।। ড. এ এইচ এম সোলায়মান।।
মহান আল্লাহ তা‘আলার ঐশী বাণী আল-কুরআন পৃথিবীর সর্বাধিক পঠিত পবিত্র গ্রন্থ। এটি আল্লাহ তা‘আলার কালাম এবং মানব জাতির জন্য হিদায়াত গ্রন্থ। এটি আমাদের জীবন-বিধান এবং এর অর্থ অনুধাবন করা সকলের জন্য অপরিহার্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
إن
هذا القران يهدى للتى هى اقوم
“এই কুরআন এমন পথ প্রদর্শন করে যা সর্বাধিক সরল” (সূরা ইসরা: ৯)। আল-কুরআন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও বর্তমান মুসলিম জাতির চরম দুরাবস্থার মূল কারণ হলো কুরআনের অর্থ অনুধাবন না করে কুরআনকে শুধু তেলাওয়াতে সীমাবদ্ধ রাখা,
কুরআনের বিধি নিষেধকে নিজের মত করে সুবিধা মত পালন করা। অথচ কুরআনের সংজ্ঞায় বিশ্ববিখ্যাত আল-মানার গ্রন্থাকার আবুল বারাক্বাত আল নাসাফী (মৃত: ১৩১০খ্রি:) বলেন-
إن القران
اسم للنظم والمعنى جميعا
“শব্দ ও অর্থের সমষ্টির নাম হলো আল কুরআন।” অতএব কুরআন অধ্যয়ন হতে হলে তেলাওয়াত, অর্থ, ব্যাখ্যা জানাও অপরিহার্য। শুধু তেলাওয়াতে সওয়াব পাওয়া যাবে বটে কিন্তু না বুঝে পড়ার জন্য তো আল্লাহ তা‘আলা কুরআন দেননি। আল্লাহ তা’আলা বারবার বলেছেন যে, কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য হলো যেন মানুষেরা তা বুঝে,
চিন্তা করে এবং উপদেশ গ্রহণ করে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
كتاب
انزلناه إليك مبارك ليدبروا اياته وليذكروا أولوا الالباب
“এক বরকতময় কল্যাণময় গ্রন্থ আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি যেন তারা এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বোধ সম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে।” (সূরা সোয়াদ:২৯)
আল্লাহর কিতাব পাঠ করাকে কুরআন কারীমে তিলাওয়াত বলা হয়েছে। তিলাওয়াত আরবি শব্দ এর আভিধানিক অর্থ আবৃত্তি বা recitation নয়। আরবি ডিকশনারী অনুযায়ী তিলাওয়াত অর্থ to follow বা অনুসরণ করা। অর্থাৎ তিনটি বিষয়ের সমষ্টি হচ্ছে তিলাওয়াত।
১. যা পড়া হবে তা শুদ্ধ করে পড়া।
২. যা পড়া হবে তা বুঝা এবং
৩. যা বুঝা হবে তা জীবনে বাস্তবায়ন করা। আবু বকর (রা.)-এর ছেলে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেছেন,
সূরা বাক্বারা পড়তে তার আড়াই বছর সময় লেগেছে। অথচ তার ভাষা আরবি। শুধু বাক্বারা পড়তে তার এতো সময় লাগলো কেন তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, তিনি এটা পড়েছেন,
বুঝেছেন এবং নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেছেন।
অতএব না বুঝে শুধু পাঠ করলে প্রকৃতপক্ষে তিলাওয়াত হয় না। তিলাওয়াত মানে পাঠের সময় পঠিত বিষয়ের পিছে চলবে এরপর জীবনটাও তার অনুসরণে চলবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
الذين
اتيناهم الكتاب يتلونه حق تلاوته أولئك يؤمنون به
“যাদের আমি কিতাব প্রদান করেছি তাঁরা তা হক্ব আদায় করে তেলাওয়াত করে, তাঁরাই এই কিতাবের উপর ঈমান এনেছে।”
(সূরা বাক্বারা-১২১)
কুরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে তারতীল সহকারে পাঠের নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
ورتل القران
ترتيلا
“কুরআন পাঠ কর সুবিন্যস্তভাবে ও স্পষ্টভাবে।” (সূরা মুযাম্মিল-৪)
এ প্রসঙ্গে ইমাম জজরী বলেন-
الاخذ
بالتجويد حتم لازم * من لم يجود القران اثم
“তাজবীদ শিক্ষা অতীব জরুরী, যে তাজবীদ বিহীন কুরআন তেলাওয়াত করল সে গোনাহগার হলো”।
কুরআনের প্রভাবঃ
