Monday, June 15, 2020

হতাশা মানব জীবনের এক ব্যাধি: আমাদের করণীয়


 
।। প্রফেসর ড সৈয়দ মাকসুদুর রহমান।।

ভূমিকা:
মানুষ স্বভাব সুলভ আশাবাদী। আগামী দিনের ঝলমলৈ সূর্য উঠার অপেক্ষায় রাতের আঁধার হাসি মূখে বরণ করে। কখনো সে প্রচন্ড আশাবাদী হয়। ধন সম্মান ও ক্ষমতা নেশা তাকে অস্বাভাবিক করে তোলে। অনেকে নিজের অজান্তেই এমনই আশাবাদী হয় যদি এর ব্যতিক্রম হয় তাহলে সে এতটা হতাশ হয় যে দুনিয়ার সবচেয়ে হতভাগা মনে করে। জয়-পরাজয়, পাওয়া-না পাওয়া, সাফলতা-ব্যর্থতা মানুষের জীবনে আসতেই পারে। তাই বলে কি হতাশ হয়ে আত্মহত্যা করতে হবে! আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। আর আত্মহত্যাকে কোনো ধর্মই সমর্থন করে না।

তার মধ্যে চলে আসে হতাশা নামক এক ব্যাধি। আস্তে আস্তে নিজেকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। সে তার পরিণতি জানে না। কোন মুমিনের মধ্যে এ অভ্যাস মোটেই কাম্য নয়। সে সর্বদাই নিজেকে আল্লাহ তাআলার নিকট সোপে দেয়।


আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
إِنَّ الْإِنسَانَ خُلِقَ هَلُوعًا
অর্থ :মানুষকে ছোট মনের অধিকারী করে সৃষ্টি করা হয়েছে৷
إِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ جَزُوعًا
অর্থ :বিপদ -মুসিবতে পড়লেই সে ঘাবড়ে যায়,
وَإِذَا مَسَّهُ الْخَيْرُ مَنُوعًا 
আর যে -ই সচ্ছলতার মুখ অর্থ :দেখে অমনি সে কৃপণতা করতে শুরু করে৷ ( সূরা আল মাআরিজ আয়াত ১৯,২০ও২১)

হতাশা কী?
হতাশা   শব্দ বিশেষ্য পদ অর্থ নৈরাশ্য, আশাভঙ্গI ব্যর্থতা, হিম, তুষার, তুহিন, তুষারপাত, তুষারপাতের কাল, হিমেল প্রভাব, জমাট অবস্থা, জমে যাওয়া, জমিয়া যাওয়া অবস্থা, হিমায়িত অবস্থা, হতাশা, তুষারকণা। ইংরেজিতে Frustration আরবিতে الإحباط এর দ্বারা আশাহত বুঝানো হয়েছে।

আলোচ্য প্রবন্ধে হতাশার কুফল এবং ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে হতাশা থেকে মুক্ত থাকার উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আরবি সাহিত্যিক বলেছেন-
مِن حقِّ نفسك عليك أنْ لا تجعلها موطنًا لليأس
অর্থ : হতাশার জায়গা না দেয়ার অধিকার আপনার আছে।
 مجموعة من المشاعر المؤلمة تنتج عن عجز الإنسان عن الوصول إلى هدف ضروريّ لإشباع حاجة ملحّة عنده.

হতাশ তিন ভাবে প্রকাশ পায়। যেমন -

*That the works be worldly (not issued by a religion), because they do not sing anything on the Day of Resurrection,

*To be worldly works that are not intended by the face of Allah

*That they are good deeds with bad deeds in excess of them, which is referred to as lightness of the balance

পরিভাষায়-
হতাশা হ'ল নিজের আকাঙ্ক্ষার পরিপূর্ণতা রোধ করার চেষ্টা। এই আকাঙ্ক্ষা ন্যায়সঙ্গত হোক বা না হোক। এর সাথে একরকম হৃদয় বিদারকতা এবং হতাশা গ্রস্থতা রয়েছে। এটি এমন একটি বেদনাদায়ক অনুভূতি যা কোনও বাধা উপস্থিতির ফলস্বরূপ হয়। যা প্রয়োজনকে সন্তুষ্ট করা বা ব্যক্তির কোনও সমস্যার সমাধান করতে বাধা দেয়।

