“স্বাস্থই সকল সুখের মূল”
মানব জীবনে
আল্লাহর অন্যতম নেয়ামত স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য শুধু দুনিয়ার নেয়ামতই নয়, তা আল্লাহর ভালোবাসা লাভের মাধ্যম, কারণ আল্লাহ শক্তিশালী ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বান্দাকে ভালোবাসেন।
দৈহিক, মানসিক ও ঈমানী দিক থেকে যে
বান্দা অধিক শক্তিশালী আল্লাহ তাকে অধিক ভালোবাসেন মর্মে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
الْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ
“দুর্বল মুমিনের চেয়ে শক্তিশালী মুমিন অধিকতর কল্যাণময় এবং
আল্লাহর নিকট অধিকতর প্রিয়, তবে উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে।” (মুসলিম, আস-সহীহ, খণ্ড-৪, হাদীস নং ২০৫২) স্বাস্থ্যের নেয়ামতের বিষয়ে
অসতর্কতা ও অবহেলা সম্পর্কে সতর্ক করে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنْ النَّاسِ
الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ
“দুটি নিয়ামতের বিষয়ে অধিকাংশ মানুষই অসতর্কত ও প্রতারিত:
সুস্থতা ও অবসর।” (বুখারী, আস-সহীহ, খণ্ড-৫, হাদীস নং ২৩৫৭)
হাদীস থেকে আমরা
জানতে পারি যে, শরীরের সুস্থতা, পরিবারের শান্তি ও নিরাপত্তা ও খাদ্যের নিশ্চয়তা এ তিনটি
বিষয় জাগতিক জীবনে মানুষের সবচেয়ে বড় পাওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمْ مُعَافًى فِي جَسَدِهِ آمِنًا
فِي سِرْبِهِ عِنْدَهُ قُوتُ يَوْمِهِ فَكَأَنَّمَا حِيزَتْ لَهُ الدُّنْيَا
“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি দেহের সার্বিক সুস্থতা এবং
পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে দিবসের শুরু করল এবং তার কাছে যদি সেদিনের খাদ্য সঞ্চিত
থাকে তবে সে যেন পুরো দুনিয়াই লাভ করল।”
(তিরমিযী, আস-সুনান, খণ্ড-৪, হাদীস নং ৫৭৪; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান, খণ্ড-২, হাদীস নং ১৩৮৭) তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান গরীব।
ইসলাম আমাদেরকে
সুস্বাস্থ্য অর্জনে ও রক্ষায় অনুপ্রাণিত করে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইসলাম আমাদেরকে এমন একটি জীবন পদ্ধতি প্রদান করেছে যে, যদি কোনো মানুষ ইসলামের এ নিয়মগুলো ন্যূনতমভাবেও মেনে চলে
তবে সাধারণভাবে সে সুস্বাস্থ্য লাভ ও রক্ষা করতে পারবে। আমরা যদি অসুস্থতা বা রোগব্যাধির
কারণ অনুসন্ধান করি তাহলে দেখব যে,
সাধারণভাবে তা
নিম্নরূপ:
(১) খাদ্য বা খাদ্যাভ্যাস জনিত। যেমন, খাদ্যের অভাব,
ক্ষতিকর খাদ্য
গ্রহণ, অতিভোজন ইত্যাদি।
(২) অলসতা, পরিশ্রমহীনতা বা
অতি পরিশ্রম।
(৩) অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন।
(৪) অপরিচ্ছন্নতা।
(৫) অশ্লীলতা,
(৬) মানসিক অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠা।
(৭) অসতর্কতা। একজন মুমিন যদি অতি সাধারণভাবেও ইসলাম
নির্দেশিত জীবন যাপন করেন তবে এ সকল কারণ সবই তার জীবন থেকে বিদায় নেয়।
খাদ্য ও পানীয়
মানুষের সুস্থতার ও অসুস্থতার অন্যতম উপাদান। ইসলামে এ বিষয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন
করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ক্ষতিকারক খাদ্য নিষিদ্ধ করা
হয়েছে এবং অতিরিক্ত পানাহার নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
وَكُـلُوا وَاشْـرَبُوا وَلا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لا
يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
“এবং তোমরা খাও এবং পান কর এবং অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি
অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।” (সূরা আ’রাফ: আয়াত ৩১)
ইসলামে পবিত্র ও
উপকারী খাদ্য হালাল করা হয়েছে এবং সকল ক্ষতিকর ও নোংরা খাদ্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ ক্ষতিকারক দ্রব্য মাদক দ্রব্য। ইসলামে সকল প্রকার মাদক
দ্রব্য কঠিনভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইসলামের দষ্টিভঙ্গি হলো, জীবনের জন্য খাদ্য,
খাদ্যের জন্য
জীবন নয়। এজন্য একদিকে যেমন অনাহারে থাকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনি অতিভোজন নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.)
