।। বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল।।
বর্তমান বিশ্বের মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে সম্পদের পিছে দৌড়াচ্ছে। যেন সম্পদ অর্জনটাই মানুষের একমাত্র কাজ এবং এর জন্যই তার অস্তিত্ব ও তার জীবন। এ সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে তারা ন্যায়-অন্যায়, হালাল-হারাম, নৈতিক-অনৈতিক কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। সমগ্র বিশ্বের সব মানুষের সব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে শুধুমাত্র এ লক্ষ্যেই। আজকের পৃথিবীর সব দেশের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাও পরিচালিত হচ্ছে শুধুমাত্র এ লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে। শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা হচ্ছে শুধুমাত্র অর্থ-সম্পদ অর্জনের যোগ্য মেশিন হিসেবে। শুধু এজন্যই উন্মোচিত হচ্ছে শিক্ষার নতুন নতুন দিগন্ত। কর্মের নতুন নতুন ক্ষেত্র। কেউ নিজেকে বা সন্তানকে যোগ্য অর্থ-সম্পদ অর্জনকারী হিসেবে দেখতে পেলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে যে, আমার জীবন স্বার্থক, আমি সফল, আমার সব কাজ সমাপ্ত, আমার দায়িত্ব পালন পরিপূর্ণ।
প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে পবিত্র কুরআনে মহান সৃষ্টিকর্তা বলেন :
أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ
(1) حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ (2) كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُونَ (3)
‘প্রাচুর্যের লালসা তোমাদের উদাসীন রাখে। এমনকি তোমরা কবরে পৌঁছে যাও। এটা কখনও উচিত নয়। তোমরা সত্বরই জেনে নেবে।’ (সুরা তাকাসুর : ১-৩)
তিনি আরো বলেন :
وَيْلٌ لِكُلِّ هُمَزَةٍ
لُمَزَةٍ (1) الَّذِي جَمَعَ مَالًا وَعَدَّدَهُ (2) يَحْسَبُ أَنَّ مَالَهُ أَخْلَدَهُ
(3) كَلَّا لَيُنْبَذَنَّ فِي الْحُطَمَةِ (4) وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْحُطَمَةُ
(5) نَارُ اللَّهِ الْمُوقَدَةُ (6) الَّتِي تَطَّلِعُ عَلَى الْأَفْئِدَةِ (7) إِنَّهَا
عَلَيْهِمْ مُؤْصَدَةٌ (8) فِي عَمَدٍ مُمَدَّدَةٍ (9)
‘যে অর্থ সঞ্চিত করে ও গণনা করে, সে মনে করে যে, তার অর্থ চিরকাল তার সঙ্গে থাকবে। কখনও না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে পিষ্টকারীর মধ্যে। আপনি কি জানেন, পিষ্টকারী কী? এটা আল্লাহর প্রজ্বলিত আগুন, যা হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছবে। এতে তাদের বেঁধে দেওয়া হবে। লম্বা খুঁটিতে।’ (সুরা হুমাযা : ১-৯)
আবদুল্লাহ ইবনে শিখখীর (রা.) বলেন, আমি একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট পৌঁছে দেখলাম তিনি সুরা তাকাসুর তিলাওয়াত করে বলছিলেন, ‘মানুষ বলে আমার ধন, আমার ধন, অথচ তোমার অংশ তো ততটুকু যতটুকু তুমি খেয়ে ফেল অথবা পরিধান করে ছিন্ন করে দাও অথবা সদকা করে সম্মুখে পাঠিয়ে দাও। এছাড়া যা আছে তা তোমার হাত থেকে চলে যাবেÑতুমি অপরের জন্য তা ছেড়ে যাবে।’ (ইবনে কাসীর, তিরমিজি, আহমদ, মা’আরেফুল কুরআন)