ইংরেজি ভাষায়
psychology, frustration is a common emotional response to opposition, related to anger, annoyance and disappointment. Frustration arises from the perceived resistance to the fulfillment of an individual's will or goal and is likely to increase when a will or goal is denied or blocked.
অর্থ :
মনোবিজ্ঞান, হতাশা, রাগ, বিরক্তি এবং হতাশার সাথে সম্পর্কিত বিরোধীদের একটি সাধারণ আবেগীয় প্রতিক্রিয়া। কোনও ব্যক্তির ইচ্ছা বা লক্ষ্য পূরণের অনুভূত প্রতিরোধ থেকে হতাশার উদ্ভব হয়।  যখন কোনও ইচ্ছা বা লক্ষ্যকে অস্বীকার করা বা অবরুদ্ধ করা হয় তখন বাড়তে পারে। তখনই তাকে হতাশা বলা হয়।

আরবি ভাষায় হতাশ সম্পর্কে বলা হয়েছে-
الإحباط هو الحيلولة دُونَ تحقيقِ المرءِ رغبةً مِن رغَباتِه، سواء أكان لهذه الرغبة ما يبررها أم لا، ويصاحب ذلك ضرب من الحسرة وخيبة الأمل. وهو مجموعة من مشاعر مؤلمة تنتج عن وجود عائق يحول دون إشباع حاجة من الحاجات أو معالجة مشكلة من المشكلات لدى الشخص
মূলতঃ কোন জিনিস একান্ত পাওয়ার আশা করা এবং ব্যর্থ হয়ে নিজেকে অথর্ব ভেবে সকল কিছু ত্যাগ করা।
 هو إعاقة المرء عن بلوغ هدف ما، وسدّ الطّريق الّتي يسلكها نحو الوصول إلى هدفه، سواء أكان السّعي نحو الهدف سعيا واعيا أو غير واع

সলামী দৃষ্টিকোণ:
পৃথিবীর এ জীবনে  মানুষের বিপদ আসেই। নানান সময় নানান প্রতিকুলতা দিক থেকে বিপদ এসে হামলে পড়ে মানুষের ওপর। অর্থসম্পদ সন্তানাদি সম্মান-মর্যাদা-আক্রান্ত হয় সবকিছুই। দুনিয়ার জীবনে এ বিপদের মুখে পড়ার কথা  আর আল্লাহ তাআলা এর মাধ্যমে মানুষের পরীক্ষা নেন। আর আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
 وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ
"নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে কিছু ভয় ও ক্ষুধা, জান ও মাল এবং ফসলের ক্ষতির মাধ্যমে পরীক্ষা করব। (হে পয়গম্বর!) আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন।"(২:১৫৫)