বলেন:
مَا مَلأَ آدَمِيٌّ وِعَاءً شَرًّا مِنْ بَطْنٍ حَسْبُ
الآدَمِيِّ لُقَيْمَاتٌ يُقِمْنَ صُلْبَهُ فَإِنْ غَلَبَتْ الآدَمِيَّ نَفْسُهُ
فَثُلُثٌ لِلطَّعَامِ وَثُلُثٌ لِلشَّرَابِ وَثُلُثٌ لِلنَّفَسِ
“আদম সন্তান তার নিজের পেটের চেয়ে নিকৃষ্টতর কোনো পাত্র
পূর্ণ করে নি। দেহকে সুস্থ-সবল কর্মক্ষম রাখতে যতটুকু খাদ্য প্রয়োজন ততটুকুই একজন
মানুষের জন্য যথেষ্ট। যদি কোনো মানুষের খাদ্যস্পৃহা বেশি প্রবল হয় (বেশি খাওয়ার
ইচ্ছা দমন করতে না পারে) তবে সে পেটের এক তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য ও এক তৃতীয়াংশ শ্বাসপ্রশ্বাসের
জন্য রাখবে।” (তিরমিযী, আস-সুনান, খণ্ড-৪, হাদীস নং ৫৯০; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান, খণ্ড-২, হাদীস নং ১১১১; হাকিম, আল-মুসতাদরাক,
খণ্ড-৪, হাদীস নং ১৩৫, ৩৬৭। হাদীসটি
সহীহ)
রাসূলুল্লাহ
(সা.) নিজে কখনো বিশেষ মেহমানদারির প্রয়োজন ছাড়া পেটপুরে আহার করতেন না। আধুনিক
চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, মানুষের অধিকাংশ
রোগব্যাধির কারণ অতিভোজন। যদি কোনো মুমিন রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর নির্দেশনা অনুসারে
পরিমিত আহারে অভ্যস্থ হন তবে তিনি এ সকল রোগব্যধি থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন বা রোগ
হলেও তা নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
পানাহারের
পাশাপাশি নিয়মিত পরিশ্রম ও বিশ্রাম সুস্বাস্থ্যের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। ইসলামী
জীবনপন্থায় তা সুনিশ্চিত করা হয়েছে। ইসলামের অলসতাকে অত্যন্ত ঘৃণা করা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বদা অলসতা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তিনি
বলতেন:
حَدَّثَنَا خَالِدُ بْنُ مَخْلَدٍ حَدَّثَنَا
سُلَيْمَانُ قَالَ حَدَّثَنِي عَمْرُو بْنُ أَبِي عَمْرٍو قَالَ سَمِعْتُ أَنَسَ
بْنَ مَالِكٍ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ اللَّهُمَّ إِنِّي
أَعُوذُ بِكَ مِنْ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْجُبْنِ
وَالْبُخْلِ وَضَلَعِ الدَّيْنِ وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ
“হে আল্লাহ, আমি আপনার আশ্রয় চাচ্ছি উৎকণ্ঠা থেকে, মনোকষ্ট থেকে,
অলসতা থেকে, কাপুরুষতা থেকে,
কৃপণতা থেকে, ঋণগ্রস্থতা থেকে এবং মানুষের কর্তৃত্বাধীন হয়ে যাওয়া থেকে।” (বুখারী,
খণ্ড-17, হাদীস নং 5892)
বস্তুত, ইসলামী জীবনধারায় অলসতার কোনো স্থান নেই। ইসলামের নিয়মিত
ইবাদত, বিশেষত নিয়মিত ফরয নামায, ও তাহাজ্জুদ,
রাতের নামায ও
অন্যান্য নফল নামায মানুষের পরিশ্রমের প্রাথমিক চাহিদা পূরণ করে এবং অলসতার পথ
বন্ধ করে। জামাতে নামায আদায়ের জন্য সর্বদা হেঁটে মসজিদে যেতে রাসূলুল্লাহ (সা.)
