্থির বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার
কোনো কারণ নেই। পাশাপাশি যে সকল রোগের বিস্তারে সংক্রমন একটি উপায় বলে নিশ্চিত জানা
যায়, সে সকল রোগের বিস্তার রোধের ও সংক্রমন নিয়ন্ত্রনের জন্য
যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ইসলাম কোনোভাবেই অসতর্ক অবস্থায় চালাফেরার অনুমতি দেয়নি।
মহান আল্লাহ স্বীয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে আমাদেরকে যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন এর যথাযথ অনুসরণ
করতে হবে।
ছোঁয়াচে বা রোগের সংক্রমণের ব্যাপারে বাহ্যত আমাদের
দৃষ্টিতে বিপরীতমুখী হাদীস পরিলক্ষিত হয়। ফলে কেউ কেউ মনে করেন ইসলামের দৃষ্টিতে সংক্রামক
ব্যাধি বলতে কিছু নেই, আবার কেউ কেউ মনে করেন সংক্রামক ব্যাধি বিদ্যমান।
এ সম্পর্কিত একটি হাদীস উল্লেখ করা হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لا
عدوى ولا صفر ولا هامة ) . فقال أعرابي يا رسول الله فما بال إبلي تكون في الرمل كأنها
الظباء فيأتي البعير الأجرب فيدخل بينها فيجربها ؟ فقال ( فمن أعدى الأول
“সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নেই, (রোগ-ব্যাধি তার নিজস্ব ক্ষমতায় একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে লেগে যায় না),
কুলক্ষণ বলেতে কিছু নেই। সফর মাসকেও অশুভ মনে করা যাবে না এবং পেঁচা
সম্পর্কে যেসব কথা প্রচলিত রয়েছে (هَامَّةَ) তাও অবান্তর। তখন এক বেদুঈন বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমার উটগুলি হরিণীর ন্যায় সুস্থ থাকে।
এরপর একটি চর্মরোগে আক্রান্ত উট এগুলির মধ্যে প্রবেশ করার পরে অন্যান্য উটও আক্রান্ত
হয়ে যায়। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তাহলে প্রথম উটটিকে কে সংক্রমিত করল। (সহীহুল বুখারী, খ. ৫, পৃ.২১৬১)।
জাহিলী যুগের অনেকে মনে করত যে, রোগ নিজস্ব ক্ষমতায় সংক্রমিত হয় তাদের ঐ মতটিকে আলোচ্য হাদীসে বাতিল সাব্যস্ত
করা হয়েছে যে, সংক্রমনের ঐ ক্ষমতা রোগের নিজের নয়; বরং আল্লাহ প্রদত্ত। আল্লাহ চাইলে সংক্রমণ হবে অন্যথায় হবে না।
বাহ্যত দৃষ্টিতে সংক্রামক ব্যাধি বিষয়ক হাদীস পরস্পর
বিপরীতমুখী মনে হওয়ায় হাদীস বিশারদগণ সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন,
ড. মাহমুদ আত-তাহ্হান তাঁর তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস
গ্রন্থে মুখতালিফুল হাদীসের উদাহরণ যে দুইটি হাদীস উল্লেখ করেছেন তা হলো:
১. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী,
" لا عَدْوَى ولا طِيَرَةَ .... "
অর্থাৎ “ইসলামে সংক্রামক ব্যাধি ও অশুভ লক্ষণ বলতে কিছু
নেই” হাদীসটি ইমাম মুসলিম রাহ. বর্ণনা করেছেন।
২. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অপর
হাদীস-
"
فِرَّ
من المَجذْوم فِرَارَكَ من الأسَدِ "
অর্থাৎ “কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত
ব্যক্তি থেকে এভাবে পালাও, যেভাবে তুমি সিংহ দেখে পালাবে”। হাদীসটি ইমাম বুখারী রাহি. বর্ণনা করেছেন। ড. মাহমুদ আত-তাহ্হান বলেন,
. فهذان
حديثان صحيحان ظاهرهما التعارض ، لأن الأول ينفي العدوى ، والثاني يثبتها ، وقد جمع
العلماء بينهما ووفقوا بين معناهما على وجوه متعددة ، أذكر هنا ما اختاره الحافظ ابن
حجر ، وٌمفادٌه ما يلي :
كيفية
الجمع:
وكيفية
الجمع بين هذين الحديثين أن يقال : أن العدوى منفية وغير ثابتة ، بدليل قوله صلى الله
عليه وسلم : " لا يٌعْدِي شيء شيئاً "
وقوله
لمن عارضه بأن البعير الأجرب يكون بين الإبل الصحيحة فيخالطها فتجرب : " فمن أعدى