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আগমনের পূর্ব পর্যন্ত আরবে জাহিলীযুগ চলছিল। তিনি যখন কুরআন নিয়ে এলেন এবং আরবদের সামনে কুরআনকে পেশ করলেন, তখন কুরআনের অলৌকিক প্রভাব ও শৈল্পিক সৌন্দর্যের কাছে অনেকে মাথা নত করতে বাধ্য হলো। কুরআনের শিক্ষাকে ধারণ করে ঐ সমাজের লোকেরাই সর্বশ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হলো। কুরআনের শিক্ষার প্রভাবে অনেক পাষাণ হৃদয় ব্যক্তি পর্যন্ত মোমের মত গলে গেল। যার বাস্তব উদাহরণ উমর (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনার মাধ্যমে ফুটে উঠে।
ওমর (রা.) বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যার উদ্দেশ্যে বের হয়ে বোন ফাতেমা বিনতে খাত্তাব ও ভগ্নিপতি সাঈদ বিন যায়েদের মুখে কুরআনের আয়াত-
طه ما
انزلنا عليك القران لتشقى ـ الا تذكرة لمن يخشى ـ تنزيلا ممن خلق الارض والسّموت
العلى ـ الرحمن على العرش استوى
“ত্বাহা (হে নবী) আমি এ কুরআন এজন্য নাযিল করিনি যে তুমি এর দ্বারা কষ্ট পাবে,
এ (কুরআন)তো হচ্ছে বরং (কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার) একটি (উপায় ও) নসীহত মাত্র- সে ব্যক্তির জন্যে,
যে (আল্লাহ তা‘আলাকে) ভয় করে,
(এ কিতাব) তাঁর কাছ থেকে অবতীর্ণ,
যিনি যমীন ও সমুচ্চ আকাশসমূহ সৃষ্টি করেছেন;
রহমান (দয়াময় আল্লাহ তা‘আলা) মহান আরশে সমাসীন হলেন।”
(সূরা ত্বাহাঃ ১-৫) শুনে তিনি এতটাই অভিভুত হয়ে পড়লেন যে তৎক্ষণাৎ ছুটে গেলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ইসলাম গ্রহণের জন্য। সাহাবায়ে কেরামগণ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে থেকে কুরআনকে উপলব্ধি করে এবং কুরআনকে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করে স্বর্ণযুগের সূচনা করেছিলেন। তাইতো আল্লাহর রাসূল ঘোষণা দিয়েছেন-
خيرالقرون
قرنى
“অর্থাৎ আমার যুগই শ্রেষ্ঠ যুগ।”
তাছাড়া আল্লাহ তা’আলা কুরআনের অপরিসীম ক্ষমতা সম্পর্কে বলেছেন-
لو انزلنا
هذا القران على جبل لرأيته خاشعا متصدعا من خشية الله ـ وتلك الامثال نضربها للناس
لعلهم يتفكرون
“আমি যদি এ কুরআন কোনো পাহাড়ের ওপর নাযিল করতাম তাহলে তুমি অবশ্যই তাকে দেখতে কিভাবে তা বিনীত হয়ে আল্লাহর ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে পড়েছে। আমি এসব উদাহরণ মানুষের জন্যে এ কারণেই বর্ণনা করছি যেন তারা (কুরআনের মর্যাদা) সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করতে পারে”। (সূরা হাশর-২১) মানুষের মত পাহাড়ের চেতনা শক্তি নাই। কিন্তু আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ চিন্তা শক্তি সম্পন্ন জীব হয়েও আল কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করে না এবং তাদের দায়িত্ব সম্পর্কেও সচেতন নয় অথচ এ কুরআনই জগতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা এবং আখেরাতে জান্নাত পাওয়ার উত্তম মাধ্যম। যে ব্যক্তি কুরআন তেলাওয়াত ও মুখস্ত করবে এবং যথাযথভাবে তার ওপর আমল করবে তার জন্য রয়েছে বেহেশতের সুসংবাদ। এ প্রসঙ্গে আমর ইবনুল আস থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেন-
يقال لصاحب
القران إقرأ وارتق ورتل كما كنت ترتل فى الدنيا فإن منزلك عند اخر اية تقرأها
“কুরআনের সাথীকে বলা হবে তুমি পড়তে থাক আর উর্ধ্বে আরোহন করতে থাক। তুমি দুনিয়ায় যেভাবে তিলাওয়াত করতে। তুমি সর্বশেষ যে আয়াত পড়বে সেখানেই তোমার বাসস্থান।” (তিরমিযী)