এই যে সম্পদ, যার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে মানুষ তার সমগ্র জীবনকে ব্যয় ও বিনাশ করছে, দ্বিধাহীন চিত্তে ও নির্ভয়ে এগিয়ে যাচ্ছে জাহান্নামের দরজার দিকে, কী তার মূল্য? কতটুকু তার সত্যিকার মূল্যমান? এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে একটি সুন্দর বর্ণনা রয়েছে। সৃষ্টিকর্তা বলেন :
وَلَوْلَا أَنْ يَكُونَ
النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً لَجَعَلْنَا لِمَنْ يَكْفُرُ بِالرَّحْمَنِ لِبُيُوتِهِمْ
سُقُفًا مِنْ فِضَّةٍ وَمَعَارِجَ عَلَيْهَا يَظْهَرُونَ (33) وَلِبُيُوتِهِمْ أَبْوَابًا
وَسُرُرًا عَلَيْهَا يَتَّكِئُونَ (34) وَزُخْرُفًا وَإِنْ كُلُّ ذَلِكَ لَمَّا مَتَاعُ
الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةُ عِنْدَ رَبِّكَ لِلْمُتَّقِينَ (35)
‘যদি সব মানুষের এক মতাবলম্বী হয়ে যাবার আশঙ্কা না থাকতো, তবে যারা দয়াময় সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করে আমি তাদের দিতাম তাদের গৃহের জন্যে রৌপ্য নির্মিত ছাদ ও সিঁড়ি, যার ওপর তারা চড়ত এবং তাদের গৃহের জন্যে দরজা দিতাম এবং পালংক দিতাম, যাতে তারা হেলান দিয়ে বসত এবং স্বর্ণ নির্মিতও দিতাম। এগুলো সবই তো পার্থিব জীবনের ভোগ সামগ্রী মাত্র। আর অনন্তকাল আপনার পালনকর্তার কাছে তাদের জন্যই যারা ভয় করে।’ (সুরা যুখরুফ : ৩৩-৩৫)
পৃথিবীতে বসবাসকারী কিছু অবিশ্বাসীর জীবনে কিছু ধন-সম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু প্রাচুর্যের স্পর্শ লাগলেও এখনো তা সৃষ্টিকর্তার ঘোষিত স্বর্ণ-রৌপ্য বর্ষণের প্রাচুর্যের দূরতম নিকটেও যায়নি। এতেই আমরা বিশ্বাসীরা যেন খেই হারিয়ে ফেলেছি। ঊর্ধ্বশ্বাসে-চোখ বন্ধ করে তাদের অনুকরণে-অনুসরণে প্রাচুর্য লাভের জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। চিন্তা করার সময় নেই। সময় নেই ভাববার ভালো-মন্দ, লাভ-অলাভ, কল্যাণ-অকল্যাণের। ধরেই নিয়েছি প্রাচুর্য মানেই উন্নতি, সম্পদের আধিক্য মানেই কল্যাণ।
অথচ উকবা ইবনে আমের (রা.) নবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন : যখন তোমরা দেখতে পাবে, সৃষ্টিকর্তা কোনো ব্যক্তিকে তার অসংখ্য পাপ ও অন্যায় সত্তে¡ও তার বাসনা অনুযায়ী পৃথিবীর অফুরন্ত নিয়ামত দান করছেন, তখন মনে করবে যে, মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে এটি সুযোগ ছাড়া আর কিছু নয়। অতঃপর তিনি সুরা আনআমের ৪৪তম আয়াত পাঠ করেন। যার অর্থÑ‘অতঃপর তারা যখন ওই উপদেশ ভুলে গেল যা তাদের দেওয়া হয়েছিল, তখন আমি তাদের সামনে সবকিছুর দ্বার উন্মুক্ত করে দিলাম। এমনকি যখন তারা প্রদত্ত নিয়ামত পেয়ে আনন্দে মেতে উঠলো ও ভোগ-ব্যবহারে মগ্ন হলো, তখন আমি আকস্মিক তাদের পাকড়াও করলাম। তখন তারা নিরাশ হয়ে গেল।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস শরীফ)
আমাদের দেখার অবকাশ নেই রাসুলের বাণী : ‘পৃথিবী যদি আল্লাহর কাছে মশার এক পাখার সমানও মর্যাদা রাখত, তবে মহান স্রষ্টা কোনো অবিশ^াসীকে পৃথিবী থেকে এক ঢোক পানিও দিতেন না।’
(তিরমিজি, মা’আরেফুল কুরআন)
আমাদের পড়ার সুযোগ হয় না সৃষ্টিকর্তার বাণী
لَتُبْلَوُنَّ فِي أَمْوَالِكُمْ
وَأَنْفُسِكُمْ وَلَتَسْمَعُنَّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ
وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا أَذًى كَثِيرًا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ
ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ (186)
Ñ‘আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোনো সম্পদ নয়।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৮৬)
মানুষের অন্তরে এগুলোর আকর্ষণ সৃষ্টি করার অন্যতম রহস্য হলো তাদের পরীক্ষা করা যে, কে এগুলোর আকর্ষণে মত্ত হয়ে অনন্তকালকে ভুলে যায় এবং কে এসবের প্রকৃত স্বরূপ ও ধ্বংসশীল হওয়ার বিষয় অবগত হয়ে শুধু ততটুকু অর্জনে সচেষ্ট হয় যতটুকু তার প্রয়োজন এবং তা অনন্তকালীন কল্যাণ লাভের লক্ষ্যেই ব্যয় করে। এ কথাই নিহিত রয়েছে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এ বাণীতে ‘পৃথিবী অভিশপ্ত এবং যা কিছু এতে আছে তাও অভিশপ্ত; তবে ওইসব বস্তু নয়,
যা দ্বারা সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জন করা হয়।’
(মা’আরেফুল কুরআন)
এ কারণেই কয়েকটি লোভনীয় বস্তুর উল্লেখ করার পরই মহান স্রষ্টা বলেন, এসবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্তু। সৃষ্টিকর্তার নিকটই হলো উত্তম আশ্রয়। অর্থাৎ এসব বস্তু হচ্ছে পার্থিব জীবনে ব্যবহার করার জন্য, যা ক্ষণস্থায়ী; মন বসাবার জন্যে নয়। আর স্রষ্টার নিকট রয়েছে উত্তম ঠিকানা। সেখানে চিরকাল থাকতে হবে। যার নেয়ামত শেষ হবে না, হ্রাসও পাবে না। এর পরই মহান স্রষ্টা বলেন, ‘হে রাসুল! যারা দুনিয়ার অসম্পূর্ণ ও ধ্বংসশীল নেয়ামতে মত্ত হয়ে পড়েছে, আপনি তাদের বলে দিন যে, আমি তোমাদের আরো উৎকৃষ্ট নেয়ামতের সন্ধান বলে দিচ্ছি। যারা সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করে এবং যারা তাঁর অনুগত, তারাই এ নেয়ামত পাবে। সে নেয়ামত হচ্ছে সবুজ বৃক্ষলতাপূর্ণ জান্নাতÑযার তলদেশ দিয়ে নির্ঝরণীসমূহ প্রবাহিত হবে। তাতে থাকবে সকল প্রকার কলুষমুক্ত পরিচ্ছন্ন সঙ্গীনিগণ এবং মহান প্রভুর সন্তুষ্টি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন : ‘বুদ্ধিমান হচ্ছে সে ব্যক্তি যে আত্মসমালোচনা ও আত্মযাচাই করতে অভ্যস্ত এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য কাজ করে। পক্ষান্তরে দুর্বল ও সাহসহীন সে ব্যক্তি, যে নিজেকে প্রবৃত্তির লালসার দাস করে দিয়েছে এবং এটা সত্তে¡ও সে স্রষ্টার নিকট থেকে অনুগ্রহের প্রত্যাশী।’ (তিরমিজি)
এখন আমাদের চিন্তা করা দরকার যে, আমরা কি বুদ্ধিমান থাকবো না দুর্বল-সাহসহীন হবো? মহামূল্যবান সম্পদের অধিকারী হবো না মূল্যহীন সম্পদের অধিকারী হবো? ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার মূল্যহীন সম্পদের লোভে মোহাচ্ছন্ন থাকবো না চিরস্থায়ী মহামূল্যবান উত্তম সম্পদের আকাক্সক্ষী হয়ে সজাগ হবো? মহানবী (সা.)-এর নিম্নোক্ত হাদীসে এর উত্তর ও উত্তম সমাধান রয়েছে। স্রষ্টা আমাদের তা গ্রহণ করার যোগ্যতা দান করুন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াকে নিজের প্রিয়তম ও লক্ষ্যবস্তু রূপে গ্রহণ করবে, সে তার পরকালের বিশেষ ক্ষতি সাধন করবে। আর যে অনন্তকালকে অধিকতর প্রিয় রূপে গ্রহণ করবে, সে অবশ্যই তার দুনিয়ার দিকের বড়ই ক্ষতিসাধন করবে। অতএব নশ্বর জগতের মোকাবিলায় স্থায়ী ও অক্ষয়কালকেই গ্রহণ করো।’ (মুসনাদে আহমদ, বায়হাকী, হাদীস শরীফ)
আমাদের জীবনের লক্ষ উদ্দেশ্য কি?
