Thursday, May 7, 2020

উচ্চাসনে সমাসীনকারী গুণ বিনয়-নম্রতা:ইসলামী দৃষ্টিকোণ


।।প্রফেসর ডক্টর সৈয়দ মাকসুদুর রহমান।।

 ভূমিকা

বিনয় ও নম্রতা মানব জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশেষত মুসলিম হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা গুণাবলী। যারা বিনয়ী নয় তাদের জন্য আল্লাহ তাআলার প্রিয় বান্দা হওয়া সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি বিনয় হবে আল্লাহ তাআলা তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। আলোচ্য প্রবন্ধে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বিনয় বিশেষ্য পদ, মিনতি, নম্রতা
ইংরেজি ভাষায় বিন‌‌‌‌‌য় হলো, manners; modesty; amenity; politeness; meekness; manner; affability; প্রতিশব্দ, বিনয়; শালীনতা; শিষ্টতা; শ্লীলতা Phonetic (English - Bangla) আরবি ভাষায় বিনয় বলতে বুঝায়,
 التواضع هو إظهار التنزل عن المرتبة لمن يراد تعظيمه. التواضع صفة محمودة تدل على طهارة النفس وتدعو إلى المودة والمحبة والمساواة بين الناس وينشر الترابط بينهم ويمحو الحسد والبغض والكراهية من قلوب الناس. وقيل: هو تعظيم من فوقه لفضله
আলী রাদি আল্লাহ তাআলা আনহু বলেন-
أمران لا يدومان في الإنسان: شبابه وقوته.- وأمران ينفعان كل إنسان: حسن الخلق وسماحة النفس . وأمران يرفعان من شأن الإنسان: التواضع وقضاء حاجات الناس. - وأمران يدفعان البلاء: الصدقة وصلة الأرحام
অর্থ: দুটি জিনিস যা কোনও ব্যক্তিতে স্থায়ী হয় না: তার যৌবন এবং তার শক্তি। এবং দুটি জিনিস যা প্রত্যেকের উপকার করে: ভালো আচরণ এবং সহনশীলতা। এবং দুটি জিনিস যা মানুষকে উন্নত করে: নম্রতা এবং মানুষের চাহিদা পূরণ করে। এবং দু'টি জিনিস যা দুর্দশাকে চালিত করেনা: সদকা এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা

বিনয় ও নম্রতার উপকারিতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
 مَنْ أُعْطِىَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ أُعْطِىَ حَظَّهُ مِنْ خَيْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ وَمَنْ حُرِمَ حَظَّهُ مِنَ الرِّفْقِ حُرِمَ حَظَّهُ مِنْ خَيْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ.
অর্থ: যাকে নম্রতার কিছু অংশ প্রদান করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখিরাতের বিরাট কল্যাণের অংশ প্রদান করা হয়েছে। আর যাকে সেই নম্রতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখিরাতের বিরাট কল্যাণ হতে বঞ্চিত করা হয়েছে (তিরমিযী হাদীস নং ২০১৩; মিশকাত হাদীস নং ৫০৭৬)
من أعطي حظه من الرفق فقد أعطي حظه من الخير , ومن حرم حظه من الرفق فقد حرم حظه من الخير  رواه الترمذي 2013وقال حسن صحيح
قال سفيان الثوري لأصحابه : أتدرون ما الرفق؟ هو أن تضع الأمور مواضعها , الشدة في موضعها , واللين في موضعه , والسيف في موضعه , والسوط في موضعه
অর্থ: আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদি আল্লাহ তাআলা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি কি তোমাদেরকে জানাব না যে, কারা জাহান্নামের জন্য হারাম বা কার জন্য জাহান্নাম হারাম করা হয়েছে? জাহান্নাম হারাম আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী প্রত্যেক বিনয়ী ও নম্র লোকের জন্য (তিরমিযী হাদীস নং ২৪৮৮; ছহীহাহ হাদীস নং ৯৩৮) আল্লাহ তাআলা কোন পরিবারের কল্যাণ প্রদান করলে তাদেরকে বিনয় ও নম্রতা প্রদান করেন,
فعن عائشة رضي الله عنها قالت: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: إذا أراد الله عز وجل بأهل بيت خيرا أدخل عليهم الرفق. رواه أحمد وصححه الأرناؤوط.
অর্থ:আযিশা রাদি আল্লাহ তাআলা আনহা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ যখন কোন গৃহবাসীকে ভালোবাসেন তখন তাদের মাঝে নম্রতা প্রবেশ করান (ছহীহুল জামেহাদীস নং ৩০৩, ১৭০৩; সিলসিলা ছহীহা, খণ্ড-২, হাদীস নং৫২৩)