ইমাম খাত্তাবী বলেন, সাহাবায়ে কেরামের বিভিন্ন বক্তব্য থেকে জানা যায় বেহেশতের ভবনগুলোর যত তলা পবিত্র কুরআনে তত আয়াত রয়েছে,
(অর্থাৎ ৬৬৬৬ আয়াত)। কুরআনের পাঠককে বেহেশতে নিয়ে বলা হবে তুমি যত আয়াত পড়তে পার। বেহেশতের তত তলা ওপরে উঠে যাও। যে ব্যক্তি সমস্ত কুরআন পড়তে পারবে সে বেহেশতের সর্বোচ্চ তলায় পৌঁছে যাবে। আর যে তার অংশ বিশেষ পড়তে পারবে সে সেই অংশ পরিমাণ উচ্চে আরোহন করতে পারবে। মোট কথা যেখানে পড়া শেষ সেখানে (ওপরে) চড়াও শেষ হবে।” (আত তারগীব ওয়াত তারহীব- ২য় খন্ড ১৪৬)
আমরা আমাদের শিক্ষা জীবনে সব গ্রন্থই বুঝে পড়ি শুধুমাত্র কুরআন ছাড়া অথচ দাবি করি কুরআন মহাগ্রন্থ। যদি সত্যি সত্যিই আমাদের এ বিশ্বাস থাকে তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে আল কুরআন সর্বাগ্রে বুঝার চেষ্টা করতে হবে। অত:পর তার উপর আমল করতে হবে। তা যদি না হয় তাহলে কুরআন শুধু পড়ে ও গবেষণা করে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। যেমন গাধার পিঠে বই-পুস্তক বোঝাই করে নেয়া হয়,
কিন্তু গাধা শুধু বহন করে, সে জানে না এবং বুঝে না সে কী বহন করছে। যে জাতির নিকট আল্লাহর কিতাব আছে কিন্তু সে বুঝে না এবং অনুসরণ করে না তার দৃষ্টান্ত গাধার মত। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
مثل الذين
حملوا التوراة ثم لم يحملوها كمثل الحمار يحمل أسفارا
“যাদেরকে তাওরাত দেয়া হয়েছিল অত:পর তার অনুসরণ করেনি তাদের দৃষ্টান্ত সেই গাধার মত, যে পুস্তক বহন করে। (সূরা জুমআ-৫)
এ বিষয়টি অত্যন্ত আফসোস করে রাসূলুল্লাহ (সা.) কিয়ামতের দিন বলবেন-
وقال الرسول
يرب ان قومى اتخذوا هذا القران مهجورا
“সে দিন রাসূল বলবেন হে আমার রব অবশ্যই আমার জাতি কুরআনকে (একটি) পরিত্যাজ্য (বিষয়) মনে করেছিল। (সূরা ফুরক্বান-৩০)
আল্লাহ তা‘আলা এ কিতাবের রচয়িতা এবং রাসূল (সা.)-এর ব্যাখ্যা দাতা। মানব জাতির পার্থিব শান্তি ও পরকালীন মুক্তি এ কিতাবের শিক্ষার ওপরই নির্ভরশীল। তাই এ কিতাব সব মানুষের পক্ষেই বুঝতে পারা সম্ভব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
ولقد يسّرنا
القرأن للذكر فهل من مدّكر
“আমি (অবশ্যই) উপদেশ গ্রহণ করার জন্যে এ কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি,
কে আছে (তোমাদের মাঝে এর থেকে) শিক্ষা গ্রহণ করার? (সূরা আল-ক্বামার: ১৭-২২,
৩২, ৪০)
অবশ্যই সবাই এ থেকে উপদেশ গ্রহণ করার যোগ্য না-ও হতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন সম্পর্কে বলেছেন-
هذا بيان
للناس وهدى وموعظة للمتقين
“এটা মানুষের জন্য এক বিবৃতি এবং মুত্তাকিদের জন্য হেদায়াত ও উপদেশ।” (সূরা আলে ইমরান: ১৩৮)
কুরআন থেকে হেদায়াত পাওয়ার জন্য কুরআনকে বুঝতে পারাই হলো প্রথম শর্ত। বুঝবার সাথে সাথে তাক্বওয়ার শর্তও থাকতে হবে। কুরআন যা মানতে বলে তা মানতে রাজী হওয়া এবং যা ছাড়তে বলে তা ছাড়তে প্রস্তুত থাকাই হলো তাক্বওয়া। কিন্তু যে কুরআন বুঝে না সে কী করে তাক্বওয়ার পথে চলবে? তাই সবাইকে প্রথমে কুরআন বুঝতে হবে।
কুরআন ও হাদীসের উপরোক্ত দৃষ্টান্তসমূহের আলোকে বলতে হয় একজন মুসলিম হিসাবে এবং ঈমানের দাবিদার হিসাবে আমাদের অপরিহার্য কর্তব্য হলো কুরআনকে বুঝে পড়া এবং কুরআনের শিক্ষাকে বাস্তবজীবনে প্রতিফলিত করা। আল্লাহ তা’আলা আমাদের তাওফিক দান করুন। আমীন!!
লেখকঃ
প্রাবন্ধিক, গবেষক
প্রিন্সিপাল, সিলেট ক্যাডেট মাদ্রাসা
0 coment rios:
You can comment here