উৎসাহ দিয়েছেন। হাঁটার ক্ষেত্রে তিনি নিজে সুদৃঢ় ও লম্বা পদক্ষেপে দ্রুত হাঁটতেন।
অবিকল তাঁর মত হাঁটা একজন মুমিনের জীবনে সুন্নাতের অনুসরণের বরকত ছাড়াও অসাধারণ
দৈহিক কল্যাণ এনে দেয়। এছাড়া ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে নিজের সকল কর্ম নিজে
করতে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি শরীরচর্চামূলক খেলাধুলা, দৌড়ঝাঁপ, সাতার ইত্যাদিতে বিশেষ উৎসাহ দিয়েছেন।
নিয়মিত পরিশ্রমের
পাশাপাশি তিনি নিয়মিত বিশ্রাম ও ঘুমের জন্য বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন। ইবাদতের আগ্রহে
বা অন্য কোনো আগ্রহে যেন কেউ বিশ্রাম ও ঘুমের ক্ষেত্রে দেহের ন্যূনতম চাহিদ পূরণে
অবহেল না করে সে বিষয়ে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন। কোনো কোনো সাহাবী ইবাদতের আগ্রহে
রাত্রে ঘুমাতেন না এবং দিনে প্রায়শ রোযা রাখতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে রাতে কিছু
সময় ঘুমাতে ও কিছু সময় নামায পড়তে এবং দিনে মাঝে মাঝে রোযা রাখতে নির্দেশ দিয়ে
বলেন:
إِنَّ لِعَيْنِكَ عَلَيْكَ حَقًّا وَإِنَّ لِجَسَدِكَ
عَلَيْكَ حَقًّا وَإِنَّ لِزَوْجَتِكَ عَلَيْكَ حَقًّا وَإِنَّ لِضَيْفِكَ
عَلَيْكَ حَقًّا وَإِنَّ لِصَدِيقِكَ عَلَيْكَ حَقًّا
“তোমার চক্ষুর প্রাপ্য অধিকার রয়েছে তোমার উপর, তোমার দেহের প্রাপ্য অধিকার রয়েছে তোমার উপর, তোমার স্ত্রীর প্রাপ্য অধিকার রয়েছে তোমার উপর, তোমার মেহমানের প্রাপ্য অধিকার রয়েছে তোমার উপর এবং তোমার
বন্ধুর প্রাপ্য অধিকার রয়েছে তোমার উপর।”
(বুখারী, আস-সহীহ, খণ্ড-২, হাদীস নং ৬৯৭, ৬৯৮, মুসলিম, আস-সহীহ, খণ্ড-২, হাদীস নং ৮১৭; আস-সহীহ নাসাঈ, আস-সুনান, খণ্ড-৪, হাদীস নং ২১০)
স্বাস্থ্য নষ্ট
হওয়ার আরেকটি কারণ অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন। বস্তুত একজন মুমিনের পক্ষে অনিয়ন্ত্রিত
জীবন কোনোমতেই সম্ভব নয়। নামায, রোযা, খাওয়া, ঘুম, বিশ্রাম, পরিশ্রম, পারিবারিক জীবন ইত্যাদির মাধ্যমে ইসলামে মুমিনের জন্য এমন একটি রুটীন নির্ধারণ
করে দেওয়া হয়েছে যার মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত জীবন বা জীবনের প্রতি স্বেচ্ছাচারিতার কোনো
সুযোগ নেই।
অসুস্থতার অন্যতম
কারণ অপরিচ্ছন্নতা, যা ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
পরিচ্ছন্নতা ইসলামের মৌলিক নির্দেশনা ও ঈমানের অংশ। ইসতিনজা, মেসওয়াক, ওযূ, গোসল, পোশাক-পরিচ্ছদের
পবিত্রতা ইত্যাদি বিষয় যদি মুমিন সঠিকভাবে সুন্নত নির্দেশিত পদ্ধতিতে আদায় করেন
তবে তিনি সহজেই অপরিচ্ছন্নতা জনিত রোগব্যধি থেকে সাধারণভাবে নিরপদ থাকতে পারবেন।
পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক ইসলাম নির্দেশিত আরেকটি কর্ম খাতনা করা। আধুনিক বিজ্ঞান
নিশ্চিতরূপে প্রমাণ করেছে যে, খাতনা শিশু, কিশোর ও বয়স্ক সকলকেই এইডসসহ অনেক মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা
করে।
অসুস্থতার অন্যতম
কারণ অশ্লীলতা। আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতায় অশ্লীলতার পথ খোলা রেখে অশ্লীলতা প্রসূত
রোগব্যধিগুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। এ হলো নৌকার ছিদ্র খোলা রেখে পানি তুলে
ফেলে নৌকা বাঁচানোর চেষ্টার মতই অবাস্তব কর্ম। অশ্লীলতা নিজেই একটি কঠিন ব্যধি।
উপরন্তু এর মাধ্যমে অগণিত মারাত্মক দৈহিক ও মানসিক রোগ মানুষকে আক্রমন করে। আমরা
একাধিক খুতবায় দেখেছি যে, ইসলামে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল
প্রকারের অশ্লীলতা এবং অশ্লীতার পথ উন্মুক্ত করতে পারে এমন সকল কর্ম নিষিদ্ধ করা
হয়েছে। হাদীস শরীফে সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোনো সমাজের
অশ্লীলতার প্রসার ঘটলে সে সমাজে আল্লাহর শাস্তি হিসেবে নতুন নতুন মারাত্মক
রোগব্যাধির প্রসার ঘটে।
দৈহিক সুস্থতার
পাশাপাশি মানসিক সুস্থতা মানুষের জন্য অপরিহার্য। বরং মানসিক সুস্থতা দৈহিক
সুস্থতার পূর্বশর্ত। প্রকৃতপক্ষে মনই মানুষের দেহ নিয়ন্ত্রণ করে। মানসিক প্রশান্তি, স্থিরতা, উৎফুল্লতা দেহের
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং সুস্থতা অর্জনের জন্য দেহের অভ্যন্তরীণ
মেকানিজমকে আগ্রহী করে তোলে। পক্ষান্তরে মানসিক উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতা দেহের অসুস্থতা
ত্বরান্বিত করে। বর্তমান জড়বাদী সভ্যতা মানুষকে দেহের শান্তি ও বিলাসিতা প্রদান
করলেও মনের প্রশান্তি ও স্থিরতা কেড়ে নিয়েছে। ব্যাপক মানসিক উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতা
নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেকইে ‘মেডিটেশন’, ‘ধ্যান’, ‘যোগ-ইয়োগা’ ইত্যাদির আশ্রয় গ্রহণ করছেন। এগুলোর ফলাফল অত্যন্ত সীমিত।
সর্বোপরি এগুলো সকলের জন্য পালনযোগ্য বা সহজ নয়। পক্ষান্তরে ইসলামের ইবাদত, প্রার্থনা ও আল্লাহর যিক্র মানসিক সুস্থতা, প্রশান্তি ও স্থিরতার জন্য অত্যন্ত সহজ, স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক ও
সর্বজনলভ্য পদ্ধতি। ধ্যান, মেডিটেশন, কোয়ান্টাম ইত্যাদিতে মানুষ জোর করে মনকে কিছু ‘মিথ্যা’ কল্পনা সত্য বলে
মানতে বাধ্য করতে চেষ্টা করে। পক্ষান্তরে আল্লাহর যিক্র, দু‘্আ ও ইবাদতে কোনো কষ্টকল্পনা
ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে আল্লাহর প্রতি প্রেমের অনুভুতি, আত্মসমর্পন ও
নির্ভরতার মমতাময় অনুভুতির মাধ্যমে মানুষ মনের প্রশান্তি ও স্থিরতা লাভ করে এবং