আয়িশা রাদি আল্লাহ তাআলা আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
 يَا عَائِشَةُ إِنَّ اللهَ رَفِيْقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ وَيُعْطِى عَلَى الرِّفْقِ مَا لاَ يُعْطِى عَلَى الْعُنْفِ وَمَا لاَ يُعْطِى عَلَى مَا سِوَاهُ.
অর্থ: হে আয়িশা! আল্লাহ তাআলা নম্র ব্যবহারকারী। তিনি নম্রতা পসন্দ করেন। তিনি নম্রতার দরুন এমন কিছু দান করেন যা কঠোরতার দরুন দান করেন না; আর অন্য কোন কিছুর দরুনও তা দান করেন না (মুসলিম, হাদীস নং২৫৯৩; মিশকাত, হাদীস নং ৫০৬৮)

বিনয় ও নম্রতা মানুষের অন্যতম গুণাবলী ঐবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বিনয় মানুষকে উচ্চাসনে সমাসীন করে। তাকে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিনয়ীকে মানুষ  সম্মান প্রদর্শন করে ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। যে যত বেশী বিনয়ী ও নম্র হয় সে তত বেশী উন্নতি লাভ করতে পারে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্বের সর্বোচ্চ বিনয়ী ছিলেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
 وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيْمٍ 
অর্থ: আর নিশ্চয়ই তুমি সুমহান চরিত্রের অধিকারী’ (সুরা আন কলাম, আয়াত :৪) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ - فَإِنْ عَصَوْكَ فَقُلْ إِنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تَعْمَلُونَ
অর্থ: এবং মুমিনদের মধ্য থেকে যারা তোমার অনুসরণ করে তাদের সাথে বিনম্র আচরণ কর। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا ۚ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
অর্থ: পবিত্র মহিমাময় তিনি , যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের বেলায় ত্ৰমণ করালেন , আল-মসজিদুল হারাম, আল-মসজিদুল আকসা পর্যন্ত , যার আশে পাশে আমরা দিয়েছি বরকত যেন আমরা তাকে আমাদের নিদর্শন দেখাতে পারি , তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সুরা বানি ইসরাইল, আয়াত:১) আয়াত থেকে আমরা জানতে পারি যে,
 وحِكم أخرى ولطائف في تشريفه صلوات الله وسلامه عليه وتكريمه؛ إذ رأى في الملأ الأعلى ما لا عين رأت، وسمع ما لا أذن سمعت؛ واستمتع بما لم يخطر على قلب بشر، وحسبكم أن احتفلت بمقدمِه ملائكة السماء، وأوحى إليه ما أوحى، ففرض عليه الصلوات المكتوبة، خمسين في الأجر، وخمسًا في الأداء.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পৃথিবী থেকে সাত আকাশের বাধা অতিক্রম করিয়ে  আল্লাহ তাআলা এই যে কাছে নিয়ে গেলেন, এরপর আবার তিনি ফিরেও এলেন এই পৃথিবীতে, জানা কথা, এই সম্মান কেবলই তাঁর। নবী হযরত মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন বলে তিনি পরিচিত মূসা কালীমুল্লাহনামে। কিন্তু কথা বলার জন্যে একেবারে কাছে ডেকে নেয়া-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিশেষ সম্মান। তিনি আল্লাহ তাআলার বান্দা ও তার প্রেরিত রাসূল। এ দাসত্বের গুণ যে যতটা বেশি হাসিল করতে পারবে, মহান প্রভুর সামনে সে নিজেকে ততটাই তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র জ্ঞান করবে। নিজেকে এভাবে তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র মনে করার নামই বিনয়। বান্দা খাঁটি মনে বিশ্বাস করবে, আমার যা কৃতিত্ব এর কিছুই আসলে আমার নয়, এসবই আমার প্রতি আমার আল্লাহর দান। আমার যা সম্পদ এগুলো আসলে কিছুই আমার অর্জন নয়, সবই আল্লাহ আমাকে দান করেছেন।