এই আয়াতে আমারা বলতে পারি যে, বিপদ আসবেই। বিপদের মুহূর্তে কী করতে হবে সেই নির্দেশনাও দেয়া আছে এ আয়াতে। কিন্তু বিপদ যখন কিছুটা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তা কেটে যাওয়ার মতো কোনো স্বাভাবিক সম্ভাবনা যখন মানুষের সামনে থাকে না। মানুষ তাৎক্ষণিক লাভ ও লোকসান হিসাবে ব্যস্ত থাকে তখন আঘাত হানে হতাশা। হতাশা তাকে আল্লাহর রহমতের কথা ভুলিয়ে দিতে চায়। আল্লাহর কুদরত থেকে তার দৃষ্টিকে সরিয়ে দিতে চায়।  দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি নিকটবর্তী আপনজন ও ভূলে থাকতে চায় । আল্লাহর সীমাহীন অনুগ্রহ এবং দয়াকে আড়াল করে দিতে চায়। অথচ পবিত্র কুরআনের ভাষ্য মতে-মুমিন কখনোই হতাশ হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
অর্থ :"তোমরা নিরাশ বা মন ভাঙ্গা হয়ো না, দুঃখিত হয়ো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মুমিন হও।" (৩:১৩৯)
ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন বার্ধক্যে উপনীত, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে একদল ফেরেশতা এসে তখন তাঁকে এক জ্ঞানী পুত্রের সুসংবাদ শোনালেন। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম জিজ্ঞেস করলেন- আমাকে তো বার্ধক্য পেয়ে বসেছে, এরপরও তোমরা আমাকে এ সুসংবাদ দিচ্ছ?!  আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَامْرَأَتُهُ قَآئِمَةٌ فَضَحِكَتْ فَبَشَّرْنَاهَا بِإِسْحَاقَ وَمِن وَرَاء إِسْحَاقَ يَعْقُوبَ
তাঁর স্ত্রীও নিকটেই দাড়িয়েছিল, সে হেসে ফেলল। অতঃপর আমি তাকে ইসহাকের জন্মের সুখবর দিলাম এবং ইসহাকের পরের ইয়াকুবেরও। [ সুরা হুদ ১১:৭১ ]
قَالَتْ يَا وَيْلَتَى أَأَلِدُ وَأَنَاْ عَجُوزٌ وَهَـذَا بَعْلِي شَيْخًا إِنَّ هَـذَا لَشَيْءٌ عَجِيبٌ
সে বলল-কি দুর্ভাগ্য আমার! আমি সন্তান প্রসব করব? অথচ আমি বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছি আর আমার স্বামীও বৃদ্ধ, এতো ভারী আশ্চর্য কথা। [ সুরা হুদ ১১:৭২ ]
قَالُواْ أَتَعْجَبِينَ مِنْ أَمْرِ اللّهِ رَحْمَتُ اللّهِ وَبَرَكَاتُهُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الْبَيْتِ إِنَّهُ حَمِيدٌ مَّجِيدٌ
তারা বলল-তুমি আল্লাহর হুকুম সম্পর্কে বিস্ময়বোধ করছ? হে গৃহবাসীরা, তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত ও প্রভুত বরকত রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ প্রশংসিত মহিমাময়। [ সুরা হুদ ১১:৭৩]

নাবী ইয়াকুব আলাইহিস সালামের সর্বাধিক প্রিয় সন্তান ছিলেন নাবী ইউসুফ আলাইহিস সালাম। কিন্তু তাঁর ভাইয়েরা বাবার এই আদরকে সহজে মেনে নিতে পারেনি, তাই কৌশলে তাঁকে একদিন বাবার কাছ থেকে নিয়ে গিয়ে কূপে ফেলে দিল। প্রিয় সন্তানের এ দুরবস্থায় তিনি হতাশ হলেন না।
يَا بَنِيَّ اذْهَبُواْ فَتَحَسَّسُواْ مِن يُوسُفَ وَأَخِيهِ وَلاَ تَيْأَسُواْ مِن رَّوْحِ اللّهِ إِنَّهُ لاَ يَيْأَسُ مِن رَّوْحِ اللّهِ إِلاَّ الْقَوْمُ الْكَافِرُونَ
অর্থ :বৎসগণ! যাও, ইউসুফ ও তার ভাইকে তালাশ কর এবং আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহর রহমত থেকে কাফের সম্প্রদায়, ব্যতীত অন্য কেউ নিরাশ হয় না। [ সুরা ইউসুফ ১২:৮৭ ] 