তার উৎকণ্ঠা দূরীভূত হয়। সকলেই প্রতিদিন নিয়মিত ইবাদত ছাড়াও অন্তত কিছু সময়
আল্লাহর যিকর করবেন। সম্ভব হলে প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে ওযূ করে দুচার রাকআত
সালাত আদায় করে কয়েক মিনিট সুন্নাত পদ্ধতিতে আল্লাহর যিকর, দরুদ ও দুআ করে ঘুমাতে যাবেন। ইনশা আল্লাহ উৎকণ্ঠা ও
দুশ্চিন্তা দূরীভূত হবে এবং অন্তরে অসীম শক্তি ও শান্তি আসবে। আল্লাহ বলেন:
أَلا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
“জেনে রাখ! আল্লাহর যিক্রে অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়।” (সূরা
রা’দ, আয়াত:২৮)
এ ছাড়া ইসলামের
নির্মল বিনোদন, খেলাধুলা, হাঁসি-তামাশা ও কৌতুকের জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ ও
তাঁর রাসূলের ভালোবাসার ক্রন্দন এবং নির্মল বিনোদন ও হাসি-কৌতুক মানুষের
ভারসম্যপূর্ণ মানসিকতার জন্য খুবই প্রয়োজন।
অসুস্থতার আরেকটি
কারণ স্বাস্থ্য বিষয়ক অসতর্কতা। বিভিন্ন হাদীসে মুমিনদেরকে স্বাস্থ্য বিষয়ে
সতর্কতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন খাদ্য ও পানীয় আবৃত করে রাখতে
নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষত রাত্রিকালে খাদ্য বা পানীয় অনাবৃত করে রাখতে কঠিনভাবে
নিষেধ করা হয়েছে। খাদ্য বা পানীয়ের মধ্যে শ্বাস প্রশ্বাস ফেলতে বা ফুঁক দিতে
নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কঠিন রৌদ্রতাপ থেকে সাধ্যমত আত্মরক্ষা করতে নির্দেশ দেওয়া
হয়েছে। ময়লা হাত পনিতে প্রবেশ করাতে নিষেধ করা হয়েছে। কুকুরের ঝুটা পাত্র মাটি ও
পানি দিয়ে ৭ বা ৮ বার ধৌত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ডান হাতকে খাওয়া-দাওয়া ও বাম
হাতকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য ব্যবহার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ সকল বিষয়ে
বিস্তারিত জানা মুমিনের প্রয়োজন। মনোদৈহিক সুস্বাস্থ্যর জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয়
বিষয় বিবাহ, ও স্ত্রী-সন্তানসহ পারিবারিক
জীবন। ইসলামে বিষয়টি অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সকল সতর্কতার
পরেও অসুস্থতা আসতে পারে। সেক্ষেত্রে মুমিনের অনেক কিছু করণীয় রয়েছে।
সর্বপ্রথম করণীয়
হলো সকল অস্থিরতা ও হতাশা থেকে অন্তরকে মুক্ত রাখা। মুমিন সকল প্রকার সতর্কতা
অবলম্বন করবেন, কারণ এরূপ করাই আল্লাহর নির্দেশ।
কিন্তু তারপরও কোনো বিপদ, অসুস্থতা উপস্থিত হলে মুমিনের
ঈমানী দায়িত্ব হলো আল্লাহর সিদ্ধান্ত সর্বান্তকরণে যথাসম্ভব আনন্দিত চিত্তে মেনে
নেওয়া। মুমিন বিশ্বাস করেন যে, সকল বিপদ, কষ্ট মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে গোনাহ মাফের জন্য বা মর্যাদা