দুনিয়াতে প্রাপ্ত সবকিছুকেই যখন আল্লাহ তাআলার নিআমত হিসেবে কেউ মেনে নেবে, তখন অনিবার্যভাবেই সে হয়ে উঠবে কৃতজ্ঞ ও বিনয়ী। আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগিতে যখন বিনয় ও কৃতজ্ঞতার পরশ থাকবে, সকল প্রাপ্তিকেই যখন সে কেবলই আল্লাহর দান বলে মেনে নেবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সে মুক্ত থাকবে অহংকার ও বড়াই থেকে। অবচেতনভাবেই তার আচার-আচরণ হবে বিনয় ও নম্রতায় পূর্ণ।
সে আল্লাহর দান বলে বিশ্বাস করবে, তার স্তরে উন্নীত নয় এমন কাউকে দেখে তখন তার মনে অহংকারের পরিবর্তে যোগ হবে কৃতজ্ঞতার এক নতুন মাত্রা। পরম বিনয়ে সে মনে মনে বলবে- সকল কৃতজ্ঞতা সেই আল্লাহ তাআলার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
 روى أبو هريرة عن الرسول عليه الصلاة والسلام أنه قال: (ما نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِن مالٍ، وما زادَ اللَّهُ عَبْدًا بعَفْوٍ، إلَّا عِزًّا، وما تَواضَعَ أحَدٌ لِلَّهِ إلَّا رَفَعَهُ اللَّهُ) صحيح مسلم
অর্থ: আবু হুরায়রা রাদি আল্লাহ তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহর জন্যে যে বিনয়ী হয় আল্লাহ তাকে সমুন্নত করেন; তখন সে নিজের চোখে তুচ্ছ হলেও মানুষের চোখে অনেক বড় বিবেচিত হয়। (শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস নং ৭৭৯০) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
في الحديث الذي رواه عياض بن حمار عن الرسول عليه الصلاة والسلام أنه قال:(إنَّ اللهَ أوحى إليَّ أن تواضَعوا حتى لا يبغيَ أحدٌ على أحدٍ، ولا يفخرَ أحدٌ على أحدٍ) [صحيح أبي داود| خلاصة حكم المحدث: صحيح
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
, فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللّهِ لِنتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لاَنفَضُّواْ مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللّهِ إِنَّ اللّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ
অর্থ: আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করুন এবং কাজে কর্মে তাদের পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহ তা'আলার উপর ভরসা করুন আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদের ভালোবাসেন। (সুরা ইমরান, আয়াত: ১৫৯) অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِيْنَ لَا يُرِيْدُوْنَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلاَ فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِيْنَ
অর্থ: এটা আখিরাতের নিবাস যা আমি নির্ধারণ করি তাদের জন্য যারা পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। মুত্তাক্বীদের জন্য রয়েছে শুভ পরিণাম’ (সূরা ক্বাছাছ, আয়াত: ৮৩)
পক্ষান্তরে উদ্ধত অহংকারী দাম্ভিকদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা  বলেন,
وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ۖ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ
অর্থ: অহংকার বশে তুমি মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করো না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে পদচারণা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পসন্দ করেন না’ (সূরা লোক্বমান, আয়াত:18)

এ বিনয় যখন কেউ অর্জন করবে তখন তার বাস্তবরুপ প্রকাশ পাবে তার ওঠা-বসায় কথা-বার্তায় এমনকি হাঁটা-চলায়ও। বিনয় হলো আল্লাহ তাআলার প্রকৃত বান্দাদের বৈশিষ্ট্য আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا
অর্থ: রহমান-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মুর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে, সালাম। (সুরা ফুরকান, আয়াত: ৬৩) আল্লাহ তাআলা তার বান্দাকে অহংকার করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّكَ لَنْ تَخْرِقَ الْأَرْضَ وَلَنْ تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُولًا - كُلُّ ذَلِكَ كَانَ سَيِّئُهُ عِنْدَ رَبِّكَ مَكْرُوهًا
অর্থ: পৃথিবীর বুকে উদ্ধতভাবে বিচরণ কর না। কারণ তুমি তো কখনও পদভারে ভূপৃষ্ঠ বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় কখনও পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না।” (সূরা ইসরা, আয়াত:৩৭-38)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচার-আচরণ ছিল বিনয় ও নম্রতার অনন্য দৃষ্টান্ত। মানুষের সঙ্গে তিনি যেভাবে মিশে যেতেন, তাতে অপরিচিত কেউ দেখলে চিনতেই পারত না- তিনি আল্লাহ তাআলার নাবী ও রাসূল। সমাজের অসহায় ও নিম্নশ্রেণির লোকদের কাছেও তিনি ছিলেন আপনজনদের চেয়েও বড় আপনজন। তিনি তার অমায়িক আচরণ, সদ্ব্যবহার ও সততা দ্বারা আরবের অন্ধকার আচ্ছন্ন মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা  পেয়েছেন। যে কেউ যখন তখন তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এর ব্যাপারে বলা হয়েছে,
 وكان " علي " رضي الله عنه إذا وصف النبي - صلى الله عليه وسلم - قال : كان أجود الناس كفا ، وأوسع الناس صدرا ، وأصدق الناس لهجة ، وأوفاهم ذمة ، وألينهم عريكة ، وأكرمهم عشرة ، من رآه بديهة هابه ، ومن خالطه معرفة أحبه ، يقول ناعته : لم أر قبله ولا بعده
অর্থ: আলী রাদি আল্লাহ তাআলা আনহু যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গুণ বর্ননা করতেন তখন তিনি বলতেন, তিনি ছিলেন প্রশস্ত হৃদয়-মহানুভব। সত্যবাদিতায় সর্বাগ্রে, নম্রতা আর কোমলতায় অনন্য, আচার-আচরণে অভিজাত প্রথম যে তাঁকে দেখত ভয় করত, কিন্তু যে-ই তাঁর সঙ্গে মিশতো তাঁকে ভালোবাসত। (জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৬৩৮)