الأول ؟
"
يعني
أن الله تعالى ابتدأ ذلك المرض في الثاني كما ابتدأه في الأول . وأما الأمر بالفرار
من المجذوم فمن باب سدِّ الذرائع ، أي لئلا يتفق للشخص الذي يخالط ذلك المجذوم حصول
شيء له من ذلك المرض بتقدير الله تعالى ابتداء لا بالعدوى المنفية ، فيظن أن ذلك كان
بسبب مخالطته له ، فيعتقد صحة العدوى ، فيقع في الإثم، فأٌمِرَ بتجنب المجذوم دفعاً
للوقوع في هذا الاعتقاد الذي يسبب الوقوع في الإثم
অর্থাৎ ‘উপরিউক্ত দুইটি হাদীসই সহীহ। তবে উভয় হাদীসে
মধ্যে স্পষ্ঠভাবে দ্বন্দ্ব দেখা যায়। কারণ প্রথমোক্ত হাদীস সংক্রামক ব্যাধিকে নাকচ
করে দেয়, পক্ষান্তরে দ্বিতীয় হাদীসটি তা প্রতিষ্ঠিতি করে। ওলামায়ে
কেরাম উভয় হাদীসকে একত্রিত করে দুইটি অর্থের মাঝে বিভিন্নভাবে সমন্বয় সাধন করেছেন।
হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী রাহি. যেসব অর্থ গ্রহণ করেছেন তা এখানে উল্লেখ করছি। এর
সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ:
সমন্বয় সাধন পদ্ধতি
এ দুইটি হাদীসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার পদ্ধতি
(প্রথমত) এ কথা বলা যায় যে, সংক্রামক ব্যাধি মূলত প্রত্যাখ্যাত ও অপ্রতিষ্ঠিত।
এর দলীল হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী। তিনি বলেছেন,
কোনো কিছু অন্য কোনো কিছুকে সংক্রমিত করতে পারে না। তাঁর এ বাণী ঐ ব্যক্তির
জন্য প্রযোজ্য, যে এ মতের বিরোধী। কারণ একটি চর্মরোগে আক্রান্ত
উটকে একটি সুস্থ উটের সাথে রাখলে এবং অসুস্থ উটটি সুস্থ উটটির সাথে মেলামেশা করলে,
সে সুস্থ উটটি রোগে আক্রান্ত হয় বা সংক্রমিত হয়। তখন প্রশ্ন উঠে যে,
তাহলে প্রথমটিকে কে সংক্রমিত করল অর্থাৎ মহান আল্লাহ যেমনিভাবে প্রথম
উটটির মাঝে রোগ সৃষ্টি করেছেন তেমনিভাবে দ্বিতীয়টির মাঝে তিনিই রোগের সূচনা করেছেন।
আর কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে পলায়নের বিষয়টি উসিলার পথকে বন্ধ করার শামিল। অর্থাৎ
সে ঐ ব্যক্তির সাথে একমত না হয়, যে লোক ঐ কুষ্ঠরোগাক্রান্ত লোকের
সাথে মেলামেশা করে ঐ রোগে আক্রান্ত হলো আল্লাহর ফয়সালার কারণেই, প্রত্যাখ্যাত সেই সংক্রামক ব্যাধির কারণে নয়। কিন্তু যে ধারণা করে যে,
সে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে ঐ কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে মেলামেশার
কারণেই। এতে সে সংক্রামক ব্যাধির বিশুদ্ধতার বিষয়ে বিশ্বাস করে গোনাহে পতিত হয়। তাই
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে বিরত
থাকতে বলেছেন, যাতে সে এ বিশ্বাসে লিপ্ত হয়ে গুনাহে পতিত না হয়।
অর্থাৎ ঐ বিশ্বাস তাকে তার গুনাহে পতিত হওয়ার কারণ হয়। তাই কুষ্ঠরোগাক্রান্ত লোক থেকে
বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’ (তাইসীরু মুসতালাহিল হাদীস)
উসংহার
আল্লাহ তাআলা বিপদ আপদ, রোগ-ব্যাধি ইত্যাদির মাধ্যমে অনেক সময় পরীক্ষা করেন। আবার অনেক সময় আমাদের
কর্মদূষে নানা সমস্যায় নিপতিত হই। আল্লাহই হলেন সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা, বিপদ-আপদ থেকে মুক্তিদাতা। তাই আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই। হাদীসের নির্দেশনার
আলোকে যথাযথভাবে সচেতনতা অবলম্বন করি। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন। আমীন।
লেখকঃ
পি.এইচডি
গবেষক ও শিক্ষক
ইসলামিক
স্টাডিজ বিভাগ,
লিডিং
ইউনিভার্সিটি,
সিলেট।
ইমেইল: zia1290@gmail.com
মোবাইলঃ
01715610866
0 coment rios:
You can comment here