বৃদ্ধির জন্য আসে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
مَا يُصِيبُ الْمُسْلِمَ مِنْ نَصَبٍ وَلا وَصَبٍ وَلا
هَمٍّ وَلا حُزْنٍ وَلا أَذًى وَلا غَمٍّ حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا إِلاَّ
كَفَّرَ اللَّهُ بِهَا مِنْ خَطَايَاهُ
“যে কোনো প্রকারের ক্লান্তি, অবসাদ, অসুস্থতা, দুশ্চিন্তা, মনোবেদনা, কষ্ট, উৎকণ্ঠা যাই মুসলিমকে স্পর্শ করুক না কেন, এমনকি যদি একটি কাঁটাও তাকে আঘাত করে, তবে তার বিনিময়ে আল্লাহ তার গোনাহ থেকে কিছু ক্ষমা করবেন।” (বুখারী, আস-সহীহ, খণ্ড-৫, হাদীস নং ২১৩৭)
কখনোই মনে করা
যাবে না যে, যদি আমি এরূপ করতাম তাহলে হয়ত
এরূপ হতো, অথবা এরূপ না করলে হয়ত এরূপ হতো
না। এ ধরনের আফসোস মুমিনের জন্য নিষিদ্ধ। বিপদ এসে যাওয়ার পর মুমিন আর অতীতকে নিয়ে
আফসোস করবেন না। বরং আল্লাহর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
يَا عِبَادَ اللَّهِ تَدَاوَوْا فَإِنَّ اللَّهَ لَمْ
يَضَعْ دَاءً إِلاَّ وَضَعَ لَهُ شِفَاءً أَوْ قَالَ دَوَاءً إِلاَّ دَاءً
وَاحِدًا .... الْهَرَمُ
“হে আল্লাহর বান্দাগণ,
তোমরা ঔষধ
ব্যবহার কর। আল্লাহ যত রোগ সৃষ্টি করেছেন সকল রোগেরই ঔষধ সৃষ্টি করেছেন, একটিমাত্র ব্যধি ছাড়া ... তা হলো বার্ধ্যক্য। (তিরমিযী, আস-সুনান, খণ্ড-৪, হাদীস নং ৩৮৩। তিনি বলেন, হাদীসটি হাসান
সহীহ)
চিকিৎসার
পাশাপাশি খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে সতর্ক হতে নির্দেশ দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)। অসুস্থ
মানুষের জন্য ক্ষতিকর খাদ্য গ্রহণে আপত্তি করেছেন তিনি। এ সকল হাদীস থেকে আমরা
বুঝতে পারি যে, ব্যবহার বা বৈজ্ঞানিক গবেষণার
মাধ্যমে রোগীর জন্য উপকারী বলে প্রমাণিত খাদ্য গ্রহণ করা এবং ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত
খাদ্য বর্জন করা ইসলামের নির্দেশনা।
ছোঁয়াচে রোগ বা
রোগের সংক্রমণ নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে। আমরা বাস্তবেও দেখতে
পাই যে, রোগীর কাছে, সাথে বা চারিপার্শে থেকেও অনেক মানুষ সুস্থ রয়েছেন। আবার
অনেক সতর্কতার পরেও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন বিভিন্ন রোগে। বস্তুত শুধু রোগজীবানুর
সংক্রমনেই যদি রোগ হতো তাহলে আমরা সকলেই অসুস্থ হয়ে যেতাম; কারণ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রকারের রোগজীবানু আমাদের দেহে
প্রবেশ করছে। রোগজীবানুর পাশাপাশি মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, রোগ জীবানুর কর্মক্ষমতা ইত্যাদি অনেক কিছুর সমন্বয়ের
মানুষের দেহে রোগের প্রকাশ ঘটে। আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন,