কী ঘরে কী বাইরে- সর্বত্রই তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ বিনয়ের ধারক। নিজ হাতে ঘরের কাজকর্ম করতেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা.-কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি ঘরের কাজকর্ম করতেন? তিনি জবাবে বললেন :
نَعَمْ، كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْصِفُ نَعْلَهُ، وَيَخِيطُ ثَوْبَهُ، وَيَعْمَلُ فِي بَيْتِه كَمَا يَعْمَلُ أَحَدُكُمْ فِي بَيْتِه.
অর্থ, হাঁ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জুতা সেলাই করতেন, কাপড় সেলাই করতেন, ঘরের কাজকর্মও করতেন, যেভাবে তোমরা তোমাদের ঘরে কাজ করে থাক। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৫৩৪১) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
عروة عن أبيه، قال: سأل رجل عائشة هل كان النبي صلى الله عليه وسلم يعمل في بيته شيئا، قالت: نعم كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يخصف نعله ويخيط ثوبه ويعمل في بيته كما يعمل أحدكم في بيته. صححه الأرناؤوط .
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিনিয়ত কীভাবে জীবন অতিবাহিত করেছেন এ ব্যাপারে আযিশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,
 وقد سئلت عَائِشَة رضي الله عنها : " مَا كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعْمَلُ فِي بَيْتِهِ؟ فقَالَتْ: كَانَ بَشَرًا مِنَ الْبَشَرِ يَفْلِي ثَوْبَهُ ، وَيَحْلُبُ شَاتَهُ ، وَيَخْدُمُ نَفْسَهُ " .
رواه أحمد (26194) ، وصححه الألباني في "الصحيحة"
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পারিবারিক আচরণ বর্ণিত হয়েছে-
وعن أم المؤمنين عائشة -رضي الله تعالى عنها- قالت: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم:  خيركم خيركم لأهله وأنا خيركم لأهلي  أخرجه الترمذي.
অর্থ: তোমাদের মাঝে সেই উত্তম, যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। আর আমি আমার  স্ত্রীর কাছে সর্বোত্তম। -(জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৮৯৫)