 এ ছাড়া এ ব্যাপারে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু  বর্ণিত হাদীস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন, ‘হাবরু হাযিহিল উম্মাহ-এই উম্মতের বিদ্বান ব্যক্তি। তিনি বলেছেন, ‘সবচেয়ে বড় কবিরা গোনাহ হচ্ছে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে র্শিক করা, আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া আর আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে পড়া। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ১৯৭০১) অন্য এক হাদীসে এসেছে
عبد الله بن مسعود رضي الله عنه قال: سألت رسول الله صلى الله عليه وسلم أي الذنب أعظم عند الله؟ قال: أن تجعل لله نداً وهو خلقك، قال: قلت له: إن ذلك لعظيم، قال: قلت: ثم أي؟ قال: ثم أن تقتل ولدك مخافة أن يطعم معك، قال: قلت: ثم أي؟ قال: ثم أن تزاني حليلة جارك


হতাশ হতে নিষেধ:
আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাকে হতাশ হতে নিষেধ করে বলেন-
, قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِن رَّحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
অর্থ :বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [ সুরা যুমার ৩৯:৫৩ ]

বিপদে পড়লে মানুষ যে কীভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এর কিছু বর্ণনা পবিত্র কুরআনেও আছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَ اِذَاۤ اَنْعَمْنَا عَلَی الْاِنْسَانِ اَعْرَضَ وَ نَاٰ بِجَانِبِهٖ  وَ اِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ كَانَ یَـُٔوْسًا.
আমি মানুষকে যখন কোনো নিআমত দিই তখন সে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও পাশ কাটিয়ে যায়। আর যদি কোনো অনিষ্ট তাকে স্পর্শ করে তাহলে সে সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে পড়ে!  (সূরা বনী ইসরাঈল - ৮৩)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন -
إِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِعَبْدِهِ الخَيْرَ عَجَّلَ لَهُ العُقُوبَةَ فِي الدُّنْيَا، وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِعَبْدِهِ الشَّرَّ أَمْسَكَ عَنْهُ بِذَنْبِهِ حَتَّى يُوَافِيَ بِهِ يَوْمَ القِيَامَةِ.
অর্থ :আল্লাহ যখন তাঁর বান্দার কল্যাণ চান তখন দুনিয়াতে তার শাস্তি ত্বরান্বিত করেন, আর যখন কোনো বান্দার অকল্যাণ চান তখন তার পাপগুলো রেখে দিয়ে কিয়ামতের দিন তাঁর প্রাপ্য পূর্ণ করে দেন। (জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৯৬) আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন-
وَالَّذِينَ كَذَّبُواْ بِآيَاتِنَا وَلِقَاء الآخِرَةِ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ هَلْ يُجْزَوْنَ إِلاَّ مَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ
বস্তুতঃ যারা মিথ্যা জেনেছে আমার আয়াতসমূকে এবং আখেরাতের সাক্ষাৎকে, তাদের যাবতীয় কাজকর্ম ধ্বংস হয়ে গেছে। তেমন বদলাই সে পাবে যেমন আমল করত। [ সুরা আরাফ ৭:১৪৭ ]
অর্থ : যে ব্যক্তি পার্থিবজীবন ও তার চাকচিক্যই কামনা করে, হয় আমি তাদের দুনিয়াতেই তাদের আমলের প্রতিফল ভোগ করিয়ে দেব এবং তাতে তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হয় না।
أُولَٰئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ إِلَّا النَّارُ ۖ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
অর্থ : এরাই হল সেসব লোক আখেরাতে যাদের জন্য আগুন ছাড়া নেই। তারা এখানে যা কিছু করেছিল সবই বরবাদ করেছে; আর যা কিছু উপার্জন করেছিল, সবই বিনষ্ট হল। নানা কারণেই মানুষ হতাশায় আক্রান্ত হতে পারে। বিপদে যদি কেউ ধৈর্যধারণ করতে না পারে তখন দেখা যায়- সামান্য সংকটেই সে ভেঙ্গে পড়ে। কখনো হতাশাগ্রস্তদের সঙ্গও আরেকজনকে হতাশ করে দেয়। নিজে হতাশ হওয়া এবং অন্যদের হতাশ করা মুমিনের কাজ হতেই পারে না।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاء مَّنثُورًا
আমি তাদের কৃতকর্মের প্রতি মনোনিবেশ করব, অতঃপর সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধুলিকণারূপে করে দেব। [ সুরা ফুরকান ২৫:২৩ ]