لا عَدْوَى ... فَقَالَ أَعْرَابِيٌّ يَا رَسُولَ
اللَّهِ فَمَا بَالُ إِبِلِي تَكُونُ فِي الرَّمْلِ كَأَنَّهَا الظِّبَاءُ
فَيَأْتِي الْبَعِيرُ الأَجْرَبُ فَيَدْخُلُ بَيْنَهَا فَيُجْرِبُهَا فَقَالَ
فَمَنْ أَعْدَى الأَوَّلَ
“সংক্রমনের অস্তিত্ব নেই। তখন এক বেদুঈন বলল, হে আল্লাহর রাসূল,
আমার উটগুলো
হরিনীর ন্যায় সুস্থ থাকে। এরপর একটি চর্মরোগে আক্রান্ত উট এগুলোর মধ্যে প্রবেশ
করার পরে অন্যান্য উটও আক্রান্ত হয়ে যায়। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: তাহলে প্রথম
উটটিকে কে সংক্রমিত করল?” (বুখারী, আস-সহীহ, খণ্ড-৫, হাদীস নং ২১৬১, ২১৭৭;
মুসলিম, আস-সহীহ, খণ্ড-৪, হাদীস নং ১৭৪২)
পাশাপাশি
সংক্রমনের বিষয়ে সতর্ক হতেও রাসূলুল্লাহ (সা.) “অসুস্থকে সুস্থের
মধ্যে নেওয়া হবে না (রুগ্ন উট সুস্থ উটের কাছে নেবে না।)” (বুখারী, আস-সহীহ, খণ্ড-৫, হাদীস নং ২১৭৭; মুসলিম, আস-সহীহ, খণ্ড-৪, হাদীস নং
১৭৪২-১৭৪৩)
إِذَا سَمِعْتُمْ بِالطَّاعُونِ بِأَرْضٍ فَلا
تَدْخُلُوهَا وَإِذَا وَقَعَ بِأَرْضٍ وَأَنْتُمْ بِهَا فَلا تَخْرُجُوا مِنْهَا
“যদি তোমরা শুনতে পাও যে,
কোনো জনপদে প্লেগ
বা অনুরূপ মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তবে তোমরা তথায় গমন করবে না। আর যদি তোমরা
যে জনপদে অবস্থান করছ তথায় তার প্রাদুর্ভাব ঘটে তবে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না।” (বুখারী, আস-সহীহ, খণ্ড-৫, হাদীস নং ২১৬৩; মুসলিম, আস-সহীহ, খণ্ড-৪, হাদীস নং ১৭৩৮, ১৭৩৯)
এভাবে
রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রায় দেড় হাজার বৎসর পূর্বে সংক্রমন প্রতিরোধে বিচ্ছিন্নকরণ
(য়ঁধৎধহঃরহব) ব্যবস্থার নির্দেশনা প্রদান করেন। মুমিন বিশ্বাস করেন যে, সকল বিষয়ের ন্যায় রোগের ক্ষেত্রেও আল্লাহর সিদ্ধান্তই
চূড়ান্ত। এজন্য সংক্রমনের ভয়ে অস্থির বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
পাশাপাশি যে সকল রোগের বিস্তারে সংক্রমন একটি উপায় বলে নিশ্চিত জানা যায় সে সকল
রোগের বিস্তার রোধের ও সংক্রমন নিয়ন্ত্রনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
অসুস্থ ব্যক্তির
সঠিক বিশ্রাম ও কষ্টদায়ক দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়া ইসলামের নির্দেশ। অসুস্থতার
কারণে নামায বসে, শুয়ে বা ইশারায় পড়তে, রোযা কাযা করতে এবং ওযূ ও গোসলের বদলে তায়াম্মুম করতে
নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদি কেউ অসুস্থতা বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও পানি ব্যবহার
করে বা সিয়াম পালন করে তবে তার সাওয়াব তো হবেই না, বরং তিনি পাপী