কৃতজ্ঞতা আদায়
অহংকার ছাপিয়ে বিনয় ও নম্রতাকে আপন করে নিতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন  শূকরিযা আদায় করা। এ কথা অনস্বীকার্য। আবার সেই বিনয় যেন শোকরের পথ রুদ্ধ করে না দেয় সেদিকেও সচেতন দৃষ্টি কাম্য। নামায আদায়ের সময় যেমন বিনয়ের সঙ্গে দাঁড়াতে হবে প্রভুর সামনে, বিনয়ের সঙ্গেই যেমন লুটিয়ে পড়তে হবে সিজদায়, তেমনি এটাও মনে করতে হবে- আল্লাহ তাওফীক দিয়েছেন বলেই নামায পড়তে পেরেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
 عن أبي هُرَيْرَةَ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ( أَنَا سَيِّدُ وَلَدِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ، وَأَوَّلُ مَنْ يَنْشَقُّ عَنْهُ الْقَبْرُ ، وَأَوَّلُ شَافِعٍ وَأَوَّلُ مُشَفَّعٍ(.
অর্থ: আমি আদম-সন্তানের সর্দার, তবে এতে বড়াইয়ের কিছু নেই; কেয়ামতের দিন আমার কবরের মাটিই প্রথম সরানো হবে, তবে এটা বড়াইয়ের কোনো বিষয় নয়,  আমিই প্রথম সুপারিশ করব, আমার সুপারিশই প্রথম গৃহীত হবে, এতেও অহংকার করার কিছু নেই, কেয়ামতের দিন হামদের পতাকা আমার হাতে থাকবে, তবে এতেও কোনো বড়াই নেই। -(সুনানে ইবনে মাজাহ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
وروى الترمذي (3615) وحسنه ، عَنْ أَبِي سَعِيدٍ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ( أَنَا سَيِّدُ وَلَدِ آدَمَ يَوْمَ القِيَامَةِ وَلَا فَخْرَ ، وَبِيَدِي لِوَاءُ الحَمْدِ وَلَا فَخْر َ، وَمَا مِنْ نَبِيٍّ يَوْمَئِذٍ آدَمُ فَمَنْ سِوَاهُ إِلَّا تَحْتَ لِوَائِي ، وَأَنَا أَوَّلُ مَنْ تَنْشَقُّ عَنْهُ الأَرْضُ وَلَا فَخْرَ ) وصححه الألباني في" صحيح الترمذي" . أَنَا سَيِّدُ ولد آدَمَ، وَلاَ فَخْرَ، وَأَنَا أَوَّلُ مَنْ تَنْشَقُّ الأَرْضُ عَنْهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَلاَ فَخْرَ، وَأَنَا أَوَّلُ شَافِعٍ، وَأَوَّلُ مُشَفَّعٍ، وَلاَ فَخْرَ، وَلِوَاءُ الْحَمْدِ بِيَدِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَلاَ فَخْرَ.
একদিকে নিআমতের বর্ণনা, সঙ্গে সঙ্গে বিনয় ও নম্রতা- এ হাদীস আমাদেরকে এ শিক্ষা-ই দেয়। তাই অতিরিক্ত বিনয় প্রকাশ করতে গিয়ে এমন কোনো কথা বলা যাবে না, যা আবার শোকর ও কৃতজ্ঞতার পরিপন্থী। নামায আদায়ের পর আল্লাহ তাআলা যে তৌফিক দিলেন সেজন্যে কৃতজ্ঞ না হয়ে যদি কেউ বলে, ‘আমার এ নামায দিয়ে কী হবেকিংবা আমাদের নামায তো আসলে কোনো নামাযই নয় মনে রাখতে হবে, এ জাতীয় বিনয় আসলে শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনো কাঙিক্ষত বিষয় নয়।

দয়াময় আল্লাহর প্রকৃত বান্দা হতে চাইলে জীবনের সর্বক্ষেত্রেই প্রয়োজন- বিনয়। ইবাদত-বন্দেগি থেকে শুরু করে ঘরে-বাইরে সবার সঙ্গে আচরণে সে বিনয় অপরিহার্য। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি কামনায় নিজেকে নীচু করে দেয়ার এ প্রশিক্ষণে যে প্রশিক্ষিত হতে পারবে, অবচেতনভাবেই সম্মান তার কাছে এসে ধরা দেবে

উপসংহার
বিনয় ও নম্রতা চরিত্রের ভূষণ। যিনি যত বেশি বিনয়ী হবেন তার চরিত্রের ভালো গুণাবলী প্রকাশিত হবে। আল্লাহ তাআলার কাছে প্রিয় বান্দা হিসেবে বিবেচিত হবেন। আল্লাহ তাআলা তার মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
 عن أَنسٍ رضي اللَّهُ عنه قال: كَانَتْ نَاقَةُ رَسُول اللَّه صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم العَضْبَاءُ لاَ تُسبَقُ، أو لا تكَادُ تُسْبَقُ، فَجَاءَ أَعْرابيٌّ عَلى قَعُودٍ لهُ، فَسبقَها، فَشَقَّ ذلك عَلى المُسْلمِينَ حَتَّى عَرفَهُ النبي صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم فَقَالَ: «حَقٌّ عَلى اللَّهِ أَنْ لاَ يَرْتَفِعَ شَيء مِنَ الدُّنْيَا إِلاَّ وَضَعَهُ»
অর্থ: বিনয়ীকে মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। যে যত বেশী বিনয়ী ও নম্র হয় সে তত বেশী উন্নতি লাভ করতে পারে। এ পৃথিবীতে যারা আজীবন স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় আসন লাভ করে আছেন তাদের প্রত্যেকেই বিনয়ী ও নম্র ছিলেন।

আসুন, আমরা বিনয়ী ও নম্রতার গুণ অর্জন করি। এবং মানুষের কাছে সর্বোপরি আল্লাহর কাছে প্রিয় পাত্র হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করি। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
লেখকঃ 
প্রফেসর, 
আল-হাদীস এন্ড ইসলামীক স্টাডিজ বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,
কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ, বাংলাদেশ।


শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here