তাই কেউ যদি হতাশাগ্রস্তদের সঙ্গে ওঠাবসা করে, তাহলে এই হতাশায় একসময় সেও আক্রান্ত হবেই। কখনো আবার প্রত্যাশার পাহাড়ও মানুষকে হতাশ করে। নিজের জীবন নিয়ে কিংবা জীবনের কোনো দিক নিয়ে যখন কেউ নিজ সামর্থ্যরে বিবেচনা না করে অনেক উঁচু স্বপ্ন দেখতে থাকে, এর পরিণতিতেও সে হতাশাগ্রস্ত হতে পারে। একের পর এক যখন আশাভঙ্গ হতে থাকে, তখন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে সে। আবার এমনও হয়- আকস্মিক কোনো বিপদ কাউকে এতটাই ঝাঁকুনি দেয়, যার ফলে সে আর মাথা সোজা করে সামনে এগিয়ে চলার হিম্মত করতে পারে না। পরিণামে কেবলই হতাশা। আল্লাহ বলেন-
أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آَمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ - وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ

"আলিফ-লাম-মীম" (২৯:১) মানুষ কি মনে করে যে, শুধু আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি বললেই আমাদের ছেড়ে দেয়া হবে এবং তাদের পরীক্ষা করা হবে না?" (২৯:২) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي كَبَدٍ
নিশ্চয় আমি মানুষকে শ্রমনির্ভররূপে সৃষ্টি করেছি।

أَيَحْسَبُ أَن لَّن يَقْدِرَ عَلَيْهِ أَحَدٌ
সে কি মনে করে যে, তার উপর কেউ ক্ষমতাবান হবে না ?

হতাশা যে কেবল পার্থিব বিষয়াদিকেই আক্রান্ত করে এমন নয়, দ্বীনী ও পরকালীন বিষয়েও মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়। কারও যখন পাপের পরিমাণ বেশি থাকে, সারাদিন যখন কেউ বড় বড় পাপে ডুবে থাকে, যখন নিজেও পাপ করে, অন্যকেও পাপের দিকে ডাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
عنه أنس بن مالك - رضي الله عنه - : (إِنَّ عِظَمَ الْجَزَاءِ مَعَ عِظَمِ الْبَلاءِ، وإِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ إِذَا أَحَبَّ قَوْمًا ابْتَلاهُمْ، فمَنْ رَضِيَ فَلَهُ الرِّضَا، وَمَنْ سَخِطَ فَلَهُ السَّخَطُ) رواه الترمذي وحسنه.
সত্যি, বড় পুরস্কার তো বড় বিপদের সঙ্গেই রয়েছে। আর আল্লাহ যখন কোনো সম্প্রদায়কে ভালোবাসেন তখন অবশ্যই তাদের পরীক্ষায় ফেলেন। তখন যে সন্তুষ্ট থাকে তার জন্যেই তাঁর সন্তুষ্টি, আর যে অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে তার প্রতি তাঁরও অসন্তুষ্টি।

একই কথা পার্থিব সংকট নিয়েও। এখানকার কোনো সংকটই স্থায়ী নয়। দুনিয়াই যেখানে ক্ষণস্থায়ী, সেখানে এসব সংকট স্থায়ী হবে কীভাবে? আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
فَاِنَّ مَعَ الْعُسْرِ یُسْرًا  اِنَّ مَعَ الْعُسْرِ یُسْرًا.
অর্থ :কষ্টের সঙ্গেই তো স্বস্তি আছে। অবশ্যই কষ্টের সঙ্গেই স্বস্তি আছে। -সূরা আলাম নাশরাহ (৯৪) : ৫-৬