আমাদের জীবনের লক্ষ উদ্দেশ্য কি, কেনো আমরা এই পৃথিবীতে এসেছি, কেনোই বা মহান স্রষ্টা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, কি চান তিনি আমাদের কাছে, পবিত্র কুরআনে তিনি বলেন :
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ
وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ (56)
‘আমি সৃষ্টি করেছি জ্বিন ও মানুষকে এজন্য যে, তারা শুধুমাত্র আমারই ইবাদত করবে।’ (সুরা যারিয়াত : ৫৬)
আমাদেরকে সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করার জন্য। এর মানে এই না যে আমরা কাজকর্ম পড়ালেখা করতে পারবো না, অবশ্যই পারবো তবে সেটা হতে হবে অপশনাল। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হতে হবে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করে জান্নাত লাভ করা।
আর জান্নাত এমন একটি স্থান যেÑকোনো চোখ তা কখনো দেখেনি, কোনো কান তা কখনো শুনেনি, কোনো অন্তর কখনো কল্পনা করতে পারেনি। আমি আপনি দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত অথচ দুনিয়া কিছুই না, এটা ক্ষণস্থায়ী আমরা সামান্য কিছুদিন এখানে থাকব, এরপর আমাদেরকে চলে যেতে হবে অনন্ত জীবনে যার শুরু আছে শেষ নেই।
পৃথিবী সম্পর্কে তিনি কুরআনে বলেন :
وَمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ
الدُّنْيَا إِلَّا لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الْآَخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ
لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ (64)
‘এই পার্থিব জীবনতো ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতিত কিছুই নয়। পারলৌকিক জীবনই তো প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানতো।’ (সুরা আনকাবূত-৬৪)
‘পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ব্যতিত কিছুই নয়।’
(সুরা হাদীদ-২০) সৃষ্টিকর্তা বলেন :
وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا
إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ (185)
‘আর পার্থিব জীবন প্রতারণার সম্পদ ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (সুরা আলে ইমরান-১৮৫)
এই পৃথিবীর মোহে পড়ে আমরা আমাদের আসল জীবনকে ভুলে গেছি। সৃষ্টিকর্তা বলেন :
بَلْ تُؤْثِرُونَ الْحَيَاةَ
الدُّنْيَا (16) وَالْآَخِرَةُ خَيْرٌ وَأَبْقَى (17)
‘বস্তুত তোমরা দুনিয়ার জীবনকে পছন্দ করে থাকো। অথচ আখেরাতের জীবনই উত্তম ও চিরস্থায়ী।’ (সুরা আল-আলা : ১৬-১৭)
আমরা মনে করি টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত, বাড়ি-গাড়ি, উচ্চডিগ্রি এগুলো থাকলেই সে সফলকাম। আসলে কিন্তু এগুলো সফলতা নয়, এসব কিছুদিনের জন্য মাত্র। মৃত্যুর পরে এসব আমার কোনো কাজে আসবে না। তাহলে আসল সফলতা কি? জান্নাত লাভ করাই হল আসল সফলতা। কুরআনে সৃষ্টিকর্তা বলেন:
فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ
وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ
‘অতএব যে জাহান্নাম থেকে বিমুক্ত হয়েছে ও জান্নাতে প্রবিষ্ট হয়েছে, ফলত নিশ্চয়ই সে সফলকাম।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৮৫)
আমাদেরকে আমাদের জীবনের লক্ষ উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে হবে, তা না হলে আমরা কঠিন বিপদে পতিত হব, যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো উপায় নাই। একটা উদাহরণ দিই তাহলে বুঝতে সহজ হবে।