হবেন। আল্লাহ যে সুযোগ দিয়েছেন তা গ্রহণ না করে অতি-তাকওয়া প্রদর্শন ইসলামে নিন্দা
করা হয়েছে।
অসুস্থ মানুষের
প্রতি সমাজের অন্য মানুষদের দায়িত্ব হলো তাদের সেবা করা, দেখতে যাওয়া,
চিকিৎসা গ্রহণে
উৎসাহ প্রদান, মানসিক আস্থা তৈরি করা ও দু‘আ করা। কাউকে অসুস্থ জানার পরেও তাকে দেখতে না গেলে কিয়ামতের
দিন আল্লাহ জবাবদিহী করবেন বলে হাদীসে বলা হয়েছে। অসুস্থ মানুষকে দেখতে যাওয়ার
সাওয়াব বিষয়ে অনেক হাদীস রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
مَنْ عَادَ مَرِيضًا لَمْ يَزَلْ فِي خُرْفَةِ
الْجَنَّةِ حَتَّى يَرْجِعَ
“যদি কেউ কোনো অসুস্থ মানুষকে দেখতে যায় তবে সে ফিরে না আসা
পর্যন্ত অবিরত জান্নাতের বাগানে ফল চয়ন করতে থাকে।” (মুসলিম, আস-সহীহ, খণ্ড-৪, হাদীস নং ১৯৮৯)
مَنْ عَادَ مَرِيْضاً لَمْ يَزَلْ يَخُوْضُ فِيْ
الرَّحْمَةِ حَتَّى يَجْلِسَ فَإِذاَ جَلَسَ اغْتَمَسَ فِيْهَا
“যদি কেউ কোনো রোগীকে দেখতে যায় তবে রহমতের মধ্যে সাঁতার
কাটতে থাকে। আর যখন সে রোগীর পাশে বসে তখন সে রহমতের মধ্যে ডুব দেয়।” (যিয়া
মাকদিসী, আল-মুখতারাহ,
খণ্ড-৭, হাদীস নং ২৬৭-২৬৮; আলবানী, সহীহুত তারগীব,
খণ্ড-৩, হাদীস নং ১৯৭।
হাদীসটি সহীহ)
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَعُودُ مُسْلِمًا غُدْوَةً إِلا
صَلَّى عَلَيْهِ سَبْعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ حَتَّى يُمْسِيَ وَإِنْ عَادَهُ
عَشِيَّةً إِلا صَلَّى عَلَيْهِ سَبْعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ حَتَّى يُصْبِحَ وَكَانَ
لَهُ خَرِيفٌ فِي الْجَنَّةِ
“যদি কোনো মুসলিম সকালে কোনো রোগীকে দেখতে যায় তবে সন্ধ্যা
পর্যন্ত ৭০ হাজার ফিরিশতা তার জন্য দোয়া করতে থাকে। আর যদি কেউ বিকালে কোনো রোগীকে
দেখতে যায় তবে পরদিন সকাল পর্যন্ত ৭০ হাজার ফিরিশতা তার জন্য দোয়া করতে থাকে। আর
সে জান্নাতে একটি বাগান লাভ করে।” (তিরমিযী, আস-সুনান, খণ্ড-3, হাদীস নং ৩০০; আলবানী, সহীহুত তারগীব ৩, হাদীস নং ১৭৯। হাদীসটি সহীহ)
কোনো অসুস্থ
মানুষকে দেখতে গেলে তার জন্য দোয়া করা সুন্নাত। এ সময়ের জন্য বিভিন্ন দোয়া হাদীসে
শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এ সকল দুআ শিখে তা আমল করা আমাদের প্রয়োজন। মহান আল্লাহ
আমাদেরকে তাওফীক প্রদান করুন। আমীন!!
লেখক:
লেখক:
প্রাবন্ধিক ও গবেষক
শিক্ষক,
জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, সিলেট।
জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, সিলেট।
মোবাইল: 01712374650
ইমেইল: zubairjcpsc@gmail.com
facebook: Imdadul Haque Zubair
Facebook Page: ইমদাদুল হক যুবায়ের
0 coment rios:
You can comment here