অন্ধকার দূর হবে অবশ্যই আলো আসবে এ জন্য হতাশ হয়ে কিছু হবে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
اَمَّنْ یُّجِیْبُ الْمُضْطَرَّ اِذَا دَعَاهُ وَ یَكْشِفُ السُّوْٓ ءَ وَ یَجْعَلُكُمْ خُلَفَآءَ الْاَرْضِ، ءَاِلٰهٌ مَّعَ اللهِ، قَلِیْلًا مَّا تَذَكَّرُوْنَ.
অর্থ :বরং তিনি, যিনি অসহায়ের আহ্বানে সাড়া দেন, যখন সে তাঁকে ডাকে এবং তিনি বিপদাপদ দূর করে দেন আর পৃথিবীতে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করেন। আল্লাহর সঙ্গে কি অন্য কোনো মাবুদ আছে? তোমরা খুব সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর। -সূরা নামল (২৭) : ৬২


আমাদের করণীয়

যদি হতাশার কারণ পরিবারের ব্যক্তিদের আচরণ হয়, তাহলে তাদের সাথে কথা বলতে হবে। সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ
অর্থ : তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।

নিজেকে একা করে না ফেলে সমাজের লোকদের সাথে মিশতে হবে। মানুষের সাথে মিশতে হবে।আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
 وَلَا تَجْعَلُوا اللَّهَ عُرْضَةً لِأَيْمَانِكُمْ أَنْ تَبَرُّوا وَتَتَّقُوا وَتُصْلِحُوا بَيْنَ النَّاسِ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ - لَا يُؤَاخِذُكُمُ اللَّهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ وَلَكِنْ يُؤَاخِذُكُمْ بِمَا كَسَبَتْ قُلُوبُكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ حَلِيمٌ
"(হে বিশ্বাসীগণ!) নিজেদের শপথের জন্য আল্লাহকে অজুহাত করো না। যেই শপথের উদ্দেশ্য হলো-সৎকাজ, আত্মসংযম বা খোদাভীতি ও মানুষের মাঝে মীমাংসা করে দেয়া থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ সবকিছু জানেন ও শোনেন।" (২:২২৪
আমি এই সমস্যা অতিক্রম করব। এই রকম একটি মানসিক শক্তি ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে আনতে হবে ধৈর্য ধরতে হবে কারণ যদি কেউ ধৈর্য ধরতে পারে আল্লাহ তাআলা তাকে সাহায্য করেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
 یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اسْتَعِیْنُوْا بِالصَّبْرِ وَ الصَّلٰوةِ اِنَّ اللهَ مَعَ الصّٰبِرِیْنَ.
হে মুমিনগণ! তোমরা সবর ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও, নিশ্চয় আল্লাহ সবরকারীদের সঙ্গে রয়েছেন। -সূরা বাকারা (২) : ১৫৩
أَيُّهَا النَّاسُ لاَ تَتَمَنَّوْا لِقَاءَ الْعَدُوِّ وَسَلُوا اللهَ الْعَافِيَةَ فَإِذَا لَقِيتُمُوهُمْ فَاصْبِرُوا.
(রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,) হে লোকসকল! তোমরা শত্রুর মুখে পড়ার কামনা করো না। বরং আল্লাহর কাছে আফিয়াত ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করো। তবে যখন তোমরা শত্রুর মুখোমুখি হয়ে পড়বে তখন সবর করো। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৯৬৫ 


উপসংহার:
উপরের আলোচনা থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, মুমিনের জীবনে কোন হতাশ ও আহাজারী থাকবে না। সে সবর, শোকর ও তাওক্কুল এর মাধ্যমে সকল সদস্যকে সমাধান করবে। তাই হতাশ নয়; মুমিন হবে আশাবাদী। আল্লাহর রহমতের আশায় থাকবে সে। আশাবাদী হয়ে শংকাহীনভাবে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে আমল করার তাওফীক দান করুন, আমীন।

লেখক:
প্রফেসর ড সৈয়দ মাকসুদুর রহমান
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া
বাংলাদেশ।


শেয়ার করুন

Author:

0 coment rios:

You can comment here