মনে করেন, আপনার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন, তাই আপনার ভাইকে পাঠালেন ডাক্তার নিয়ে আসার জন্য। সে হাসপাতালে যায় ঠিকই, কিন্তু ঘটনাক্রমে তার এক পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে যায়Ñফলে সে তার সাথে কথা বলতে বলতে তার হাসপাতালে আসার উদ্দেশ্য ভুলে যায়, সে ভুলে গেল তার বাবা অসুস্থ। সে ডাক্তার নিয়ে যাওয়ার জন্য হাসপাতালে এসেছে বন্ধুর সাথে কথা বলতে নয়। এদিকে ডাক্তার না আসার ফলে আপনার বাবা মৃত্যুবরণ করেন। এখন কোনো উপায় আছে কি আপনার বাবাকে ফিরিয়ে আনার। কেনো এমনটা হয়েছে শুধুমাত্র লক্ষ উদ্দেশ্য ভুলে যাওয়ার কারণে।
ঠিক তেমনি আমরাও পৃথিবীর মোহে পড়ে এখানে আসার লক্ষ উদ্দেশ্যকে ভুলে গেছি, যার ফলস্বরূপ আমাদেরকে ভোগ করতে হবে কঠিন শাস্তি। তাই আজ থেকেই ক্ষমা মগ্ন হয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট করে চিরস্থায়ী ভোগবিলাসের জান্নাত অর্জন করুন। সৃষ্টিকর্তা বলেন :
وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا
الصَّالِحَاتِ لَنُبَوِّئَنَّهُمْ مِنَ الْجَنَّةِ غُرَفًا تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا
الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا نِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِينَ (58)
‘যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে, অবশ্যই আমি তাদেরকে জান্নাতের সুউচ্চ প্রসাদে স্থান দেব, যার নিচ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হতে থাকবে। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। কতই না উত্তম প্রতিদান সৎকর্মশীলদের জন্য।’ (সুরা আনকাবূত : ৫৮)
পৃথিবীতে কোনো মানুষ চিরস্থায়ী নয়। প্রত্যেক মানুষই মরণশীল। মৃত্যুর স্বাদ সকলকেই গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যুর পর একজন মানুষের সব কিছুই বিলীন হয়ে যায়, শুধু বিলীন হয় না তার কৃতি। মানুষ তার কর্ম এবং ব্যবহারের মাধ্যমেই বেঁচে থাকে মরণের পরও। আসলে টাকা-পয়সা দিয়ে সুখ কেনা যায় না, সুখ হলো সম্পূর্ণ মনস্তাত্তি¡ক একটি ব্যাপার। এটি একধরনের অনুভ‚তির নামÑযার অর্থ অন্তরের পরিতৃপ্তি। কোনো মানুষ তখনি প্রকৃত সুখী হয় যখন সে যা পায় তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। টাকা আমাদের জীবনে অত্যাবশ্যকীয় বটে, সুখী হওয়ার জন্য টাকারও যে একটা বিরাট ভ‚মিকা রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। এই অর্থ প্রকৃতপক্ষে আমাদের সুখ দিতে পারে না। মনের শান্তিটাই আসল শান্তি। সমাজের ধনী ব্যক্তিরা সর্বাধিক সুখী নয়; তারা দিনের পর দিন নির্ঘুমভাবে রাতকাটায়, বিভিন্ন সমস্যা ও দুশ্চিন্তা নিয়ে জীবন অতিবাহিত করে। অথচ আমাদের সমাজে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র লোক আছে যারা অল্পতেই তুষ্ট থাকে এবং তারা শান্তিতে ও সুনিদ্রায় জীবন কাটায়। অর্থাৎ ধনী না হয়েও কোনো দরিদ্র ব্যক্তিও যদি সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হয় তাহলে সে সুখের নিশ্চয়তা পেতে পারে যেখানে টাকা-পয়সা কখনোই মানুষকে সুখের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। শুধুমাত্র নৈতিক ও আত্মিক উন্নয়নই মানুষের সুখের অন্যতম কারিগর।
লেখক : প্রাবন্ধিক, প্রকাশক ও সংগঠক
0 coment rios:
You can comment here